| 7 অক্টোবর 2024
Categories
প্রবন্ধ সাহিত্য

সাহিত্যে কৃষ্ণকথার ইতিহাস । সৌভিক ঘোষাল

আনুমানিক পঠনকাল: 6 মিনিট
বাংলা সাহিত্যে কৃষ্ণকথার শুরু শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যটির মধ্যে দিয়ে। বড়ু চন্ডীদাসের লেখা এই কাব্যটি দীর্ঘদিন লোক চক্ষুর অন্তরালে ছিল। অবশেষে ১৯০৯ সালে বিখ্যাত গবেষক বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বৎবল্লভ বাঁকুড়ার কাকিল্যা নামে এক গ্রামের একটা বাড়ির গোয়ালঘরের মাচা থেকে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন এর এখনো অবধি পাওয়া একমাত্র পুঁথিটি উদ্ধার করেন। আবিষ্কারের সাত বছর পরে ১৯১৬ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ থেকে এটি মুদ্রিত হয়। প্রকাশের পরেই বইটিকে ঘিরে যথেষ্ট সাড়া পড়ে যায়। এর আগে বাঙালি চন্ডীদাসের পদাবলী কীর্তন শুনেছে। শুধু শুনেছে তাই নয়, চণ্ডীদাসের পদাবলী চৈতন্যদেব থেকে শুরু করে বাঙালিকে গত ৫০০ বছর ধরে মাতিয়ে রেখেছে। কিন্তু সেই চণ্ডীদাসের পদাবলীর রসধারার সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের কোন মিল পাওয়া গেল না। তাই একটা প্রশ্ন উঠে এলো কে এই বড়ু চন্ডীদাস ? যিনি পদাবলী লিখেছিলেন এই আখ্যানকাব্যটিও কি তাঁরই লেখা নাকি এর রচয়িতা অন্য কেউ ? অনেক বাক-বিতণ্ডা আলাপ আলোচনা চলল। শেষ পর্যন্ত পণ্ডিতেরা এই সিদ্ধান্তে এলেন চন্ডীদাস নামে কোন একজন নন, অনেকে ছিলেন। রাধা কৃষ্ণের প্রেমলীলার অসাধারণ পদগুলি যিনি লিখেছেন তিনি হলেন পদাবলীর চন্ডীদাস আর শ্রীকৃষ্ণকীর্তন যিনি লিখেছেন তিনি হলেন ভিন্ন এক চন্ডীদাস। তিনি বাসুলী সেবক হিসেবে নিজের পরিচয় দেন, তাঁর নাম বড়ু চন্ডীদাস।
ঠিক কবে বড়ু চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন লেখা হয়েছিল সে নিয়ে পণ্ডিত গবেষকদের মধ্যে অনেক বিতর্ক আছে। ড অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এই সমস্ত বিতর্ক পর্যালোচনার পরে মনে করেছেন পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষের দিকে বা ষোড়শ শতকের গোড়ার দিকে এই কাব্যটি রচিত হয়ে থাকবে। যদি এই অনুমান সঠিক হয় তাহলে নিশ্চিত ভাবে বলা যায় বড়ু চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন হলো বাংলা সাহিত্যে লেখা প্রথম কৃষ্ণকথা। বাংলা সাহিত্যে কৃষ্ণকথার ক্রমবিকাশ নিয়ে আমরা একটু পরে কথা বলব। তার আগেই চলে আসা যাক কৃষ্ণকথার উৎপত্তি এবং ভারতীয় সাহিত্যে কৃষ্ণকথার ক্রমবিকাশ এর কয়েকটা টুকরো সংবাদের দিকে।
পণ্ডিতেরা আমাদের জানাচ্ছেন কৃষ্ণের নাম ছান্দোগ্য উপনিষদে প্রথম পাওয়া যায়। খ্রীষ্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীর মধ্যে ছান্দোগ্য উপনিষদ রচিত হয়েছিল বলে অনুমান। যদিও ঋগ্বেদের একটি সূক্ততে একজন কৃষ্ণের কথা দেখা যায়, যিনি ১০ হাজার সেনা নিয়ে যুদ্ধে উপস্থিত – কিন্তু ঋগ্বেদের এই সূক্তটিকে পণ্ডিতেরা অনেক পরবর্তী কালে প্রক্ষিপ্ত বলে মনে করেছেন। অনেকের মতে ছান্দোগ্য উপনিষদের কৃষ্ণ হলেন ঘোর আঙ্গিরসের শিষ্য। শঙ্করের ব্যাখ্যার সূত্রে এই মতটি জনপ্রিয় হলেও অনেকে এই মত মানেন নি। যেমন বিশিষ্ট গবেষক বিমানবিহারী মজুমদার। এই বিতর্কে এখানে আমরা প্রবেশ করতে চাই না। আমরা দেখে নিই পুরাণ কাব্যে পাওয়া কৃষ্ণের পরিচয়ের দিকে। সেখানে বলা হচ্ছে কৃষ্ণ ছিলেন সান্দিপনি মুনির শিষ্য আর তার পারিবারিক পুরোহিত ছিলেন গর্গ। ভাগবত সহ বিভিন্ন পুরাণ কৃষ্ণকথা সবচেয়ে বিস্তারিতভাবে বলেছে। কিন্তু আমরা জানি ভাগবত অনেক পরবর্তী কালের রচনা। খ্রীষ্টজন্মের অন্তত ৭০০ বছর পরেকার বলেই পণ্ডিতেরা সাধারণভাবে মনে করেছেন। সে আলোচনায় আমরা পরে যাব।
ফিরে আসা যাক প্রাচীনতর ছান্দোগ্য উপনিষদের দিকে। সেখানে বলা হয়েছে কৃষ্ণ হলেন দেবকীর ছেলে। আর ছান্দোগ্য উপনিষদ এর প্রায় সমকালীন রচনা তৈত্তিরীয় আরণ্যকে রয়েছে বাসুদেব শব্দটির উল্লেখ, যেখান থেকে বোঝা যায় বাসুদেব কৃষ্ণ হলেন বসুদেবের ছেলে। তবে এই প্রসঙ্গে ভিন্নমত ব্যক্ত করা প্রখ্যাত পণ্ডিত আর জি ভাণ্ডারকরের কথাটি উল্লেখ করা দরকার। তাঁর মতে তৈত্তিরীয় আরণ্যকে উল্লিখিত বাসুদেব আমাদের পরিচিত বাসুদেব নন। ইনি সাত্ত্বত বৃষ্ণিকুলের কুলদেবতা। এই কৃষ্ণের সঙ্গে আঙ্গিরস শিষ্য কৃষ্ণের সমীকরণ তৈরি করা হয়েছে অনেক পরে। ভারতীয় সাহিত্যের অন্যতম বিশেষজ্ঞ কিথ দুই কৃষ্ণের এই তত্ত্ব মানতে চান নি। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে ভাণ্ডারকর আর কিথের মধ্যে এই বিতর্ক পণ্ডিত মহলে বেশ সাড়া ফেলেছিল।
জে এন ফারকুহার অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘পার্মানেন্ট লেসনস অফ দ্য গীতা’ এবং তারপর প্রকাশিত তাঁর ‘প্রাইমার অফ হিন্দুইজম’ ইত্যাদি বইতে আমাদের জানিয়েছেন খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর মধ্যেই রাম আর কৃষ্ণ দুজনেই যুদ্ধবীর হিসেবে খ্যাতিলাভ করে গেছেন। মেগাস্থিনিস এর সময় রাম আর কৃষ্ণের নামের প্রথমে ভগবানের উপাধি যোগ হয়েছে এবং খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর গোড়া থেকেই তারা বিষ্ণুর সঙ্গে একাত্ম হয়ে দেখা দেন। খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে বৈয়াকরণ পাণিনি বাসুদেব কৃষ্ণ এবং অর্জুনের নাম একসঙ্গে উল্লেখ করেছেন। মহাভারতে কৃষ্ণের পার্থসারথি রূপ তখনকার মানুষের মনে এমন প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছিল যে রাজারা যুদ্ধে গেলে সৈন্যবাহিনীর সামনে কৃষ্ণের প্রতিমূর্তি বয়ে নিয়ে যেতেন। খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীর ঐতিহাসিক কার্টিয়াস জানিয়েছেন ভারতের স্মরণীয় যোদ্ধা পুরু যখন আলেকজান্ডারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রা করেছিলেন তখন সেনাবাহিনীর সামনে ছিল কৃষ্ণের প্রতিমূর্তি।
বৈয়াকরণ পতঞ্জলি খ্রীষ্টপূর্ব ১৫০ সাল নাগাদ তাঁর মহাভাষ্যতে লিখছেন যে তার সময়ে কৃষ্ণ জীবনের নানা রকম ঘটনা নিয়ে অনেক নাটক তৈরি হয়ে গিয়েছিল। বিশেষ করে কৃষ্ণের কংস বধ অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। পতঞ্জলি বলেছেন এই নাটকে কংস পক্ষে যারা থাকতো তারা হলো কালা মুখ আর কৃষ্ণপক্ষে যারা অভিনয় করত তারা হল রক্তমুখ।
মহাকাব্য মহাভারত জুড়ে কৃষ্ণের অবস্থানের কথা আমরা সবাই জানি। মহাভারত খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী থেকে তার লিখিত রূপ পেতে শুরু করেছিল ঠিকই কিন্তু এর কাহিনী যে অনেক পুরনো সেই সম্পর্কে সংশয়ের কোনো অবকাশ নেই। মহাভারতের ভারত যুদ্ধ কবে হয়েছিল তাই নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে। কেউ কেউ ভক্তিবসে একে খ্রীষ্ট জন্মের বেশ কয়েক হাজার বছর আগে পাঠিয়ে দিতে চান। কিন্তু ঐতিহাসিক গবেষণা মনে করে পনেরশো খ্রীষ্টপূর্ব থেকে ৮৫০ খ্রীষ্টপূর্বর মধ্যে কোন একটা সময় এই ভারত যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল। আর গীতার সময়কাল সম্ভবত খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী। পরে কোনোসময়ে এটি মহাভারতের মধ্যে সন্নিবিষ্ট করে দেওয়া হয়।
ধ্রুপদী সংস্কৃত সাহিত্য এবং প্রাকৃত সাহিত্যে কৃষ্ণ কথার ধারাবাহিক বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে। ভাগবত পুরাণ যে কৃষ্ণকথাকে অবলম্বন করে রচিত এবং আমাদের পরিচিত কৃষ্ণকথার সর্ববৃহৎ আকর এ কথা আমরা সবাই জানি। হরিবংশ পুরাণ, ভাসের বাল চরিত নাটক, প্রাকৃত ভাষার কবি সাতবাহন হাল রচিত গাঁথা সপ্তসতী ইত্যাদিও বেশ বিস্তারিতভাবে আমাদের কৃষ্ণকথা শুনিয়েছে।
কৃষ্ণকথা নিয়ে ভাগবৎ পুরাণের পরে যেটি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য রচনা, সেটির রচয়িতা একজন বাঙালি। তবে রচনাটি ক্লাসিক্যাল সংস্কৃত ভাষায় লেখা। দ্বাদশ শতাব্দীতে লক্ষণ সেনের রাজসভার কবি জয়দেবের এই গীতগোবিন্দম এর জনপ্রিয়তা তুঙ্গস্পর্শী। দ্বাদশ সর্গে সমাপ্ত সংলাপধর্মী সঙ্গীতময় এই কাব্যের ছন্দ, অলঙ্কার, শব্দঝঙ্কার ও চিত্ররূপময়তা শুধু বাংলা নয়, গোটা ভারতের সাহিত্য পাঠকের চিত্তজয় করে নিয়েছে। অনাবৃত শৃঙ্গারচর্চার জন্য আধুনিককালে এর বিরুদ্ধে অনেকে আপত্তি তুলেছেন বটে, কিন্তু ভারতীয় সাহিত্যের ঐতিহ্যে তা অস্বাভাবিক ছিল না। পরবর্তীকালে বাংলা সহ বিভিন্ন ভাষায় রচিত বৈষ্ণব সাহিত্যকে জয়দেবের গীতগোবিন্দ গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। বাংলার বৈষ্ণবসমাজ জয়দেবকে গোস্বামীর পর্যায়ে তুলে ধরেছেন, অবৈষ্ণব সমাজেও তাঁর খ্যাতি কম নয়। মাইকেল মধুসূদন বা রবীন্দ্রনাথ – বিপরীত মেজাজের কবিদের কেউই জয়দেব বা তাঁর গীতগোবিন্দকে এড়িয়ে যান নি। মধুসূদন জয়দেবের সঙ্গে গোকুলভবনে মানস পরিক্রমা করেছেন আর রবীন্দ্রনাথ বর্ষার মেঘমেদুর অন্ধকারে জয়দেবকে স্মরণ করে লিখেছেন – “যেথা জয়দেব কবি কোন বর্ষাদিনে/ দেখেছিলা দিগন্তের তমাল বিপিনে/ শ্যামচ্ছায়া, পূর্ণ মেঘে মেদুর অম্বর”।
জয়দেব এর মধ্য দিয়ে বাঙালির কৃষ্ণচর্চার যে উল্লেখযোগ্য ইতিহাস শুরু হল দ্বাদশ শতাব্দী থেকে, পরবর্তী প্রায় নশো বছর ধরে তা অবিরাম গতিতে এগিয়েছে। পঞ্চদশ বা ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম ভাগের মধ্যে লেখা শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের কথা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি। এই শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের মধ্যে জয়দেবের গীতগোবিন্দমের অনেক প্রভাব আছে। তেরোটি খণ্ডে রাধা কৃষ্ণের কাহিনী এখানে বর্ণনা করেছেন বড়ু চণ্ডীদাস। এই তেরোটি খণ্ডের নাম থেকেই এর কাহিনীসূত্রটি সম্পর্কে আভাস পাওয়া যায় – জন্মখণ্ড, তাম্বুলখণ্ড, দানখণ্ড, নৌকাখণ্ড, ভারখণ্ড, ছত্রখণ্ড, বৃন্দাবনখণ্ড, কালিয়দমনখণ্ড, যমুনাখণ্ড, হারখণ্ড, বাণখণ্ড, বংশীখণ্ড ও রাধাবিরহ। এই শেষখণ্ড রাধাবিরহ অবশ্য পুরোটা পাওয়া যায় নি, পুঁথির শেষের দিকের কয়েকটা পাতা নেই। তাই আমরা জানি না কৃষ্ণের বৃন্দাবন থেকে মথুরা গমনে রাধার বিরহ কাতর অভিব্যক্তির মধ্যে দিয়েই কাব্যটি কবি শেষ করেছিলেন, ভারতীয় সাহিত্যের স্বাভাবিক নিয়ম মেনে কল্পনা মিলনে তাঁর সমাপ্তি হয়েছিল।
চৈতন্য পূর্ববর্তী যুগের এই কাব্যটি পরবর্তীকালে তাঁর জনপ্রিয়তা হারিয়ে লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে গিয়েছিল, কিন্তু প্রাকচৈতন্য যুগের আরেকটি কাব্য বৈষ্ণবসমাজে বিশেষ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সেটি অবশ্য স্বাধীন রচনা নয়, ভাগবত পুরাণের আংশিক অনুবাদ। মালাধর বসুর এই অনুবাদ কাব্য শ্রীকৃষ্ণবিজয়ের একটি পংক্তি – ‘নন্দের নন্দন কৃষ্ণ মোর প্রাণনাথ’ – চৈতন্যদেবের খুব প্রিয় ছিল। মালাধর বসু দশম ও একাদশ ভাগবতের দুটি স্কন্ধ মাত্র অনুবাদ করেছিলেন। সম্পূর্ণ ভাগবত মোট বারোটি স্কন্ধ বা পরিচ্ছেদ নিয়ে রচিত। তাতে রয়েছে ৩৩২ টি অধ্যায়। মোট শ্লোকসংখ্যা ১৮,০০০। ভাগবত পুরাণ কবে রচিত হয় তাই নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে যথেষ্ট বিতর্ক আছে। ভাণ্ডারকর মনে করেছেন এটি খ্রীষ্টীয় সপ্তম শতকের রচনা। পুরনো সংস্কৃত, প্রাকৃত বা বাংলা গ্রন্থগুলির সাল তারিখ নিয়ে বিতর্ক ও মতভেদ প্রচুর। তবে মালাধর বসুর অনুবাদ শ্রীকৃষ্ণবিজয় সেই দিক থেকে ব্যতিক্রমী। গ্রন্থকার নিজেই স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন – ১৩৯৫ শকে গ্রন্থ রচনার শুরু ও ১৪০২ শকে তার সমাপ্তি। অর্থাৎ এই গ্রন্থের রচনাকাল ১৪৭৩ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৪৮০ খ্রীষ্টাব্দ। মালাধর ভাগবতের দুটি খণ্ডকে বেছে নিয়েছিলেন কারণ এই দুটি খণ্ডই কৃষ্ণকথার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। ভাগবতের দশম স্কন্ধে কৃষ্ণের জন্ম থেকে দ্বারকালীলা পর্যন্ত বর্ণিত হয়েছে। এখানে কাহিনী অংশ বেশি। তুলনায় একাদশ স্কন্ধে কাহিনি অংশ অনেক কম। এখানে যদুকুল ধ্বংস ও কৃষ্ণের মৃত্যুকাহিনী বর্ণিত।
বাংলা সাহিত্যে কৃষ্ণকথার ক্রমবিকাশের কাহিনী বলতে গিয়ে মৈথিল বিদ্যাপতির কথা বাদ দেওয়া যায় না বাংলা কবিতার লেখক ও পাঠকের ওপর তাঁর গভীর ও বিস্তৃত প্রভাবের কারণেই। পদাবলীর চণ্ডীদাসের মতো তিনিও বাঙালির প্রাণের কবি পাঁচশো বছর ধরে। সেকালের গোবিন্দদাস বিদ্যাপতির দ্বারা এত ঘনিষ্টভাবে প্রভাবিত ছিলেন যে তাঁকে বলাই হয় দ্বিতীয় বিদ্যাপতি। রবীন্দ্রনাথ কাব্যজীবনের শুরুতে বিদ্যাপতির প্রভাবেই যে তাঁর ভানুসিংহের পদাবলী লিখেছিলেন একথাও আমাদের সবারই জানা। বিদ্যাপতির মাথুর বা প্রার্থণা পর্যায়ের বেশ কিছু পদ বাঙালি সংস্কৃতির চিরন্তন অঙ্গ হয়ে গেছে।
বিদ্যাপতির কাছ থেকে যদি বাঙালি অলঙ্কারবহুল কাব্য শুনে থাকে তবে চণ্ডীদাসের কাছ থেকে সে শুনেছে বিপরীতধর্মী সহজ ভাষার পদাবলী। চণ্ডীদাসও বিদ্যাপতির মতোই বাঙালি সংস্কৃতির চিরন্তন অঙ্গ। বিদ্যাপতির উত্তরাধিকার যদি আমরা চৈতন্য পরবর্তীকালে গোবিন্দদাসের মধ্যে পাই, তবে চণ্ডীদাসের উত্তরাধিকারের ধারাটি পাই জ্ঞানদাসের মধ্যে। এই চারজন প্রধানতম বৈষ্ণব কবি ছাড়াও উল্লেখযোগ্য পদাবলী রচয়িতাদের মধ্যে আছেন বলরামদাস, রায়শেখর, বংশীদাস, নরহরি চক্রবর্তী, রাধামোহন ঠাকুর প্রমুখরা। বাংলা বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্য রচনা করেছেন এমন কবিদের তালিকা বানালে তা কয়েক শত হতে পারে। মনে রাখা দরকার মধ্যযুগে মুসলিম কবিরাও পদাবলীর মধ্যে দিয়ে কৃষ্ণকথা শুনিয়েছেন আমাদের। বিভিন্ন আধুনিক ভারতীয় ভাষাতেও কৃষ্ণকথা ও বৈষ্ণব পদাবলীর অতুলনীয় সম্ভার রয়েছে। মীরার ভজনের কথা আমরা কে না জানি। কিন্তু তা ছাড়াও নানা ভাষায় নানা কবিদের অসংখ্য অসামান্য রচনা রয়েছে। দক্ষিণ ভারতের তামিল ভক্তকবিদের থেকে শুরু করে, গুজরাটের নরসিংহ মেটা বা আসাম সহ উত্তর পূর্ব ভারতে মহন্ত শঙ্করদেব – অনেকেই ভারতীয় বৈষ্ণব সাহিত্যকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করে গেছেন। সতী ঘোষ তাঁর মূল্যবান বইতে সে সবের এক চমৎকার আলোচনা করেছেন।
বাঙালিকে কাব্যের দিক থেকে জয়দেব এবং বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস কৃষ্ণকথার দিকে উন্মুখ করে তুলেছিলেন। কিন্তু ভারতীয় ভক্তি আন্দোলনের যে ধারাটি গৌড়বঙ্গে চৈতন্যদেবের মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করল ষোড়শ শতকের শুরুর সময় থেকে, সেটাই যে কোটি কোটি বাঙালিকে শতকের পর শতক ধরে কৃষ্ণকথার দিকে প্রাণিত করেছে সে কথা বলাই বাহুল্য। বাঙালি চৈতন্যের চোখ দিয়ে কৃষ্ণলীলাকে দেখেছে, একথা বললেও অত্যুক্তি হয় না। চৈতন্যদেব, তাঁর পার্ষদ ও শিষ্য পরম্পরা, বৃন্দাবনের ষড়গোস্বামী, চৈতন্য জীবনীকার প্রমুখদের বাদ দিয়ে বাংলা সাহিত্যে কৃষ্ণকথার আলোচনা হয় না। এখানে এই উল্লেখমাত্র করে তা তুলে রাখা গেল পরবর্তী কোনও আলোচনার জন্য।
আধুনিক যুগে উনিশ বিশ শতক জুড়ে কৃষ্ণকথা নিয়ে গবেষণার যে ধারাটি আমরা দেখেছি তা একবিংশ শতাব্দীতেও বহমান। বঙ্কিমচন্দ্রের কৃষ্ণচরিত্র থেকে শুরু করে এর বিস্তারিত আলোচনাও পরে কোনো সময়ে করার ইচ্ছে রইলো।
আকর গ্রন্থ –
১) আর জি ভাণ্ডারকর – বৈষ্ণবিজম, শৈবিজম অ্যাণ্ড মাইনর রিলিজিয়াস সিস্টেমস
২) জে এন ফারকুহার – পার্মানেন্ট লেসনস অব গীতা, আ প্রাইমার অব হিন্দুইজম
৩) হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী – মেটেরিয়ালস ফর দ্য স্টাডি অব আর্লি হিস্ট্রি অব দ্য বৈষ্ণব সেক্ট
৪) রমেশচন্দ্র মজুমদার – ক্লাসিক্যাল অ্যাকাউন্টস অব ইন্ডিয়া
৫) অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় – বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত
৬) শশিভূষণ দাশগুপ্ত – শ্রী রাধার ক্রমবিকাশ : দর্শনে ও সাহিত্যে
৭) সত্যবতী গিরি – বাংলা সাহিত্যে কৃষ্ণকথার ক্রমবিকাশ
৮) ড সতী ঘোষ – ভারতের বৈষ্ণব পদাবলী
৯) শঙ্করীপ্রসাদ বসু – মধ্যযুগের কবি ও কাব্য, চণ্ডীদাস ও বিদ্যাপতি
১০) নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী – মহাভারতের ভারতযুদ্ধ এবং কৃষ্ণ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত