ট্রলিতে শুয়ে থাকা রক্তাক্ত লোকটা কাতরাচ্ছে কাটা কইমাছের মতো। গায়ের শার্ট রক্তে জবজব,মাথা মুখ নাক গাল বেয়ে জমাট বাঁধা আর নির্গত রক্তের স্রোত দেখে আঁচ করা যাচ্ছে না শরীরের রক্তস্রোতের উৎসস্থান । পাশে আর্তনাদ করছে যে নারী, সম্ভবত লোকটির স্ত্রী। অ আল্লাহ এইডা তোমার কেমন বিচার গ আল্লাহ! তোমার কাছে আমি কি গুনা করছি গো আল্লাহ। আহত লোকটির মাঝে মাঝে চোখ খুলে তাকানো প্রমাণ করছে তার বেঁচে থাকা। নইলে নারীটির আর্তনাদে লোকটিকে মৃত ভাবাই সঙ্গত ছিলো সমবেতদের।
আশেপাশে লোকজন জমে গেছে প্রচুর। সবাই কোন না কোন রোগীর এটেনডেন্স। কারো বউ পোয়াতী, কারো ভাই মারদাঙ্গা করে ছুরিকাহত, কারো বাবার ক্যান্সার। এই মূহুর্তে সবাই সবকিছু ভুলে দৌড়াচ্ছে আহত লোকটি নিয়ে গড়িয়ে চলা ট্রলিটির পেছন পেছন। যেনো এই নবাগত আহত লোকটি এদেরই স্বজন। এভাবে চেনা অচেনায় স্রোতে মিশে দৌড়ানোটা দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে।
অসুস্থ স্বজনকে সামলাতে সামলাতে তারা ক্লান্ত। জীবন আর মৃত্যুর মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে স্নায়ুর উপর যে চাপ, শারিরীক কষ্টের যে অমানবিক পীড়ন রোগীর সাথে রোগীর এটেন্ডেন্স কেও বহন করতে হয় সে যন্ত্রনা কাঁধে জোয়াল নেয়া গরুর মতো অনিচ্ছায় কিংবা দায়িত্বে, স্নেহে অথবা মায়ায়। এই দৌড়ে ওষুধ কিনতে যাও, ডাক্তারের অপেক্ষায় থাকা,স্বজনের বেড়ে যাওয়া কষ্ট অসহায় দেখে যাওয়া ছাড়া কিছু করার নেই। এ এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা!!
নতুন আসা রোগী কিংবা রোগীর আসার সাথেসাথে তার সাথে দৌড়ানো সেখানে হঠাৎ একটু দম ফেলার অবকাশ যেনো। দুঃসহ অক্টোপাস বন্ধন থেকে মুক্তি। সমবেত লোকগুলোর যেনো হঠাৎ মনে হয় , আরে এ রোগী তো আমার কেউ হয় না। যাক বাবা বেঁচে গেলাম একে নিয়ে আমার চিন্তার কিছু নেই। মুখে কেউ বলেনা কিন্তু তাদের অন্তরের এই স্বস্তি দীর্ঘদিন নিজের রোগী টানার অসহনীয় অনিবার্য কষ্ট থেকে অকারণ মুক্তি দেয় ক্ষণিকের জন্য।
কী হইছে গো, কী হইছে গো বলে ট্রলির রোগী সমেত দলটির পিছু নেয় দিলারা। সাথে আহাজারি করতে করতে দৌড়াতে থাকা নারীটি সম্ভবত আহত লোকটির স্ত্রী, মুখ ঝামটে উত্তর করে, এসকিডেন গো এসকিডেন। আহারে! কেমনে হইলো গো! বাঁচবো নি গো আল্লাহ। অপরিচিত নারীর আতঙ্ক হাহাকারের সাথে তার হাহাকার একসুরে মিলে যায়। কে বলবে দুজন কেউ কারো পরিচিত নয়।মাত্রই হাসপাতালের বারান্দায় তাদের দেখা হয়েছে।
ইমার্জেন্সির দিকে যেতে যেতে ভীড় পাতলা হয়ে যায় ভেঙে যাওয়া জনসভার মতো। আহত লোকটিকে ইমার্জেন্সি ডাক্তারের ইশারায় বেডে তোলা হয় জনাকয় লোকের ঘর্মাক্ত তৎপরতায়। লোকটির বেহুঁশ অবস্থায় উপস্থিত মানুষগুলো দ্বিধাগ্রস্ত হয়, লোকটি বেঁচে আছে না মরে গেছে। তারা কেউ কেউ ফিসফাস করে, নাই নাই। কেউ বা বলে, আছে আছে। জ্ঞান হারাইছে। তার যা হবার হোক।
এই রক্তাক্ত লোকটি কিংবা আহাজারি করা বউটি কেউ এই গল্পের চরিত্র নয়। এরা বহিরাগত। এই বহিরাগতদের আহত রক্তাক্ত দেহের সাথে ট্রলির পেছনে পেছনে আসা একজন মহিলাটির সাথে আমাদের পরিচয় হয়, দিলারা খাতুন । মুখভর্তি পান। গালভেঙে ঢুকেছে মাড়ির ভেতরে। গালে কালোকালো ছোপে নানান দুঃখ পাঁচালীর মানচিত্র। গায়ে জমে থাকা টক দইয়ের মতো ঘামের গন্ধ। তার তখন হুঁশ ফিরে যখন ইমার্জেন্সি ডাক্তার রুম খালি করেন রুম খালি করেন বলে রূঢ় স্বরে আদেশ দেন। আর উপস্থিত দালাল, কর্মচারিরা ঠেলে ধেক্কে অনাহুত দলটিকে দরজার বাইরে বের করে দেয়।
দিলারা বেগমের তখন হাতের টিফিন বক্সটির কথা মনে পড়ে। দেওয়ান বাড়ি থেকে চেয়ে আনা আজকের খাবার।এতোক্ষণ মনেই ছিলো না হাতের টিফিন বক্সটির কথা।আজ নিয়ে পাঁচদিন তার বাড়ি থেকে খাবার আনা হয়েছে। দেওয়ানের বউয়ের দরাজ দিলের সুনাম আছে বুয়া মহলে। খাবার দিতে তার কার্পণ্য নেই।নিজে যা খায় তাই দেয় বুয়াদের পাতে। সেও কিনা আজ বলে দিয়েছে আর বাটি নিয়ে না যেতে! সত্যি তো কাঁহাতক! কথা গায়ে না মাখলেও আর যে দেওয়ানের বউ খাবার দেবেনা এটুকু সে বোঝে গেছে দেওয়ানের বউয়ের কণ্ঠস্বরে।
ভীড় থেকে নিজেকে বিযুক্ত করে দিলারা ৷লম্বা বারান্দা ডিঙিয়ে চুপিসারে বসে পড়ে ট্যাংকির পাশে, নিরাপদ জায়গা। কেউ দেখতে পায় না । গৃ্হস্থের ঘর থেকে মাছ চুরি করে আনা বিড়ালের মতো নিজেকে আড়াল করে সে।
ট্যাংকি ভরে উপচে পানিতে ভেসে যাচ্ছে। পানিতে ভাসছে উচ্ছ্বিস্ট খাবার। পচা দুর্গন্ধে ডুবে গেছে চারপাশ। হাসপাতালের রক্তাক্ত ব্যাণ্ডেজ, কালো হয়ে উঠা স্যানিটারি প্যাড, সিরিঞ্জ, ওষুধের পরিত্যক্ত প্যাকেট সব গলাগলি করে ভাসছে।ওদিকে চোখ গেলেই পেট উগলে বমি আটকানো দায়।
এখানেই সিঁড়ির মতো উঁচু জায়গাটিতে বসে খাবারের বাটি খুলে পরখ করে সে। এমন করে চলছে গত কয়েকদিন। চেয়ে চিনতে যার বাড়ি থেকেই যা আনে সবাই বড় রুইমাছের টুকরা কিংবা মুরগির ঠ্যাং টাই দেয়। বউকে দেয়ার আগে একনজর দেখে নেয় শুধু। আজ ইলিশ মাছ। লোভ সামলনো দায়। এক টুকরো মাছ। এমন নয় যে অনেকদিন ইলিশ মাছ খায়নি। আজ বছর পনেরো শহরের বাসা বাড়িতে কাজ করে দিলারা। ছেলেগুলা সব বিয়ে করে যে যার মতো চলে গেছে। দিলারার দিকে ফিরে তাকানোর বোকামী কেউ করে নি।সাথে ছিলো অবিবাহিত ছোট ছেলে। তার বিয়ের বছরখানেক পরই দিলারা টের পেলো এই দয়ার দুমুঠো ভাতের চেয়ে গতর খেটে খাওয়া অনেক শান্তির। তারপর এই শহরের পথ ধরা তার।
যে বাড়িগুলোতে পালাক্রমে দুপুরের খাবার খায় কারো না কারো বাসায় মাঝেমাঝেই ইলিশ মাছ পাতে দেয়। তবে সে হয় লেজের দিকের টুকরো নয়তো লেজ। এমন গাদা পেটে টুকরো অনেকদিন খায়নি সে। আগপাছ না ভেবে নিজের লোভকেই প্রশ্রয় দেয় সে অবলীলায়। মাছটা মেখে ভাতটুকু গোগ্রাসে খেয়ে নেয় দিলারা। বাটিটা ধুয়ে পানি খাবার জন্য টিউবওয়েলের দিকে আগায় । আর তখন মাথায় চিন্তা ভর করে বঊটা বসে আসে খাবারের জন্য।
এখন কার কাছে যায় আরেকবাটি ভাতের জন্য! রোগী বাচ্চা। হাসপাতালে ভর্তি। মাকে খাবার দেয় না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।প্রতিদিন দুবেলা দিলারাকেই যোগাড় করে আনতে হয় খাবার। পলিথিনে খাবারের বাটি প্যাচাতে প্যাচাতে প্রতিদিন সে মনে মনে গালি পাড়ে। বেটি,ভাতের জন্য একদিন বাড়ি ছাড়ছিলাম। পরলি না। আবার আমার ঘাড়েই পরলি দুইটা ভাতের লাইগ্যা! আল্লার বিচার আল্লাহ দুনিয়াতেই দেখাইয়া নেয়।
মহিলা ও শিশু ওয়ার্ডের দিকে আর পা ই বাড়ায় না দিলারা। লম্বা বারান্দা ধরে আবার ফিরে আসতে আসতে পাশ কাটিয়ে যাওয়া একজনকে জিজ্ঞেস করে কয়টা বাজেরে ভাই? লোকটি জবাব দেয়,তিনটা। হক সাহেবের বাড়িমুখো হাঁটা দেয় সে। এই বাড়িটিই সবচেয়ে কাছে হাসপাতাল থেকে। হক সাহেবের বউটা দেওয়ানের বউয়ের উলটা। কিপ্টার হদ্দ। বাসি ভাত তরকারি ছাড়া কিছু পাতে দেয়না কখনো বুয়াদের। তারপরও মুখ ঝামটা দেয় অকারণে তিনটা। মুখ ঝামটা দেবে জেনেও আর উপায় নেই। তিনটা বাজে। সকাল থেকে না খেয়ে আছে বউটা। হোক পরের বেটি। শাশুড়ির ভরসাতেই তো বাচ্চাটাকে নিয়ে সদরের হাসপাতালে আসছে।
সত্যি মুখ ঝামটে উঠে হক সাহেবের বউ। এখনো তোমার নাতিন ভালা হয় নাই? নাগো খালাম্মা, জোরে জোরে শ্বাস নেয়। পাঁজরের হাড়ের নিচে বুকটা বইসা যায়। নাকে মুখে নল লাগাইয়া রাখছে, কুন্তা খায় না। আঁচলে চোখ মুছে ডুকরে কাঁদে দিলারা। দিলারা কথায় কথায় কাঁদতে পারে। যে কান্না যে কাউকে বিব্রত করার জন্য যথেষ্ট। মনে মনে বিরক্ত হলেও প্রকাশ করতে কুণ্ঠিত হয়। হক সাহেবের ক্যাটক্যাটে বউটাও এর বাইরে যায় না। বাটি নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে যায়। এবার আর বাটি খুলে দেখে না কী দিয়েছে ভেতরে।
বউটার পাশে নতুন রোগী, গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করতে যাওয়া কম বয়সের তরুণী। সব হাড়ভাঙায় কোকাতে থাকা, খুক খুক কাশতে থাকা, তীব্র জ্বরের ঘোরে গোঙাতে থাকা সব অসহ্য শব্দ গিলে খাচ্ছে তরুণীটির আর্তচিৎকার। সেদিকে ভালো করে তাকানোর আগেই দিলারার হাত থেকে ক্ষুধার্ত বাঘের মতো হামলে পড়ে খাবার বাটি টেনে নেয় বউটা। প্যানপ্যান করে, বেডি জানস হারাদিন খাই নাই। তারপরও হাইঞ্জাকালা আইলি। বাটি খুলে মন খারাপ নয় মেজাজ চড়ে যায় বউয়ের। হারাদিন বওয়াইয়া রাইখ্যা নি এই হুধা ভাত আর ডাইল। শোনেনা শোনেনা করে মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে বউয়ের কাছ থেকে বাচ্চাটার কাছে যায় দিলারা। হাতে টাটকা ইলিশ মাছের ঘ্রাণ। যদি বউটার নাকে যায়! আড়চোখে দেখে বউ গোগ্রাসে গিলছে খালি ডালভাত।
বাচ্চাটা মরে গেলেই ভালো, মনে মনে ভাবে দিলারা। দুইটা মাইয়া আগেই ঘরে আছে। ছেলেও আছে দুইটা । বেক্কল না হইলে কেউ আবার বাচ্চা বিয়ায়? তাও মাইয়া বাইচ্চা? নিজের তিন তিনটা মেয়ে পার করতে নিঃস্ব হয়েছে সে। জমি জিরাত বসতবাড়ি সব গেছে যৌতুকের বিনিময়ে মেয়েগুলোরে পার করতে। তবু যদি সুখে থাকতো একটাও। মোবাইলে মেয়েগুলোর ফোন আসলেই অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে দিলারার। হয় কোনটা জামাইয়ের বেদম মাইরে চিৎকার করে কাঁদতেছে, কোনটা গলা আর গায়ের সম্মিলিত জোরে জামাইকে গালি দিচ্ছে, হারামীর পোলা, বদমাইশ….আর তীব্র খেদে জানাচ্ছে, আজ এক সপ্তাহ জামাই বাড়ি আসেনা। রাত কাটায় বাজারের মেয়ে মানুষের ঘরে। কোনটা ইনিয়েবিনিয়ে টাকা চায়। ছেলেগুলোর এক অশান্তি মায়ের খবর নেয় না। কিন্তু মেয়েগুলোর অশান্তি হাজারটা। আল্লাহ ক্যান যে পেটে মেয়ে সন্তান দেয়!
পোলাটারও হইছে তিনটা মেয়ে। ভবিষ্যত চিন্তায় ভাঁজ পড়ে দিলারার কপালে। পাঁচ পাঁচটা সন্তান নিয়ে একবেলা আধবেলা খেয়ে দিন কাটে এখনই। তারউপর আজ এটার পেট ব্যাথা তো অন্যটার জ্বর। বউটাও কেমন বেখেয়ালি, এই ঠাডা গরমে কাঁচা বাইচ্চার নিমুনিয়া বাঁধাইয়া আইছে। ডাক্তার অবশ্য বলে ঘেমে ঠাণ্ডা লেগেছে। ঘামতেই পারে। ছোট একচালা ঘর, দাঁড়ালে টিনের চালা মাথায় লাগে। ঘরে ফ্যান নাই, কারেন্টের একটা বাতির লাইন সদর রাস্তার থাম্বা থেকে চুরি করে আনা।
নার্স এসে খালি স্যালাইনের প্যাকেট খুলে আরেকটা স্যালাইন লাগিয়ে দেয়। বউকে ডাকে, বাচ্চাটাকে একবার ব্রেস্ট ফিডিং ট্রাই করেন৷ বেস্ট ফিডিং মানে বুকের দুধ খাওয়ানো। দিলারা এই কদিনে শব্দটার মানে আবিষ্কার করেছে। দিলারার নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে। লোকজন দেখতো না।বাচ্চা কাদলেই গলার জোরে ডাকতে থাকতো,অ দিলারা, দিলারা আবুর মুখে বুনি দে……।পাড়া পড়শি, ক্ষেতে খামারে সবাই শুনতো।
বউ এগিয়ে এসে কপাল কুঁচকে শাশুড়িকে বলে, সরেন সরেন। বউয়ের মেজাজ খারাপ দিলারা আঁচ করে। আসার পর থেকে দুবেলাই মাছ ভাত খাচ্ছে। আজ খেতে হলো খালি ডাল দিয়ে।
বিছানা ছেড়ে দাঁড়িয়ে দিলারা বউকে জানায় আর খাবার দিতে পারবে না সে। টাউনের যতো বাড়ি তার চেনাজানা সবার কাছ থেকে একাধিকবার খাবার আনা হয়ে গেছে। বউ হতাশ চোখে একবার শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে আবার বাচ্চার দিকে মনোযোগ দেয়। লিকলিকে বাচ্চাটাকে কোলে নেয়া বড়ো কঠিন। দিলারা ঝগড়াটে গলায় বলে, ডাক্তার আইলে কইবি অনেক হইছে চিকিচ্ছা। আর লাগবো না।এখন ছাইড়া দিক। বাড়িত নিয়া যতন করুমনে। বউ উত্তর করে না। এখানে যতোদিন থাকে শাশুড়ি ঠিক চেয়ে চিনতে ভাত এনে খাওয়াবে সে জানে। যতোদিন থাকতে পারে ততোদিনই লাভ। দুবেলা পেট পুরে মাছ ভাত খেতে পারে। বাড়িতে বাচ্চাদের বাপ খালের জলে চাঁই ফেলে রাতে মাছ আটকায় আর দিনে এগুলো বাজারে বেচে যা রোজগার করে তাতে ভাতই ঠিকমতো জুটে না তায় আবার রুই কাতলা।হাটে নিয়ে যাওয়া ঝাঁকা থেকে মাঝেমধ্যে দুমুঠো কুঁচো মাছ সে তুলে রাখে বটে কিন্তু বাচ্চাদের বাপ খেঁকিয়ে উঠে। বাজারে যে মাছ পঞ্চাশ টাকায় বিক্রি হয় না, সেই মাছ বউ রাখলেই দাম কয়েকগুণ বেড়ে যায়। জানস বাজারে এগুলার দাম একশ টেহা! পালটা মুখ ঝামটা দেয় বউও কোনুদিন তো দেখলাম না মাছ বেইচ্যা একশ টেহার নোট লইয়া ঘরে ঢুকছেন। বউয়ের এসব যুক্তির পালটা যুক্তি দেবার প্রয়োজন বোধ করে না, ঝাঁকা কাঁধে বাজার মুখি দৌড়ায় লোকটা।
তখনই ওয়ার্ড জুড়ে হুড়োহুড়ি লেগে যায়। ডাক্তার আসছে। আগুনে পোড়া মেয়েটিকে নিয়ে বের হয়ে গেছে স্বজনরা। ঢাকায় নিতে হবে৷এখানে চিকিৎসা হবে না। ডাক্তার জানিয়ে দিয়েছে। শিশু ডাক্তার এসে বাচ্চার চোখ জিহবা বুকের নিচ পরখ করে। নার্সদের দিকে তাকিয়ে বলে কোন ইম্প্রুভ নেই। দিলারা আর বউ পরস্পরের দিকে তাকায়,শব্দটির অর্থ বুঝার চেষ্টা করে। ডাক্তার খসখস করে কাগজে ওষুধ লিখতে লিখতে বলে, ইঞ্জেকশন গুলো এখানে নেই। বাইরে থেকে কিনতে হবে৷ আরো কয়েকদিন বাচ্চাটাকে ভর্তি রাখতে হবে।
দুইটাকা সঙ্গে নেই, ইঞ্জেকশন কিনবে কি দিয়ে? কোথায় বাচ্চাটাকে নিয়ে চলে যাবার কথা ভাবছে দিলারা, মনে মনে ভেবে রেখেছিলো ডাক্তার এলে আজ ছেড়ে দেবার কথা বলবে। ডাক্তারের ভাব দেখে প্রসঙ্গ তোলারই সাহস পেলো না।
ডাক্তার চলে গেলে দুজনে পরামর্শ করতে বসে ইঞ্জেকশনের টাকা কোথা থেকে যোগাড় করা যায়। দিলারা সাফ জানিয়ে দেয়,তার আর হাত পাতার জায়গা নাই। বউ কাকুতি করে, ও মা দ্যাহেন না, কেউ না কেউ দিবো। কত্তোবছর টাউনে আছেন, কত্তো চিন পরিচয় আপনের। শেষের কথাটায় শাশুড়িকে তুষ্ট করার প্রয়াস টুকু শাশুড়ি বুঝতে পারে না । বরং শ্লাঘায় স্বীকার করে, হ তাত আছে কিন্তু চাইলেই কি নগদ টাকা কেউ ছাড়ে! ফেরত দেয়ার নিশ্চয়তা নেই যার তারে কেউ ধারও দিতে চায় না। এরা হাসপাতালে আসার পর থেকে সব বাসাবাড়িতে ঠিকঠাক কাজেও যেতে পারেনা দিলারা। সবাই বিরক্ত। দু’দুটো বাসা না করে দিয়েছে। নতুন বুয়া খোঁজে নিয়েছে তারা। এদের কাছে মাসের বেতন অগ্রিম চাওয়া যেতো। কিন্তু এভাবে চললে টাকা চাওয়া দূরে থাক, কাজগুলোই থাকে কিনা ভরসা নাই।
বউটা ফুঁপিয়ে কাঁদে। কী হবে গো আম্মা! নার্স এসে তাগাদা দেয়, ইঞ্জেকশন আনিয়েছেন? বউ তটস্থ হয়ে ছোট পোটলা থেকে একটুকরো কাগজ বের করে। ফুফাতো ভাইয়ের বড় কাপড়ের ব্যবসা শহরে। ধনী আত্মীয় গরীব আত্মীয়ের খবর রাখা দূরের কথা সম্পর্ক স্বীকারই করে না। গরীব আত্মীয়রা নিজ তাগিদে তাদের ফোন নাম্বার রাখে।দরকারে অপমান হজম করেও ফোন দেয়। বউ বেরিয়ে যায় কারো কাছে চেয়ে একটা ফোন করার ধান্ধায়।
দিলারা বেগমের মাথায় তখন হঠাৎ বুদ্ধিটা চাপে। আচ্ছা এখন আশেপাশে কেউ নাই। কোন সাক্ষী সাবুদ নাই। সবার অলক্ষ্যে সব নল ফল খুলে নিলেই তো সব ঝক্কি চুকে যায়। কয়েক মিনিটের ব্যাপার। যে কোন সময় বউটা ফিরবে। দিলারা কি কাজটি করবে, দ্বিধায় পড়ে সে।

১৯৭০ সনের ০৭ মে হবিগঞ্জে জন্ম। জেলা শহর থেকে প্রকাশিত সংকলনগুলোতে লেখালেখির মাধ্যমেই হাতেখড়ি। শুরুটা আরো অনেকের মতোই কবিতা দিয়ে। ২০০০ সালে প্রকাশিত হয় কাব্যগ্রন্থ ‘নির্বিশঙ্ক অভিলাষ’। এরপর ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়েন মঞ্চনাটকে। রচনা করেন কমলাবতীর পালা, বিভাজন, জ্যোতি সংহিতা ইত্যাদি মঞ্চসফল নাটক। অভিনয়ও করেন। মঞ্চে নাটক রচনার পাশাপাশি নিরব অন্তঃসলিলা স্রোতের মতো বহমান থেকেছে গল্প লেখার ধারাটি। জীবন ও জগতকে দেখা ও দেখানোর বহুস্তরা এবং বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতার উৎসারণ ঘটেছে ২০১৫ সালের বইমেলায় প্রকাশিত ছোটগল্প সংকলন ‘ব্যবচ্ছেদের গল্পগুলি’তে। ‘প্রসঙ্গটি বিব্রতকর’ প্রন্থভুক্ত গল্পগুলোতে সে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি হয়ে উঠেছে আরও নির্মোহ, একবগগা, খরখরে কিন্তু অতলস্পর্শী ও মমতাস্নিগ্ধ। গল্প লেখার স্বীকৃতিস্বরূপ ইতোমধ্যে পেয়েছেন বৈশাখী টেলিভিশনের পক্ষ থেকে সেরা গল্পকারের পুরস্কার, ফেয়ার এন্ড লাভলী সেরা ভালোবাসার গল্প পুরস্কার। ২০১৪ সাথে মঞ্চনাটকে অবদানের জন্য পেয়েছেন ‘তনুশ্রী পদক’। বর্তমানে সক্রিয় রয়েছেন বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের পত্র-পত্রিকা, লিটলম্যাগ এবং বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে প্রকাশিত অন্তর্জাল সাহিত্য পোর্টালে লেখালেখিতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এম. এ সম্পন্ন করে শিক্ষকতা পেশায় জড়িত রয়েছেন। ব্যক্তিগত জীবনে স্বামী অনিরুদ্ধ কুমার ধর ও যমজ সন্তান অদ্বিতীয়া অভীন্সা পদ্য ও অদ্বৈত অভিপ্রায় কাব্যকে নিয়ে হবিগঞ্জে বসবাস করছেন।
মঞ্চে কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ ঢাকা থিয়েটার প্রবর্তিত, ফওজিয়া ইয়াসমিন স্মৃতি পদক,থিয়েটার প্রবর্তিত জাকারিয়া পদক।
প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ৫টি। নাটক ২ টি ও মুক্তিযুদ্ধের কিশোর ইতিহাস সহ প্রকাশিত গ্রন্থ ৯টি।