| 7 অক্টোবর 2024
Categories
ধারাবাহিক সময়ের ডায়েরি

পদসঞ্চার (পর্ব-৩)

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

২৪ মার্চ । মঙ্গলবার

গতকাল আনন্দবাজার পত্রিকার ‘কলকাতার কড়চা’য় ‘স্মরণাঞ্জলি’ শিরোনামে ‘সোমেন চন্দ ও তাঁর রচনাবলি’ ও ‘সোমেন চন্দের সাহিত্যচর্চা’ বইদুটির উল্লেখ ও নাতিদীর্ঘ আলোচনা আছে। এসব শুভাশিস চক্রবর্তীর কাজ। সে যেন দেনা শোধবার ভার নিয়েছে । অপরে পাওনা আদায় করেছে আগে, আমাদের পরে দেনা শোধবার ভার। সোমেন চন্দকে , এপার বাংলায় তার আবিষ্কারককে শুভাশিস নতুন করে প্রতিষ্ঠা করল।

কাল সকালে সে আমাকে ফোন করেছিল। বলল ‘কলকাতার কড়চা’র লেখাটা দুবার লেখা হয়েছে। প্রথমে ঠিক ছিল ২৭ তারিখে কলেজ স্ট্রিটের ‘বৈচিত্র্য’ হলে যে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হবে, তার সম্বন্ধে লেখা হবে। তারপরে দেখা গেল লকডাউন হয়ে গেছে। রাজ্য সরকার ৩১ মার্চ পর্যন্ত লকডাউন ঘোষণা করেছিলেন,

কেন্দ্রীয় সরকার ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত লকডাউন ঘোষণা করলেন। বাংলাদেশের যশোর থেকে বেনজিন খান, ত্রিপুরা থেকে রামেশ্বর ভট্টাচার্য ও মনীষ চক্রবর্তীর আসার কথা অনুষ্ঠানের অতিথি হিসেবে। তাঁরা জানিয়ে দিয়েছেন তাঁদের পক্ষে আসা সম্ভব নয়। কলেজ স্ট্রিট বন্ধ, গাড়ি-ঘোড়া নেই, সন্ত্রস্ত মানুষ। কেই আসবেন না। তাছাড়া সভার অনুমতিও মিলবে না। তাই শুভাশিস ‘কড়চা’য় বইদুটির উল্লেখ করেছিল। বাবু বা বুলবুল ইসলাম ফোন করে আমাকে বলল, ‘কাকু, বাবা বেঁচে থাকলে আজ খুব খুশি হত। আনন্দবাজারে সোমেন চন্দকে নিয়ে আগে কখনও খবর বা আলোচনা বেরোয় নি।’  ‘বাবা’ মানে আমার প্রিয় বন্ধু মজহারুল ইসলাম। অনেকদিন আগে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।

আমেরিকার ডেট্রয়েট থেকে ফোন করেছিল বাবু। করোনা পরিস্থিতি নিয়ে তার সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা হল। সে বলল আমেরিকায় সংক্রমণ নিয়ে তেমন উদ্বেগ দেখা যাচ্ছে না। প্রেসিডেন্ট তো ব্যাপারটাকে তেমন পাত্তা দিচ্ছেন না। করোনা ভাইরাসকে কখনও ‘উহান ভাইরাস’, কখনও ‘চিনা ভাইরাস’ বলে মশকরা করছেন। বাবুও পরিহাস করে বলল, ‘হয়তো ঠেলার নাম বাবাজি হবে।’

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে বিশ্বে সংক্রমণের সংখ্যা ৩ লক্ষ ৩৩ হাজার। প্রায় ১৫ হাজার মানুষ মৃত্যু বরণ করেছেন।

আস্তে আস্তে অগ্রসর হচ্ছে ভারত। আক্রান্তের সংখ্যা ৪১৫। মৃত্যু এ পর্যন্ত ১৩ জনের।  গোষ্ঠী সংক্রমণ হচ্ছে বা হতে পারে কিনা তা নিয়ে চলছে গবেষণা। আক্রান্তের রাজ্য অনুযায়ী হিসেব = কেরল-৬৭, মহারাষ্ট্র-৬১, দিল্লি-২৯, রাজস্থান-২৭, কর্নাটক-২৬, তেলেঙ্গানা-২৬, পাঞ্জাব-২১, হরিয়ানা-২১, তামিলনাড়ু-৯, পশ্চিমবঙ্গ-৭, চণ্ডীগড়-৫, মধ্যপ্রদেশ-৪, উত্তরাখন্ড-৩, বিহার-২, হিমাচল প্রদেশ-২।

ফেসবুকে বেনজিন খান ও অন্যান্যদের লেখা থেকে জানতে পারলাম বাংলাদেশে প্রথম করোনা সনাক্ত হয় ৮ মার্চ। পর্যন্ত আক্রান্ত ৩৩ জন, মৃত্যু ৩ জনের।

লকডাউন ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে চাল-ডাল-তেল-নুন-মুড়ি-চিনি কেনার হুড়োহুড়ি পড়ে গিয়েছে। সকলেরই বাঁচার তাগিদ। কিন্তু এই ‘সকলে’ কারা ? উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষ। এঁরা চাকরি-বাকরি করেন। কিছু সঞ্চিত অর্থ এঁদের আছে। তাই এঁরা কিছুদিনের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয়  সামগ্রী সঞ্চয় করে রাখতে পারেন।

কিন্তু কি হবে হাসিম শেখ আর রামা কৈবর্তদের!

কি হবে দিন-আনা-দিন-খাওয়া মানুষদের! হাজার হাজার শ্রমিক এক রাজ্য থেকে আর এক রাজ্যে আটকা পড়েছে। কি হবে তাদের জীবন ও জীবিকার! কি হবে যখন নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে কালোবাজারি শুরু হবে! অর্থনৈতিক মন্দা এখন অবধারিত। চাকরি যাবে হাজার হাজার মানুষের।  কি করে দিন গুজরান করবে তারা!

ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী যে গদ্যময়, সেটা অতি বাস্তব। করোনা ভাইরাসের চেয়ে ক্ষুধা ভাইরাস আরও সাংঘাতিক। সেই ক্ষুধার জ্বালায় মানুষ কি মানবে কোয়ারেন্টাইন?

এসব ভাবতে ভাবতে অবশ হয়ে যেতে লাগল শরীর। আর ঠিক সেই সন্ধিক্ষণে মনের ভেতর গুণগুণ করে উঠল কিছু কথা। খাতা-কলম নিয়ে বসে গেলাম। যা লেখা হল, তাকে কি নামে অভিহিত করব জানি না। গদ্যের মতো, কিন্তু ঠিক গদ্য নয়। কবিতার মতো, কিন্তু ঠিক কবিতা নয়। আসলে এই লেখার মধ্যে মনের ক্ষোভ, বিস্ময় বিমূঢতা মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। লেখাটা এইরকম :

পুরাণে পড়েছি মহাপ্রলয়ের কথা ;

এখন দেখছি তার নীরব অবয়ব,

উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিমে দুর্বার গতি,

ভেসে আসছে হাহাকার,

মৃতদেহের স্তূপের সামনে হতবাক মানুষ,

কিংকর্তব্যবিমূঢ।

ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে গর্বোদ্ধত মুখরতা,

বিশ্বজয়ের স্পর্ধিত আস্ফালন,

যেন থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে বসুন্ধরা আচম্বিতে।

জল-ঝড় নেই, ভূমিকম্প নেই, নেই আগ্নেয়গিরির উচ্ছ্বাস ;

দৃশ্যত নেই কোন প্রতিপক্ষ, অথচ প্রতিমুহূর্তে

তাড়া করে বেড়াচ্ছে  অশরীরী আতঙ্ক,

অদৃশ্য এক অনুজীবের নীরব বিভীষিকা।

জনশূন্য রাস্তা, বন্ধ দোকানপাট, অচল সব যন্ত্রদানব ;

প্রহর গুনছে ঘরবন্দি মানুষ, কে কোথায় পালাবে,

কে কাকে বাঁচাবে ব্যাধিগ্রস্ত পৃথিবীতে!

আত্মপক্ষ সমর্থনে শক্তিমানেরা উচ্চকণ্ঠ,

এ ওর দিকে তুলছে আঙুল,

চলছে চাপান-উতোরের খেলা,

আর সেই অবসরে আর এক খেলায় মেতেছে

তাদেরই তৈরি অদৃশ্য আর অমোঘ ফ্রাঙ্কেনস্টাইন।

 

 

[ক্রমশ]

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত