একটি স্বপ্নের নাম বিদ্যানন্দ
‘কভিড ১৯’ ভাইরাসের কবল থেকে রেহাই পেতে সারা দেশ যখন প্রায় অচল ঠিক তখনই আশার আলো নিয়ে হাজির বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের একদল স্বপ্নবাজ তরুণ। জীবাণুনাশক কর্মসূচি ছাড়াও কোয়ারেন্টাইনে থাকা মানুষের বাসায় বিনামূল্যে খাদ্য পৌঁছে দিচ্ছেন তারা। জনপ্রিয় ‘এক টাকায় আহার’ প্রকল্পের মতো আরও বেশ কিছু মহৎ উদ্যোগের নেপথ্যে আছে এই ফাউন্ডেশন। আর এই ফাউন্ডেশন ও এর নেপথ্য উদ্যোক্তার পুরো নাম কিশোর কুমার দাশ। জন্ম ঢাকার নারায়ণগঞ্জে। বাবার সরকারি চাকরিসূত্রে বেড়ে উঠেছেন চট্টগ্রামের কালুরঘাটে। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে কিশোর তৃতীয়। নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্ম বলে অবহেলা, বঞ্চনা আর দারিদ্র্যের সংগ্রামে নিজেদের টিকিয়ে রাখাটাই তাদের কাছে দুঃসাধ্য ছিল। পরিবারে এক বেলার খাবারের জোগান হলে মাথায় রাখতে হতো অন্য বেলার কথা। পাশে ছিল না কোনো প্রতিবেশী কিংবা কাছের কোনো আত্মীয়স্বজন। কখনো কখনো অনেকে থেকেও যেন নেই।
পরিবারের এমন আর্থিক অনটন যখন তাদের পিছু ছাড়ছে না তখন একবার আত্মহত্যার পথও মাড়াতে চেয়েছিলেন কিশোর। সৌভাগ্যবশত সে যাত্রায় তিনি বেঁচে যান। এমন অপচেষ্টা একবার প্রাপ্ত বয়সেও করে বসেন। সেবারও ভাগ্যের জোরে বেঁচে যান। এরপর অসংখ্য বাধাকে তুচ্ছ করে নিজের স্বপ্নের দুয়ারে পৌঁছেন তিনি। সেই স্বপ্নবাজ কিশোর কুমার দাশ এখন একজন সফল উদ্যোক্তা। দক্ষিণ আমেরিকার দেশ পেরুতে তিনি বসবাস করছেন। চাকরি করছেন সেখানকার শীর্ষস্থানীয় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পর্যায়ে।
কিশোর কুমারের কথা
কিশোর কুমার তাঁর ছোটবেলার স্মৃতি বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলেন, ‘আসলে সবার ছোটবেলা সত্যিই অনেক আনন্দের আর ভালো লাগার হয়। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে ছিল ঠিক উল্টো। আমাকে যদি বলা হয় আবার ছোটবেলায় ফিরে যেতে তবে আমি সেটা কখনোই চাইব না। আমি নিজ চোখে পরিবারের আর্থিক দুর্দশা দেখেছি। পড়াশোনা কোনো রকমে চালিয়ে গেলেও এসএসসির সময় তা দুই বছরের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। আমি ছাত্র হিসেবে তেমন ভালো ছিলাম না। কারণ আমার চোখে দেখা ও কানে কম শুনতে পাওয়ার কিছুটা সমস্যা ছিল। এরপর কীভাবে যেন মাধ্যমিকের পর পড়াশোনা আবার শুরু করি এবং খুব ভালো ফলাফল করতে থাকি। ব্যাপারটা আমার কাছে এখনো মিরাকল। অবশ্য পড়াশোনায় আমার অনেক প্রচেষ্টা ছিল। সঙ্গে অনেকের প্রেরণাও। এভাবে হঠাৎ একদিন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) ভর্তি পরীক্ষায় চান্স পাই। যদি দারিদ্র্যের কথা বলতে হয় এক সময় এসব দারিদ্র্য থেকে রেহাই পেতেই আমি আত্মহত্যার মতো নিষ্ঠুর পথ বেছে নিয়েছিলাম।’
কিশোর আরও বলেন, ‘২০১১ সালের দিকে স্ত্রী’র সঙ্গে আমার ডিভোর্স হয়। তখনো আমি বিত্তবান ছিলাম। অর্থ-সম্পদের অভাব ছিল না। দেশে বেশ বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উচ্চপদে চাকরি করেও দিন শেষে খুব নিঃসঙ্গ বোধ করতাম। তাই মনে হলো- এই জীবনটাই অর্থহীন। তাই আবারও আত্মহত্যা করতে গিয়ে ঈশ্বরের অশেষ কৃপায় বেঁচে ফিরি। তখন থেকেই ভাবতাম, আমার জীবনে এমন একটা সময় ছিল যখন এক বেলা খাবারের জন্য আমার পরিবারকে চিন্তা করতে হতো। আর এখন এমন অবস্থায় আছি যেখানে আমি আরও পাঁচটি পরিবারকে বিলাসবহুলভাবে চালাতে পারব। জীবনের দুটো অধ্যায় পার করে এটুকু পথ এসেছি। উপলব্ধি করলাম- কিছু না থাকলেও যেমন নেই, তেমনি অনেক কিছু থেকেও কিছুই থাকে না। ভাবলাম, আমি যেভাবে এক দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে এসেছি। ঠিক এমনই আমাদের দেশের অসংখ্য পরিবার দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করছে প্রতি মুহূর্তে। তাই এবার আমার দেশের অসহায় দরিদ্র পরিবারগুলোর জন্য কিছু করা দরকার। বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন গড়ার বিষয়টি চিন্তা করি পেরুতে থাকার সময়ই। দীর্ঘ কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই বিদ্যানন্দের সূচনা হয়েছিল।’
বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের যাত্রা
বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের শুরুর গল্প বলতে গিয়ে কিশোর কুমার বলেন, ‘২০১৩ সালের শেষের দিকে আমি বিদ্যানন্দকে একদম ছোট পরিসরে গড়ার পরিকল্পনা নিয়েছিলাম। আমি পেরুতে থাকায় কীভাবে করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আর দেশে এ কাজ করবে এমন কাউকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম। পরে শিপ্রা দাশ নামে একজনের সঙ্গে পরিচয় হয়। তাকেই পুরো দায়িত্বটা দিলাম। আমাদের বিদ্যানন্দের প্রথম কর্মসূচি ছিল সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষা প্রদান করা। তারা নারায়ণগঞ্জের এক রেলস্টেশনকে বেছে নেয়। প্রথম দিকে বিদ্যানন্দের সব আর্থিক জোগান পেরু থেকে আমিই দিতাম। আর সব কার্যক্রম স্বেচ্ছাসেবকরা পরিচালনা করত। নারায়ণগঞ্জ থেকে একদম ক্ষুদ্র পরিসরে শুরু করা এই সংগঠন এখন গোটা বাংলাদেশে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে।’
কিশোর জানান, বিদ্যানন্দের কার্যক্রম শুরুর দিকে নিজের আর্থিক সহায়তায় পরিচালনা করা হলেও একসময় এর আরেকটি শাখা করা হয় চট্টগ্রামে। এরপর থেকে সবার আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রামসহ কক্সবাজার, রাজবাড়ী, রাজশাহী ও রংপুরেও কার্যক্রম শুরু করে। এভাবে একের পর এক কর্মকান্ড দিয়ে দেশব্যাপী ইতিবাচক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয় এই সংগঠন।
কিশোর বলেন, ‘বিদ্যানন্দ কোনো সুদীর্ঘ পরিকল্পনার মাধ্যমে শুরু হয়নি তা আমি সবসময় বলি। কিন্তু যখন বিদ্যানন্দ কিছুটা পরিচিতি পেয়েছে তখন এর মাধ্যমে সবসময় সৃষ্টিশীল বিষয়গুলো নিয়ে আমরা চিন্তা-ভাবনা করেছি।’
দান নয়, সম্মান
২০১৩ সালে গতানুগতিক শিক্ষাধারার বাইরে এসে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পড়াশোনার পাশাপাশি নানা ধরনের বিনোদনের মাধ্যমে শিশুদের শিক্ষাদানে মনোনিবেশ করার উদ্যোগ থেকে হয় এই সংগঠনের সূচনা। এরপর ২০১৬ সালে সুবিধাবঞ্চিত শিশু, প্রতিবন্ধী ও ষাটোর্ধ্ব কর্মহীন মানুষদের ‘এক টাকায় আহার’ নামে একটি প্রকল্প চালু করে সংগঠনটি। এই প্রকল্প কিছু দিনের মধ্যেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা পায়। এক টাকায় আহার প্রকল্পে প্রতিদিন প্রায় ৩ হাজার অসহায়ের মাঝে খাবার বিতরণ করেন তারা।
এই প্রকল্পের কার্যক্রম সম্পর্কে বিদ্যানন্দের ঢাকা বিভাগের পরিচালক সালমান খান ইয়াসীন বলেন, ‘এক টাকায় আহার’ প্রকল্পটিতে জন্মদিন, বিয়ে আকদ-সহ যেকোনো বিশেষ দিনের খাবারের আয়োজন করেন আমাদের শুভাকাক্সক্ষীরা। সারা দেশে প্রতিদিন গড়ে ৩ হাজারেরও বেশি মানুষের খাবার বিতরণ করেছি আমরা। সর্বনিম্ন মূল্য মাত্র ১ টাকায় খাবার বিক্রি করার কারণ যারা এই খাবার গ্রহণ করছেন তারা যেন খাবারটিকে দান ভেবে নিজেদের ছোট মনে না করে। এছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানের বেঁচে যাওয়া ভালো খাবারগুলো বিদ্যানন্দে পাঠালে সেগুলোও আমরা ছিন্নমূলদের মাঝে বিতরণ করি। এক টাকার আহারে সাদা ভাত, ভুনা খিচুড়ি, ডিম কারি, মুরগি পর্যায়ক্রমে থাকে।’
ঠিক একই ভাবে এক টাকায় চিকিৎসা নামে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্বেচ্ছাসেবী চিকিৎসকদের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করছে এ সংগঠন। এছাড়াও বিদ্যানন্দের নিজস্ব গার্মেন্টস ‘বাসন্তী’র মাধ্যমে স্যানিটারি প্যাড বানিয়ে দেশের প্রান্তিক গোষ্ঠীর কাছে বিভিন্ন রেলস্টেশন ও বস্তিতে মাত্র ৫ টাকায় বিক্রি করছে। সালমান বলেন, ‘বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের স্যানিটারি প্যাড, এতিমখানার জন্য টি-শার্ট, স্কুলের পোশাক, চটের ব্যাগসহ আমাদের যা প্রয়োজন হয় তা আমাদের নিজস্ব গার্মেন্টসে তৈরি করা হয়। নারীর ক্ষমতায়ন প্রকল্পের দিকে লক্ষ্য রেখে যে সমস্ত নারী কাজ পাচ্ছে না তাদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে আমাদের নিজস্ব গার্মেন্টসে কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে প্রতি বছর শীতবস্ত্র, ঈদের নতুন পোশাকসহ পবিত্র রমজানে দেশে লক্ষাধিক মানুষকে ডিজিটাল ইফতার ভেন্ডিং মেশিনের মাধ্যমে ইফতার বিতরণ করেছে সংগঠনটি। বইমেলায় সততার স্টল কিংবা নির্বাচনী পোস্টার নিয়ে ব্যতিক্রমী চিন্তাধারা থেকে অভিনব কৌশল দেখিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় বরাবরের মতো আলোচনায় এসেছে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন।
উদ্যোগে অভিনব কৌশল
২০১৯ সালের অমর একুশে বইমেলায় সততার স্টল নামের একটি বিক্রেতাবিহীন বইয়ের স্টল স্থাপন করে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। সততার স্টল থেকে বইপ্রেমীরা নিজ পছন্দের বই কিনে টাকার বাক্সে নির্ধারিত মূল্য রেখে যাচ্ছেন- এমনই একটি ভিডিওচিত্র ফেইসবুকে ভাইরাল হয়। এরপর গত বইমেলায় উদ্যোগটিকে আরও ভিন্নভাবে সাজাতে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন বাতিল জিনিসের বিনিময়ে নতুন বই দেওয়ার পরিকল্পনা নেয়।
ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রচারণার বড় একটি অংশ জুড়ে থাকা পোস্টারিং এবং অন্যান্য প্রচার সামগ্রী নিয়ে কিছুটা চিন্তিতই হয়ে পড়েছিলেন নগরবাসী। নির্বাচনের পর ঢাকার অলিগলিতে ছেয়ে যাওয়া সেসব পোস্টার যখন বর্জ্য হয়ে পরিবেশের হুমকি হয়ে দাঁড়াল, ঠিক তখনই বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন উদ্ভাবন করল পোস্টার ব্যানারের মাধ্যমে শিক্ষা উপাদান বানানোর অভিনব কৌশল। বিদ্যানন্দের এসব কার্যক্রমও সাড়া ফেলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। দেশ ছাড়িয়ে এমন উদ্যোগকে স্বাগত জানান ওপার বাংলার বিশিষ্টজনরাও।
এ বিষয়ে সালমান খান ইয়াসিন বলেন, ‘বছরের শুরুতে বিদ্যানন্দের এতিমখানা ও স্কুলগুলোতে বাচ্চাদের অনেক খাতা, ব্যাগের প্রয়োজন হয়। তাই এবার এক স্বেচ্ছাসেবকের আইডিয়াতে সিটি নির্বাচনের ২০ টন ব্যানার ও পোস্টার দিয়ে প্রায় ৪০ হাজার শিক্ষাসামগ্রী বিতরণ করি।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন নিয়ে বলেন, ‘বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের সব সৃজনশীল কার্যক্রম পুরো বাংলাদেশকে একটি বিশাল উচ্চতায় নিয়ে গেছে। তারা যেসব কাজ করে সমাজের মানুষদের দেখিয়ে দিচ্ছে, তা থেকে আমাদের সবার শেখা উচিত।’
করোনাভাইরাসের ক্রান্তিলগ্নে
এই ফাউন্ডেশনের করোনাভাইরাস মোকাবিলা কার্যক্রম প্রসঙ্গে সালমান খান ইয়াসিন বলেন, ‘করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে মার্চ মাসের শুরু থেকেই বিদ্যানন্দের বাসন্তী গার্মেন্টসে বানানো মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার সামগ্রী বিভিন্ন এলাকায় বিতরণ করছিলাম। তবে ১৫ মার্চের পর থেকে আমরা পুরোদমে মাঠে সক্রিয় হই। এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে দিনে-রাতে ছুটেছি জীবাণুনাশক ছিটাতে। ১৮ মার্চের পর দেশের পরিস্থিতি যখন আরও ভয়াবহ রূপ নেয় তখন ৬০ জন সদস্যকে ভাগ করে ৩০ জন করে আমরা দুটি দল গঠন করি। তারা দুই শিফটে কাজ করছেন। ঢাকা ও চট্টগ্রামে প্রতিদিন প্রায় ৯ হাজার লিটার জীবাণুনাশক ছিটিয়ে দিচ্ছি। ঢাকার মধ্যে যারা হোম কোয়ারেন্টাইনে আছেন তারা কল করে জানালেই তাৎক্ষণিক খাবার পৌঁছে দিচ্ছি।
মাঠ পর্যায়ে ঝুঁকি নিয়ে এসব কাজের ব্যাখা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ স্থান এখন কুয়েত মৈত্রী ও কুর্মিটোলা হাসপাতাল। করোনা আক্রান্ত রোগীদের সেখানে রাখা হচ্ছে। আমরা সেখানেও গিয়েছি। এইতো তিন দিন আগের ঘটনা, আমিসহ আমার টিম কুর্মিটোলা হাসপাতালে জীবাণুনাশক ছিটাতে গিয়ে খুব ভয়ংকর অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি। যদিও আমরা এসব কাজ করতে অত্যন্ত সাবধানতা অবলম্বন করে পিপিই ব্যবহার করছি। তবুও আপনার পাশে যখন বেশ কয়েকজন করোনা আক্রান্ত রোগীকে দেখবেন তখন নিশ্চয়ই আপনার মনেও কিছুটা শঙ্কা তৈরি হবে। কুর্মিটোলা হাসপাতালের কিছু চিকিৎসকের অনুরোধে আমরা কয়েকজন একদম করোনা আক্রান্ত রোগীর ওখানে গিয়ে পুরো ফ্লোরে জীবাণুনাশক ছিটিয়ে এসেছি। আক্রান্ত রোগীদের কষ্ট দেখলে আরও মানবিক হয়ে উঠতে ইচ্ছে করে।’
মাঠপর্যায়ে কাজ করে রাজধানীতে কেমন সচেতনতা দেখছেন এ প্রশ্নের জবাবে সালমান জানান, গত কয়েকদিনের ব্যবধানে এখন কিছুটা সচেতনতা লক্ষ করা যাচ্ছে। তবে সবাই যদি নিজ অবস্থান থেকে এখনো ঘরে আবদ্ধ না থাকেন তাহলে সামনের পরিস্থিতি ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়বে। সারা দেশে চিকিৎসকদের সুরক্ষার জন্য প্রায় ১ হাজার পিপিই প্রদান করেছে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। শুধু তাই নয়, দেশের দিনমজুর গরিবদের মাঝে সংকটময় এই সময়ে ত্রাণ বিতরণ করার কথাও জানান সালমান ইয়াসিন।
কর্মযজ্ঞে স্বেচ্ছাসেবক যারা
সারা দেশে শতাধিক স্বেচ্ছাসেবকের বলয়ে গড়ে ওঠা দেশের সর্ববৃহৎ এ সংগঠনে যারা কাজ করছেন তাদের অনেকেই ছেড়ে এসেছেন নিজের পরিবার কিংবা অনেকেই বিসর্জন দিয়েছেন স্বপ্নের ক্যারিয়ার। তবু দিন শেষে তাদের এই মানবিক কার্যক্রমকে সব পরিবারের সদস্যরাই সাধুবাদ জানান। বিদ্যানন্দের প্রতিষ্ঠাতা কিশোর কুমার বলেন, ‘বিদ্যানন্দের প্রাণ হচ্ছে আমাদের প্রতিটি স্বেচ্ছাসেবক। তাদের নিজেদের লোভ-লালসা কিংবা ব্যক্তিস্বার্থের উদ্দেশ্য কখনো এই সংগঠনের কাজে জড়িত ছিল না। আমি সত্যিই আমাদের সব স্বেচ্ছাসেবকের প্রতি কৃতজ্ঞ। তাদের ত্যাগের বিনিময়েই বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন বিশ্বজুড়ে এক মহৎ উদ্যোগ হিসেবে গণ্য হচ্ছে। রিপ্রেজেন্ট করছে বাংলাদেশকে। সে সঙ্গে যারা আমাদের শুভাকাক্সক্ষী। আমাদের আর্থিক, মনোবল বা তাদের অসাধারণ মতামত দিয়ে সহযোগিতা করছেন তারাও আমাদের অনুপ্রেরণার বাতিঘর।’
বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন কি সনাতন (হিন্দু) ধর্মীয় সংগঠন?
২০১৭ সালের মে মাসে বিবিসি বাংলার নাম অনুকরণে ‘blogspot’-এ তৈরি করা একটি ফ্রি ব্লগিং ওয়েবসাইটে “খাবারের সাথে ‘গো’চেনা মিশিয়ে ইফতার বিতরণ করছে সনাতন হিন্দুদের সংগঠন বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন”-এমন শিরোনামে একটি খবর প্রকাশ করা হয়। বিবিসি বাংলার নামে তৈরি করা এবং বিবিসি বাংলার লোগো ব্যবহার করা হলেও এই সাইটটির সাথে বিবিসি নিউজ এর কোন সম্পর্ক নেই। এই ব্লগ ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সব খবর বানোয়াট, যেসব সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যেই প্রকাশ। এই ওয়েবসাইটের প্রতিটি শিরোনামই উস্কানিমূলক ও বিদ্বেষপূর্ণ। বর্তমানে সাইটটির কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায় না।
২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন একটি শিক্ষা সহায়ক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। সরকার নিবন্ধিত সংগঠনটি সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণীর ছেলেমেয়েদের শিক্ষা সংক্রান্ত সহায়তা প্রদান করে থাকে। সারা দেশে প্রতিষ্ঠানটির ৮টি শাখা রয়েছে। বিনামূল্যে শিক্ষাদান, বইপত্র ও শিক্ষা উপকরণ বিতরণ, উন্মুক্ত পাঠাগার সেবা, শিশুদের এক টাকায় খাদ্য প্রদানসহ বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে সংগঠনটি।
প্রতিষ্ঠানটি ধর্মীয় কোন সংগঠন নয়। এর নামটি এসেছে ‘বিদ্যা+আনন্দ’ থেকে এবং নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তির নাম অনুসারে নয়। বিভিন্ন ধর্মালম্বি স্বেচ্ছাসেবকদের দ্বারাই এই সংগঠনটি পরিচালিত হচ্ছে, কোন প্রাতিষ্ঠানিক অনুদানে নয়, বরং সাধারণ মানুষের সরাসরি অনুদানে। এই সংগঠনের অন্যতম উদ্যোগ হচ্ছে ‘১ টাকায় আহার’ যার মাধ্যমে প্রায় প্রতিদিন ১,৫০০ দুঃস্থ মানুষের মাঝে মাত্র ১ টাকায় খাদ্য প্রদান করা হয়। এই রমজানে এই উদ্যোগটি ‘১ টাকায় ইফতার ও সেহরি’ প্রদানের মাধ্যমে কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে।
‘বিবিসি বাংলা’ নাম ব্যবহারে করে প্রচারিত রিপোর্টটি ধর্মীয় উস্কানি প্রদান করে সংগঠনটিকে ‘ইসলাম বিদ্বেষী’ ও ‘হিন্দু ধর্মীয়’ সংগঠন বলে প্রচার করে এবং দাবী করে যে বিতরণ করা ইফতারে ‘গোমূত্র’ মেশানো হচ্ছে।
আলোচনায় সারাদিন কিশোর কুমারের পদত্যাগ ও সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা
বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন থেকে পদত্যাগ করেছেন এর প্রতিষ্ঠাতা প্রধান কিশোর কুমার দাশ। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষাসহায়ক এই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার ফেসবুক পেজে এক পোস্টে মঙ্গলবার তার পদত্যাগের কথা জানানো হয়।
পদত্যাগের কারণ হিসেবে পোস্টে লেখা হয়েছে, ‘বিদ্যানন্দ’ নামটি দিয়েছেন এক মুসলমান ব্র্যান্ড এক্সপার্ট। ‘আনন্দের মাধ্যমে বিদ্যা অর্জন’ স্লোগানের সাথে মিল রেখে তিনি নামটি দিয়েছিলেন। অনেকেই এটাকে ব্যক্তির নাম থেকে ভেবে ভুল করেন। এ জন্য আমরা দুই বছর আগে নাম পরিবর্তনের পক্ষে-বিপক্ষে ভোটে করি এবং স্বেচ্ছাসেবকরা নাম পরিবর্তনের বিপক্ষে ভোট দেন।
‘বিদ্যানন্দের প্রবাসী উদ্যোক্তা সশরীরে খুব অল্পই সময় দিতে পারেন। ৯০ শতাংশ মুসলিম স্বেচ্ছাসেবকই চালিয়ে যান প্রতিষ্ঠানটির বিশাল কর্মযজ্ঞ। তবুও উদ্যোক্তার ধর্ম পরিচয়ে অনেকেই অপপ্রচার চালায় মিথ্যা তথ্য দিয়ে। যাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কার্যক্রম, অনুদানের গতি।’
এতে আরও বলা হয়, ‘গত মাসেই বিদ্যানন্দের প্রধান পদত্যাগের কথা জানিয়ে দেন স্বেচ্ছাসেবকদের। সাম্প্রদায়িক অপপ্রচারে নয়, বরঞ্চ ব্যক্তিগত ত্যাগে স্বেচ্ছাসেবকদের অনুপ্রাণিত করার এবং নতুন মেধায় প্রতিষ্ঠানকে সমৃদ্ধ করার স্বপ্নে এমন সিদ্ধান্ত তার। তিনি প্রধানের পদ ছাড়লেও বিদ্যানন্দ ছাড়ছেন না, বরঞ্চ সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব নিতে চেয়েছেন। আমরা বিষয়টি প্রকাশ করতে চেয়েছিলাম চলমান ক্যাম্পেইনের পরে। কিন্তু কিছুদিন ধরে চলা মাত্রাতিরিক্ত অপপ্রচারে জল ঢালতে খবরটি আজকে শেয়ার করলাম।’
‘আমাদের স্বেচ্ছাসেবকদের জন্য বিষয়টি হতাশার নয়। বরঞ্চ পদ আঁকড়ে থাকার মানসিকতার এই সমাজে উল্টা পথে হাঁটতে পারার জন্য গর্ব হচ্ছে। আর বিদ্যানন্দে পদে কি যায় আসে? এখানে তো কাজটাই আসল, আর সেটাই আমরা করে ছাড়বো।’
পদত্যাগপত্র জমা দেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মাথায়ই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছেন বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান কিশোর কুমার দাস। প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের চালানো হচ্ছে, এমন অভিযোগ এনে মঙ্গলবার (০৫ মে) পদত্যাগের কথা জানিয়েছিলেন তিনি।
তবে এদিন সন্ধ্যায় তিনি একটি গণমাধ্যমকে জানান পূর্ববর্তী সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার কথা। কিশোর বলেন, “সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমার বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু পরে অনুধাবন করতে পারলাম, এটা প্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পেইন ও কার্যক্রমের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।”
বিদ্যানন্দ সূত্রে জানা গেছে, কিছু ধর্মীয় মৌলবাদী কিশোরকে কটাক্ষ করে। তারা বিদ্যানন্দকে “হিন্দু নাম” এবং এটির প্রতিষ্ঠাতাকে “হিন্দু” আখ্যা দেয়। কিশোর বলেন, “আমি কখনোই এই পদটি চাইনি, কারণ আমাদের কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে আমার কাছে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান পদে থাকব।”
এ বিষয়ে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে পরেই সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানান তিনি।
এর আগে এদিনই বিদ্যানন্দের ঢাকা বিভাগীয় শাখা ব্যবস্থাপক সালমান খান ইয়াসিন জানিয়েছিলেন, ব্যক্তিগত ও ধর্মীয় আক্রমণের কারণে কিশোর কাজ চালিয়ে যেতে পারছিলেন না। তাই মঙ্গলবার সংগঠনের প্রধানের পদ থেকে পদত্যাগপত্র জমা দেন তিনি।
যদিও সংগঠনটির নির্বাহী কমিটি কিশোর দাশের পদত্যাগপত্রটি গ্রহণ করেনি।
উল্লেখ্য, প্রতিষ্ঠানটির ৮০% কর্মী মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও গত দুই বছর ধরে নাম ও প্রতিষ্ঠাতার ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্রমাগত আক্রমণের শিকার হয়ে আসছিলেন।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে চলমান লকডাউনেও সংগৃহীত অনুদানের অর্থে দুঃস্থদের মাঝে খাবার বিতরণ করছে বিদ্যানন্দ।
প্রতিবছর রমজানেই হাজার হাজার অসহায় মানুষকে সেহরি ও ইফতার করায় প্রতিষ্ঠানটি।
বছরখানেক আগে বিদ্যানন্দের প্রতিষ্ঠাতা কিশোর কুমার বলেছিলেন, খালি পেটে কেউ ঘুমাতে যাবে না, এমন একটি পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেন তিনি।
সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম, ক্ষুধা ও বিভিন্ন কু-প্রথার বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য ২০১৩ সাল থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক প্রশংসিত হয়ে আসছে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন।
প্রসঙ্গত, কিশোর কুমার দাশ ২০১৩ সালে নারায়ণগঞ্জে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাটির তার কার্যক্রমের মাধ্যমে ডালপালা বিস্তার করতে থাকে। সর্বশেষ ২০২০ সালে খাগড়াছড়িতে ১২তম শাখা চালু করা হয়। এই সংগঠনটি প্রতিদিন দুই হাজারেরও বেশি সুবিধাবঞ্চিত পথশিশু, দরিদ্র ও অসচ্ছল শিশুর মৌলিক শিক্ষা, এক টাকায় খাবার, চিকিৎসা ও আইনসেবা দিয়ে আসছে।
বিশ্বের সর্বশেষ খবর, প্রতিবেদন, বিশ্লেষণ, সাক্ষাৎকার, ভিডিও, অডিও এবং ফিচারের জন্যে ইরাবতী নিউজ ডেস্ক। খেলাধুলা, বিনোদন, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং স্বাস্থ্য সহ নানা বিষয়ে ফিচার ও বিশ্লেষণ।