পদসঞ্চার (পর্ব-৬)
২৭ মার্চ । শুক্রবার । বিকেল ৪টা
একটা অণুজীব, খালি চোখে দেখা যায় না যাকে, সে বিশ্বে ঘটিয়ে চলেছে প্রলয় । কেউ কি বুঝতে পারে নি তার আবির্ভাবের কথা ? পারে নি অনুমান করতে ? ছিল কি পূর্বাভাস ?
ছিল বৈকি, বলছেন কেউ কেউ ।
কেউ বলছেন বাইবেলের ‘বুক অফ রেভেলেশনের’ কথা । সেখানে নাকি ছিল এই মহাপ্রলয়ের কথা । সেই বাইবেলের ‘এন্ড অফ ডেজ’ পড়ে দেখ । খুঁজে পাবে আজকের করোনাকে । আরে, পৃথিবীর শেষ লগ্নে যে চার অশ্বারোহীর কথা আছে, তার একজন তো আজকের করোনা ।
কেউ টেনে আনছেন নস্ত্রাদামুসকে । ষোড়শ শতকের ইতালীয় মিস্টিক নস্ত্রাদামুস । নানা বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করে তিনি যেসব কথা বলেছিলেন, গ্রন্থাকারে তা প্রকাশিত হয় ১৫৫৫ সালে । তিনি নাকি সাংকেতিকভাবে করোনা মহামারীর কথা বলে গিয়েছিলেন ।
কেউ আবার বাবা ভাঙ্গারের কথা বলছেন । ইনি বুলগেরিয়ার ভবিষ্যৎ বক্তা । ইনি বলেছিলেন আফ্রিকায় নেমে আসবে এক ভয়ংকর মহামারী । আফ্রিকার জায়গায় হয়েছে চিনে, এই যা ।
১৯৮১ সালে মার্কিন লেখক ডিন কুন্টজ একটা বই লেখেন । নাম ‘দি আইজ অফ ডার্কনেস’ । সে বইতে ‘উহান-৪০০’ নামে এক ভাইরাসের কথা আছে । লেখক বলেছেন এই ভাইরাস পৃথিবীতে আনবে মহামারী ।
প্রসঙ্গত এসে পড়ে সিলভিয়া ব্রাউনের কথা । ২০০৮ সালে তিনি লেখেন ‘এন্ড অফ ডেজ : প্রেডিকশনস আ্যান্ড প্রফেসিজ’ । এতে তিনি বলেছিলেন ২০২০ নাগাদ ফুসফুস ও শ্বাসনালীর সংক্রমণজনিত মহামারীর কথা ।
মার্কোর নামও আজ অনেকের মুখে ঘুরছে । বছর সাতেক আগে ইনি নাকি টুইটারে করোনা মহামারীর ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন ।
এসব ভবিষ্যদ্বাণীকে গ্রাহ্য না করলেও গ্রাহ্য করতে হয় বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞানকর্মীদের কথাকে । করোনাই যে আসবে, সে কথা তাঁরা বলেন নি । এরকম নির্দিষ্ট করে, তথাকথিত ভবিষ্যৎ বক্তাদের মতো বলা যায় না বলেই বলেন নি তাঁরা । কিন্তু আগামী দিনে এরকম মহামারী যে আসতে পারে সে কথা তাঁরা বলেছিলেন ।
বিল গেটস তো কয়েক বছর ধরে মহামারীর সতর্কতা দিচ্ছিলেন । বলেছিলেন যদি ২০১৫ সালে মহামারী হয়, তার জন্য পৃথিবী তৈরি নয় । ২০১৮ সালে ম্যাসেচুটেস মেডিকেল সোসাইটি ও নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন আয়োজিত সভায় তিনি বলেছিলেন পরের দশকে সম্ভাব্য মহামারীর কথা, ‘ In the case of biological threats , the sense of urgency is lacking . The world needs to prepare for pandemics in the same way it prepare for war’ .
সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ মাইকেল ওস্টারহোম ২০০৫ সালে ‘ফরেন আ্যফেয়ার্স’ পত্রিকায় পরবর্তী মহামারীর জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছিলেন । ২০১৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর বই ‘ ডেডলিয়েস্ট এনিমি : আওয়ার ওয়ার এগেনস্ট কিলার জার্ম’ । এতে তিনি বলেছিলেন এই মারণ জীবাণুর ব্যাপারে আমেরিকা সতর্ক নয় ।
ভাইরোলজিস্ট ও ফ্লু বিশেষজ্ঞ রবার্ট জি ওয়েবস্টার তাঁর বই ‘ফ্লু হান্টার : আনলকিং দি সিক্রেটস অফ আ ভাইরাস’ বইতে বলেছিলেন আর একটা ভয়ংকর মহামারী আসতে চলেছে, শুধু সময়ের অপেক্ষা—‘ It is just a matter of time’ .
আমেরিকার ফরেন ডিজাসটার আ্যসিসট্যান্স বিভাগের প্রাক্তন ডাইরেক্টর জেরেমি কোনিয়ানডেক বলেছিলেন ২০১৮ সালের ফ্লু ভাইরাসের মতো এক ভয়ংকর ভাইরাস আর্বিভূত হতে পারে ।
ম্যাসেচুসেটসের জনস্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালকেরা এক দশক আগেই নতুন ধরনের এক শ্বাসযন্ত্রের অসুখের আর্বিভাবের কথা বলেছিলেন ।
তার মানে বিজ্ঞানের সতর্কবাণী ছিল । কিন্তু রাষ্ট্রনেতারা তাকে গ্রাহ্য করেন নি । লাভ ও লোভের আকর্ষণে চালিত হন তাঁরা । বর্তমানের কথা ভাবেন, আগামী দিনের কথা ভাবেন না । নিজেদের কথা ভাবেন, ভাবেন না মানুষের কথা । মহামারী এলে, বিপর্যয় এলে সাধারণ মানুষই বেশি মরে, কষ্ট পায়, হাহুতাশ করে ।
মোবাইল ফোন বেজে উঠল । ফোনে মামনির নাম । ফোন তুলতে সে বলল , ‘ বাবা, আমি দাঁড়িয়ে আছি, দরজা খোল ।’
প্রথমে ভাবলাম রসিকতা করছে । এরকম অচলাবস্থায় সে আসবে কি করে ! পর্ণশ্রী থেকে তার শ্বশুরবাড়ি সোদপুরের দূরত্ব ৬ মাইলের কম নয় । দোতলা থেকে তাকিয়ে দেখে বুঝলাম, না, রসিকতা নয় । সত্যই সে হাজির হয়েছে । কাল আমার জন্মদিন তাই ।
তালা খুলে তাকে ঘরে ঢুকিয়ে জানতে চাইলাম সে এল কি করে ! সে বলল, ‘রিক্সা চলছিল । গলি দিয়ে আসা যেত । কিন্তু সেটা রিস্কি হত । তার চেয়ে হেঁটে আসা ভালো ।’
তার মা বলল, ‘ কেমন দেখলি রাস্তাঘাট ?’
সে বলল, ‘ তবু অলি-গলিতে দু-একজনের মুখ দেখতে পাওয়া যায়, কিন্তু ডায়মন্ড হারবার রোড একদম ফাঁকা । গা ছমছম করার মতো ।’
জামা-কাপড় ছেড়ে, গরম জলে স্নান করে সে এসে বসল বৈঠকখানায় । তারপরে হাসতে হাসতে বলল, ‘বোধহয় বেকার হয়ে গেলাম । আমাদের মতো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অনেকেরই চাকরি যাবে । দুমাসের মাইনে দিয়ে দিয়েছে, এটাই ভাগ্য ।’
আরতি বলল, ‘১৪ এপ্রিল পর্যন্ত লকডাউন । তারপরে দেখবি সব স্বাভাবিক হবে ।’
মামনি বলে, ‘পাগল নাকি ! যেভাবে দেশে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, তাতে লকডাউন তাড়াতাড়ি উঠবে বলে মনে হয় না । কেরল, মহারাষ্ট্র, দিল্লি, রাজস্থানের অবস্থা দেখছ না ! বাড়বে আমাদের রাজ্যেও । পরীক্ষাও ঠিকমতো হচ্ছে বলে মনে হয় না । অনেকে আবার ঘাপটি মেরে ঘরে বসে আছে । কেন্দ্রীয় সরকারের টনক নড়েছে অনেক পরে । ২৩ মার্চ । কেরল আর পশ্চিমবঙ্গ সরকার করোনার ব্যাপারে সচেতনতার প্রচার চালাবার পরে । এমন কি সংসদও চালিয়ে গেছেন । মার্চের প্রথম থেকে লকডাউন শুরু করলে পরিস্থিতি এত ঘোরাল হত না ।’
আমাদের সব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আছে কিনা জানতে চাইল মামনি । বলল, ‘ আমি অন লাইনে কিছু অর্ডার দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম । কিন্তু সার্ভিস বন্ধ । কিন্তু তাই বলে তোমরা একদম বাইরে বেরিও না ।’
আরতি আমাকে ইঙ্গিত করল কিছু না বলার জন্য । সে যে মাঝে মাঝে বেগরখালের বাগানে গিয়ে সবজি আনছে, সে কথা বলা চলবে না মামনিকে ।
আমি বললাম, ‘আমাদের বেরোতে না বলছিস, কিন্তু তুই তো বেরোচ্ছিস ।’
সে বলল, ‘ করোনা ভাইরাস কিন্তু বড়োদের বেশি হচ্ছে, তাদের কাবু করছে বেশি ।’
আমি বললাম, ‘আমাদের দেশের ক্ষেত্রে কিন্তু ব্যাপারটা রকটু অন্যরকম । ৪০/৪৫ বছরের মানুষ বেশি আক্রান্ত হচ্ছে । কেন জানিস ?’
-‘কেন ?’
-‘ কারণ আমাদের দেশে এখনও ছেলে-মেয়েরা বুড়ো মা-বাবার কেয়ার করে । এই যেমন তুই ও তোর ভাই আমাদের উপর বাইরে না বেরুবার হুকুম জারি করেছিস । আমাদের দেশে কমবয়েসিরাই চাল-ডাল- ওষুধপত্র আনার জন্য বাইরে বেরুচ্ছে । তাই তারা করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে বেশি ।’
আরতি বলল, ‘ কাল তোর বাবা ইতালির একটা ভিডিও দেখাচ্ছিল । দেখলাম এই অবস্থাতেও সেখানে বুড়ো মানুষেরা বাজারে বেরিয়েছে । কি করবে, সে সব দেশের নিয়ম অনুযায়ী প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে গেলে ছেলে-মেয়ে আলাদা থাকে যে !’
মামনি বলল, ‘ ইতালি আর স্পেনের অবস্থা ভয়াবহ । সেসব দেশে প্রৌঢ় মানুষের সংখ্যা খুব বেশি ।
সিলভার সুনামির ঢেউ । তাছাড়া সতর্কও হয় নি তারা । সেজন্য আমেরিকাকেও মাশুল দিতে হবে । বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে আমেরিকা আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যায় ছাড়িয়ে যাবে সবাইকে। এদের একটা কেয়ার-ফ্রি মনোভাব ছিল ।’
মামনি বলল, ‘ বাবা, তোমার কি মনে হয় এই ভাইরাসটা কোন ল্যাবে তৈরি নয় ?’
তার মানে ষড়যন্ত্রতত্ত্ব ! যেটা এখন ঘুরছে সোশ্যাল মিডিয়ায় । চেষ্টা করব এটার উপর কিছু আলোকপাত করতে ।
[ ক্রমশ ]
![দিলীপ মজুমদার](https://irabotee.com/wp-content/uploads/2022/12/10806374_1509715065966249_665369-150x150.jpg)
গবেষক