আজ ২৫ আগষ্ট কবি ও কথাসাহিত্যিক তসলিমা নাসরিনের শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।
আমার কবিতা
আমার বেশ কিছুদিনের চেনা এক কবি এর মধ্যে বেশ কিছু কবিতা পড়ে ফেলেছেন আমার। বললেন, আমার কবিতা খুব আটপৌরে। আটপৌরে বলতে ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছেন জানি না। কী? খুব পাশের বাড়ি পাশের বাড়ি, চিনি চিনি ধরনের? খুব ঘরের কিছু, মাছ ভাত, হলুদ নুনএর মতো? পানের বাটা, চালকুমড়ো, দিদিমা দিদিমা, মা মা? নাকি মেঝের আল্পনা, মুড়ি ভাজা, দুপুরবেলার উল্টোরথ, দিদিদের শ্বশুরবাড়ি চলে যাওয়া? কবি আমাকে ঠিক বলেন নি কী। তবে আটপৌরে শব্দটা উচ্চারণ করতেই মা’র পরণের সেই আটপৌরে ধনেখালি শাড়িটা যেন উড়ে এসে আচমকা আমার শরীর, আমার মুখ চোখ ঢেকে দিল। আমি শুধু চোখ বুজে ঘ্রাণ নিলাম আমার মা’র শরীরের। একটা জুঁই ফুল জুঁই ফুল ঘ্রাণ ছিল মা’র শরীরে! কত হাজার বছর মা’কে দেখিনা!
মা মারা যাওয়ার পর বেশ কয়েক বছর আমি ঘুমের মধ্যে একটা স্বপ্ন দেখতাম। ওই একটা স্বপ্নই আমি প্রতিরাতে দেখতাম। স্বপ্নটা এমন: মা বাড়িতে আছে, হাঁটছে, হাসছে, কথা বলছে। ঠিক আগের মতো সবকিছু। মা’কে আমরা সবাই খুব আদর যত্ন করছি, খুব ভালোবাসছি, মা’ও বাড়ির সবার খোঁজ খবর নিচ্ছে, সবাই খাচ্ছে কিনা, ঘুমোচ্ছে কিনা, বাড়ি ফিরছে কিনা দেখছে। মা’র শরীরে অসুখ। কিন্তু অসুখটা নিয়েই মা বেঁচে আছে। মা মারা যাবে এরকম ভাবছে অনেকে, কিন্তু মা আসলে মারা যাচ্ছে না। অথবা মারা গিয়েছিলো, কিন্তু কী করে যেন মৃত্যুকে ঠেলে সরিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছে। এই স্বপ্নের নরম পালক কে যেন আমার চোখে মুখে আলতো ছুঁইয়ে ঘুম ভাঙাতো। ঘুম ভাঙার অনেকক্ষণ পর্যন্ত আমার মনে হতো যে স্বপ্নটা বুঝি সত্যি। অনেকক্ষণ, সম্ভবত কয়েক সেকেণ্ড। স্বপ্নের জন্য, ঘোরের জন্য, পরাবাস্তবতার জন্য কয়েক সেকেণ্ডই অনেকক্ষণ। কয়েক সেকেণ্ড পার হলে বুঝে যেতাম, ও স্বপ্ন, মা বেঁচে নেই। খুব কষ্ট হতো। স্বপ্নটা সত্যি হোক, কী যে ভীষণ চাইতাম! মা’র না মরে যাওয়াটা যদি সত্যি সত্যিই সত্যি হতো! স্বপ্নটাকে সত্যি করে ফেলা আর সত্যিটাকে স্বপ্ন করে ফেলার ইচ্ছেটা আমার ভেতরে চিরকাল বোধহয় রয়েই যাবে। আমি ঠিক জানিনা কেন আজকাল ওই স্বপ্নটা আমি আর দেখি না। কেন আমি ওই একই স্বপ্ন প্রতিরাতে দেখতাম, সেও জানি না। মা’কে, ঠিকই যে, আজকাল আগের চেয়ে কম মনে পড়ে। মা’কে নিয়ে ‘নেই কিছু নেই’ বইটা লিখে ফেলার পর, আমি লক্ষ্য করেছি, ভেতরে ভেতরে দায়িত্ব পালন করার পর যেমন এক প্রশান্তি জোটে, তেমন জুটেছে। বেদনার তীব্রতা কমে এসেছে ধীরে ধীরে। বইটা লেখার সময় চোখের জল অনেক ঝরেছে। একহাতে জল মুছেছি, আরেক হাতে লিখেছি। লিখলে, আমার বিশ্বাস, দুঃখ কষ্ট অনেক কমে। সে কারণেই বোধহয় ওই স্বপ্নটা আমি আর দেখি না। খুব ইচ্ছে করে স্বপ্নটা আবার দেখি। আবার দেখি মা বাড়িতে আছে, হাঁটছে, হাসছে, কথা বলছে। ঠিক আগের মতো সবকিছু। লেখকরা কি খুব স্বার্থপর? আমি তো কবিতা লিখেও অনেক বিরহের যণ্ত্রণাকে কমিয়ে ফেলেছি। কমিয়েছি নারীবাদী লেখা লিখে বৈষম্যের বিরুদ্ধে জমে থাকা দীর্ঘ বছরের রাগকে, ক্ষোভকে।
আমি আটপৌরে জীবনই চাই, আমার কবিতাও আমার জীবনের মতো। একরকম জীবন যাপন করবো, আর আরেক রকম কবিতা লিখবো, তা আমার দ্বারা হবে না। যে ভাষায় কথা বলি, সেই ভাষাটাকে, সেই ভাষার শব্দ আর অক্ষরকেই তো রোপন করবো কবিতার মাটিতে। জীবনই তো জন্ম নেবে ছত্রে ছন্দে! জীবনকেই তো তুলে নেবো শব্দ থেকে। তুলে নিয়ে শহর বন্দর গ্রাম খালি পায়ে দৌড়ে বেড়াবো। যে জীবনটাকে চিনিনা, যে শব্দ আমি প্রতিদিন ব্যবহার করি না, প্রতিদিন শুনি না, যে বাক্য আমি নির্মাণ করি না, যে বাক্য আমি আমার চারপাশের কাউকে নির্মাণ করতে শুনি না, সেই শব্দ বাক্য আমি কবিতায় জড়ো করি না। যে ভাষায় আমি মনে মনে নিজের সঙ্গে কথা বলি না, সে ভাষায় আমি কবিতা লিখি না। লিখলে সেই কবিতাকে, আমি খুব ভালো করে জানি, আমার নিজের কবিতা বলে মনে হবে না। লিখলে সেই কবিতা মিথ্যে কবিতা হবে। মিথ্যের সঙ্গে আমার ওঠা বসা নেই। লেনদেন নেই। কোনও মিথ্যেকে আমি আমার বলে মনে করি না। আমি লেখায় কায়দা খাটাই না, যা-ই লিখি, যা কিছুই লিখি, হৃদয় দিয়ে লিখি। কী লিখলে অত্যাধুনিক কবিতা হবে, কী ঢংএ লিখলে ক্রিটিকদের প্রশংসা পাওয়া যাবে, কী ধরণের ছন্দ হলে নতুন কবিতার ধারা তৈরি হবে, এসব আমার ভাবনার বিষয় নয়। পাঠক আমার লেখা বুঝবে কি না, আমার লেখাকে ভালো বলবে কি না, সে নিয়েও আমি ভাবি না। পাঠককে সুখ আনন্দ জোগাতে আমি কখনও কোনও লেখা লিখিনি। কিছু কথা আমার ভেতর-ঘরে বসে হাঁসফাঁস করে, আমি তাই জানালা দরজাগুলো খুলে দিই। এটুকুই। যা কিছুই লিখি, লিখি আমার মায়ের ভাষায়, যে ভাষা মা আমাকে শিখিয়েছিল সে ভাষায়, হৃদয়ের ভাষায়। ধার করে লিখি না। অনুকরণ করি না। কবিতকে নিয়ে জাদুঘরে নিয়ে যাই না, কবিতাকে পড়ে থাকতে দিই কলমিলতায় ছেয়ে থাকা পুকুরপাড়ে।
দীর্ঘ নির্বাসনের শেকল ছিড়ে যখন কলকাতায় এসে থাকতে শুরু করেছিলাম, দুপুরবেলায় বারান্দার রোদে কাপড় শুকোতো আর হাওয়ায় ভাসতো রান্নার সুগন্ধ, হলুদ মরিচের, ধনে জিরের সুগন্ধ। ঠিক ওই ছবিটিকে আমি স্থির করে রাখতাম মনে, ওই ছবিটিই আমাকে আমার শৈশব দিত, কৈশোর দিত। বিদেশের আধুনিক জীবন যাত্রা তুচ্ছ করে ওই ছবিটির জন্য আমি বাঙালির আটপৌরে জীবনের কাছে ফিরেছিলাম। মা’র আটপৌরে শাড়ির আঁচলখানির কাছে। আঁচল ছিঁড়ে ফেলেছে লোকেরা।
কিন্তু আমার আটপৌরে কবিতাকে আমি বাঁচিয়ে রেখেছি। ওগুলো ছিঁড়ে টুকরো করতে এখনও পারেনি কেউ। আমার কবিতা থেকে সোঁদামাটির যে ঘ্রাণ আসতো, সে ঘ্রাণ এখনও আসে। সবচেয়ে যে ঘ্রাণটা বেশি আসে, সে আমার মা’র শরীরের জুঁই ফুল জুঁই ফুল ঘ্রাণটা। আর কেউ পায় কি না জানি নি, ঘ্রাণটা আমি পাই। ওই ঘ্রাণটা যতক্ষণ না পাই, ততক্ষণ বুঝি যে আমার কবিতা কবিতা হয়ে ওঠে নি।
মুক্তি
যদি ভুলে যাবার হয়, ভুলে যাও।
দূরে বসে বসে মোবাইলে, ইমেইলে হঠাৎ হঠাৎ জ্বালিয়ো না,
দূরে বসে বসে নীরবতার বরফ ছুড়ে ছুড়ে এভাবে বিরক্তও করো না।
ভুলে গেলে এইটুকু অন্তত বুঝবো ভুলে গেছো,
ভুলে গেলে পা কামড়ে রাখা জুতোগুলো খুলে একটু খালি পায়ে হাঁটবো,
ভুলে গেলে অপেক্ষার কাপড়চোপড় খুলে একটু স্নান করবো,
ভুলে গেলে পুরোনো গানগুলো আবার বাজাবো,
ভুলে গেলে সবগুলো জানালা খুলে একটু এলোমেলো শোবো।
রোদ বা জ্যোৎস্না এসে শরীরময় লুকোচুরি খেলে খেলুক, আমি না হয় ঘুমোবো,
ঘুমোবো ঘুমোবো করেও নিশ্চিন্তের একটুখানি ঘুম ঘুমোতে পারিনা কত দীর্ঘদিন!
কেবল অপেক্ষায় গেছে। না ঘুমিয়ে গেছে। জানালায় দাঁড়িয়ে গেছে।
কেউ আমাকে মনে রাখছে, কেউ আমাকে মনে মনে খুব চাইছে, সমস্তটা চাইছে,
কেউ দিনে রাতে যে কোনও সময় দরজায় কড়া নাড়বে,
সামনে তখন দাঁড়াতে হবে নিখুঁত, যেন চুল, যেন মুখ, যেন চোখ, ঠোঁট,
যেন বুক, চিবুক এইমাত্র জন্মেছে, কোথাও ভাঙেনি, আঁচড় লাগেনি, ধুলোবালি ছোঁয়নি।
হাসতে হবে রূপকথার রাজকন্যার মতো,
তার ক্ষিধে পায় যদি, চায়ের তৃষ্ণা পায় যদি!
সবকিছু হাতের কাছে রাখতে হবে নিখুঁত!
ভালোবাসতে হবে নিখুঁত!
নিমগ্ন হতে হবে নিখুঁত!
ক্ষুদ্র হতে হবে নিখুঁত!
দুঃস্বপ্নকে কত কাল সুখ নামে ডেকে ডেকে নিজেকে ভুলিয়েছি!
ভুলে যেতে হলে ভুলে যাও, বাঁচি।
যত মনে রাখবে, যত চাইবে আমাকে, যত কাছে আসবে,
যত বলবে ভালোবাসো, তত আমি বন্দি হতে থাকবো তোমার হৃদয়ে, তোমার জালে,
তোমার পায়ের তলায়, তোমার হাতের মুঠোয়, তোমার দশনখে।
ভুলে যাও, মুখের রংচংগুলো ধুয়ে একটু হালকা হই, একটুখানি আমি হই।
এক থোকা লাল টকটকে ঈর্ষা
বলতে কারও সঙ্গে কোনও সম্পর্ক টম্পর্ক নেই, বেশ লাগতো শুনতে।
বলেও তো ছিলে বয়স হয়ে গেছে তোমার, ওসব আর আসে না, ওই সেক্স টেক্স।
বয়স আর এমন কী হল, বলেছিলাম, ত্বকে তো একফাঁটা ভাঁজও এখন অবধি পড়েনি!
বলেছিলাম বটে, মনে মনে কিন্তু তোমাকে ভেবে নিয়েছিলাম, অফিস করছো, সন্ধ্যেয়
বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছো, মদ খাচ্ছো, নয়তো কোনও মঞ্চে কবিতা পড়ছো,
মেয়ে দেখলে এখন আগের মতো ছোঁক ছোঁক করছো না, ছলে কৌশলে বিছানায়
শোয়াচ্ছো না, ওই যে বলেছিলে, বয়স হয়েছে, ভেবেছিলাম সত্যিই বয়স হয়েছে,
শরীরের নড়বড়ে এটা ওটা ধীরে ধীরে গুটিয়ে রেখেছো, ভেবেছিলাম আমাকে বোধহয়
দুপুরবেলাটেলায় মাঝে মাঝে ভাবো, কী রকম প্রচণ্ড এক ঝড় তুফান হারিয়েছো, ঠিক ওরকমটি তো আর কারও সঙ্গে হবার নয়, তাই বোধহয় জিভের জলও শুকিয়ে ফেলেছো নিজেই। সেক্স টেক্স সব তো নিজের হাতেই। তুমি তো আর ধর্ষক নও, যে, বলবে তোমার ইচ্ছে টিচ্ছে সামলোনো তোমার হাতে নেই, আছে ভগবানের হাতে! ভেবেছিলাম রাত হলে পথ হাতড়ে হাতড়ে আগের মতো বাড়ি ফিরছো।
হয়তো ফিরছো, তবে আমার সঙ্গে মধ্যরাত অবধি গড়াগড়ি খেয়ে যেমন ফিরতে,
তেমন আরেক জনের সঙ্গে খেয়ে এখন ফেরো। নিজেই বললে আজ, অনেকগুলো বছর পর।
এত দীর্ঘদিন দূরে আছো, ভুলেই গিয়েছো যে, আসলে সত্যটা তুমি
আমাকে কখনো বলো না, বরাবরই মিথ্যেটাই বলো।
মিথ্যেটা যতদিন বলছিলে, ততদিন আমার জন্য সামান্য হলেও
কিছু ছিল হয়তো তোমার, মায়া টায়া বা ওরকম কিছু।
সত্যটা দিব্যি বলে দিলে আজ, কারণ তুমি ভুলেই গেছো যে কারও সঙ্গে প্রেম ট্রেম করছো শুনলে আমি কষ্ট পাবো, ভুলেই গেছো যে কারও সঙ্গে আগের মতো শুচ্ছো টুচ্ছো শুনলে আমার খুব মন খারাপ হবে। ফাঁক পেলেই শহরের অলিতে গলিতে গৃহস্থ বাড়ির বউদের সঙ্গে শুতে শুতে তুমি ভুলেই গেছো যে একটা সময় ছিল যখন আমরা বৃষ্টিতে ভিজতাম,
একটা সময় ছিল খুব দুরন্ত, আমরা খুব কিশোর কিশোরীর মতো সাঁতার কাটতাম।
আর তোমাকে নিয়ে লেখা সেই যে আমার একশ’ কবিতা! তুমি পড়তে কবিতাগুলো,
কী চমৎকারই না শোনাতো, একটা মেঘ ডাকা মেঘ ডাকা কণ্ঠ ছিল তোমার!
গোপনে গোপনে বরাবরই অবশ্য ক্যাসানোভা হতে চাইতে তুমি।
মিথ্যেই বলতে। মিথ্যেটা তোমাকে মানাতো।
তোমাকে চোখকান বুজে বিশ্বাস করাটাও আমাকে মানাতো খুব।
হঠাৎ কী হল কে জানে, তুমি দিব্যি আমাকে বললে তোমার এখনকার প্রেম-ট্রেম-
সেক্স-টেক্সের কথা। জিজ্ঞেস করলে, তোমার? এখন কার সঙ্গে?
বলেছি, কারও সঙ্গেই না।
কারও সঙ্গেই না?
না, কারও সঙ্গেই না। তবে হলে মন্দ হত না। যার তার সঙ্গে আবার আসে না আমার! আচ্ছা তুমিই তো বলেছিলে একদিন, বয়স হয়ে গেছে তোমার। ওসব নাকি আর আসে টাসে না!
দিব্যি বললে, বয়স আর এমনকী হয়েছে!
ভালবাসো মেয়েটাকে, এখন যার সঙ্গে?
হ্যাঁ সে তো কিছুটা বাসিই।
তুমি ভালোবাসো? জানো তবে বাসতে! আমাকে লুকিয়েই তো কত কোথাও যেতে, বলোনি অবশ্য কখনও। পকেটের ভায়াগ্রাগুলো দিব্যি ফুরিয়ে যেতো তোমার! যেতো না?
চিরকালই একটা ছোটখাটো শহরে একটা ছোটখাটো ক্যাসানোভার জীবন
নির্বিঘ্নে যাপন করে গেলে, কেউ এসে মারধোর করলো না, শহর ছাড়তেও হল না,
তোমার ভাগ্য দেখলে স্বয়ং ক্যাসানোভাও হয়তো ঈর্ষা করতো।
এতটা বছর আমিও সতী সাধ্বী থাকিনি, হয়তো কারও সঙ্গে দু’একদিন কিছু একটা হয়েওছে, হ্যাঁ ওই দু’একদিনই।
ওই যে বলেছিলাম যার তার সঙ্গে পারি না, আর খুঁজেও তো কাউকে বেড়াই না তোমার মতো!
তোমাকে খুব মিথ্যে বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল আজ, খুব ইচ্ছে হচ্ছিল বলি,
হ্যাঁ আমিও, বেশ আছি। বেশ প্রেম ট্রেম, জমিয়ে সেক্স হচ্ছে, ছেলেটা ফাটাফাটি।
কোথায় বললাম! মিথ্যেটা আসে না আমার। এই একটা মুশকিল।
তোমাকে তবে আজ একটুও বুঝতে দিইনি, তোমার এখনকার গল্প শুনে
আমি মনে মনে সেই একশ’ কবিতা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলেছি,
মনে মনে আমাদের সাঁতার কাটার সরোবরটিতে প্রচণ্ড কাদা ঢেলে দিয়েছি,
সেই বৃষ্টিতে ভেজার বদলে মনে মনে নর্দমায় পা ফসকে পড়েছি।
চুমু খাও, মেয়েটাকে?
বলেছো, হ্যাঁ।
মিথ্যে বলতে জানলে বলতাম, তুমি তো জানতেই না কী করে চুমু খেতে হয়,
ছেলেটা কী যে ভালো জানে!
সেক্স টেক্স করছো, অত বাজেনি, যখন বলেছো চুমু খাও বা ভালোবাসো, বেদনার মতো কী যেন একটা বেজেছে বুকে। শরীরের চেয়ে মনটাকে, স্বভাব গেল না, এখনও ওপরেই রাখি।
আর এতকাল ভালো না বাসতে বাসতে যখন ভালো বাসতে সত্যি কাউকে শিখলে, তোমাকে বলি, আমি প্রাণপণে ভেবে নিচ্ছি, ওই একশ’ কবিতার একটিও তোমাকে নিয়ে নয়, একটি অক্ষরও নয়। তুমিও যে করেই হোক ভেবে নিও। কবিতাগুলো ওই কাদার সরোবরে তোমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে ডুবিয়ে দিচ্ছি। এগুলো নিয়ে তোমার যে গোপন একটা অহংকার ছিল, সেটাকে নষ্ট করে ফেলছি দেখ।
যেখানেই কোকিল ডাকে যেও যতদিন বাঁচো।
কখনও সত্যটা যদি বলো, এবার থেকে দেখ নিও, একটুও চমকাবো না।
বেড়ালের সঙ্গে আত্মীয়তা
*
যেভাবে বন্ধু গড়ে ওঠে ধীরে ধীরে, আত্মীয় সেভাবে ওঠে না গড়ে।
কাউকে বেছে নিইনি কাকে আমি আত্মীয় চাই।
জন্মের পর চোখ খুলে দেখি ভিড়, আত্মীয়দের ভিড়।
আত্মীয় অনেকে জন্মও নিল চোখের সামনে। আমি চাই বা না চাই, নিল।
ভালো বাসি বা না বাসি, তারা আত্মীয়।
খুব দুঃসময় আমার।
আত্মীয়রা এক এক করে ছেড়ে গেছে
ঘনিষ্ঠতা ছিল তারাও বছরের পর বছর গেছে,
একটু একটু করে ভুলতে ভুলতে পুরোটা ভুলেই গেছে, চলে গেছে,
যেদিকে গেলে ভালো হয় সেদিকে।
এর মধ্যে এক বেড়ালের সঙ্গে জানাশোনা হতে হতে,
দুপুরের রোদ পড়া উদাস বারান্দায় বসে, বিকেলগুলো খেলে, গুটিশুটি রাতে দু’জন,
এভাবে জীবন কাটাতে কাটাতে ধীরে ধীরে আত্মীয়তা গড়ে উঠছে,
বেড়ালও সে কথা জানে।
যত আত্মীয় আছে আমার, এসে এক পাশে দাঁড়াক,
বেড়াল দাঁড়াক আরেক পাশে,
আমি বেড়ালের দিকেই যাবো।
যত বন্ধু আছে, তারাও দাঁড়াক,
আমি তবু বেড়ালের দিকেই যাবো।
বন্ধুদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়, চাইলেই আত্মীয়তা হয় না।
বেড়ালের সঙ্গে সব হয়।
আত্মীয় হিসেবে মানুষের চেয়ে বেড়াল ভালো।
মানুষ যে কোনও সময় লুটপাট করে চলে যাবে, বেড়াল যাবে না,
আঙিনায় বসে অপেক্ষা করবে,
যতক্ষণ না ফিরি করবে,
চোখ বেঁধে নদীর ওইপর ফেলে দিয়ে আসি,
পখ খুঁজে খুঁজে, গায়ের ঘ্রাণ শুঁকে শুঁকে, ফিরে আসবে।
বেড়ালরাও যায়, যেতে জানে।
তবে একবার আত্মীয়তা হয়ে গেলে
আত্মীয়দের মতো আর নিষ্ঠুরতা করে না।
পাড়া ঘুরে বলেও বেড়ায় না যে ভালোবাসে,
কিন্তু বাসে, ভীষণ বাসে, বেড়ালের মতো লুকিয়ে চুরিয়ে ভালোবাসে।
পা টিপে টিপে, কেউ যেন না দেখে, বেড়ালের মতো আসে সে.
ভালোবেসে আসে। কাছে।
*
বেড়ালের আর কিছু চাই না, শুধু নিশ্চিন্তি হলেই হয়।
দুবেলা খাবার আর ধারে কোথাও পানীয় জল,
নির্ভাবনায় ঘুমোবার ঘরের কোণ বা বিছানা,
প্রাকৃতিক কাজে কর্মে কোনও এক আড়াল,
শত্রুর যাতায়াত নেই, উৎপাতহীন একটি শান্ত শিষ্ট বাড়ি।
শীতে ওম, আর গরমে ঠাণ্ডা হাওয়া।
নিশ্চিন্তের জীবন।
নিশ্চিন্তি কে না চায়!
আমিও তো চাই, তুমিও।
সবাই আমরা যার যার মতো এক একটা বেড়াল।
সবাই আমরা গোপনে গোপনে বেড়াল।
মানুষের মতো দেখতে ছোট বড় বেড়াল।
*
একা থাকতে থাকতে বদঅভ্যেস হয়ে গেছে
মানুষের ভিড় থেকে নিজেকে আলগোছে সরিয়ে একাই থাকি।
বেড়াল পুষতে পুষতে এখন বেড়াল দেখলেই পুষতে ইচ্ছে করে।
একা থাকা মেয়েরা নাকি বেশ বেড়াল পোষে,
শুনেছি ওদের ঘরে সাদা বা কালো বা ছাই বা সোনালি রংএর বেড়াল
দুএকটা থাকেই, গায়ে না চড়লেও, আহলাদ না করলেও,
থাকে ঘরের কোণে বা উঠোনে কোথাও,থাকে।
মেয়েরা নাকি হোঁচট খেতে খেতে, জলে বা কাদায় ডুবতে ডুবতে,
এখানে সেখানে পুড়তে পুড়তে এইটুকু জেনেছে,
পুরুষ পোষার চেয়েও বেড়াল পোষা ভালো।
আমারও কি বছরের পর বছর পুরুষ পুষতে পুষতে মনে হয়নি কালসাপ পুষছি আসলে!
এত প্রাণী জগতে, পুষতে যদি হয়ই পুরুষ কেন!
কথা শোনে, বোঝে, চোখে ভাষাও আছে, কাছে আসে, ভালোবাসে, পাশে শোয়,
আচঁড়ায় না, কামড়ও বসায়না আচমকা,
রক্তাক্ত করে না, এমন কিছুকে দিব্যি পোষা যায়, নির্ভাবনায়।
ভালোবাসা ১
ভালোবাসো, এই বলে অদৃশ্য হয়ে গেলে একদিন।
যেন জমা দিয়ে গেলে ব্যাংকের সেভিংস একাউন্টে,
যে কোনও দিনই যখন ইচ্ছে দাবি করতে পারো।
ভেবেছিলে ভালোবাসা আরও ফুলে ফেঁপে বড় হবে
বছরভর না-দেখায় না-ছোঁয়ায় অনেক ধারালো।
ভেবেছিলে যেমন রেখে গিয়েছিলে,তেমনই দেখবে এসে,
ভেবেছিলে যা কিছুই দিনে দিনে নষ্ট হোক,
ভালোবাসা হবে না, ঝরে যাওয়া উড়ে যাওয়া মরে যাওয়া
বলে কিছু নেই এর, এ না হলে এর নাম ভালোবাসা কেন!
ভালোবাসা ছুরির মতো, যে ছুরিতে হৃদয় কাটে।
জানো না এমন নয়, জানো।
ফেলে রাখো, দেখ জং ধরে ভোঁতা হয়ে
সরু কোনও সুতোও কাটবে না, হৃদয়ের প্রশ্ন ওঠে না।
ভালোবাসা ছুরি যদি, ছুরির কি ধর্ম নেই?
ভালোবাসি শব্দটি উচ্চারণ করে যত দূরে খুশি যাও,
যত মাস, যত বছর চোখের আড়ালে ইচ্ছে করে, থেকে যাও
আচমকা ফিরে এসে সুদে আর আসলে অন্য কিছু ফেরত চেও,
ভালোবাসা চেও না। এ গুদামজাতের দ্রব্য নয়, টাকাকড়ি নয়।
বাণিজ্য অন্য কোথাও করো, আমার সঙ্গে নয়।
ভালোবাসা আমি বন্ধক রাখি না, যে রাখে রাখুক।
ভালোবাসা ২
তাকে ভেবে রাতের ঘুম না ঘুমোনোর কথা নয় আমার,
দিনের সমস্ত ব্যস্ততা উপেক্ষা করে
উদাস বসে থাকার আমার কথা নয়।
অন্য কোথাও সে তার মতো সুখে আছে, অন্য কোনোখানে,
এ খবর শুনেও যে কোনো কাজেই বড় অন্যমনস্ক হই,
তাকে চাই, সেই আগের মতো চাই,
অপেক্ষা করার কথা নয়, অথচ করি।
তার ছলাকলা, তার চতুর চোখ, তার বহুগামি শরীর, তার অনর্গল মিথ্যে,
তার হৃদয়হীন নষ্ট জীবনের সঙ্গে জীবন–
আমি ছাড়া দীর্ঘদিন আর কেউ যাপন করবে না বলে চাই।
আমার জীবন ছাড়া অন্য কোনও জীবন নিয়ে
শখের খেলাধুলার কোনো সুবিধে নেই বলে চাই,
ভালোবাসি বলে নয়।
ভালোবাসি বলে নয়, জীবন খুব খালি খালি বলে নয়,
তাকে চাই, তাকে সুখ দিতে।
শেষ বিন্দু সহিষ্ণুতা ঢেলে তার আনন্দ চাই।
আমার যা কিছু আছে, সবটুকু তাকে দিয়ে, তার কিছু না-দেওয়াটুকুই চাই।
![তসলিমা নাসরিন](https://irabotee.com/wp-content/uploads/2019/08/images-2019-08-25T001859.869-150x150.jpeg)
জন্ম: ২৫ আগস্ট, ১৯৬২ বাংলাদেশের একজন সাহিত্যিক ও চিকিৎসক। বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে একজন উদীয়মান কবি হিসেবে সাহিত্যজগতে প্রবেশ করে তসলিমা এই শতকের শেষের দিকে নারীবাদী ও ধর্মীয় সমালোচনামূলক রচনার কারণে আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ করেন।