বিশ্বটা যেভাবে পাল্টে যাবে
২০১৯–এর ডিসেম্বরের পরের পৃথিবী আগের মতো আর থাকছে না। পরিবর্তনটা হবে অস্বাভাবিকভাবে ভিন্ন এবং মৌলিক। নতুন অনেক কিছুর জন্য প্রস্তুত হতে হবে মানব প্রজাতিকে। কিছু কিছু পরিবর্তন স্থায়ী হয়ে উঠবে। ১৯৪৫ সালের মে মাসের আগের ও পরের বিশ্ব আলাদা হয়ে গিয়েছিল। করোনাভাইরাস মহাযুদ্ধের চেয়েও বেশি মাত্রায় চেনাজানা বিশ্বকে পাল্টে দিতে পারে। এই অর্থে করোনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সবচেয়ে বড় ‘রাজনৈতিক ঘটনা’।
বিশ্ব হবে কম মুক্ত ও কম উন্নত
করোনাসংকট রাষ্ট্রকে আরো শক্তিশালী করবে এবং জাতীয়বাদ নতুন মাত্রায় বিকশিত হবে। সব ধরনের সরকার সংকট মোকাবিলায় নানা ধরনের কাজ করতে বাধ্য হবে এবং এর মধ্য দিয়ে তারা শক্তিশালী হবে। অনেকেই সংকট পরবর্তী সময়ে তাদের এই ক্ষমতা ছাড়তে চাইবে না, বলেন হার্ভার্ডের আন্তর্জাতিক রাজনীতির অধ্যাপক স্টিফেন এম ওয়াল্ট। তার মতে, করোনা বৈশ্বিক শক্তি পশ্চিম থেকে পূর্বে স্থানান্তর করবে। দক্ষিণ কোরিয়া এবং সিঙ্গাপুর সবচাইতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পেরেছে। চীন প্রথম দিকে ভুল করলেও পরবর্তীতে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। তুলনামূলকভাবে ইউরোপ-আমেরিকার মহামারি মোকাবিলার কম সাফল্যের কারণে এমনটি ঘটবে। কিন্তু বিশ্ব রাজনীতির যে সাংঘর্ষিক চরিত্র তার পরিবর্তন হবে না। পূর্বের মহামারিগুলোও এই চরিত্র পরিবর্তন করতে পারেনি, করোনাও পারবে না। একটি হাইপার গ্লোবালাইজেশন পরিস্থিতি তৈরি হবে। করোনা পরবর্তী দুনিয়া হবে কম উন্মুক্ত, স্বল্পোন্নত এবং অল্প স্বাধীন।
করোনা-জাতীয়তাবাদের কাল শুরু
যখনই বিদায় নিক, করোনা বিশ্বায়ন ধারণাকে নতুন এক চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে যাবে। করোনা দেখিয়েছে, এত দিনকার বিশ্বায়ন টেকসই নয়। এই বিশ্বায়নের কেন্দ্রে ছিল বাণিজ্যিক স্বার্থ, রাজনৈতিক যৌথতা নয়। করোনা বিশ্বায়নের অন্ধকার অংশে আলো ফেলে দিয়েছে। করোনার সংক্রমণে রাষ্ট্রগুলো যেভাবে নিজ নিজ সীমান্ত নিয়ে সচেতন হয়ে গেল, তাতে স্পষ্ট, রাষ্ট্র উবে যাওয়ার প্রচারণা আর এগোবে না। খোদ ‘ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন’ও এককভাবে এবার কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি; বরং ইউনিয়নভুক্তরা একে অপরের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ করার চেষ্টায় ছিল কঠোরভাবে। ইতিমধ্যে এই প্রবণতাকে ‘করোনা-জাতীয়তাবাদ’ বলা শুরু হয়েছে। এর আরও গোছানো রূপ দেখতে শুরু করব আমরা শিগগিরই। করোনাকালে আশপাশের দেশ থেকে কোনো সাহায্য না পেয়ে সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার ভুচিস ইউরোপীয় ঐক্যের ধারণাকে একটা ‘রূপকথা’ বলে অভিহিত করে শোরগোল তুলেছেন। ইতালিও এবারের দুর্যোগে ইইউ সদস্যদেশগুলো থেকে প্রত্যাশিত সহায়তা পায়নি। এর একটা প্রতিক্রিয়া অনিবার্য ও আসন্ন। মনে হচ্ছে, ভবিষ্যতে বিশ্বজুড়ে কর্তৃত্বের কাঠামোগত ওলট–পালট ঘটতে চলেছে। যার ফলে আঞ্চলিক মেরুকরণ বাড়বে। যেসব দেশে ফেডারেল ব্যবস্থা ছিল, সেখানেও ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন বাড়ার তাগিদ তৈরি হবে। আন্তর্দেশীয় খোলামেলা সীমান্তগুলো আর আগের মতো থাকবে না। এসব প্রবণতা বিশ্বায়নের বিরুদ্ধেই যায়। এটা একটা শূন্যতা। ভূরাজনীতিতে এই শূন্যতা কীভাবে পূরণ হবে, আমরা এখনই তার পুরোটা জানি না।
পণ্যমূল্য ও বেকারত্ব—দুটোই বাড়তে পারে
করোনাকালীন অভিজ্ঞতা থেকে দেশগুলো গুরুত্বপূর্ণ পণ্য ও সেবার ক্ষেত্রে স্বনির্ভর হওয়ার পুরোনো ধারণায় ফিরে যেতে পারে। বিভিন্ন দেশ আন্তর্দেশীয় পণ্য চলাচলে স্বাস্থ্য সুরক্ষাজনিত বাধা অনেক বাড়াবে। এমনকি দেশে দেশে যানবাহন থেকে হোটেল পর্যন্ত ব্যবসা করতে হলে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এর ফলে পণ্যের দাম আগের চেয়ে বাড়বে। করোনা–পরবর্তী বেকারত্ব বৃদ্ধির সঙ্গে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি যুক্ত হয়ে একটা কঠিন পরিস্থিতির আভাস দেয়। আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খুব খারাপ এক আগামীর প্রস্তুতি নিতে বলেছেন সবাইকে। সঙ্গে ৫০ বিলিয়ন ডলার নিয়ে কাজে নামছে সংস্থাটি। বিশ্বব্যাংকও ১২ বিলিয়ন ডলার তহবিল গঠনের কথা বলছে। আইএমএফ জানিয়ে দিয়েছে, বিশ্বের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ এখন পুরোই অনিশ্চিত। ভাইরাসের সংক্রমণ কবে কোথায় গিয়ে কমে আসবে, সেটা অনুমান করা দুঃসাধ্য হয়ে আছে। উপরন্তু এবারের সংকটে খোদ আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক এবং ডলারকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার অকার্যকারিতাও দেখা গেল। ফলে এসব সংস্থার দেওয়া কিছু ডলার দেশে দেশে ব্যবসায়ী সমাজকে রক্ষায় সাহায্য করলেও দীর্ঘ মেয়াদে জনস্বার্থে সামান্যই কার্যকর হবে। যদি না অর্থনীতিবাদী অন্ধ প্রকৃতিকেন্দ্রিক পরিকল্পনাগুলো বদলানো না হয়। ভাইরাস–ঝড় থামার পরই পুঁজি তার পুনরুত্থানের জন্য অটোমেশনের ওপর জোর দেবে এবার। কারখানা ও সাপ্লাই চেইন দুটোর অটোমেশন করা গেলে হবু ভাইরাস যুদ্ধগুলোকে এড়ানো সহজ হতে পারে। অটোমেশন যুগের ব্যাপকতা বাংলাদেশের মতো শ্রমজীবীনির্ভর দেশগুলোর জন্য খারাপ খবর। বিশ্বজুড়ে এশিয়া-আফ্রিকার শ্রমিক গ্রহণে স্বাস্থ্য বিবেচনা আগের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব পেতে থাকবে এখন। অপ্রশিক্ষিত শ্রমিক গ্রহণের হারও কমে আসবে।
বিশ্ব অর্থনীতির কেন্দ্র চলে যাবে চীনে
এনইউএস-এর ফেলো এবং ‘হ্যাজ চায়না ওন’ বইয়ের লেখক কিশোর মাহবুবানি মনে করেন, বৈশ্বিক অর্থনীতির গতিপথের মৌলিক পরিবর্তন আসবে না। শুধু বিশ্ব অর্থনীতির কেন্দ্র আমেরিকা থেকে সরে চীনে স্থানান্তরিত হবে, যা ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। কারণ আমেরিকার জনগণ গ্লোবালাইজেশনের উপর যখন আস্থা হারাচ্ছে তখন চীন তাদের জনগণকে গ্লোবালাইজেশনের নতুন নতুন মাত্রার দিশা দিচ্ছে। এই শিক্ষা তারা পেয়েছে তাদের নিজেদের ইতিহাস থেকে। ১৮৪২-১৯৪৯ সাল পর্যন্ত চায়নার মন্দভাগ্য ছিলো দুনিয়া থেকে তাদের বিচ্ছিন্নতার ফল। এছাড়া চীনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কারণে সেখানকার জনগণ বিশ্বাস করে তারা যে কোনো জায়গায় প্রতিযোগিতা করতে সক্ষম।
আমেরিকার সামনে এখন দুটি রাস্তা খোলা। যদি তারা বিশ্ব মোড়লের আসন ধরে রাখতে চায়, তবে তাদের আপসহীনভাবে চীনের সঙ্গে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা চালিয়ে যেতে হবে। অন্যদিকে আমেরিকা যদি তার জনগণের কল্যাণ চায়, তবে চীনের সঙ্গে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক জোরদার করতে হবে।
অবাধ উৎপাদন ও পরিবহন কমবে
কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন-এর গ্লোবাল হেলথ বিষয়ক ফেলো এবং পুলিৎজারজয়ী বিজ্ঞান লেখক লরাঁ গ্যারেট মনে করেন, বৈশ্বিক পুঁজিবাদ এক নতুন নাটকীয়তার সূচনা হবে। বৈশ্বিক বাণিজ্যিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জন্য মৌলিক ধাক্কা হলো, গ্লোবাল সাপ্লাই চেইন এবং ডিস্ট্রিবিউশন নেটওয়াক ভেঙে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। ফলে করোনাভাইরাস যে শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি ডেকে আনবে তা নয়, বরং কিছু মৌলিক পরিবর্তন ঘটাবে। বিশ্বায়নের ফলে কোম্পানিগুলো বিশ্বব্যাপী পণ্য উৎপাদন করতে পারছে এবং সেগুলোর সংরক্ষণ ব্যয় ছাড়াই জাস্ট-ইন-টাইমভিত্তিতে বাজারে সরবরাহ করতে পারছে। করোনা বুঝিয়ে দিয়েছে রোগজীবাণু শুধু মানুষকেই আক্রান্ত করে না, পুরো জাস্ট-ইন-টাইম ব্যবস্থাকেও গুঁড়িয়ে দেয়।
গত ফেব্রুয়ারি থেকে বিশ্ব বাজারে যে ধস নেমেছে, তার মাত্রা হিসাবে নিয়ে কোম্পানিগুলো এই মহামারির প্রভাব থেকে বাঁচার জন্য জাস্ট-ইন-টাইম ব্যবস্থা এবং বিশ্বব্যাপী অবাধ উৎপাদন সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে বসবে। ফলাফল হতে পারে পুঁজিবাদের নয়া স্টেজ এ প্রবেশ, যেখানে ভবিষ্যৎ বিপদের কথা মাথায় রেখে সাপ্লাই চেইন নিজ দেশের কাছাকাছি থাকবে এবং অবাধ উৎপাদন কমিয়ে আনা হবে। এতে কোম্পানিগুলোর মুনাফা কম হলেও স্থায়িত্ব বাড়বে।
করোনা রাষ্ট্রীয় নজরদারি বাড়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে
করোনাভাইরাস কেবল বিশ্বব্যবস্থার ধরনই নয়, হয়তো অনেক সামাজিক মূল্যবোধই আমূল পাল্টে দিতে পারে। নতুন ‘স্বাভাবিক’-এর পথে ২০১৯-এর ডিসেম্বরের আগের স্বাভাবিক অবস্থা হারিয়ে ফেলব আমরা। মহামারির অতীত ইতিহাস অন্তত আমাদের তেমন ধারণাই দেয়। তবে সামাজিক পরিবর্তনের ভবিষ্যৎটি অনুমান করা এখনো কঠিন। কারণ, ক্ষয়ক্ষতি মূল্যায়নের অতিপ্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে বিশ্ব। করোনামুক্ত থাকতে গোলার্ধজুড়ে মানুষ প্রতিদিনকার জীবনধারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে পাল্টে প্রমাণ দিল—উন্নত ও নিরাপদ জীবনদর্শনে তাদের প্রণোদিত করা মোটেই দুরূহ নয়। তবে বাস্তব প্রচেষ্টা সব সময় শুভবুদ্ধি দ্বারা চালিত হবে, এমন নিশ্চয়তা নেই। ইতিমধ্যে করোনা রাষ্ট্রীয় নজরদারি বাড়ার ইঙ্গিত দিয়ে যাচ্ছে। কেবল বর্তমান ধাঁচের বায়োমেট্রিক কলাকৌশলই নয়, মানুষের হাত ধোয়া পর্যন্ত নজরে রাখার দিকে যাবে ‘রাষ্ট্র’। কোনো কোনো দেশে কমিউনিটি পর্যায়ে স্বাস্থ্য বিষয়ে স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকা সব নাগরিকের জন্য বাধ্যতামূলক হতে পারে ভবিষ্যতে। চলাচল ও সমাবেশে স্বাধীনতার ধারণা আগের মতো আর শর্তহীন থাকবে না। মানুষের নিরাপত্তা এবং ‘নিরাপদ সমাজ’ গড়ার কথা বলেই মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করা হবে। তাদের শারীরিক সংঘ এড়িয়ে অনলাইনভিত্তিক করার উদ্যোগ চলবে। অনেক দিন ধরে প্রযুক্তির রাজনীতি এ রকম উদ্যোগ চালাচ্ছিল। এবার সেটা প্রাতিষ্ঠানিকতা পাবে খানিকটা। এতে গোলার্ধের পূর্ব-পশ্চিম সর্বত্র ‘সমাজ’-এর ভূমিকা হ্রাসের ইঙ্গিত স্পষ্ট। ইতিমধ্যে শক্তিশালী হয়ে থাকা ‘রাষ্ট্র’ আরও কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠবে তাতে। চীনের কর্তৃত্ববাদী শাসন মডেল করোনা প্রতিরোধে কার্যকর প্রমাণিত হওয়ায় উদারনৈতিক গণতন্ত্রের ওপর অবশ্যই নতুন করে বিশেষ চাপ তৈরি হলো। উদারনৈতিক ব্যক্তিস্বাধীনতার জন্য সামনের সময়টা হবে কঠিন। তাকে রক্ষণশীল নতুন অনেক আইনের মুখে পড়তে হবে তাড়াতাড়ি। চীনা মডেলের ভক্তরা বলছেন, ভাইরাস–যুদ্ধটা জীববিদ্যার বিষয়—এর মোকাবিলায় রাজনীতিবিদ্যাকে দূরে রাখা উচিত। স্পষ্ট যে আমলাতন্ত্র আবারও অনেক দিন চালকের আসনে থাকবে।এসব বিতর্কের মধ্যে ইতিবাচক একটা দিক দেখা যাচ্ছে, অনেক ভাষ্যকার করোনা–পরবর্তী বিশ্বে বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের দিকে মানুষের বাড়তি মনোযোগেরও ইঙ্গিত করছেন। এটা বিজ্ঞানসম্মত চিন্তাভাবনার নতুন এক যুগের দিকে নিয়ে যেতে পারে সভ্যতাকে। উপাত্ত-বিশ্লেষণই যখন মানুষকে প্রতিদিনকার করণীয় সম্পর্কে জানাবে।
গোলার্ধজুড়ে স্বাস্থ্যসচেতনতার নতুন তরঙ্গ
কোভিড-১৯–এর আগে ইউরোপ-আমেরিকা তার স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে গর্ব করত। তাদের একাংশ এখন ভাইরাস ছড়ানোর জন্য চীনসহ ‘বাইরের মানুষ’দের দায়ী করছে। এ রকম মনোভাব ভবিষ্যতে সেখানে এশিয়া-আফ্রিকার মানুষদের ‘নোংরা অপর’ জ্ঞান করার প্রবণতা বাড়াতে পারে। আবার নতুন ভ্যাকসিন উদ্ভাবনও শুরু হবে জোর কদমে। ভাইরাসের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় বিশ্বব্যাপী স্থল, নৌ ও আকাশযানের চলাচল ধারণাতীতভাবে কমায়—প্রকৃতিতে দূষণ কমেছে ব্যাপকভাবে। এটা অন্য রোগ অনেক কমিয়ে আনতে পারে ভবিষ্যতে। পুরো গোলার্ধে স্বাস্থ্য সচেতনতার একটা নতুন তরঙ্গ তুলেছে করোনা। এটাই সর্বশেষ এই মহামারি থেকে তাৎক্ষণিক সামাজিক লাভ। আর এ–ও তো জানাই, বৃষ্টির পরই রংধনু ওঠে এবং রংধনুতে এক-দুটি নয়, থাকে অনেক রং। কিন্তু এই মৃত্যু–বৃষ্টি কবে থামবে, আমরা এখনো তা জানি না। আবার কবে মানুষ উদ্বেগহীনভাবে আনন্দে অপরকে জড়িয়ে ধরবে, কবে মুখোশ খুলে মুক্ত বাতাসে শ্বাস নেবে সবাই, সে–ও অনুমান করা দুঃসাধ্য। এটা হতে পারে কয়েক মাস; বছরও। তবে নিশ্চিত যে মানুষ আবারও উঠে দাঁড়াবে। নতুন অভিজ্ঞতায়, নতুনভাবে। প্রতিটি বড় বিপর্যয়ের পর এমন হয়েছে।
ভোগ ও জীবনযাপনের ধরন পাল্টাতে চলেছে
এত দিন প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তাকে যেভাবে দেখা হতো, এ ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আশা করা যায়। প্রতিটি সংকটই কিছু সম্ভাবনার দ্বারও খুলে দেয়। খাবারে মানুষের শুচিবায়ু বাড়ার সম্ভাবনা আছে এবার। এর ফলে অর্গানিক ফুডের বাজার চাঙা হয়ে উঠবে। বিশেষ করে যেসব খাবার রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, সেগুলোর দিকে মানুষের আগ্রহ বাড়বে। মাস্ক পরার চেয়েও শরীরে পর্যাপ্ত ভিটামিন ডি থাকা যে অধিক জরুরি ছিল, সেটা করোনা ভালোভাবেই জানিয়েছে। ফলে ভোগের ধরন পাল্টাবে। জীবনযাপনের ধরনও। ‘লাইফস্টাইল’ জগতে তাই পরিবর্তন হবে ভূমিকম্পতুল্য। চীনে বন্য প্রাণী খাওয়া বন্ধের মধ্য দিয়ে এর সূচনা হয়েছে বলা যায়। নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষায় শক্তিশালী অনেক দেশকে এবার মাস্ক ও সাধারণ মেডিকেল যন্ত্রপাতির জন্য অন্য দেশের দিকে হাত বাড়াতে হয়েছে। এ শিক্ষা মনে রেখে গতানুগতিক ধাঁচের প্রতিরক্ষা বাজেটের কিছু অংশ স্বাস্থ্য শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতের সামর্থ্য বাড়াতে ব্যয় করবে অনেক দেশ। দৃশ্যমান শত্রুর বদলে অদৃশ্য শত্রু প্রতিটি দেশকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। সুতরাং বিশ্বজুড়ে শত্রু-মিত্রের পুরোনো ধারণাও পাল্টাতে বাধ্য। নাগরিকদের জাতীয় নিবন্ধনের মতোই অনলাইনের স্বাস্থ্যতথ্য সংরক্ষণ ভবিষ্যতে বাধ্যতামূলক হয়ে উঠবে অনেক অঞ্চলে। একটা মিসাইল সংগ্রহের চেয়ে একজন ডাক্তার তৈরি যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ, সে সত্য বয়ে বেড়াচ্ছে করোনা–সাহিত্য। এর মধ্য দিয়ে সামরিক গৌরব অর্জনের চেয়ে কিউবার মতো জনস্বাস্থ্যের গৌরব প্রলুব্ধ করতে পারে নীতিনির্ধারকদের কাউকে কাউকে। তবে করোনার আগে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয় যে প্রয়োজনীয় মনোযোগ পাচ্ছিল এবং তার মোকাবিলা যেভাবে মানবসমাজের অগ্রাধিকার হয়ে উঠেছিল, সেই স্থানটি করে নিতে পারে এখন সরাসরি স্বাস্থ্য প্রশ্ন। এমনকি ব্যবসায়ীরাও সেই অর্থের বড় অংশ নিয়ে নিতে পারে। ইউরোপের দেশগুলো ইতিমধ্যে শিল্প ও ব্যবসা খাতকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার সহায়তার ঘোষণা দিচ্ছে। এই অবস্থা অ-রাষ্ট্রীয় পথে দরিদ্র দেশগুলোকে দেওয়া ধনী দেশগুলোর সামাজিক সহায়তাও কমতে পারে কিছুকালের জন্য। আবার নতুন সাহায্য চলে যাবে, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ও রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করার প্রকল্পগুলোতে।
ক্ষমতার ভারসাম্যে পরিবর্তন আসবে
হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের অধ্যাপক এবং আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্টের পলিটিক্যাল অ্যাফেয়ার্স-এর সাবেক আন্ডার সেক্রেটারি নিকোলাস বার্নস বলেন, করোনা এই শতকের সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা। দুনিয়ার ৭.৮ বিলিয়ন মানুষ ঝুঁকিতে আছে। এই ঘটনার অর্থনৈতিক প্রভাব ২০০৭-০৮ এর চাইতেও বেশি হতে পারে। প্রত্যেক সংকটই এমন ধাক্কা দিতে পারে, যার ফলে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা এবং ক্ষমতার ভারসাম্য স্থায়ীভাবে পরিবর্তন হতে পারে। আন্তর্জাতিক ঐক্য এখনো শোচনীয় পর্যায়ে আছে। যদি বিশ্বের দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন তাদের কথার যুদ্ধকে পাশ কাটিয়ে সংকট মোকাবিলার পথে না হাঁটে তবে দুই দেশের গ্রহণযোগ্যতাই প্রশ্নবিদ্ধ হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন যদি ঠিকঠাক তার ৫০০ মিলিয়ন জনগণকে সাহায্য করতে না পারে, তবে ভবিষ্যতে দেশগুলোর সরকার ব্রাসেলস-এর চাইতে বেশি ক্ষমতাধর হয়ে উঠবে।
দেশে দেশে আমরা মানুষের মধ্যে বিপুল প্রাণশক্তি লক্ষ্য করছি। ডাক্তার, নার্স, রাজনৈতিক নেতা ও সাধারণ মানুষ সকলে মিলে একসাথে কাজ করছে সংকট মোকাবিলায়। ফলে নারী-পুরষ সকলে মিলে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আরো শক্তিশালী ভূমিকা রাখবে বলে আশার সঞ্চার হয়।
![ইরাবতী ডেস্ক](https://irabotee.com/wp-content/uploads/2021/12/irabotee-cover-e1640636602578-150x150.jpg)