| 7 অক্টোবর 2024
Categories
ধারাবাহিক সময়ের ডায়েরি

পদসঞ্চার (পর্ব-৫)

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

২৭ মার্চ । শুক্রবার । সকাল

করোনা ভাইরাসের কোন প্রতিযেধক নেই। চেষ্টা চলছে আবিষ্কারের। বছরখানেক লেগে যেতে পারে। এখন একমাত্র উপায় সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং।

সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং? মানে সামাজিক দূরত্ব? কিন্তু মানুষ যে সমাজবদ্ধ জীব। সমাজিক দূরত্ব বজায় রেখে তার পক্ষে বাঁচা কি সম্ভব?

আমাদের ছোটবেলার একটা দৃশ্য ভেসে উঠল চোখের সামনে। কাঁথি শহরের থেকে মাইল দুয়েক দূরে খাগড়াবনি গ্রামে আমাদের বাস। সেই গ্রামের প্রান্তে কালিকাপুর গ্রাম লাগোয়া অঞ্চলে নন্দকাকুদের বাড়ি। নন্দকাকু আমার পিসতুতো দাদার বন্ধু। তাঁর ছোটভাই বলাইএর টিবি রোগ ধরা পড়ল। তখন এ রোগের ভালো চিকিৎসা ছিল না। গ্রামের মানুষ নন্দকাকুদের একঘরে করে দিলেন। আমার ছোড়দারাও বন্ধুকে এড়িয়ে চলতেন।

আর বলাই?

সে যদি বাড়ি থেকে বেরোত, তাহলে দূর থেকে লোকে তাকে ইঁট মারত।

করোনার আতঙ্ক আমাদের সমাজে এরকম অস্পৃশ্যতাবোধ জাগ্রত করে তুললে বিপদ। সেরকম কিছু লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি। দেশের বাড়ি থেকে ফোন করেছিল দুর্লভ। সে বলল আমাদের পাশের গ্রামে কিছু লোক ফিরেছে কেরল থেকে। রাতের বেলায় এসেছে বলে গ্রামের লোক দেখতে পায় নি তাদের। সকালে রাষ্ট্র হয়ে যেতে গ্রামের লোক তাদের বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলল। কিন্তু কোথায় যাবে তারা? শেযকালে স্থানী্য় প্রশাসন একটা ব্যবস্থা করল। যারা বাইর থেকে এসেছে তারা ও তাদের বাড়ির লোক দিন পনেরো কুড়ি বাড়ি থেকে বেরোবে না। চালটাল তাদের বাড়ির দোরগড়ায় রেখে দেওয়া হবে।

বারাসতের দিকে এক বাড়ির এক  প্রৌঢ়ের সর্দিজ্বর  হওয়ায় তার ভাই এরা তাদের পরিবার নিয়ে অন্য কোথাও চলে গেছে। মহা ফাঁপরে পড়েছে প্রৌঢ়। তার স্ত্রী পঙ্গু, শয্যাশায়ী। এ অবস্থায় কি করে সে খাবার-দাবার জোগাড় করবে! অসুস্থ মা-কে ছেড়ে ছেলের পালিয়ে যাবার খবরও শুনলাম। ছেলে যদি কৈফিয়ৎ দেয়, ‘কেন, আমি সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখছি!’

এর নাম আতঙ্ক। আতঙ্ক থেকে নিজের নিজের প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করে নেওয়া। বাইরের রাজ্য থেকে যাঁরা আসছেন, আইসিলোশনের ভয়ে তাঁরা লুকিয়ে রাখছেন নিজেদের। তাতে বিপদ বাড়াচ্ছেন আরও। সর্দিজ্বর বা শ্বাসকষ্ট হলেই যে করোনায় আক্রান্ত নয়, এ কথা মানুষকে হয়তো ঠিকমতো বোঝানো হয় নি। সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং বা সামাজিক দূরত্ব বলেও একটা আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়েছে। আসলে বলতে হবে ফিজিকাল ডিসট্যান্সিং বা দৈহিক দূরত্বের কথা। এমন কি গৃহবন্দি থাকলেও পরিবারের সদস্যদের দৈহিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।

করোনা নিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে, কিন্তু করোনার ব্যাপারটা সাধারণ মানুষকে ঠিকমতো বোঝানো হয় নি বলেই মনে হয়। অজ্ঞতা থেকে আতঙ্ক আরও বাড়ছে।

আসুন, আমরা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জৈব প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক কৌস্তভ পাণ্ডার বক্তব্য একটু শুনেনি।

করোনা ভাইরাসের আছে অভূতপূর্ব সংক্রমণ ও মারণ ক্ষমতা। এত ক্ষমতা এর আগে অন্য কোন জীবাণুতে দেখা যায়নি। ভাইরাসটির জিন গঠন থেকে দেখা যাচ্ছে যে, সে আমাদের মধ্যে ছড়িয়ে যাচ্ছে দ্রুত, আমাদের ফুসফুসকে ঝাঁজরা করে দিচ্ছে। মানুষের শরীরে ঘাপটি মেরে সে বসে থাকতে পারে। শরীরের ভেতর ভাইরাস আছে, অথচ ২১ থেকে ২৫ দিন মানুষটির শরীরে রোগের কোন উপসর্গ নেই [ আ্যাসিম্পটম্যাটিক]। এ রকম মানুষকে আমরা ‘লক্ষণবিহীন বাহক’ বলতে পারি।

লক্ষণবিহীন বাহকরা নিজেদের অজান্তে গোষ্ঠী সংক্রমণ ঘটিয়ে যায়। এ ভাবে রোগটি স্টেজ ২ থেকে স্টেজ৩-এ এসে যায়। কথাটা ভাবলে একটু চমকে উঠতে হব বৈকি! আমাদের দেশে এরকম কত ‘লক্ষণবিহীন বাহক’ আছেন ? আমরা জানি না।

‘নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিনে’র এক প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে করোনা ভাইরাস হাওয়ায় বেঁচে থাকে ৩ ঘন্টার বেশি, প্লাস্টিক বা স্টিলে বাঁচে ২-৩ দিন। তার মানে মানুষের মুখ থেকে সরাসরি যেমন ছড়ায়, তেমনি স্টিল বা প্লাস্টিক থেকেও ছড়াতে পারে?

করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য এই মুহুর্তে আমাদের হাতে চিকিৎসাশাস্ত্রগত কোন অস্ত্র নেই। নেই বলেই কি আমরা যুদ্ধের আগেই হেরে বসে থাকব? সংক্রমণের গতিকে রোধ করে দেওয়াই আমাদের একমাত্র কাজ। মডেল হিসেবে আমরা আমাদের সামনে রাখতে পারি ছোট দেশ ভিয়েতনামকে। আমাদের মতোই গরিব দেশ। কিন্তু চিন সীমান্তের কাছাকাছি সে দেশ রুখে দিতে পেরেছে করোনার সংক্রমণের দুর্বার, অপ্রতিহতগতি। চিন থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে থেকেও ইউরোপ আমেরিকা যা পারছে না।

করোনার সংক্রমণের গতিকে রুখে দেওয়ার জন্য :

ক. গৃহবন্দি থাকতেই হবে। ঘরে থাকলেও পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বজায় রাখতে হবে দৈহিক দূরত্ব।

খ. খোলা অবস্থায় পড়ে থাকা কোন জিনিস পরিষ্কার না করে ব্যবহার করা চলবে না।

গ. জরুরি কাজে বাইরে গেলে জামা-কাপড় ও জুতো পরিষ্কার করে নিতে হবে, স্নান করে নিতে হবে গরম জলে।

থাকতেই হবে ঘরবন্দি।

এই প্রেক্ষিতে প্রশ্ন তুলেছেন অনিতা অগ্নিহোত্রী। বলেছেন, ‘বন্দি থাকার ঘর নেই যাঁদের’ তাঁদের কি হবে। গুরুতর প্রশ্ন। এই মুহূর্তে পুরো দেশটাকে রাস্তা থেকে ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া অসম্ভব। ২০১২ সালের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, তখন আড়াই কোটির মতো ঘরের অভাব ছিল। এর মথ্যে আছে গৃহহীন মানুষ, এবং যাদের বাড়ি পড়োপড়ো বা কাঁচা বা অর্পযাপ্ত।

২০১২ সালের পর আর গৃহসংকট বিষয়ক কোন পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। ২০১৮ সালে গৃহ ও নগরী দারিদ্য উন্মূলন বিভাগটি লুপ্ত হয়ে মিশে গেছে নগর বিষয়ক মন্ত্রকের সঙ্গে। শহরে গৃহহীনদের সংখ্যাটা এরকম: দিল্লি—১লক্ষ ৫০ হাজার থেকে ২ লক্ষ; চেন্নাই—৪০ হাজার থেকে ৫০ হাজার; মুম্বাই- ২ লক্ষ; ইন্দোর- ১০ হাজার থেকে ১২ হাজার; বিশাখাপত্তনম-১৮ হাজার; ব্যাঙ্গালোর—৪০ হাজার থেকে ৫০ হাজার; হায়দ্রাবাদ—৬০ হাজার; আমেদাবাদ—১ লক্ষ; পাটনা—২৫ হাজার; কলকাতা –১ লক্ষ ৫০ হাজার; লক্ষৌ—১৯ হাজার।

২০১৯ সালে ভারতে গৃহহীনতার সমস্যা নিয়ে সমীক্ষা করেছিলেন কেরেন ওয়াটস। তাঁর মতে গৃহহীনতা স্বাস্থ্য ও সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি করবে, ‘ By  2025,  42%  of Indians   will live   in urban  areas   and 18  million  will  be  in  need   of  low-income  housing.  Without   their   needs   being  addressed,   the   slum  population   and   the  number  of   those   sleeping  rough  will   increase.   Houselessness   is   a   reflection   of   a   country   dogged  by   inequality   and   addressing  their  vulnearabilities    will   be  a   vital    component   of   the   country’s   social   development–  one   which, for   a fair   society  will  need   to  keep  up  with   economic   growth.’

এর পরে আসে বস্তির কথা। ভারতের চারটি বঢ় শহরে বস্তির জনসংখ্যা এইরকম: দিল্লি—১৮৫১২৩১; চেন্নাই—৮১৯৮৭৩;  বৃহত্তর মুম্বাই—৬৪৭৫৪৪০; কলকাতা—১৪৮৫৩০৯;  অন্যান্য ছোট শহরে—৭০৬৫০৯৭।

বস্তিগুলি ঘনবসতিপূর্ণ, অস্বাস্থ্যকর। এখানে কে কখন আসে ও চলে যায় তার হিসেব রাখা দুষ্কর। এইসব বস্তিতে যদি করোনা সংক্রমণ শুরু হয় তাহলে কে ঠেকাবে?

আজকের খবর পৃথিবীতে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ৫ লক্ষ ৮৬ হাজের। এর একটা বড় অংশ অবশ্য ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স আর আমেরিকার। আমেরিকায় একদিনে মৃত্যু ২ হাজার। ধীরে ধীরে ভারত ও তার প্রতিবেশী দেশগুলিতে করোনার তরঙ্গ লাগছে। ভারতে আক্রান্ত ৮৩০, মৃত্যু ২০ জনের। বাংলাদেশে আক্রান্ত ৪৮, মৃত্যু ৫। পাকিস্তানে আক্রান্ত ১৪৯৫, মৃত্যু ১২। শ্রীলঙ্কায় আক্রান্ত ১১০।

পাশের বাড়ির অনুপ ডাকল। প্রাচীরের এপার থেকে কথা হয় আমাদের দুই বাড়ির। অনুপের ছেলে অর্ক অভিমান করেছে। রবিবার তাকে বলেছিলাম বাড়ির বাইরে না বেরোতে। ছোটছেলে, সে ভাবল জেঠু তাকে তার বাড়িতে আসতে বারণ করেছে। তাই সে ঘরের চৌকাঠ মাড়ায় না। তার ধারনা, দিনকয়েক পরে খুলে যাবে তার স্কুল। আবার বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হবে। দীর্ঘদিন অবরুদ্ধ থাকলে বাচ্চাদের মনে অবসাদ সৃষ্টি হতে পারে। হচ্ছেও কিছুটা। পড়ুয়াদের অনলাইনে পড়ানোর কথা  শুনছি। কিন্তু আমাদের মতো দেশে সেটা খুব কার্যকর হবে বলে মনে হয় না। আর একটা জিনিস শুনছি। ঘরবন্দি জীবনে দেশে চুরি-ডাকাতি কমে গেছে। কিন্তু বাড়ছে নাকি ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স। মনে হয় এটা আমাদের মতো সাধারণ ঘরের ব্যাপার নয়। যেসব বাড়ির পুরুষ-নারী স্বভাবত বাহিরমুখী, দিনান্তে যাদের পার্টি-ফার্টিতে কাটে, অবরুদ্ধতা তাদের ভায়োলেন্ট করে তোলে।

অনুপ বলল, ‘দাদা, কিছু চাল তুলে রাখি। দাম কিন্তু বাড়ছে। আর সেই সঙ্গে কিছু ডাল আর তেল।’

আমি হাসলাম। বললাম, ‘বৌদির সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নাও।’

সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতাটা মনে পড়ে গেল। ‘ ফাটা ডিমে আর তা দিয়ে কি ফল হবে?’

অনুপ হাসতে হাসতে বলল, ‘এ সময় ভিয়েতনাম বা তাইওয়ানে চলে যেতে পারলে ভালো হত।’ মন্দ বলে নি কথাটা।

চিনের কাছাকাছি দুটি দেশ। অথচ তারা করোনাকে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখতে পেরেছে তাদের দেশের সীমানায়, ঢুকতে দেয় নি। কত দূরের দেশ ইতালি. স্পেন, ফ্রান্স আর আমেরিকা; সেসব দেশে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে করোনা।

 

 

[ক্রমশ]

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত