আধুনিক যুগের জন্ম কাহিনি (পর্ব -২)। হোমেন বরগোহাঞি
লেখক পরিচিতি-
১৯৩২ সনে লক্ষ্মীমপুর জেলার ঢকুয়াখনায় হোমেন বরগোহাঞির জন্ম হয়। ১৯৫৪ সনে কটন কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যের স্নাতক। সাময়িকভাবে সরকারি চাকরি করে সাহিত্যচর্চা এবং পরবর্তীকালে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ‘নীলাচল’, ‘জনক্রান্তি’, ‘নাগরিক’,’অসম বাণী’ইত্যাদি কাগজের সম্পাদনা করেন। ‘পিতাপুত্র’ উপন্যাসের জন্য ১৯৭৭ সনে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ‘আত্মানুসন্ধান’,‘বিভিন্ন নরক’,‘সুবালা’, ‘মৎস্য গন্ধা’, ‘সাউদর পুতেকে নাও মেলি যায়’ লেখকের অন্যতম গ্রন্থ। লেখকের ছোট গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ এবং আত্মজীবনী মূলক রচনা অসমিয়া সাহিত্যকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করে তুলেছে। ১২ মে ২০২১ সনে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়।
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ‐– বাসুদেব দাস
(২)
আধুনিক যুগ বললে আমরা কি বুঝি?
আধুনিক শব্দের অভিধান-গত অর্থ হল,’এখনকার, আজকালের, নতুন।’ কিন্তু আধুনিক শব্দটিকে আরও একটি গভীরতর অর্থে ব্যবহার করা হয় কতগুলি বিশেষ লক্ষণাক্রান্ত একটি ঐতিহাসিক যুগকে চিহ্নিত করার জন্য। এই যুগটি অবশ্যই ইউরোপীয় ভাব- বিপ্লবের ইতিহাস। বর্তমানকালে সমগ্র মানব- সমাজই ইউরোপর সভ্যতা সংস্কৃতির দ্বারা বিপুলভাবেপ্রভাবিতহয়েছে সেজন্য শিক্ষিত মানুষ মাত্রই ইউরোপের বৌদ্ধিক ইতিহাসের সঙ্গে সামান্য পরিমাণে হলেও পরিচিত হওয়া দরকার।
ইউরোপে আধুনিক যুগের সূচনা হয় পনেরো শতকে। ইংরেজ দার্শনিক ফ্রান্সিস
বেকনকে আধুনিক যুগের সবচেয়ে মেধাবী মানুষ বলা হয়ে থাকে। অন্য অনেকেই বলতে চায় যে তিনি ছিলেন আধুনিক যুগের প্রথম উদ্গাতা অথচ ফ্রান্সিস বেকনের জন্ম হয়েছিল ১৫৬১ সনে। ১৫ এবং ১৬ শতকে ইউরোপের ভাবজগতে এমন কিছু মহত্ত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছিল যে সমস্ত ঘটনা মধ্যযুগের অবসান ঘটিয়ে আধুনিক যুগের সূচনা করল। সেই জন্য ঐতিহাসিক অর্থে আমরা যে আধুনিক যুগের কথা এখানে বলতে চাইছি সেই যুগটি গত প্রায় ৪০০ বছর অতিক্রমকরে এসেছে ।
এই প্রসঙ্গে বলে রাখা দরকার যে ইউরোপের ইতিহাসকে মোটামুটি তিনটি প্রধান যুগে ভাগ করা যেতে পারে১) প্রাচীন যুগ ২) মধ্যযুগ এবং ৩)আধুনিক যুগ । ইংরেজিতেClassical antiquity নামে পরিচিত প্রাচীন যুগটি খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ সন থেকে আরম্ভ হয়ে প্রায় ৫০০খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চলেছিল ।অবশ্য একটা কথা ঠিক যে ঐতিহাসিক যুগগুলি কোনো একটি বিশেষ বছরের বিশেষ দিনে আরম্ভ হয়ে অন্য একটি বিশেষ বছরের বিশেষ দিনে শেষ হয় না। কাজের সুবিধার জন্য মোটামুটি ভাবে একটি তৎপর্যপূর্ণ বছর ধরে নেওয়াহয় ।যাই হোক না কেন সুদীর্ঘ ১৫০০ বছর কাল অতিক্রান্ত ইউরোপীয় ইতিহাসের এই প্রাচীন যুগটি কিন্তু আসলে গ্রিক এবং রোমানদের যুগ। এই যুগটির প্রথম ভাগে গ্ৰিকরা এবং পরের ভাগে রোমানরা ইউরোপের সভ্যতা সংস্কৃতি গড়ায় প্রধান ভূমিকা নিয়েছিল। মানব সভ্যতায়গ্ৰিকদের অবিনাশী দান হল তাদের সাহিত্য, বিজ্ঞান-দর্শন এবং শিল্প-কলা। অন্যদিকে রোমানরা উত্তরাধিকার হিসেবে রেখে গেছে তাদের শাসনব্যবস্থা এবং আইন ব্যবস্থা। ইউরোপের সভ্যতার সংস্কৃতি গড়ায়গ্রিক এবং রোমানদের অসাধারণ ভূমিকার কথা বোঝাতে হলে মাত্র দুটি কথা বললেই যথেষ্ট হবে ।ইউরোপীয়রা বিশ্বাস করে যে প্রকৃতির অন্ধ শক্তিগুলিছাড়া এই পৃথিবীর প্রতিটি জীবিত এবং চালিকা শক্তি সম্পন্ন বস্তুর মূল উৎস হল গ্ৰিক। সন্দেহ নেই যে এটা হল একটি অতিশোয়ক্তি।এইচ.এ.এল ফিশার নামের একজন ঐতিহাসিক এই অতীত শক্তির বিরুদ্ধে আপত্তি তুলে বলেছেন যে সমস্ত লোক গ্ৰিকদের বিষয়ে এইরকম ধারণা পোষণ করে, তারা ভারতীয়, চৈনিক, কিংবা জাপানি সভ্যতার বিরাট আধ্যাত্মিক সম্পদের কথা পুরোপুরি ভুলে যায়। অবশ্য সেই একই ঐতিহাসিক এই কথাও বলেছেন যে যদি পৃথিবী মানে ইউরোপকে বোঝানো হয় এবং সঙ্গে অন্যান্য মহাদেশের ওপরে ইউরোপের সামগ্রিক প্রভাবের কথা বোঝানো হয়, তাহলে এই কথা মেনে নেওয়ায় কোনো আপত্তি নেই। সমগ্র ইউরোপীয় সভ্যতা সংস্কৃতির উৎপত্তিস্থল হল প্রাচীন গ্রিস। ঠিক সেভাবে ইউরোপের ইতিহাসে প্রাচীন রোমান সভ্যতার মহত্বপূর্ণ ভূমিকার গুণ কীর্তন করে একজন রোমান কবি বলেছিলেনঃ
‘ভিন্ন ভিন্ন জনগোষ্ঠীর মানুষকে একত্রিত করে
তুমি একটা জাতি গড়ে তুললে;
তোমার চরণপ্রান্তেলুটিয়েপড়তে পেরে
ধন্য হয়েছিল অন্যায় আচরণকারীরা
তোমার শত্রুরাও সমান অংশীদার হিসেবে
গ্রহণ করেছিল তোমার আইন
আর এভাবেই একই জায়গায় মিলিত হয়েছিল
মহানগর এবংপৃ্থিবী।
আরো পড়ুন: আধুনিক যুগের জন্ম কাহিনি (পর্ব -১)। হোমেন বরগোহাঞি
(৩)
প্রায় ৫০০ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপের ইতিহাসের প্রাচীন যুগের অন্ত পড়ল। আরম্ভ হল মধ্যযুগ। মধ্যযুগ পনেরো শতক পর্যন্ত বা আর ও সঠিকভাবে বলতে গেলে প্রায় ১৪৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চলেছিল বলে ধরা হয়। মধ্যযুগ নামে পরিচিত ইউরোপের এই এক হাজার বছরের ইতিহাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল এই যে এই সময়ে ইউরোপের সভ্যতা সংস্কৃতি, ধর্ম- দর্শন এবং সাধারণ জীবনধারার কেন্দ্রীয় চালিকা-শক্তি ছিল খ্রিস্টীয় চার্চ তথা খ্রিস্টীয়যাজকসম্প্রদায়। জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে খ্রিস্টীয়ধর্মীয় সংগঠনের প্রভাব ছিল অপরিসীম। প্রাচীন যুগে ইউরোপীয় সমাজ এবং সভ্যতার কেন্দ্রবিন্দু স্বরুপ রোমান সাম্রাজ্যই যে ভূমিকা নিয়েছিল, মধ্যযুগে সেই ভূমিকা নিয়েছিলরোমান চার্চ খ্রিস্টানধর্মীয় সংগঠন। এমনকি স্থানীয় নৃপতি রাও রোমান চার্চ এর অধীন ছিল । সমগ্র ইউরোপে রোমান চার্চের কর্তৃত্ব সমগ্র ইউরোপের জ্ঞান চর্চার ভাষা ছিল লেকিন ফলের সমগ্র ইউরোপ এক বিশ্বজনীন রাষ্ট্রের চেহারা নিয়ে ছিল। কিন্তু প্রতিটি যুগই নিজের গর্ভে ধারণ করে অনাগত যুগের ভ্রূণ। মধ্যযুগেরদ্বিতীয়ার্ধ থেকে এরকম কিছু ঘটনা ঘটতে লাগল – যেসব খবর শেষে মধ্যযুগের অবসান ঘটিয়ে আধুনিক যুগের সূচনা করল। সেরকম একটি ঘটনা হল যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতি সাধন। এখানে একটি কথা বলা দরকার যে যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতি সভ্যতার ইতিহাসে কয়েকবারযুগান্তর এনেছে একটি মাত্র উদাহরণ হিসেবে নাবিকের কম্পাসের কথায় উল্লেখ করা যেতে পারে প্রাচীনকাল থেকে মানুষ সাগরে নৌকা বাজা চালিয়ে আসছে। কিন্তু মাঝ সাগরে দিক নির্ণয় করতে না পেরে পথ হারানোরভয়ে মানুষ আগের দিনে উপকূল থেকে সাগরের বেশি দূরে যেতে বা মহাসাগর গুলি অতিক্রম করতে সাহস করে নি ফলে আটলান্টিক মহাসাগরের একটি বিশাল অনাবিস্কৃত মহাদেশ আছে সে কথা মানুষ জানত না। ইউরোপের মানুষের পক্ষে সমুদ্রপথে ভারত বা চীন দেশে এসে এই সমস্ত দেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করা সম্ভব ছিল না । কিন্তু ১৩০০ খ্রিস্টাব্দেফ্লেভিঅ’গিওজা নামে ইটালির একজন মানুষ চুম্বকের কম্পাস আবিষ্কার করার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর প্রতিটি মহাসাগরের ওপরে মানুষের অবাধ রাজত্ব আরম্ভ হল। মানুষ আমেরিকা আবিষ্কার করল।প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের মধ্যে সমুদ্রপথেযাতায়াত সম্ভব হল । মাত্র একটি শতাব্দীর ভেতরে পৃথিবীটা এবং মানব সভ্যতার রূপটি চিনতে না পারার মতো ভাবে পরিবর্তিত হয়ে পড়ল। এমনকি পৃথিবীটা যে একটা থালার মতো চ্যাপ্টা নয়, একটা বাতাবি লেবুর মতো গোলাকার, এই আধুনিক বৈজ্ঞানিক ধারণাও বেশিরভাগ মানুষের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব হল দুঃসাহসী নাবিকদের জাহাজে পৃথিবীর চারপাশে প্রদক্ষিণ করে দেখানোর পরে। অথচ এই সমস্ত কিছুর মূলে ছিল একটি ক্ষুদ্র জিনিসঃ চুম্বকের কম্পাস।
যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতি সাধন কীভাবে ইউরোপে যুগান্তরের সূচনা করেছে এখন সে কথা বলছি। মধ্যযুগেরপ্রথমার্ধে ইউরোপের বেশিরভাগ মানুষই ছিল কুয়োর ব্যাঙের মতো; নিজের ক্ষুদ্র বাসভূমিছেড়ে তারা কোথাও যেত না এবং পৃথিবীতে কোথায় কী ঘটছে তারা তার আভাস পেত না। কিন্তু এগাৰো শতকে একটি বড়ো ঘটনা ঘটল। খ্রিস্টানদের পবিত্র ভূমি জেরুজালেম মুসলমানরা দখল করায় রোমের পোপ দ্বিতীয় আর্বান ১০৯৫খ্রিস্টাব্দে এই বলে ফতোয়া জারি করলেন যে ইউরোপের সমুদায়ক্রিশ্চিয়ান যুদ্ধ করে জেরুজালেম পুনরুদ্ধার করতে হবে । আরম্ভ হল ইউরোপের ইতিহাসের বিখ্যাত ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধগুলি। ক্রুসেড শব্দটি এসেছে ক্রিশ্চানদের পবিত্র চিহ্ন ক্রুশ থেকে।১০৯৫থেকে ১২৯১খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত নয় বার মুসলিমদের বিরুদ্ধে ক্রুসেডঅর্থাৎ ধর্মযুদ্ধ চালানো হয়েছিল কিন্তু ক্রুসেডের মূল লক্ষ্য পূরণ হল না। জেরুজালেম পুনরুদ্ধার করতে না পারলেও অন্যপ্রকারে কিন্তু ইউরোপীয়খ্রিস্টানদেরবড়ো লাভ হল। প্রথম লাভ হল প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন ।ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে জেরুজালেমে ধর্মযুদ্ধ করতে যাওয়া মানুষেরাপ্রাচ্যের নানা বিলাস বৈভবের উপকরণগুলির সঙ্গে পরিচিত হয়ে সেই সমস্ত এনে ইউরোপের বাজারে বিক্রি করতে লাগল। পরবর্তীকালে অনেক মানুষ সেই সমস্ত জিনিস প্রাচ্য থেকে আমদানি না করে নিজের জায়গায়উৎপাদন করতে লাগল। বড়ো পরিসরে বাণিজ্যের জন্য দরকার যাতায়াতেরসুব্যবস্থা। যাতায়াতের ব্যবস্থা উন্নত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রধান পথগুলিৰ আশেপাশে অনেক সমৃদ্ধিশালী নগর গড়ে উঠল। এই নগর গুলিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠল একটি নতুন ধনী মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়। এই মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়টি প্রধানত গঠিত হয়েছিল স্বাধীন ব্যবসায়ী এবং কারিগরদের নিয়ে । এই নবোত্থিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের প্রভাবে পড়েমধ্যযুগেরসামন্ততন্ত্র রূপ পরিবর্তন করতে আরম্ভ করল। রাজা বা ভূস্বামীরা কেবল মাটি লেনদেনে সন্তুষ্ট না থেকে রাজনৈতিক ক্ষমতা আহরণ করার প্রয়োজন অনুভব করতে লাগল অর্থাৎ ঠিক এই সময়ে গির্জার সর্বময় কর্তৃত্বের বিপরীতে একটা সেকুলার তথা ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি একটু একটু করে মাথা তুলতে লাগল। পরবর্তীকালে এই দুই শক্তির মধ্যে যে সংঘর্ষ হল তার ফলেই জন্ম হল আধুনিক জাতীয়তাবাদ তথা জাতি‐রাষ্ট্রগুলির।
দ্বিতীয়তঃক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ গুলির ফলে ইউরোপের মানুষ যে কেবল প্রাচ্যেরবিলাসবৈভবের উপকরণ গুলির সঙ্গে পরিচিত হল এরকম নয়। তার সঙ্গে তারা পরিচিত হল ইসলামী সভ্যতার শ্রেষ্ঠ আধ্যাত্মিক সম্পদ এবং জ্ঞান বিজ্ঞানের সঙ্গে। ইউরোপের চেয়েপ্রাচ্যের ইসলামের সভ্যতা সমস্ত প্রকারে বেশি উন্নত ছিল। প্রাচীন গ্রিসের যে বিপুল জ্ঞান ভান্ডারের সঙ্গে তখন পর্যন্ত ইউরোপীয়দের কোনো পরিচয়ঘটেনি সেই জ্ঞান ভান্ডারের চাবিকাঠি ছিল আরব জ্ঞান তপস্বীদের দখলে। এই আরবদের সংস্পর্শে এসে ইউরোপের চোখ নতুন করে খুলে গেল। এমনকি যে গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল সুদীর্ঘ পাঁচশো বছর ধরে ইউরোপীয় জ্ঞান সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র সম্রাট ছিলেন আর যার দার্শনিক চিন্তাধারাকে খ্রিস্টধর্ম নিজের বলে গ্রহণ করেছিল, সেই এরিস্টটলকেও আবিষ্কার করেছিল আরব পন্ডিতদের মাধ্যমে। অষ্টম শতকে স্পেন জয় করা আরবরাত্রয়োদশ শতক থেকে এরিস্টটলেররচনাবলী ইউরোপে বহন করে আনে। এরিস্টটেলেরদর্শনেরআরবি অনুবাদের মাধ্যমে ইউরোপের মানুষ তার দার্শনিক চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার প্রথম সুযোগ পায়।
ইসলামী তথা আরবি সভ্যতার সঙ্গে ঘটা সংস্পর্শ ইউরোপীয় চিন্তা এবং জ্ঞান চর্চায় নতুন প্রাণ সঞ্চার করল ঠিক কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে ইউরোপীয়রা নিজের সাধনার দ্বারাই মধ্যযুগে কোনো মহৎ সৃষ্টি করতে পারেনি। মধ্যযুগে আধুনিক জাতীয়তাবাদের কীভাবে সূচনা হয়েছিল সে কথা আমরা আগে বলেছি। এই জাতীয় চেতনা ইউরোপীয় মানসে প্রথমবারের জন্য দেশ প্রেমের নতুন ধারণারও সৃষ্টি করল। দেশ প্রেমের সঙ্গে সঙ্গে এল স্থানীয় ভাষাগুলির প্রতি সেই ভাষা বলা মানুষদের এক নতুন শ্রদ্ধার মনোভাবঅর্থাৎ অন্যভাবে বলতে গেলে নবোন্মোষিত জাতীয় চেতনা একদিকে যেভাবেখ্রিস্টীয় গির্জার সর্বময় কর্তৃত্বকে প্রত্যাহ্বান জানাতে আরম্ভ করেছিল অন্যদিকে ঠিক সেভাবেই ইউরোপের স্থানীয় ভাষাগুলিও ল্যাটিন ভাষার একাধিপত্বকে অস্বীকার করে নিজের স্বাধীন অস্তিত্ব এবং বিকাশের অধিকার ঘোষণা করেছিল ইতালির এই ধরনের একটি স্থানীয় ভাষায় রচিত ‘ডিভাইন কমেডি’ নামের মহাকাব্যটিই মধ্যযুগের ইউরোপের সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্য কীর্তি। এই মহাকাব্যের রচয়িতা হলেন আলিগিয়েরিদান্তে(১২৬৫-১৩২১)। যে চারজন মহাকবিকে ইউরোপের সর্বকালেরসর্বশ্রেষ্ঠ কবি বলে বিবেচনা করা হয় তাদের মধ্যে একজন হলেন দান্তে। বাকি তিনজন হলেন হোমাৰ (গ্ৰিস),শেক্সপিয়ার(ইংল্যান্ড) এবং গ্যেটে(জার্মান)।দান্তের’ডিভাইন কমেডি’ একদিকে একটি দার্শনিক মহাকাব্য অন্যদিকে তা সমগ্র মধ্যযুগের বিশ্বকোষ। দান্তের’ডিভাইন কমেডি’মধ্যযুগের সমাপ্তি ঘোষনা করেছে বলা যেতে পারে। কিন্তু সেই সমাপ্তি ছিল অস্তমিত সূর্যের সোনালি আভা অপরূপ করে তোলা দিনাবাসনের মতোই সুন্দর।

অনুবাদক