শুভ জন্মদিন সনজীদা খাতুন
বাঙালিকে তার সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হতে দেননি যাঁরা, সন্জীদা খাতুন তাঁদের একজন। পাকিস্তান সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সংস্কৃতজনদের নিয়ে আয়োজন করছিলেন কবিগুরুর জন্মশতবর্ষ উদ্যাপনের। নতুন দেশ পাওয়ার পর তার সাংস্কৃতিক পথরেখা নির্ধারণে জীবন উৎসর্গ করেছেন। সংস্কৃতিসাধনা ও সাংস্কৃতিক যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন আজও তিনি ছায়ানটের সভাপতি সন্জীদা খাতুন।
‘১৯৫৬ সালের এক সন্ধ্যায় কার্জন হলে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনপ্রতিনিধিদের জন্যে একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছিলো। সেই সন্ধ্যায় রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইবার জন্যে আমি আমন্ত্রিত হয়েছিলাম। কে একজন এসে বলল যে শেখ মুজিবর রহমানের ইচ্ছা মঞ্চে যেন ‘আমার সোনার বাঙলা’ গানটি গাওয়া হয়। পাঁচ স্তবকের পুরা গানখানি আমি সেদিন গেয়েছিলাম। এ গান গাওয়ানোর পেছনে যে সুচিন্তিত পরিকল্পনা ছিলো, সে কথা বুঝতে পারিনি তখন। ঢের পরে উপলব্ধি করেছি, বিশেষ করে পশ্চিম পাকিস্তানিদের কাছে “সোনার বাংলার” জন্য বাঙালীর ভালবাসার কথা তুলে ধরতে চেয়েছিলেন মুজিব। অত আগেই বাঙলা আর বাঙালীর ভাবনা তাঁর মাথায় ছিলো”।
শিল্পী সনজীদা খাতুন জাতীয় সঙ্গীতের জন্য “আমার সোনার বাংলা “গানের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসার প্রথম দিককার বর্ণনা এভাবেই দেন ।
কাজী মোতাহার হোসেন এবং সাজেদা খাতুনের সন্তান সন্জীদা খাতুন (জন্ম: ৪ এপ্রিল, ১৯৩৩) ঐতিহ্যবাহী পরিবারের পরম্পরা রক্ষা করেননি শুধু, নিজেই সৃষ্টি করেছেন নতুন ঐতিহ্যধারা। বায়ান্নর মিছিল থেকে ২০১৮-তে নীলফামারীর রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের উৎসবমঞ্চ আলো করে থাকেন তিনি, অন্ধকারের প্রবল প্রতিপক্ষ হয়ে। একুশ তাঁকে ভাষা দিয়েছিল, একাত্তরে সুরের আগুনকে অস্ত্র করে তুলেছেন তিনি-তাঁকে আমরা পেয়েছি মুক্তিযুদ্ধের সাংস্কৃতিক ফ্রন্টে, রূপান্তরের গান-এ, মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’র সভাপতিরূপে। অর্ধশতাব্দীকালের অনলস সাধনায় বাংলা নববর্ষ উৎসবকে ধর্মবর্ণ-নির্বিশেষে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক জাতীয় উৎসবে রূপদানের অন্যতম পুরোধা তিনি।
পাকিস্তান আমলে বাংলা একাডেমিতে অত্যল্পকালের পেশাজীবনে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মহার্ঘ্য কৃতি আঞ্চলিক ভাষার অভিধান-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন যেমন, তেমনি ফিরোজা বেগম সংকলিত কয়েক খণ্ডের নজরুল সংগীত স্বরলিপি পুস্তকাকারে প্রকাশে রেখেছেন উদ্যোগী ভূমিকা। শুচিস্নিগ্ধ মানুষটি এই বাংলার প্রিয় প্রকৃতির মতোই, এ শ্রাবণের বুকের ভেতর আগুন আছে যেন। হ্যাঁ, বুকের ভেতর আদর্শের আগুন ছিল বলেই ছায়ানট, জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ, ব্রতচারী আন্দোলন, নালন্দা বিদ্যালয়সহ নানা উদ্যোগ-আয়োজনের সৃষ্টি-নেতৃত্ব কিংবা সম্পৃক্ততা তাঁর।
পাকিস্তানি রাষ্ট্রপক্ষ তাঁকে স্বস্তি দেয়নি; বাঙালি সংস্কৃতি বিকাশের ‘অপরাধ’এ কলেজে শিক্ষকতাকালে তাঁকে ঢাকা থেকে বদলি করা হয়েছে সুদূর রংপুরে। তাঁর পক্ষে স্বাভাবিক ছিল নিরস্ত হয়ে যাওয়া কিন্তু সন্জীদা খাতুনের অভিধানে ‘নিশ্চলতা’ বলে কোনো শব্দ নেই; সে জন্যই ২০০১-এ রমনায় ছায়ানটের বর্ষবরণ উৎসবে ভয়ংকর বোমাবর্ষণের পরও তিনি বলতে পারেন ‘বাঙালির সাংস্কৃতিক যুদ্ধ চলবেই’।
কবি শঙ্খ ঘোষ তাঁর দামিনীর গান বইটি-সন্জীদা খাতুনকে উৎসর্গ করে উৎসর্গপত্রে লিখেছেন ‘অনায়াসে যিনি গান শোনান সেই সন্জীদা খাতুনকে…’।
কেন্দ্র-প্রান্তের বিভাজনে তিনি ভেঙে দিতে চান; তাই গানের গুণী হিসেবে সিলেট থেকে রামকানাই দাশ কি ময়মনসিংহ থেকে নূরুল আনোয়ারকে নিয়ে এসেছেন আমাদের সমুখে।
বৃহৎ বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে এভাবে সর্বতোভাবে জড়িয়ে আছেন সন্জীদা খাতুন, কাছের মানুষদের ‘মিনু আপা’, শান্তিনিকেতনের ‘মিনু দি’।
দেশভাগ, দাঙ্গা ও রক্তপাতের শতাব্দীপ্রায় সাক্ষী আবার বাঙালির দুঃখ ও জরা জয়ী সাহসী সাংস্কৃতিক অভিযাত্রার অবিকল্প সারথি সন্জীদা খাতুন; গৌরবদীপ্ত জীবনের পঁচাশি বসন্ত পূর্তিতে আপনাকে আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসাপূর্ণ অভিবাদন জানাই।
‘… বিএ, বিএসসি, এমএ, এমএসসি পাস করাই শিক্ষা নয়। এই সনদ পেয়েও অনেকে কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসমুক্ত হতে পারেনি। … যুক্তিনির্ভর চিন্তার ক্ষমতা অর্জন করে আত্মশক্তিতে দাঁড়ানোর শিক্ষাই প্রকৃত শিক্ষা এবং এই শিক্ষাকে গ্রহণ করতে হবে অন্তরে।
… সুযোগসন্ধানী স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে সকলকে হিংসা-হানাহানির পথে ঠেলে দিচ্ছে। এই অপশক্তিকে হটাবার দায়িত্ব যথার্থ শিক্ষায় শিক্ষিত সচেতন সমাজের।
… গঠনমূলক কাজের মধ্য দিয়ে দেশের সকলকে পূর্ণ মানুষ করে তোলার সাধনা করতে হবে। এই দেশটিকে আলোকিত করে তুলব। বারবার অপশক্তির কাছে পরাজিত হতে দেব না। এ দায়িত্বটা আমার আপনার সকলের। বাংলাদেশে সুদিন আসবেই।’
— ১৪২০ বর্ষবরণ আয়োজনে ছায়ানটের অধ্যক্ষ সংগীতজ্ঞ ড. সনজীদা খাতুন।’
‘জন্মদিন আমার কাছে কোনো গুরুত্ব বহন করে না। এটা একটা জৈবিক ব্যাপার, এমনই কোনো একদিন জন্মেছিলাম। আরেকটু বুড়ো হয়ে গেলাম এই আর কি!’ কিন্তু না আপনি চিরনবীনা।
শুভ জন্মদিন সনজীদা খাতুন