আজ ০৪ মার্চ কবি, কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও সম্পাদক বীরেন মুখার্জীর শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।
জীবনের মুখোমুখি
জীবনের মুখোমুখি বসে আছে জীবন- অঘ্রাণের রাতে;
আহা জীবন! নিরীক্ষায় গেঁথে রাখা চতুর প্রতিভা ছুঁয়ে
সোৎসাহে দৌড়াচ্ছি; নিশ্চুপ- বিমর্ষমুখ- অবনত;
কখনও ক্লান্তির প্রলম্বিত ছায়া পড়ছে নির্জন খেতের আলে
আবার, ডুবেও যাচ্ছে জীবিকার ঘ্রাণে; তবুও- দিনশেষে
দেখতে পাচ্ছি না নিবিড় শিল্পতরু তোমাকে, বঙ্গঋতুনাট্যে!
নিমগ্ন এই রাতের ভাঁজ খুলে, যদি উড়ে যায় দীঘল জীবন
জীবনের খোঁজে, পঞ্চমীর চাঁদ ছুঁয়ে মায়াবী বিষণœ হে-
নিষ্ফল উজিয়ে দাঁড়াতে অন্তহীন, ছুঁড়ে দিয়ে ধূসর প্রতীক!
ঘুরে ফিরে জীবন একই- প্রত্যাশাকাতর প্রত্যুষে;
উহ্য ঋতুর সংগীত
পৃথিবীর আহ্লাদী সন্ধ্যায় আমি এক উহ্য ঋতু; ক্ষীণকণ্ঠ, আলোচিত ভীড়ের ভেতর সংগুপ্ত থেকে থেকে বিশীর্ণ রোদ্দুর ছুঁয়ে গড়িয়ে নেমেছি- উন্নয়ন হাওয়ায়; এভাবেই- উপল ভ‚মির দিকে যেতে যেতে ভেতরে জমিয়েছি কানামাছি দিন, বিবর্ণ হেমন্ত আর মানুষের প্রতীতি;
আমার চোখে মুদ্রিত আছে সময়ের কোমল গরল; অনেক না-বলা কথা, ধূসর ও রুগ্ন ইতিহাস; আছে- সময়ের কুষ্ঠনালী বেয়ে গড়িয়ে পড়া স্বেদ; উজ্জ্বল আশাবাদ-ও; তবুও হে প্রান্তরের মানুষ, মনে রেখো, সৃজনের নিয়ত আঁধারে শুধু তোমাদের গানই গেয়েছি; একদিন-বহুদিন, সমষ্টির পরিসর ভেঙে, সূ²াতিসূ² স্বর- নগর ও জনপদে-
এইসব গোপন ইশারায়
ন্যায্যতাকে পাশ কাটিয়ে নীরবে বয়ে যাচ্ছো- হেমন্ত; যাও, এবার হয়তো পরেই আসবে শীতকাল; সুতরাং হাঁটতে হাঁটতে পাল্টে আমিও দেবো ঋতুর ধারণা; পোশাকের পরিকল্প ছিন্ন করে পৃথক হবো তোমার মতো উঁচুতে; রাত্রি ও নিদ্রায় প্রশ্নশীল হয়ে যেমন বিন্যস্ত হয়েছে প্রবাহের ধারা-
ঋতুচক্র ঘুরে, নির্দিষ্ট দূরত্বে থিতু হলে আমাদের ভাষা ও বেদন; প্রতিজ্ঞার পৃষ্ঠা ছিঁড়ে জন্ম নেবে নতুন সকাল- দেখবে, সেখানে ধ্যানস্থ হতেই স্বপ্নেরা পেয়ে যাবে নিজস্ব থালা-বাটি-ঘটি, দৈনন্দিন তৈজসপত্র;
একদিন রোদের প্রয়োজনে মণিমুক্তাসমেত তামাশা উঠে আসবে- এমনকি, তোমার আলিঙ্গনমাখা শয্যাও তখন খুঁজবে না নিয়তির দাগ; ও হেমন্ত; বরং দীর্ঘকাল বয়ে যেতে যেতে, বিবাহিত রাত্রির গোপন কথায় ন্যায্যতার কর বসিও…
পাতার ডায়েরি
অঘ্রাণের ভেজা মাঠে চিকন আলোয়
কীসের নিলাম ডাকে নিখিলের বোধ?
কার প্রিয় ওগো তুমি- মুগ্ধ প্রাণ এক
বিস্ময়-দরজা খুলে সীমাহীন ওড়ো!
পাতার অক্ষরে লেখা- এইসব ঋণ
মায়ার জলধি জুড়ে ফোটায় ফেনিল;
লিখেছে কে এ-যাতনা কলহ-রঙিন
বলো: কে ফেরায় ফের, ভবঘুরে দিন?
পায়ে পায়ে, যদি নাচে সময়ের মাছি
মধুকুপী দিন, শিশিরে ফোটাবো আমি
সূ² চেতনার হুল- অন্য কোনো ভোরে
তারপর; সয়ে যাবো- সুনীল প্রবোধ!
রাতভর ফোটে কেন- হতাশার ফুল
প্রেরণা গুঞ্জনে তার কে ভাঙায় ঘুম!
পাথর বোঝাই নদী
পাথর বোঝাই একটি নদী- নিজস্ব উদ্যোগে
খুব সজোরে করলো আঘাত, উত্তেজনা বাজে;
জানি না কার উপস্থিতি বলছে ভীষণ লাজে
স্রোতবাহী তুমিও কী- সৃষ্টি এবং ভোগে?
ভালোবাসা লজ্জানত ভেসে ঋতুর জলে
বলবে না তো পরিযায়ী, এবার তবে থামো!
গুটিসুটি, উৎকণ্ঠিত নাই বা বলুক থামো
তখন আমি পৌঁছে যাবো- নিজস্ব কল্লোলে!
আত্মপরিমিতি
অকৃপণ নিষ্ঠুরতা; অহমিকার দৃশ্য সরালেই দেখতে পাবে সারি সারি কানাবক, ঋতুর সমীহ পেছনে রেখে যারা পাখা মেলেছে গোধুলির আসমানে; কোথায় চলেছে তারা, এমন জিজ্ঞাসা উহ্য রেখেই গন্তব্যে ফিরতে হবে, তোমাকে- ওহে যাদু, ছদ্মবেশী নীতি আর গোয়ার্তুমি শিকেয় রাঙিয়ে!
কেননা, জীবনের সবিশেষ ধরে একদিন টানতে থাকবে পৃথিবীর বিমল হাওয়া, তখন, দীর্ঘশ্বাসে চুমু দিয়ে- সমূহ সত্যের কাছেই ফিরতে হবে তোমাকে; যেভাবে ফিরেছে সকলে, প্রস্তর গভীর থেকে ভেসে এসেছে যেদিন অলৌকিক স্বর; অবিনশ্বর সে-স্বর ভাসছে এখনো- বয়োজীর্ণ পৃথিবীর শীতে;
বাঁকফেরা নদী
অঘ্রাণের বাঁকভাঙা নদী, সময়ের বাঁকে
এসে দেখে- সব দৃশ্য শুয়ে আছে
বাস্তচ্যুত আতপ আলোয়;
দৃষ্টির অতীত কেউ, ঝমঝম শ্রাবণের বন;
আর, স্তন ও নাভির সৌরভ হারানো
দ্যোতনার পথে, অর্ধসত্য- সকলে রঙিন;
সঘন রোদের মাঠে- প্রণয়কাতর দিন
দেয় হাতছানি; সে-ও বলে ডেকে-
স্মৃতি খুঁড়ে তুমিও পেতে পারো চেতনার ঘাস!
সময়ের পথে থেমে বাঁকফেরা নদী,
বলে চুপিচুপি: ওহে চেতনার দাস-
তবুও, তোমাকেই ‘ভালোবাসি’…
বাসের সিটে, পাশেই
লোকাল বাসের সিটে, পাশেই; বলল হেসে সরি!
তারই খোঁপায়, চুলে- দেখি,
সন্ধ্যা এলোমেলো;
নিশ্বাসে তার মদির গন্ধ, সন্ধি-পয়গাম সে-কী!
কী আর বলি, যখন দেখি
নিজেই সে চমকালো!
ড্যাবডেবে চোখ, স্মিতহাসি, ফুটন্ত এক প্রসূন;
বলল আবার, নিঃসঙ্কোচে
স্বস্তি নিয়েই বসুন!
উৎকণ্ঠিত তারই কথায়, ভাবছি, কী যে করি-
ভুল ভ্রমণের বার্তা বাজাও,
খুব বুঝি- অপ্সরী!
নভেম্বর : একটি রাত্রি
নভেম্বর : একটি রাত্রি সাক্ষী
– চলে যাই রাত্রির গভীরে, এবং
বহু প্রকৃতির মানুষ জাগিয়ে- বিভ্রম বিস্তারে।
দেখি, সংহিতা খুলে- উড়ছে উত্তাল;
বৃদ্ধ ইতিহাস, মলিন বেসাতি জীবনের নামে,
পুষ্পের করুণ কান্না সেখানেও, তাহলে?
– আমি ভবিষ্যত লিখি তাদেরই নামে, মর্মে;
অরণ্যে নামাই পাখিদল, তীর্থ পৃথকের আগে
ক্যালেন্ডারে রেখে যাই দাগ, বঙ্কিম;
মগ্ন সন্ন্যাসীর মতো, অবশেষে!
একটি রাত্রির ডাকে চলে যাই অন্য বাসনায়-
মসৃণ ঋতুর দায় পড়ে থাকে পাঠে ও পাপে;
যাই সিদ্ধান্তের সূত্র নাড়িয়ে, ওহে নভেম্বর,
হয়তো বা অন্য পৃথিবীর ভবিষ্যে,
পুনর্বার দেখা হতে পারে-
মুহূর্তের কবিতা
অন্তরে লাগালে খিল-
কী যে মুশকিল,
দৌড়ে এসেও থামতে হয়;
বলি ধীর লয়ে-
প্রেম অথবা প্রণয়ে
থামতে পারাও মন্দ নয়!
![বীরেন মুখার্জী](https://irabotee.com/wp-content/litespeed/avatar/bfe650917f5e9a05c79c5c799ee5747e.jpg?ver=1739168151)
নব্বইয়ের সময়পর্বের কবি ও নির্মাতা। তিনি গল্পকার, সাহিত্য সমালোচক, ও কলাম লেখক হিসেবেও পরিচিত। গবেষণা করেন লোকসাহিত্য ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। জন্ম ১৯৬৯ সালের ৪ মার্চ মাগুরার শালিখা উপজেলার দরিশলই গ্রামে। সম্পাদনা করেন শিল্প-সাহিত্যের ছোটকাগজ ‘দৃষ্টি’। দৈনিক যায়যায়দিন পত্রিকার, সম্পাদকীয় বিভাগে কর্মরত।