লেখালিখি, জীবন এবং সাহিত্য ভাবনা নিয়ে হান কাংয়ের আলাপচারিতা
অনুবাদ: নাহার তৃণা
দক্ষিণ কোরিয়ার লেখক হান কাং, ‘দ্য ভেজিটেরিয়ান’ উপন্যাসটির মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী পাঠকের সঙ্গে তাঁর পরিচিতি গড়ে ওঠে। কোরিয়ান কাম্যু হিসেবে খ্যাত হান কাং ২০২৪ সালের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। এই আলাপচারিতাটি সুইডিশ একাডেমি নোবেল বিজয়ী হিসেবে তাঁর নাম ঘোষণার মাত্র ১০ ঘণ্টা আগে মেইল বিজনেস নিউজ পেপারকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকার। সাক্ষাৎকারের জন্য নির্বাচিত প্রশ্নের উত্তর তিনি ই-মেল মারফত পাঠিয়েছিলেন। হান যে বিশ্ব সাহিত্যের সবচেয়ে সম্মানীয় পুরস্কারটি অর্জন করতে চলেছেন তার বিন্দুবিসর্গও সেসময় তিনি জানতেন না। মেইলের সঙ্গে লিখিত এই আলাপচারিতায় তিনি তাঁর সাম্প্রতিক জীবন, লেখালিখি, সাহিত্যভাবনা এবং তাঁর নতুন কাজ সম্পর্কে একান্ত ভাবনা তুলে ধরেন।
যেহেতু তখন পর্যন্ত সাহিত্যের নোবেল পুরস্কার ঘোষিত হয়নি, সেটি প্রাপ্তির উত্তেজনা শুরুর আগে দেওয়া এই সাক্ষাৎকারের প্রশ্নগুলোর উত্তর লেখার সময় সঙ্গত কারণেই সে প্রসঙ্গটিও আসেনি। এই আলাপচারিতার শুরুতেই হান পাঠপ্রীতির প্রতি তাঁর প্রগাঢ় ভালোবাসা প্রকাশ করেন। লেখক পরিচয়ের আগে, নিজেকে তিনি একজন পাঠক হিসেবে ভাবতে অধিক ভালোবাসেন। তিনি লিখেছেন, “আমি যতই ক্লান্ত থাকি না কেন, প্রতিদিন অন্তত একটি অনুচ্ছেদ পড়ার পরই শান্তিতে ঘুমাতে পারি।” মেইলের আলাপে তিনি তাঁর সাম্প্রতিক পাঠ তালিকা নিয়েও কথা বলেছেন। চো হাই-জিনের ‘লাইট অ্যান্ড মেলোডি,’ কিম এ-রানের ‘ওয়ান অফ দেম ইজ এ লাই,’ জুডিথ শ্যালানস্কির ‘অ্যান ইনভেন্টরি অফ লসেস’ এবং জঁ-জাক রুশোর ‘লেটারস অন দ্য এলিমেন্টস অফ বোটানি’ বইগুলো তাঁর পাঠ তালিকায় রয়েছে বলে জানান।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সাহিত্য পুরস্কারের বিজয়ী হান বলেন, লেখালিখির স্বীকৃতির জন্য তিনি গভীরভাবে কৃতজ্ঞ, তবে একই সঙ্গে এসব স্বীকৃতির কারণে একটি বাড়তি চাপও তিনি অনুভব করেন। হান বললেন, “সৌভাগ্য, বা দুর্ভাগ্যবশত, লেখার সময় সেই চাপটি অদৃশ্য হয়ে যায়। ছোটো হোক বা বড়, গল্প লেখা সহজ কাজ নয় এবং এতে বাড়তি চাপ অনুভব করার জন্য খুব কম মানসিক জায়গা থাকে।”
তাঁর কর্মস্থল প্রকাশনা সংস্থা সামতোহ( publishing house Samtoh) থেকে ইনচনের ইয়ংজং দ্বীপে এক কর্মশালার উদ্দেশ্যে ভ্রমণের সময়, তিনি এমন একটি গল্প লেখার জন্য অনুপ্রাণিত হন যেখানে জোয়ার চলে যাওয়ার পর জেগে ওঠা কর্দমময় প্রান্তরে মরিচা ধরা নোঙ্গরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দু’জন মানুষের কথা বলা হয়। এভাবেই তাঁর প্রথম ছোটোগল্প ‘রেড অ্যাঙ্কর’ জন্ম নেয়। হান বলেন, সে সময় তিনি ভীষণ ভাবে এমনসব ভাবনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন যে, কীভাবে মানুষ জীবনকে সহ্য করে, পালিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে এবং একা জীবনের ক্লান্তি বহন করে। তাঁর কৌতূহল ও প্রশ্ন করার প্রবণতাই তাঁকে লিখতে উৎসাহ যোগায়। তিনি বলেন, “আমার কাছে উপন্যাস একটি ধারাবাহিক, সংযোগ বোধের জায়গা। গল্পের ক্ষেত্রে তেমনটি নয়। গল্পে যা একটির সঙ্গে আরেকটি সংযুক্ত নয়, বরং সেখানে বিচ্ছিন্নভাবে একের পর এক প্রশ্ন উঠে আসে। আমি আমার লেখালিখির ভেতর প্রায় সবসময়ই নির্দিষ্ট কিছু প্রশ্ন নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করি, এবং আমার উপন্যাসগুলো সেই প্রশ্নগুলোকে আরও গভীরে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টায় লেখা হয়।”
তিনি বলেন, “ওই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার বদলে, যখন মনে হয় আমি একটি প্রশ্নের শেষ প্রান্তে পৌঁছেছি, তখন আমি পরবর্তী প্রশ্নে চলে যাই।” বিষয়টা আরো খোলাসা করে তিনি উল্লেখ করেন, তার কিছু কাজ পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত। উদাহরণস্বরূপ, ‘দ্য ভেজিটেরিয়ান’ হলো ‘দ্য ফ্রুট অফ মাই ওম্যান’ এর একটি বৈচিত্র্যময় পর্ব, যা লেখক নিজেই স্বীকার করেছেন। তবে তিনি বলেন, নতুন কিছু লেখার সময় তার পূর্ববর্তী কাজগুলো সম্পর্কে সচেতনভাবে ভাবেন না। তিনি সময়ের সাথে সাথে এবং তার কাজের মধ্য দিয়ে নিজেকে পরিবর্তিত হতে দেখতে পান, কিন্তু কখনও কখনও কিছু বিষয় অপরিবর্তিত থাকে। তিনি আরও উল্লেখ করেন, “আমার মনে হয় সেটাই আমার মূল সত্তার একটি অংশ।”
ওয়ারশ শহরে বসবাসের অভিজ্ঞতা হানের ‘দ্য হোয়াইট বুক’ লেখার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলেছিল। তিনি বইটি লেখার সময় ওয়ারশতে কাটানো মুহূর্তগুলো যথার্থই উপভোগ করেছিলেন। তবে এটি তাঁর জন্য এমন কোনো মোড় ঘোরার মুহূর্ত ছিল না বলে মনে করেন না, যা তাঁকে ইতিহাস ও আঞ্চলিকতাকে কেন্দ্র করে গল্পের দিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। ‘হিউম্যান অ্যাক্টস’ এবং ‘আই ডু নট বিড ফেয়ারওয়েল’ এ দুটি পরস্পর সংযুক্ত উপন্যাসের মতো। বিষয়টি তিনি এভাবে ব্যাখ্যা করেন, “আসলে, ‘হিউম্যান অ্যাক্টস”-এর এপিলগ এবং ‘আই ডু নট বিড ফেয়ারওয়েল’-এর প্রোলগ একে অপরের সঙ্গে যুক্ত, এবং আমি সেগুলো লিখেছিলাম এই আশায় যে, তারা বর্তমান ও অতীত, কল্পনা ও বাস্তবতার মধ্যে সেতু হিসেবে কাজ করবে।”
‘আই ডু নট বিড ফেয়ারওয়েল’ মূলত ‘হিউম্যান অ্যাক্টস’ প্রকাশের কিছুদিন পর আমি যে স্বপ্নটি দেখেছিলাম, তা থেকে শুরু হয়। সেই স্বপ্নে, হাজার হাজার কাটা মাথাসহ কালো লগগুলো মাঠে পোঁতা ছিল, এবং কবরগুলো ছিল তাদের পেছনে, যার ওপরে এসে আছড়ে পড়া সমুদ্রের ঢেউ কবরগুলোকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। কখনও কখনও স্বপ্ন বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতার চেয়েও শক্তিশালী প্রভাব ফেলে। ওই দুটো উপন্যাস লিখতে প্রায় নয় বছর সময় লেগেছে, এবং আমার মনে হয়, মাঝখানে দেখা সেই স্বপ্নটি যেন দুটো কাজকেই আলিঙ্গন করে রেখেছে।”
হান কাংয়ের উপন্যাসগুলোর সার্বিক বিষয়বস্তু কি? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “আমার মনে হয় আমি সবসময়ই ভেবেছি মানুষ হওয়া মানে কী, বেঁচে থাকা মানে কী, এবং আমি প্রতিবার বিভিন্ন উপন্যাসের মাধ্যমে সে চিন্তাভাবনাগুলো প্রকাশ করতে চেয়েছি। আমার লেখার মাধ্যমে পাঠকদের সঙ্গে এই অনুসন্ধানটি ভাগ করে নিতে পারা যদি কিছুটা অর্থবহ হয়ে থাকে, তবে তা আমার জন্য তৃপ্তির।” ২০১৬ সালে, যখন তিনি ইন্টারন্যাশনাল ম্যান বুকার পুরস্কার লাভ করেন, সেই সময়ের একটি সাক্ষাৎকারে হান বলেছিলেন, “মানবতার বিষয়বস্তু তার কাজের চালিকা শক্তি।” তিনি আরও বলেছিলেন, “আজকাল, আমি প্রায়ই জীবন নিয়ে ভাবি। আমি এমন জিনিসগুলোর প্রতি আগ্রহী হয়েছি, যা জীবনের বাহক হিসেবে উঠে আসে, এবং আমি আমার পরবর্তী উপন্যাসে জীবনের এই অনুভূতিকে অন্বেষণ করতে চাই।”
ইতোমধ্যেই বিশ্বজুড়ে তাঁর লেখার পাঠক রয়েছে, এবং নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তিতে তাঁর কাজ আরও বৃহত্তর বৈশ্বিক পাঠকের কাছে পৌঁছানোর উজ্জ্বল সম্ভাবনা তৈরি করেছে। ভাষা ও সংস্কৃতির বিভাজন অতিক্রম করে বৈশ্বিকভাবে পাঠ ও অনুধাবন করা, এবং ব্যাপক সহানুভূতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এটি লেখক ও পাঠকের জন্য কী অর্থ বহন করবে? “সাহিত্য স্বভাবতই সংযোগের শক্তি বহন করে। ভাষা হলো আমাদের একসঙ্গে যুক্ত করার জন্য একধরনের সুতো। পৃথিবীর যেকোনো স্থানে পাঠক থাকুন না কেন, কোরিয়ান লেখকদের কাজ সেই পাঠকের সঙ্গে সংযোগ ঘটানোর এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।” হান বলেছিলেন।
হান কাং কি কোনো লেখক বা সাহিত্যকর্মকে বিশেষভাবে প্রিয় মনে করেন? তিনি মনে করেন না যে কোনো নির্দিষ্ট লেখকের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছেন, তবে লেখকদের একটি সমষ্টিগত প্রভাবক দ্বারা “গভীরভাবে প্রভাবিত এবং কখনও কখনও আবেগপ্রবণ” হয়েছেন বইকি। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, “লেখকরা সবসময়ই আমার কাছে একটি সমষ্টি হিসেবে ছিলেন, প্রত্যেকে নিজেদের নিজস্ব উপায়ে নিমগ্ন, তাঁদের নিজ নিজ বিষয় নিয়ে লড়াই করার এবং তা অতিক্রম করার চেষ্টা করছেন।”
উপন্যাস লেখা ও পড়ার শক্তি কী বলে হান বিশ্বাস করেন? পৃথিবীতে উপন্যাস কি ভূমিকা পালন করে থাকে? হান বলেন, উপন্যাস পাঠকদের গুরুত্বপূর্ণ অনুভূতি এবং প্রশ্ন খুঁজে পেতে সাহায্য করতে পারে। তিনি বলেন, “প্রতিদিনের জীবনে গভীর সত্যগুলো দেখা বা প্রকাশ করা সহজ নয়।“ এটি বন্ধুর সঙ্গে খাওয়ার টেবিলের সাধারণ কথোপকথন নয় যে বন্ধুকে বলা যায়, ‘আমি এই দিনগুলোতে বেঁচে থাকার অর্থ কী তা নিয়ে ভাবছি৷’ সাহিত্যের মাধ্যমে আমরা সেই গুরুত্বপূর্ণ অনুভূতি, গভীর প্রশ্ন, এবং চিন্তাগুলো অনুসন্ধান করতে পারি, যা আমাদের নাড়া দেয় এবং প্রকাশ করা কঠিন। যখন মানুষ উপন্যাসে এসব অনুভূতি পড়ে, তারা হঠাৎ নিজেদের মধ্যে যা ছিল তা পুনরায় আবিষ্কার করে। উপন্যাসের একটি চরিত্রে পরিণত হয়ে, বারংবার সেই চরিত্রের বাইরে বেরিয়ে আসা এবং ফিরে যাওয়ার অভিজ্ঞতা অর্জনে সক্ষম হয়, যেখানে তাদের সচেতনতাবোধের স্তরটি এক মুহূর্তে খুলে যায়, যা তাদের নিজেদেরকে স্পষ্ট এবং স্বচ্ছভাবে দেখতে সাহায্য করে,” হান ব্যাখ্যা করেন। “এভাবে, আমি বিশ্বাস করি সাহিত্য আমাদের জন্য একটি অপরিহার্য বিষয়, যেন একটি সুতো যা আমাদের সংযুক্ত করে।”
যখন তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল লেখার সময় তিনি যে মানসিক দৃশ্যপট দেখেন, সেখানে কে যাচ্ছে, কে কথা বলছে এবং কী ঘটছে, ইত্যাদি বয়ানের পন্থা নিয়ে তার ভাষ্য কী। হানের সরল উত্তর, “যেখানে হৃদয়ের গহিণে একটি খুব ছোটো শিখা জ্বলে, এবং এমন একটি জায়গা যেখানে বৈদ্যুতিক স্রোতের মতো জীবনের অনুভূতি উদ্ভূত হয়।”
লেখক বর্তমানে নতুন একটি উপন্যাসের কাজ করছেন, যা তিনি প্রথমে ২০২৪ সালের গ্রীষ্মের মধ্যে শেষ করার পরিকল্পনা করেছিলেন, তবে এখন ধারণা করছেন সময়ের দৈর্ঘ্য শীতকাল পর্যন্ত গড়াবে। তিনি বলেন, “কখন আমি একটি উপন্যাস শেষ করব, তা পূর্বাভাস দেওয়া সবসময়ই কঠিন, এবং আমি প্রায়ই আমার পূর্বাভাসে ভুল প্রমাণিত হই।”
[ সাক্ষাৎকারটি ২৫ অক্টোবর, ২০২৪ Maeil Business Newspaper-এ প্রকাশিত হয়।]
নাহার তৃণা। জন্ম ২ আগস্ট ঢাকায়। বর্তমানে ইলিনয়ে বসবাস। মূলত গল্প লেখায় ঝোঁক। পাশাপাশি অনুবাদ, প্রবন্ধ, সিনেমা, সাহিত্য সমালোচনা লিখে থাকেন। দুই বাংলার বিভিন্ন সাহিত্যপত্রিকা এবং ওয়েবজিনে নিয়মিত লিখছেন। একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০-এ ‘পেন্সিল পাবলিকেশনস প্রতিভা অন্বেষণে তার ‘স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট’ সেরা গল্পগ্রন্থ নির্বাচিত হয়। একই বছর অন্বয় প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় ‘এক ডজন ভিনদেশি গপ্পো’। সম্পাদিত গ্রন্থ: ‘গল্পের পুষ্পিত কুঞ্জ’(২০২১, বইয়ের হাট প্রকাশনী), ‘গল্পপাঠ নির্বাচিত জাপানি গল্প সংকলন’(যৌথ সম্পাদনা, ২০২২, কবি প্রকাশনী)। প্রকাশিতব্য অনুবাদ গল্প সংকলন, ‘দূরদেশের গল্প(২০২২, চৈতন্য প্রকাশনী)’।