আজ ১৬ মার্চ কবি,কথাসাহিত্যিক ও সম্পাদক অ্যাঞ্জেলিকা ভট্টাচার্যের শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।
সুজাতা আজ ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছিল- ভোর পাঁচটা। অন্যদিন সকাল সাতটাতে উঠলেও হয়ে যায় কিন্তু আজ দিনটা অন্যরকম। অ্যালার্মের আওয়াজ শুনে পরিমল একটু চোখ খুলে বিড়বিড় করে বলল– যতসব পাগলামি। সুজাতা আগছালো চুলটা খোঁপা করতে করতে আর চোখে একবার পরিমলের মুখের দিকে তাকাল। কানের কাছে ফিসফিস করে বলল– মাঝে মাঝে পাগলামি করা ভালো।পরিমল মুখ থেকে একটা বিরক্তি জনক আওয়াজ বার করে অন্যপাশ ফিরে কোলবালিশ জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ল ।
সুজাতা বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েছে। এপ্রিল মাসের শুরুতেই বেশ গরম। কিন্তু এই সকালবেলাটা কি ভালো লাগছে। অনেকদিন এমন ভোর দেখা হয়নি। বাড়ির পিছন দিকে একটা ছোট বাগান আছে। সেখানে একটা শিউলি গাছ, পেয়ারা গাছ। শীতকালে কিছু ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা লাগিয়েছিল। সেগুলো এখনও জল পেয়ে জীবিত আছে। কি অদ্ভুত বাগানটাকে রোজই দেখে কিন্তু আজ খুব ভালো লাগছে।
টাবুন স্কুলে যেত যখন তখন বছরের পর বছর কাকভোরে উঠেছে, ছেলেকে তৈরি করেছে, টিফিন করেছে। স্কুল বাসে তুলতে গেছে। সব একার দায়িত্ব। পরিমলের দায়িত্ব ছিল সুজাতার হাতে টাকাটা তুলে দেওয়া। সেই সুজাতাকেই দৌড়তে দৌড়তে ব্যাঙ্কে, স্কুল ফিস জমা দিতে যেতে হত। টাবুন পুনেতে এম বি এ পড়ছে। এখন সুজাতা অনেকটা নিশ্চিন্ত।
অবশ্য বাকি কাজগুলো কমেনি- বাজার করা, ইলেকট্রিক বিল জমা দেওয়া। আত্মীয় স্বজন, পাড়া পড়শি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ, দায়িত্ব কর্তব্য করা সবকিছুই সুজাতার ডিপার্টমেন্ট। আপদে বিপদে তো পাড়াপড়শি ছুটে আসবে আগে। সুজাতা মাঝে মাঝে হেসে পরিমলকে বলে– মনে হয় আমি এ পাড়ার বউ নই মেয়ে। পরিমল ঠিক বুঝতে পারে না এটা ঠেশ দিচ্ছে নাকি নিজের প্রশংসা করছে। পরিমল তেতো মুখে বলে– ওরকম সারাদিন ঘরে বসে থাকলে পাড়ার খবর নেওয়া যায়। আমার মতো সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত অফিসে রগড়ালে এসব বেড়িয়ে যেত।
কিন্তু সুজাতার ঘরে বসে কদিন থেকেই পাগল পাগল লাগছিল। আগে টাবুন, টাবুনের বন্ধুরা ঘর ভরে থাকত। সুজাতাও যেন ওদের সঙ্গে বাচ্চা হয়ে যেত। ওরাও এসে আবদার করত কাকিমা আজ বিরিয়ানি খাবো, কাবাব খাবো । সুজাতা কতো যে রান্না শিখেছে ইউটিউব ঘেঁটে ঘেঁটে। এখন তারাও সব বাইরে পড়তে গেছে। সুজাতার সময় কাটানো দায় হয়েছে। ছুটির দিনে পরিমলকে যদি একটু এদিক সেদিক যেতে বলে ব্যাস মুখ হাঁড়ি। ছুটির দিনে তার একটাই কাজ ঘুমানো। আর অন্যদিন অফিস আর সন্ধ্যেবেলায় ফিরে সিরিয়াল গেলা।
এই তো সাতদিন ধরে কাকি শাশুড়ি কোমর ভেঙে বিছানায় পড়ে। সুজাতা ফল, বিস্কুট নিয়ে দেখতে গেছিল। ও বাড়ির সবাই জিজ্ঞেস করেছে– পরিমল এলো না? সুজাতাকেই গ্যাটিস দিতে হয়েছে– অফিসে খুব চাপ, তার উপর প্রেশারটা বেড়েছে। কিন্তু সুজাতাও জানে কুড়ি মিনিটের দূরত্ব না যাওয়ার কিছু ছিল না। ঘরে বসে মুড়ি চিববে তাও নড়বে না।
Read More:রবিবারের ছোটগল্প সেদিনও আকাশে তারা ছিল লিখেছেন রুনা তাসমিনা
সুজাতা ব্রাশ করতে করতে ঘড়ি দেখল পাঁচটা তিরিশ। – না তাড়াতাড়ি কাজ সারতে হবে। বাঁশি কাপড় ছেড়ে গ্যাসে ভাত বসিয়ে স্নান করে এলো। তারপর পুজো সেরে নিল। শাশুড়ি রাধামাধবকে তার ঘাড়েই চাপিয়ে ইহলোক ত্যাগ করেছেন।
পরিমলকে ঠ্যালা দিল সাতটা বাজে। ততক্ষনে ভাত রেডি। ফ্রিজে আটা মাখাই ছিল রুটি করে নিল। নিজের দুটো আর পরিমলের টিফিনের দুটো। গত রাতের ডাল, তরকারি সব আছে শুধু ডিমের অমলেট করে নিল। আজকাল অল্প রান্না করলেও যেন রোজ বেড়ে যায়। কিছুতেই শুধু দুজনের রান্না আর হয়ে ওঠে না।
কাজের মেয়ে পুঁটিকে বলেছে সকাল সকাল আসবি। কিন্তু তার এখনও পাত্তা নেই। সাতটা পঁয়তাল্লিশ বাজে এবার সুজাতাকে বেরোতে হবে।
প্রথমদিন কোন শাড়ি পড়বে সেই নিয়ে গতরাতেই প্রায় আলমারিটা ঘেঁটে ফেলেছিল। বাচ্চারা উজ্জল রঙ খুব পছন্দ করে। তাই হলুদ রঙের একটা শাড়ি বেছে রেখেছিল। কিন্তু পড়ে মনে হচ্ছে ভীষণ ক্যাটক্যাটে লাগছে। আয়নায় নিজেকে দেখে মুচকি হাসল– লাগুক ক্যাটক্যাটে।
চোখের নিচে কি আটচল্লিশ বছরের ভাঁজটা বেশি প্রকট? অনেকদিনের অব্যবহৃত মেকাপ ক্রিমটা একটু ঘষে নিল। বিয়েবাড়ি ছাড়া আর এসব জিনিস ব্যবহার হয় না। কাজলটা চোখে দিতেই মনে পড়ল প্রথমদিন কলেজ যাওয়ার কথা। এরকম ভাবেই নিজেকে সাজাতে বসেছিল। কিন্তু বাবা খুব রেগে মেগে লিপস্টিকটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল, বলেছিল– কলেজে পড়াশুনো করতে যাচ্ছ নাকি প্রেম করতে যাচ্ছ?
সুজাতা নিজের মনেই মুখ ভেটকে বলল– ঈশ! তার সুযোগ দিলে কোথায়? যা মিলিটারি শাসন ছিল। কলেজ শেষ করতেই ছাদনাতলায়। সুজাতা মোবাইল থেকে একটা সেলফি তুলল। ঈশ লিপস্টিকের কালারটা একটু ডিপ হয়ে গেছে। বন্ধুদের গ্রুপে পোস্ট করবে পরে, এখন আর সময় নেই। এখনও তো কাউকে জানায়নি সুজাতা দিদিমনি হয়েছে।
অনেক দেরি হয়ে গেছে পরিমলের খাবার ঢাকা দিয়ে বাথরুমে নক করে এলো– এই আমি বেরচ্ছি। দরজা ভেজিয়ে গেলাম। ভিতর থেকে পরিমল চিৎকার করছে– ডুপ্লিকেট চাবিটা নিয়েছ? সুজাতা লম্বা জিব কাটে– এমা ভুলে গেছি একদম। ভিতরে পরিমলের বকবক শোনা যাচ্ছে- ভালো সারাদিন ওই স্কুলেই থেকো।
সুজাতা সোজা সামনের রাস্তায়, সেখান থেকে অটো ধরে জিটি রোড। রাস্তার দু-ধারটা দেখে নিল। সুজাতা এদিকটা তেমন আসেনি। ইন্টার্ভিউয়ের দিন জায়গাটা ভালো করে দেখে গেছিল। তবে ভাবেনি তার বাড়িতে ফোন আসবে। কারণ সে তো ইন্টার্ভিউয়ের দিন বলে দিয়েছিল তার কোন প্লে স্কুল ট্রেনিং নেই, এমনকি ছেলে মানুষ করা ছাড়া আর কোন দ্বিতীয় অভিজ্ঞতা নেই। সামনে মস্ত বড় শাড়ির দোকানের ব্যনার দেখল- এই তো চলে এসেছি। এখানেই দাঁড়াও।
-অটো ভাড়া দুটাকা বেড়েছে কাকিমা। অন্যসময় হলে খিটমিট করত কিন্তু আজকে দিনটাই অন্য। কিন্তু সুজাতার কাকিমা ডাকটা শুনে হাসি পেল। বন্ধুরা যে বলে এখনও তিরিশ বলে চালিয়ে দেওয়া যাবে। অবশ্য দিদিমনি হতে গেলে একটু কাকিমা লাগাই ভালো। রাস্তা পেরিয়ে সামনেই একটা গলি। গলিটার বাঁক নিতেই একটা বেশ বড় বাড়ি। উপরে বড় বড় করে লেখা “লিটল স্টার প্লে স্কুল”। বাড়ির নিচের তলায় স্কুল। আজ সুজাতা একটু তাড়াতাড়ি এসেছে, চাকরির প্রথমদিন বলে কথা। সুজাতা দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে এলো। আগেরবার দেখে গেছে কি সুন্দর সাজানো, গোছানো, দেওয়ালে মিকিমাউসের ছবি, কতো খেলনা। সেসব দেখলে সুজাতারই লোভ হয়। উপর থেকে মিসেস সিনহা নেমে আসছেন। স্থূলকায়, লম্বা তবে সুজাতার থেকে অনেকটাই বড়। তিনি এই স্কুলের মালিক। -ও সুজাতা তুমি চলে এসেছ? অসীমা এখনও আসেনি? এই বড় দোষ ওর, বড্ড লেট করে। সুজাতাকে অসীমাই এই স্কুলের খোঁজ দিয়েছিল। সে শ্বশুরবাড়ির তরফ থেকে এক দুঃসম্পর্কের আত্মীয়। তাই তার হয়ে সাফাই গাওয়াটা সুজাতার নৈতিক কর্তব্য মনে হল। -অসীমা মনে হয় জ্যামে পড়ে গেছে। এই সময়টা স্কুলের বাস, অটো এতো বিচ্ছিরি অবস্থা হয়। কিন্তু মনে হল না মিসেস সিনহার ব্যপারটা খুব একটা ভালো লেগেছে। উনি হেসে বললেন –সুজাতা প্লিজ, নো এক্সকিউস। আজকে স্কুলের প্রথম দিন তাই বাচ্চাগুলোর কান্নাকাটি হল্লাহাটি বেশি। অসীমার বয়েস কম, সে দুবছরের এই কাজে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। কিন্তু সুজাতা বুঝতে পারেনি একটা প্লে স্কুলের এতো হেফা। প্রায় সব চুপ করলেও দুটো বাচ্চা চুপ করছেই না, ট্যাঁ ট্যাঁ করে কেঁদে যাচ্ছে। সুজাতা একটাকে কোলে নিয়ে ছাদে চলে এসেছে। কিন্তু সে নাছোড় বান্দা তার মায়ের কাছে ফেরত পাঠাতে হবে। আড়াই, তিনবছরের বাচ্চাটা কি ভীষণ জেদি সে সুজাতার চুল টেনে একসা করেছে। খোপা খুলে গেছে, লিপস্টিক ভেদ করে দুগালে উঠে পড়েছে। রীতিমতো হাফাচ্ছে। বাকীটা অসীমা এসে সামলেছে।
Read More: রবিবারের ছোটগল্প কচ্ছপ রাজার রাজপ্রাসাদ লিখেছেন শাম্মী তুলতুল
দুটো ক্লাসরুমই আছে মন্ট ওয়ান আর মন্ট টু। সুজাতার ভার পড়েছে মন্ট ওয়ানের। পনেরটা বাচ্চা, আরও আছে তারা নাকি আজ আসেনি। সবই কাছেপিঠে পাড়ার থেকে। কিন্তু ওই পনেরটা নিয়েই সুজাতার লঙ্কাকাণ্ড বেঁধেছে। তাদের হিসু করানো, টিফিন খাওয়ানো। সব সুজাতাকেই করতে হয়েছে। টিফিন খাওয়ানো নিয়ে আরেক প্রস্থ নাটক। গার্জেনরা বলে গেছেন– ম্যডাম একটু দেখবেন যেন টিফিন খায়। কিন্তু বাচ্চাগুলো এতোটাই ত্যাঁদড় কেউ দেওয়ালে কেক মাখিয়েছে, কেউ বিস্কুটগুলো গুড়ো করেছে বসে। একজন বমি করেছে। কোন দিক দেখবে সুজাতা! তার গালেও কিছুটা কেক লেগে আছে।
বাচ্চা ভোলানো, তাদের শেখানো এই আটচল্লিশ বছর বয়েসে সুজাতার নতুন করে এনার্জি ড্রিংক দরকার। তারপর ছাদে ওঠা নামা করায় পায়ের ব্যথা বেড়েছে। সুজাতার একটাই প্রশ্ন– আয়া নেই? সে তো টিচার সে কেন বাচ্চার হিসু, বমি পরিষ্কার করবে। মিসেস সিনহার কাছে অনুযোগ করেছিল। কিন্তু উনি হেসে জবাব দিয়েছেন – আগের আয়াটা ছেড়ে দিয়েছে। দেখি কতদিনে নতুন একজন পাই! ততদিন অগত্যা।
বারোটায় ছুটি। আজ আর সুজাতার টিফিন খাওয়া হয়নি। ঘরে ফিরে শাড়ি না ছেড়েই আগে গপগপ করে রুটি আর অমলেট খেল। আজ আর দুপুরে ভাত খাবে না। গা ধুয়ে নাইটি পড়ে ফ্যানের তলায় চিতপটাং। সকালের কথা মনে পড়লে খুব হাসি পাচ্ছে। একবার ভাবল কাল থেকে আর যাবে না, মিসেস সিনহাকে ফোন করে জানিয়ে দেবে। কিন্তু পরিমল খুব হাসবে– বলবে দিদিমনি হওয়ার শখ মিটল? খুব তো গেছিলে হাজার টাকার লোভে। কিন্তু সুজাতা নিজে জানে সে কোন টাকার লোভে চাকরী করতে যায়নি। সে তার একাকীত্ব কাটাতে চায়। সন্তানের অপেক্ষায় পাগল হতে চায় না। আচ্ছা পরিমল আর দুবছর পর রিটায়ার করবে। তখন পরিমল কি করবে? সারাদিন ধরে টিভি দেখবে আর ঘুমবে। একটা মানুষ এরকম ভাবে বেঁচে থাকতে পারে? জানে না সুজাতা কিন্তু সে এরকম ভাবে পারবে না। এই আটচল্লিশ বছর বয়েসে আর নতুন করে সে কোথাও চাকরী পাবে না। সংসার করা ছাড়া তার কোন গুনও নেই। কিন্তু মাঝে মাঝে মনের ভিতর মরা কোটাল জেগে ওঠে- তার দ্বারা কি কিছুই হবে না!
সারাদিন নেট খোলা খোলার সময় পায়নি। এই মাত্র খুলতেই একসঙ্গে মেসেজ ঢুকছে টং টং করে। বন্ধুদের গ্রুপে সকালের সেলফিটা পোস্ট করতেই সবাই তারিফের বন্যা। -কিরে দ্বিতীয়বার প্রেমে পড়লি নাকি?
বেশ মজা লাগছে সুজাতার। প্রায় দশটা কমেন্টস চলে এলো। সুজাতাও বলতে পারে সে এখন শুধু হাউস ওয়াইফ নয়। স্কুলের ম্যডাম। সে প্লে স্কুল তো কি হয়েছে। আরে টাবুনের মেসেজ, ভোর সাতটায় করেছে– বেষ্ট অফ লাক মা ফর ইয়র নিউ ওয়ে।
– রাস্তা! ঠিক রাস্তাই তো। বাইরে তখন কালবৈশাখী উঠেছ, এলোমেলো হাওয়া আর ধূলোর ঝাঁপটা। খোলা বারান্দায় বেরিয়ে এলো। বৃষ্টি শুরু হয়েছে সঙ্গে শিল পড়ছে। সুজাতা দুরন্ত কিশোরীর মতো সেগুলো তুলে নিচ্ছে।