আমরা কী তাঁর যোগ্য উত্তরসূরী
ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর বলতেই মনের ক্যানভাসে ফুটে ওঠে ধুতি-চাদর-তালপাতার চটি পরিহিত ইস্পাতের মতো দৃঢ় অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এক মহান ব্যক্তির ছবি। বাংলাভাষা ও সাহিত্যে এবং সমাজ ও শিক্ষাসংস্করক হিসেবে তাঁর অবদান সকলেরই জানা। ক্ষুদ্র বনজঙ্গলের ঝোপ ভেদ করে বৃহৎ বনস্পতি যেমন মাথা তুলে শূন্যে গগনমুখী হয় সেরকম তিনিও তৎকালীন সংকীর্ণ বঙ্গসমাজের অস্বাস্থ্যকর, জীর্ণ পরিবেশকে তুচ্ছ করে বৃহৎ বৃনস্পতির ন্যায় সমাজসংস্করণের পথে শব্দহীন সুদূর নির্জনে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
নারী সমাজের জন্য তাঁর সংগ্রামী অবদানের ফসল আজও আমরা প্রতিটি নারী ভোগ করছি। বাল্যবিবাহ ও বিধবাদের বোবাকান্না তিনি শুনতে পেয়েছিলেন, তাতে তাঁর হৃদয় বিগলিত হয়। ২৮ জানুয়ারি, ১৮৫৫ সালে বিধবাবিবাহ সম্পর্কে তিনি প্রথম গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “বিধবাবিবাহের প্রথা প্রচলিত না থাকতে যে নানা অনিষ্ট ঘটিতেছে, ইহা এক্ষণে অনেকেরই বিলক্ষণ হৃদয়ঙ্গম হইয়াছে। অনেকেই স্ব স্ব বিধবা কন্যা ভগিনী প্রভৃতির পুনর্বার বিবাহ দিতে উদ্যত আছেন। অনেকে ততদূর পর্যন্ত যাইতে সাহস করিতে পারে না ; কিন্তু এই ব্যবহার প্রচলিত হওয়া নিতান্ত আবশ্যক হইয়া উঠিয়াছে , ইহা স্বীকার করিয়া থাকেন ।…বিধবাবিবাহকে অকর্তব্য কর্ম বলা কোনও ক্রমেই শাস্ত্রসম্মত অথবা বিচারসিদ্ধ হইতেছে না । অতএব কলিযুগে বিধবাবিবাহ যে সর্বপ্রকারেই কর্তব্য কর্ম সে বিষয়ে আর কোন সংশ্রয় অথবা আপত্তি হইতে পারে না । ” তিনি সমাজের জ্যোতির্ময় আলোকস্তম্ভ । ৪ অক্টোবর, ১৮৫৫ সালে বিধবাবিবাহ আইনসিদ্ধ করার জন্য ভারতীয় ব্যবস্থাপক সভায় আবেদনপত্র পেশ করেন। ১৬ জুলাই ,১৮৫৬ সালে বিধবাবিবাহ সরকারিভাবে বিধিবদ্ধ হয়। তার জন্য বিদ্যাসাগর মহাশয়কে অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হয়েছিল । বিধবাদের পুর্নবিবাহ দিয়ে জীবনের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার জন্য তিনি বহু লোককে বুঝিয়ে ছিলেন। অবশেষে ৭ ডিসেম্বর ১৮৫৬ সালে কলকাতার বর্তমান ৪৯, সুকিয়া স্ট্রিটের বাড়িতে প্রথম বিধবাবিবাহ সম্পন্ন হয়। তারপর তাঁর উদ্যোগে অনেক সম্মানিত বংশের বাল্যবিধবাদের পুনর্বিবাহ হয়। ১১ আগষ্ট , ১৮৭০ কলকাতার বাড়িতে নিজ পুত্র নারায়ণচন্দ্রের সঙ্গে ১৪ বছর বয়সী দরিদ্র বিধবা কন্যার বিবাহ দিয়ে ছিলেন। তিনি বলেন, “বিধবাবিবাহ প্রবর্তন আমার জীবনের সর্বপ্রধান সৎকর্ম্ম। এ জন্মে যে ইহা অপেক্ষা অধিকতর আর কোন সৎকর্ম্ম করিতে পারিব , তাহার সম্ভাবনা নাই। এ বিষয়ের জন্য সর্বস্বান্ত হইয়াছি এবং আবশ্যক হইলে প্রাণান্ত স্বাকারেও পারন্মুখ নহি।…. আমি দেশাচারের নিতান্ত দাস নহি, নিজের বা সমাজের মঙ্গলের নিমিত্ত যাহা উচিত বা আবশ্যকবোধ হইবে তাহা করিব।”
সেই সময় কুলীন ব্রাহ্মণেরা একসঙ্গে ত্রিশ-চল্লিশটা করে বিবাহ করতেন। তিনি এই জঘন্য বহুবিবাহ প্রথার বিরুদ্ধেও লড়াই করেছিলেন। ২৭ ডিসেম্বর ১৮৫৫ সালেই বহুবিবাহ রদ করার জন্য ভারতীয় ব্যবস্থাপক সভায় ২৫ হাজার সইসহ আবেদনপত্র পেশ করেন।
আজ আমরা দাঁড়িয়ে আছি সেই মহান ব্যক্তির দ্বিশতবর্ষ জন্মজয়ন্তীর দ্বার ধরে। তাঁর মহান কর্মযজ্ঞ জীবনে চলার পথে আমাদের কতটা পাথেয় হয়ে উঠেছে সে বিষয়ে একটা জিজ্ঞাসাসূচক চিহ্ন থেকেই যায়! আজও কি সমাজে বিধবাদের যথাযোগ্য পদমর্যাদা দেওয়া হয় ? না কি পুরোটাই নকল সোনার রাংতায় মোড়া চকমকি পাথর? সমাজে বর্তমানে নারীমর্যাদার স্থান সেভাবে শক্তপোক্ত হয়নি। বহুবিবাহ প্রথাও সম্পূর্ণভাবে নির্মূল হয়নি। দু’ শো বছর তো কম নয়। জাতিগঠনের মেরুদন্ড শক্ত হওয়ার পক্ষে যথেষ্ট সময়। আমরা তাঁর যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে কতটা নির্ভরযোগ্য সেই বিতর্ককে কোনভাবেই এড়িয়ে যেতে পারি না।
শিক্ষক,গদ্যকার