| 28 মার্চ 2024
Categories
দুই বাংলার গল্প সংখ্যা

উড়ে কাঁসারির গ্রাম

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com‘‌কাঁসার বাসন নেবে গো…‌।’ প্লুতস্বরা সে হাঁক ছড়িয়ে পড়ত দু’ চারটে পাড়ায়। বাড়ির ব‌উ‌য়েরা রাস্তায় এসে দাঁড়াত। মাথায় বড় বাজরা, হাতে কাঁসি, তাতে টুং টুং শব্দ করতে করতে কাঁসারি এগিয়ে আসছে। গ্রামে ধার–বাকিতে তার কারবার। খাতা–কলমের বালাই নেই। তার চেয়ে বড় ‌কথা বিশ্বাস। কাঁসারির বড় বিশ্বাস ছিল গ্রামের লোকের ওপর। অথচ মানু্ষটা কোথায় থাকে কেউ জানত না, কেউ খোঁজ–খবরও নেয়নি কোনওদিন। অথচ তার জন্যই মাসভর অপেক্ষা। মাসে একবার, বিয়ের লগ্ন থাকলে বড়জোর দু’ বার চন্দনপুর গ্রামে আসত কাঁসারি। বাকি সময় অন্য গ্রামে ফেরি করে বেড়াত।

শোনা যায় উড়িশার মানুষ। এখানে দু’ একটা গ্রাম ছাড়িয়ে বাসা বেঁধেছিল। উড়ে কাঁসারি বলেই গ্রামের লোক চিনত। ঘরে সমত্থ মেয়ে থাকলে গরিব বাপ-মায়ের ভরসারস্থল ছিল উড়ে–কাঁসারি। ধারবাকিতে মেয়ের বিয়ের দানের বাসন-কোসন আগেই কিনে রেখে দিত। ফলে বিয়ের সময় বাবা-মায়ের চিন্তার ভার অনেকটাই লাঘব হত। ডাগর মেয়ে দেখলে কাঁসারিই তার মা ডেকে বলত, ‘‌এই সময় একটা একটা করে থালা-বাসন কিনে রাখো বউ। মেয়েদের বাড়, দেখতে দেখতে বিয়ের যোগ্যি।’‌ ছোট বেলায় বাবার সঙ্গে আসত কাঁসারি। তখন তার মাথায় থাকত বাজরা। বাবা কাঁসিতে টুং–টুং বোল তুলত, ‘‌কাঁসার বাসন নেবে গো…‌’‌ বলে হাঁক পাড়ত। বাবা মারা যেতে সেই হাঁক নিঁখুত করে গলায় তুলে নিল ছেলে। ওই হাঁক–আর কঁাসির শব্দই তার ব্যবসার পরিচয় হয়ে উঠেছিল। কাঁসারির নাম একটা হয়তো ছিল, কিন্তু গ্রামের লোক চিনত উড়ে-কাঁসারি বলেই।

চন্দনপুর গ্রামের বোসেরা ছিল ধনী লোক। তাই উড়ে–কঁাসারি বড় খদ্দের হল বোসেরা। বোস কর্তার গ্রামে বেজায় দাপট। ইউনিয়ন বোর্ডের প্রাক্তন চেয়ারম্যান। জমি-জায়গা, ব্যবসা–পত্তর চারিদিকে ছড়ানো। বোস বাড়ির সঙ্গে কাঁসারির ব্যবসায়িক যোগও ছিল। বোসেদের বন্ধকী কারবারের বিকিয়ে যাওয়া যত পুরনো বাসন কাঁসারি কুঁদিয়ে (‌পালিশ)‌ এনে দিত। বোসেরা সেটা আবার বেশি দামে বিক্রি করত। একদিন ব্যবসার টাকা-পয়সা নিয়ে বোসবাড়ির সঙ্গে গোল বাধল কাঁসারির। অনেক টাকার গড়মিল। কাঁসারি গ্রামের লোককে বলত, বোসকর্তা তার অনেকটাকা মেরে দিয়েছে। কিন্তু বড়লোক, তার ওপর ইউনিয়ন বোর্ডের প্রাক্তন চেয়ারম্যান বলে কথা। নানা জনকে জানিয়েও কিছু হল না। দীর্ঘদিনের ব্যবসা লাঠে ওঠে গেল কাঁসারির। পাগল হয়ে গ্রামের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরত আর হাঁক পাড়ত, ‌‘‌কাঁসার বাসন নেবে গো…।’‌ এভাবে রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে কাঁসারি একদিন গুম হয়ে গেল। লোকের সন্দেহ গিয়ে পড়ল বোসবাড়ির দিকে। সে অনুমান মিথ্যেও ছিল না। কিন্তু প্রমাণ করবে কে!‌

কাঁসারি গুম হয়ে যাওয়ার মাসখানেক পর গ্রামে এক আতঙ্ক ছড়াল। দিন-দুপুরে যে হাঁক শুনে বাড়ির বউ-মেয়েরা বাইরে বেরিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করত। গভীর রাতে সে হাঁক গ্রামের মানুষের রক্ত হিম করে দিল। অবিকল সেই হাঁক ‘‌কাঁসার বাসন নেবে গো…।’‌ যেদিন সে হাঁক শোনে চন্দনপুরের মানুষ তার পরদিন গ্রামে একটা করে অশুভ ঘটনা ঘটে। কারও বাড়িতে আগুন লেগে যায়, কেউ দুর্ঘটনার কবলে পড়ে আবার কোনও মায়ের কোল শূন্য হয়। হাঁক শুনলেই গ্রামের মানুষ প্রহর গোণে এবার কী ঘটতে চলেছে!‌ শান্তি–সমৃদ্ধির চন্দনপুর ভয়ে, শোকে ক্রমে সিঁটিয়ে যেতে লাগল। গ্রামের মানুষ অনেক কিছু করল, হোম-যজ্ঞ, গুনিন ডেকে তুকতাক, ঘটা করে কালীর পুজো। কিন্তু কিছুতেই আতঙ্ক কাটল না। বরং দিন দিন ভয় আরও ভয়ানক হল। রাত-বিরেতে মানুষ বাড়ির বাইরে বেরনোই ছেড়ে দিল। ব্যবসা-পত্তর, হাট-বাজার সন্ধে নামলেই বন্ধ হয়ে যেত।

বোস বাড়িতেও এরপর থেকে সুখ ছিল না। একটার পর একটা ঘটনা ঘটতে থাকল। ব্যবসা-পত্তর আগের মতো আর চলল না। অযাচিত ক্ষতির ধাক্কা সামলাতে সামলাতে ক্লান্ত হয়ে পড়ল বোসকর্তা। কিন্তু বাইরে সেই একরোখা অহংকারটা ছিলই। বাড়ির বড় ছেলে দুর্ঘটনায় মারা গেল। পাটের গুদামে আগুন লাগল। সেই বছরই জেলা বোর্ডের দুর্নীতি কাণ্ডে নাম জড়িয়ে গেল বোসকর্তার। টাকা-পয়সা ক্ষয়রাতি করে জেলযাত্রা কোনও রকমে রোখা গেলেও গ্রামের মানুষের কাছে বোসকর্তার সেই জ্বলজ্বলে ভাবমূর্তি আর রইল না। কাঁসারির বলে যাওয়া কথাটা ধীরে ধীরে গ্রামের মানুষের কাছে মান্যতা পেলে। ক্ষোভ জমাট বাঁধতে থাকল চন্দনপুরে।

এদিকে মাসে মাসে একটা একটা করে ক্ষতির ধাক্কায় গ্রামের মানুষও ক্লান্ত। সকলের ঘরেই কিছু না কিছু অঘটন ঘটেছে। অন্যের ঘর পুড়ছে বলে মানুষের আর আনন্দের সময় রইল না। এ থেকে নিষ্কৃতি পেতে জোট বাঁধল গ্রামের মানুষ। কাঁসারির কথায় তখন অনেক সমব্যাথী হয়েছিল বটে তবে বোসবাড়ির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মুখখোলার সাহস কারও ছিল না। আপদে-বিপদে দরকার হলে বাসন-কোসন বন্ধক দিয়ে বোসদের থেকে টাকা পেত গ্রামের মানুষ। তাদের বিরুদ্ধে কথা বলে কেউ বিষ নজরে পড়তে চায়নি। কিন্তু দিন দিন ক্ষয় ধরছিল বোসবাড়ির প্রতিপত্তিতে। ঘটা করে দুর্গাপুজো-বাসন্তী পুজো বন্ধ হয়ে গেল। গ্রামের মানুষের কাছে গরিমা হারাল বোসবাড়ির।    

গুনিন বলেছিল কাঁসারির আত্মাকে শান্ত করতে গেলে তার জীবদ্দশার ক্ষোভ মেটাতে হবে। তার জীবদ্দশার ক্ষোভ গ্রামের মানুষের কাছে অজ্ঞাত ছিল না। একদিন ঢেঁড়া পিটিয়ে গ্রাম ষোলোআনা সভা বসল। সকলে একমত হল বোসবাড়ির কাছে কাঁসারির হয়ে পাওনা-গন্ডা তারা বুঝে নেবে। অহংকারী বোসকর্তার কাছে সে খবর গেল। আগে হলে টাকা, সুদ মুকুবের টোপ দিয়ে গ্রামবাসীর জোট ভেঙে দিতে পারত। সে বুদ্ধি ছিল তার মজ্জাগত। এর জোরেই বোস কর্তা একদিন ইউনিয়ন বোর্ডের শীর্ষে বসেছিল। কিন্তু টাকার জোর, সেই রাজনৈতিক আমল আর ছিল না। গরিব মানুষের রাজনৈতিক শক্তি তখন জমাট বাঁধতে শুরু করেছে। যে গরিব মানুষগুলো বোসবাড়ির আশাপাশে যেতে ভয় পেত তারাই একদিন হাজির হল বোস বাড়ির উঠোনে। বোসকর্তা জনরোষের ভয়ে গ্রাম ছাড়ল।

সে রাতেই গ্রামের মানুষ শুনল ‘‌কাঁসার বাসন নেবে গো…।’‌ সে প্লুতস্বরা হাঁক ছড়িয়ে পড়ল সারা গ্রামে। পরদিন মানুষ অপেক্ষায় রইল কখন কার ঘরে কী অঘটন ঘটে!‌ সারাদিন গেল, গ্রামের কোথাও কিছু ঘটল না। সন্ধেয় স্বস্তির শ্বাস ফেলল গ্রামবাসীরা। পরদিন গ্রামের এক গরিব ছেলের দীর্ঘদিনের আটকে থাকা চাকরি চিঠি এল। বারবার বিয়ে ভেঙে যাওয়া মেয়ের যেচে সম্বন্ধ এল। এর পর প্রতিমাসে কাঁসারির হাঁক শোনার পর চন্দনপুর গ্রামে একটা পর একটা ভাল জিনিস ঘটতে থাকল। ঘরে ঘরে সুখ-শান্তি ছড়িয়ে পড়ল। গভীর রাতে সে হাঁক এখনও শোনা যায় চন্দনপুরে। গ্রামের মানুষ এখন অপেক্ষায় থাকে হাঁক শোনার জন্য।‌ সেই হাঁককে শুভ মনে করে গ্রামবাসীরা। চন্দনপুরের সমৃদ্ধির মূলে সেই কাঁসারি, এমনটা বিশ্বাস করে আশপাশের গ্রামের মানুষও। চন্দনপুরকে লোকে এখন সকলে বলে উড়ে-কাঁসারির গ্রাম।‌‌‌

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত