| 1 সেপ্টেম্বর 2024
Categories
গদ্য সাহিত্য

ধুলো পড়া চিঠি

আনুমানিক পঠনকাল: 2 মিনিট
প্রিয় টিটু,
প্রযত্নে: আকাশ
কেমন আছিস? এখন কি শুধু আকাশ জোড়া মেঘেদের সাথেই সখ্যতা তোর? তুই ইচ্ছে মতন উড়ে বেড়াস, আকাশে-মেঘেদের দলে, তাইনা? পেঁজা তুলো হয়ে কখনো কি ঝরে পড়িস তোর-আমার প্রিয় শহরের কোন গাছের মগডালে, চিলেকোঠার কার্ণিশে, নয়তো স্টেডিয়ামের সবুজ ঘাসে? তুই না খুব ঘুড়ি ওড়াতে ভালোবাসতিস এখন আর ওড়াস না, বল? তোকে কতদিন দেখিনা বলতো, একলা শহরে বুঝি দম বন্ধ লাগেনা আমার! সেই কবেকার এক ২৬ জুনে আমাদের সবার উপর অভিমান করে যে মরণডুব দিয়েছিলিস যমুনার অতলান্তে আর উঠলিই না! এটা ঠিক হলো বল?
এভাবে বুঝি কাঁদাতে আছে মাকে, বাবাকে, বন্ধুদের, ভাইদের আর তোর যে প্রিয় ক্রিকেট ব্যাট তাকেও! একদিন পর তোর দেহের ভার যখন আর কালযমুনা নিতে চাইলো না তুই কত সহজেই না ধরা দিয়েছিলিস জেলেদের জালে। ভেসে উঠেছিলিস, কাঁদিয়েছিলিস পরিবারকে, প্রিয় বন্ধুদের। যাদের সাথেই গিয়েছিলিস নদী তীর্থে, আমি না হয় তোর কাছের বন্ধু ছিলেমনা। তাই হয়তো যাইনি তোর সাথে। তাই হয়তো তোর শবযাত্রায়ও যাইনি শশ্মানে, কিন্তু জানিস অনেক দূরে থেকেও খবরটা পেয়ে সেদিন আমারও কেমন মুচড়ে উঠেছিলো ভেতরটা। এই আজো যেমন উঠছে অনেকদিন পর তোকে আবার লিখতে গিয়ে।
জানিস, আজো কলেজ পাড়ার মোড় দিয়ে যাওযার সময় সেই পুরোনো ছোট্ট লাল ডাকবাকসোটার দিকে চেয়ে থাকি অপলক। ছেলেবেলায় যখন তোর কাছাকাছি- প্যারাডাইস পাড়ায় থাকতাম, তখন ওটার সামনে এসে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে পড়তাম ভাবতাম ইস্! কেউ কি আমার জন্যে কিছু ফেলে না ওতে! ভাবতাম বড় হলে নিশ্চয়ই ফেলবে, আর কেউ না হোক, তোর মতো কোন প্রিয় বন্ধু অন্তত। এখন যখন বড় হলাম তখন আর চিঠি লেখার চল- ই রইলো না, তুইও না; অথচ দেখ কী আশ্চর্য সেই বাকসোটা আজো ধুলোর ওভারকোট পড়ে আমাদের বোবা শহরে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে প্রতীক্ষায় আর যেমনি আমরা থাকি তোর।
আচ্ছা, একসময়তো প্রায়ই দেখতাম নিজের রুমালকে ক্রিকেট বলের স্টাইলে গোল করে করতলে নিয়ে রাস্তাঘাটে হেঁটে চলার সময়ও শ্যাডো প্র্যাকটিস করতিস; এখন আর করিস না, না? ওমনি করে রুমালের বদলে -পেঁজা তুলোর মত মেঘ মুঠো বন্দি করে আকাশে আর ক্রিকেট খেলা যায় না, নারে? এখনও মাঝে মাঝে বড় ইচ্ছে হয় তোর সঙ্গে খুব ক্রিকেট খেলি- স্টেডিয়ামে, আউটার স্টেডিয়ামে নয়তো ঈদগাহ্ মাঠে। ইচ্ছে করে প্রতিপক্ষদের ভীষন ধবলধোলাই দিই।
পাকিস্তানীদের যেমন দিয়েছে বাংলাদেশ। সিরিজ জিতে নিই-ভারতের কাছ থেকে সম্প্রতি যেমন নিল টাইগার বাহিনী। মনে পড়ে ক্রিকেট খেলতে গিয়েই একবার তোর সবচে কাছাকছি আসার সুযোগ হয়েছিল। জীবনে ঐ একবারই উদ্বোধনী জুটি হয়ে নেমেছিলাম তুই আর আমি। গতরাতে ভারতের কাছে শেষ ম্যাচে বাংলাদেশ যেভাবে হেরে গেল! একই দুঃখের পুনরাবৃত্তি হয়েছিল আমাদের বেলায়ও। মাঝে-মধ্যে আমাদের শহরে গেলে এখনও স্টেডিয়ামে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকি কিন্তু ক্রিকেট খেলিনা। আমাদের আর ক্রিকেট খেলা হলোনা রে! জীবন ও মরণের সীমানা ছাড়িয়ে যাচ্ছে আমাদের সব ইচ্ছেগুলো।
সেদিন, হুট করে মাসিমা’র সাথে দেখা হয়ে গেল ক্যাপসুল মার্কেটে। তাঁর চোখের দিকে ভাল করে তাকাতে পারি না! কেমন একটা অপরাধবোধ কুঁড়ে কুঁড়ে খায়, খাবেই না বা কেন, বল? তুই চলে যাবার পর আমরা কদিনই বা খোঁজ নিয়েছি তাঁর। অনেকদিন পর আবার তোকে নিয়ে অনেক কথা হলো- কষ্টের কথা, সুখের কথা! চলে আসবার সময় মাসিমা বারবার করে তোদের বাসায় যাবার কথা বললেন, চুপ করে ছিলেম-মাথা নীচু করে। জানি হয়তো যাওয়া হবে না আর কখনোই – মিছেমিছি কষ্ট বাড়িয়ে কী লাভ, বল? জীবন ও মৃত্যু আমাদের সত্যিই খুব দূরে সরিয়ে দিয়েছে, তাইনারে? খুউব ভালো থাকিস তুই। আমি ভালো নেই…।
ইতি,
তোর বন্ধু জুয়েল
২৬ জুন ২০১৫
দুপুর, ঢাকা 
পুনশ্চ:
আচ্ছা, তোর কি আর ফিরে আসতে ইচ্ছে করে না আমাদের প্রিয় শহরে – কথা বলতে ইচ্ছে করে না আমাদের প্রিয় নদীটির সাথে। ভুলেও কী মনে পড়ে না মাসিমার মুখ অথবা, তাঁর মুখ- চৈত্রসংক্রান্তির দিনে প্যারাডাইস পাড়া দূর্গা মন্দিরের পাশের রাস্তায়, দুষ্টুমির ছলে- আমরা পিছু নিয়েছিলাম সেই যে মায়াবী মুখের-হরিণী চোখের…। ইদানিং মাঝরাতে আচমকা ঘুম ভেঙে গেলে আমারও ভীষণ মরে যেতে ইচ্ছে করে। 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত