| 6 অক্টোবর 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

আলোর পথযাত্রী

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট
মোহর বুকের ওপর চেপে বসল। তার চোখের দৃষ্টি এখন সাপের মত।হিস হিস স্বরে বলে উঠল, ‘আমার থেকে তোমার মুক্তি নেই। ভেবেছো এ বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেই সব আনন্দ, স্বাধীনতা ভোগ করতে পারবে? বেঁচে থাকতে কখনো  তা হতে দেব না বাবুসোনা!’ তার ঠোঁটটা নেমে এল নিচে। যেন ড্রাকুলার মতো সব রক্ত এখুনি চুষে নেবে সে।রক্তশূন্য শরীর হয়ে পড়ে থাকতে হবে একটু পর থেকেই। ভয়ে চোখ খুলে ফেলল প্রত্যুষ। সারা গা ঘামে ভিজে গেছে। কোনো রকমে বেড সুইচটা অন করে ঘড়ি দেখল। রাত আড়াইটে। অথচ সাড়ে বারোটার সময় সে  স্লিপিং পিল খেয়েছিল। মাথাটা যন্ত্রনায় ছিঁড়ে যাছে। মনে হচ্ছে কেউ বুঝি পাঁচ হাজার ভোল্টের ব্যাটারি চার্জ করেছে মাথায়। অথবা একশোটা সূর্য জ্বলছে। সেই তাপে সে ঝলসে যাচ্ছে।
বিছানা থেকে উঠে সে ঢকঢক করে পুরো এক বোতল জল খেয়ে নিল সে। বাথরুমে গিয়ে চোখে মুখে জল দিয়ে সিগারেট হাতে ঘরের লাগোয়া পুবের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। দমকা একটা হাওয়া এসে লাগল। দূরে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে বোধহয়। এখানেও হোক। মেঘ ভাঙা বৃষ্টি হোক। সব জলের তলায় চলে যাক। ধবংস হয়ে যাক সব। কি হবে বেঁচে থেকে! অর্থহীন জীবন, নিজের মনেই ভাবল প্রত্যুষ।
অসম্ভব সুন্দরী মোহর। যেখানে যায় আলোকিত হয়ে ওঠে। ঘাড় বেঁকিয়ে ঈষৎ ঠোঁট চেপে মোহর যখন হাসে তখন মনে হয় আলোর ঝরনা ঝরে পড়ছে। চোখের তারায় বিদ্যুৎ খেলে। প্রত্যুষ মোহরের প্রেমে পড়ে। সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দেয়।ফাল্গুনে চার হাত এক হয় ।
মোহর বলে, ‘এই আকাশ এই পৃথিবী যে এত সুন্দর তুমি আমার জীবনে না এলে বুঝতাম না।’ প্রত্যুষ তার হাত নিজের মুঠিতে নিয়ে বলে, ‘তোমার ভালবাসা পরিপূর্ণতা দিয়েছে আমায়। তোমায় কোনো দিন কষ্ট দেব না’।
প্রত্যুষের বাড়ি নদীর তীরে। অফিস থেকে ফিরে তারা দুজনে বেড়াতে যায় সেখানে। পাড় ধরে হাঁটে।মোহর হাঁটতে হাঁটতে গান শোনায়। প্রত্যুষ ভাবে, ‘আহা; আমি কত সুখী!’ বছর ঘোরে। তারা দুজন থেকে তিনজন হয়। ফুটফুটে এক ছেলে। বাড়িতে আনন্দ উপচে পড়ে। অথচ মোহর বদলে যেতে থাকে। সে বাচ্চাটিকে প্রতিপক্ষ ভাবে। এক মাসের মাথায় ছেলেকে আয়ার কাছে রেখে সে বেড়াতে চলে যায় প্রত্যুষের সাথে। সেই প্রথম সে লক্ষ্য করে মোহরের চোখে অদ্ভূত নিষ্ঠুরতা। মোহর তাকে বলে, ‘তুমি আমাকে থেকে বেশি ছেলেকে ভালোবাসবে আমি তা কিছুতেই হতে দেব না’।
‘কি যা তা বলছ? ও তো আমাদেরই সন্তান, তোমার জন্যই তো তাকে পেলাম। তোমার থেকে বেশি তাকে কি ভালবাসা যায়?’ প্রত্যুষ তাকে বোঝায়।
‘যা তা? নার্সিংহোম থেকে ফিরে কেন তুমি বাবানকে বুকে জড়িয়ে ধরে গন্ধ নিচ্ছিলে? আদর করছিলে?আমাকে তো কর নি! আমি কি ফুরিয়ে গেছি? নাকি আমার গায়ের গন্ধ আর ভাল লাগছে না?’ মোহরের চোখে হিংস্রতা।
প্রত্যুষ অবাক হয়ে যায় তার কথায়। তাকে কাছে টেনে  নিয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে  বলে, কি বোকা তুমি? এই অবস্থায় কি সেভাবে সম্পর্ক করা উচিৎ সোনা? তোমার তো কষ্ট হতো।
আমার কষ্ট হবে? মিথ্যে কথা। আসলে তুমি এর মধ্যেই অন্য কাউকে পেয়ে গেছ। আমি সব বুঝি।বাচ্চা পেটে আসার পর থেকে তুমি আর আমাকে ভালবাস না। বাড়িতে আমাকে বাচ্চার কাছে বন্দী রেখে তুমি অন্য জায়গায় ফুর্তি করবে? তোমাদের পুরুষ জাতটাকে আমার ভাল চেনা আছে।
প্রত্যুষের মোহরকে অচেনা লাগে। সে খানিকটা সামলে নিয়ে ম্লান হাসে, বাঃ! তুমি তো অনেক কিছু জান! তা কবে এত পুরুষ দেখলে তুমি? আমি ভাবতাম তুমি নেহাতই ছেলে মানুষ। এখন তো দেখছি তুমি বেশ বড়। তার কথা শুনে মোহর আরো ক্ষেপে গেল। ধাক্কা মেরে তাকে বিছানায় ফেলে বাধ্য করল আদিম খেলায় মাততে।
ফিরে এসে ডাক্তারের সাথে কথা বলল প্রত্যুষ।
‘বাচ্চা হবার পর অনেক মেয়েই বিশেষ করে যারা অল্প বয়সে বিয়ের পরই মা হয়ে যায় তারা একটা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে।’ ডাক্তার জানালেন।
‘কিন্তু মাঝে মঝে সে এত হিংস্র হয়ে যাচ্ছে যে মনে হয় ছেলেকে বুঝি মেরেই ফেলবে। প্রত্যুষ ভীত গলায় বলে।
-এত ভয় পাওয়ার কিছু নেই। স্ত্রীকে একটু সময় দিতে হবে, তার সাথে গল্প করতে হবে, আর যারা বাচ্চাকে দেখতে আসবেন তাদেরও বলে দেবেন তারা যেন আগে বাচ্চার মার সাথে কথা বলে।তাহলেই দেখবেন তিনি ধীরে ধীরে নিজেই বাচ্চা দেখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন। ডাক্তার তাকে আশ্বস্ত  করেন।
প্রত্যুষ এর পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অফিসের কাজ মিটিয়ে বাড়ি ফেরে। মোহরকে নিয়ে বেড়াতে যায়, গল্প করে, রাতে বাইরে খেয়ে ফেরে দুজনে। বাবান আয়ার কাছে বড় হতে থাকে। বাবান এখন দেড় বছর। সে আধো স্বরে কারণে অকারণে ‘মা’ বলে মোহরের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কখনো ‘মা কোলে, কোলে নাও,’ বলে বায়না ধরে, কখনো বা ‘মা, হামি’ বলে গাল দুটি বাড়িয়ে দেয়। মোহরের ধীরে ধীরে বাচ্চার প্রতি টান তৈরি হয়। সে বাচ্চাকে ফেলে একা আর কোথাও যেতে চায় না। প্রত্যুষ ভাবে,যাক!এতদিনে বুঝি মোহর স্বাভাবিক হল। সে আবার আগের মত কাজে ডুবে যায়।
সময় গড়িয়ে চলে। একদিন টিভিতে উত্তম সুচিত্রার সিনেমা চলছে। প্রত্যুষ সোফায় বসে নিবিষ্ট মনে দেখছে। তার জানলার নীল শাদা পর্দা হাওয়ায় দুলছে। এক অবর্ননীয় মায়াবী বাতাবরণ তৈরি হয়েছে ঘরের অল্প আলোয়। মোহর রান্নাঘর থেকে জিজ্ঞেস করল – ‘কি দেখছ গো এমন মন দিয়ে?’
‘সপ্তপদী। সুচিত্রাকে কি লাগছে! কি তাকানো! কি রূপ!’ মোহর বেরিয়ে এসে প্রত্যুষের মুখের দিকে একবার তাকাল। তারপর ঘরে ঢুকে গেল।
বেশ কিছুক্ষণ সারা না পেয়ে সে ‘মোহর মোহর কোথায় গেলে? বাবান কাঁদছে তো!’ উত্তর না পেয়ে রান্না ঘরে উঁকি মারল। নেই। বাবান কেঁদেই চলেছে।তবে সে কি ঘরে?
সে বেডরুমের ভেজানো দরজা আলতো করে ধাক্কা দিল। পরমুহূর্তেই চিৎকার করে উঠল, কি করছ কি তুমি?
মোহর বিছানার উপর চেয়ার তুলে ফ্যানের সাথে কাপড় ঝুলিয়ে গলায় বাঁধার চেষ্টা করছে। দৃষ্টি অস্বাভাবিক। যেন কোনো অশুভ আত্মা ভর করেছে। সে কাঁপা কাঁপা হাতে মোহরকে ধরে নামাল। তার ঘোলাটে চোখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। অজানা এক কণ্ঠস্বরে সে বলল, ‘তোমার ওই নায়িকা সুন্দর! বুঝি না ভেবেছ কিছু? পারভাটেড কোথাকার! সব ন্যাকামি ঘুচিয়ে দেব। জেলের ঘানি টানাব। আমার থেকে সুন্দর!
কি পাগলামি করছ? আমি কখন বললাম তোমার থেকে সুন্দর! নায়িকাকে ছবিতেই মানায়। তুমি তো আমার ঘরের লক্ষ্মী। তার সঙ্গে কি তোমার তুলনা হয় সোনা? মোহর তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তারপর সাপের মত লতিয়ে হিসহিস করে বলে উঠল, বল আমার থেকে বেশি সুন্দর কেউ নেই; তুমি আমি ছাড়া কাউকে ভালবাস না! শান্ত স্বরে বৌকে কাছে টেনে নিয়ে সে বলল, না। কাউকে বাসি না। মোহর তার বুকে মাথা রেখে কাঁদতে লাগল। 
বেশ কিছুদিন কোনো উত্তেজনা ছাড়াই কেটে গেল।মোহর সংসার, বাচ্চা নিয়ে ব্যস্ত। বাবান এখন তিন।স্কুলে যাচ্ছে। প্রত্যুষ অফিস থেকে ফিরে দু’একটা কথা বলে পাড়ায় আড্ডা মারতে যায়। সিগারেট, চা, সাহিত্য থেকে রেঁস্তোরা, ভ্রমণ সব গল্পই উঠে আসে সেখানে। চায়ের দোকানে বাল্য বন্ধু বাচ্চু বলে, জানিস, গত মাসে বৌ বাচ্চা নিয়ে দীঘা গেছিলাম। হেভভি মজা করলাম।
-বা! কোন হোটেলে উঠলি?
-পান্থ শালা। পার ডে পাঁচশো টাকা। তা নিয়ে আফশোষ নেই। রোজগার করছি যখন তখন ভাল থাকাই ভাল।
-ঠিক। বৌদিরা খুশি?
-হ্যাঁ, ছেলেটার সমুদ্র খুব ভাল লেগেছে, ভাবছি এর পর পুরী যাব।
-ভাল তো! প্রত্যুষ মাথা নাড়ে। অবাক ও হয়। কত শান্তি এদের জীবনে! অল্পতেই খুশি! আর তারা? এই সেদিন দুই দিনের জন্য বিষ্ণুপুর গিয়েই পঁচিশ হাজার গেল। তাতেও মোহরের মন ভরে নি। বলে,  ভিখারীর সাথে বিয়ে হলে এমন বাজে ভাবেই থাকতে হয়। বাবা আমাকে ফাইভস্টার ছাড়া রাখেনি কখনো।
মাঝে মাঝে তার খুব ইচ্ছে করে মোহরকে জিজ্ঞেস করতে, তার বাবা সামান্য সরকারি চাকরি করে কি করে তাকে ফাইভস্টারে রাখতেন? কিন্তু সাহসে কুলায় না। কি জানি মোহর কি করে বসবে সে কথা শুনে। সুখ কাকে বলে? শান্তি কিভাবে আসে? সে নিজের মনেই ভাবে।
সুখ একটা অনুভূতি। তার সাথে টাকা পয়সা বৈভব প্রাচুর্য …কোনো কিছুরই কোনো সম্পর্ক নেই। আসল বিষয় হল মন। সে ঠিক থাকলেই সব আসবে। স্কুলের মাস্টার মশাই কে সি র কথা মনে পড়ল তার।সে দিনগুলো কত সুখের ছিল। ভাড়া বাড়ি, একটা  ঘর, জল নিয়ে নিত্য অশান্তি! তবু ঘরে ফিরে মা যখন খেতে দিতেন কত শান্তি! কোনো রকমে নাকে মুখে গুঁজে পাড়ার মাঠে ফুটবল খেলা। কি আনন্দ।আর আজ বড় চাকরি, ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স, বিদেশ ভ্রমণ…। তবু যেন আশ মেটেনা।
মোহরের দাবি ক্রমশই বাড়ছিল। এখন সে চায় সে পাঁচটার মধ্যে ঘরে ফিরুক। তারপর এক কাপ চা হাতে ধরিয়ে মোহর টিভিতে মগ্ন হয়ে যায়। ব্রেক চলাকালীন উঠে দেখে যায় প্রত্যুষ কি করছে। যদি বই পড়ে ভাল, ফোন করতে দেখলেই …
-কার সাথে কথা হচ্ছে?
-মিসেস রায় জানতে চাইছিলেন অর্ডার ঠিক মত প্লেস হয়েছে কিনা? সে ভীত স্বরে জবাব দেয়।
-অফিসের বাইরে এত রাতে কিসের কাজ? চিৎকার করে ওঠে মোহর।
-এ নিশ্চয়ই তোমার নতুন প্রেমিকা। ফোন নম্বর দাও বলে উত্তরের অপেক্ষা না করে ফোন কেড়ে নিয়ে রিং করে।
-মিসেস রায় হেয়ার। বলা মাত্র বিন্দু মাত্র সৌজন্য না দেখিয়ে সে বলে ওঠে, ‘মি মোহর। প্রত্যুষ’স ওয়াইফ।তারপর বাঙলায় বলে, ‘রাত দুপুরে ফোন করে আমার বরের সাথে ফস্টি ন্সটি হচ্ছে? তোর নামে কমপ্লেন করব থানায়। চাকরি কি করে থাকে দেখব। বলা শেষ করে ফোন ছুঁড়ে মাটিতে ফেলে দেয়।মোবাইলটা টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে মাটিতে।
প্রত্যুষ বলার চেষ্টা করে, এখন সবে ছ’টা। অফিস খোলা। কাজ  না করলে চাকরি চলে যাবে, সে কথা উপেক্ষা করে সে তার চুল টেনে ধরে বলে, বাড়িতে বসে কাজ দেখানো হচ্ছে! ভালোমানুষের মুখোশ পরে নোংরামি! তোকেও থানায় দেবো। তারপর দরজা বাইরে থেকে টেনে বন্ধ করে দিয়ে আবার টিভি দেখতে বসে যায়। 
লজ্জায়, অপমানে প্রত্যুষ বদ্ধ ঘরে বসে কখনো কাঁদে, কখনো হা হা করে পাগলের মত হেসে ওঠে। শূণ্যে ঘুষি ছোড়ে। চিৎকার করে গান গায়, নাচ করে, তারপর ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। মোহর গভীর রাতে ঘরে ঢুকে খাবার খাওয়ায়, তাকে কাছে টেনে নিয়ে আদর করতে করতে অস্ফুট স্বরে বলে, তুমি আমার, আর কারোর নও। প্রয়োজনে আমি তোমায় খাওয়াবো। কাল থেকে অফিস যেতে হবে না’।
সে আঁতকে ওঠে। মনে পড়ে যায় বিখ্যাত এক লেখকের গল্পের নায়িকার কথা, যেখানে ভালোবাসার চূড়ান্ত অধিকারে মেয়েটি তার স্বামীকে জড়িবুটি খাইয়ে অন্ধ করে বাড়িতে বন্দী করে রাখে, নিজে বোষ্টমী হয়ে ঘুরে ঘুরে খাবার যোগাড় করে বন্দি পতিকে খাওয়ায়। আমার পরিণতি কি তাই হবে! এ কথা ভেবেই সে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকে। তার থেকে দূরে সরে আসার চেষ্টা করে। মোহর তার শরীর নিয়ে খেলতে শুরু করলে সে আরো কুঁকড়ে যায়।
সুযোগ বুঝে একদিন সে দরজা খোলা পেয়ে পালায়। ঘুরতে ঘুরতে এসে পড়ে এক পুরোনো বন্ধু তাপসের বাড়ি। বিধ্বস্ত চেহারায় তাকে দেখে সে কোনো প্রশ্ন না করে পূবের ঘরটা খুলে দেয় তার জন্য। তার স্ত্রী নদী বলে, যান আগে স্নান করে খেয়ে নিন, তারপর আড্ডা মারব।
প্রত্যুষ অবাক চোখে তাকে দেখে। সে বলে , কোনো সংকোচ করবেন না। আমি আপনার বোনের মত। বাথরুমে সব দিয়ে দিচ্ছি। প্রত্যুষ বিষন্ন ভাবে হাসে। অজানা ভয়ে কেঁপেও ওঠে। এখানেও যদি ধরা পড়ে যায় এরা কি পারবে মোহরের হাত থেকে তাকে বাঁচাতে? একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে স্নানে যায়। বহু দিন পর অনেকক্ষণ ধরে স্নান করে। না কেউ তাকে তাড়া দিচ্ছে না। সে নিশ্চিত হয়ে মুক্তির হাসি হাসে।শাওয়ারের জল মাথা বেয়ে শরীর জুড়ে নামতে থাকে।
সে আনন্দে গান গাইতে গাইতে বেরিয়ে আসে।নদীকে দেখে বোকার মত হাসে। নদী বলে, চলুন খেতে খেতে গল্প হবে। আলুপোস্ত ভাত। তার প্রিয় খাবার। যেন জন্মান্তরের অভুক্ত এমন ভাবে গোগ্রাসে খায় সে। অনেক রাতে নদী তাকে একটা ওষুধ দিয়ে ঘুমোতে যেতে বলে নির্ধারিত ঘরে পৌঁছে দেয়। তার চোখে ক্লান্তি। শোওয়া মাত্র ঘুম।
হঠাৎই সে  দেখে  তার চারপাশে জমাট কালো অন্ধকার। সেখানে মোহর এসেছে। তার বুকের ওপর চেপে বসে হিংস্র হাসি হেসে বলছে, পালিয়ে বাঁচবে ভেবেছো? সে হচ্ছে না সোনা, এই দেখ আমি এসে গেছি। তারপর গালে হাত বুলিয়ে- তোমায় ছাড়া যে আমার চলে না বাবুসোনা।
প্রত্যুষ চিৎকার করে ওঠে, ‘আমায় মুক্তি দাও…। সেই চিৎকারে তাপস-নদী ছুটে আসে। আলো জ্বেলে ডাকে তাকে। খারাপ স্বপ্ন দেখছিলি! জল খা, বলে তাপস বোতল এগিয়ে দেয়। প্রত্যুষ এক সাথে অনেকটা জল খেয়ে নেয়, তারপর ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে তাপসের দিকে। কিছু হয়নি, কেউ নেই এখানে, আমরা আছি, আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমোন, নদী যেন বলে তাকে।
সে নদীর দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। তার মনে হয় নদী বলছে, কিসের ভয় আপনার? জানেন এক একটা মুহূর্ত এক একটা আলোর বিন্দুর জন্ম দেয়।আমরা ধরতে পারি না। খালি খুঁজে যাই, অথচ আমাদের চারদিকেই আলো,
-আমি কি কোনোদিন আলো পাব? আমার চারপাশে বড় অন্ধকার!সে বিড়বিড় করে।
-ঘর অন্ধকার রেখে দেখুন ওগুলো জ্বলছে। 
-তুমি কে? লেডি অ্যারিস্টটল, সক্রেটিস? আমায় পথ দেখাবে?
-একটা নিঃস্তরঙ্গ পুকুরে ঢিল ছুঁড়লে সেটা একটু ঢেউ তুলে আবার থিতিয়ে যাবে, কিন্তু সমুদ্রে ছুঁড়লে তার হদিশ পাবে না। মন কে সেরকম বানাতে হবে। কেউ একজন বলে তাকে।
প্রত্যুষের চোখ জলে ভরে ওঠে। সেই মুহূর্তে দূরে কোথাও কারোর বাড়ি থেকে ভেসে আসে,
‘এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয় …।’

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত