| 14 মার্চ 2025
Categories
ধারাবাহিক লোকসংস্কৃতি

নারী পুরুষের মিলন কাহিনী (পর্ব-৮)

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

বিবাহ  মানব সমাজের প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠান। যুগে যুগে প্রতিষ্ঠানটি এর আদি রূপ থেকে বর্তমান কাঠামোয় উপনীত হয়েছে। বিবাহপ্রথাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে প্রধানত ধর্ম। বিয়েসংক্রান্ত সকল নিয়মকানুন বিধিবদ্ধ হয়েছে ধর্মীয় অনুশাসনে। প্রাচীনকাল থেকে বাংলায় ধর্মীয় শাস্ত্রের বিধানই ছিল সামাজিক আইন, ধর্মীয় আইনের দ্বারাই শাসিত হতো সমাজ-সংসার। ধর্মীয় এবং রাষ্ট্রীয় আইনের পাশাপাশি লোকজ সংস্কৃতিও বৈবাহিক জীবনকে প্রভাবিত করেছে নানাভাবে। মনুস্মৃতি এবং অর্থশাস্ত্রে আট প্রকারের হিন্দু-বিবাহ পদ্ধতির উল্লেখ আছে। ‘ব্রাহ্ম’, ‘দৈব’, ‘আর্য’, ‘প্রজাপত্য’, ‘অসুর’, ‘রাক্ষস’, ‘পৈশাচ’ ও ‘গান্ধর্ব’ এই আট ধরনের বিবাহের মধ্যে ব্রাহ্ম বিবাহই শুধু গ্রহণযোগ্য ছিল। দায়ভাগ গ্রন্থে জীমূতবাহন উল্লেখ করেছেন যে, ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য, প্রজাপত্য এবং গান্ধর্ব বিবাহ অনিন্দনীয়। ধর্মশাস্ত্রের বিধান অনুযায়ী নিজ বর্ণের মধ্যে বিবাহ ছিল সাধারণ নিয়ম। সবর্ণে বিবাহ উৎকৃষ্ট হলেও মনু ব্রাহ্মণ পুরুষকে নিজ বর্ণ ছাড়া নিম্নতর তিন বর্ণে বিবাহের অধিকার দিয়েছিলেন। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে, যেমন চন্ডীমঙ্গলে, মুসলমানদের নিকা বিবাহের কথা বলা হয়েছে। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে, এমনকি বিশ শতকেও মুসলমানদের মধ্যে বহুবিবাহ ব্যাপক হারে প্রচলিত ছিল। উচ্চশ্রেণীর অবস্থাপন্ন মুসলমানদের একাধিক স্ত্রী থাকত। বিশ শতকের শুরুতে কুলীনদের বাইরে হিন্দু সমাজে বহুবিবাহ তেমন প্রচলিত ছিল না। বিয়ের এমন অনেক জানা অজানা বিষয়ে আলো ফেলেছেন ড. রোহিণী ধর্মপাল তাঁর এই ধারাবাহিক ‘নারী-পুরুষের মিলন কাহিনী’-তে। আজ থাকছে নারী-পুরুষের মিলন কাহিনীর ৮ম পর্ব।


যে কাহিনীর আভাস দিয়ে শেষ হয়েছিল সপ্তম পর্ব, সেই যযাতির গল্পের শুরুতে আসি। অবশ্য একা যযাতির গল্প নয়, বরং অসাধারণ একটি প্রেমের গল্প রূপে বর্ণনা করা যায় এটিকে।  Tragedy প্রত্যাখ্যান প্রেম ঈর্ষা হত্যা  বিশ্বাসঘাতকতা যৌনতা সব রয়েছে কচ-দেবযানী এবং শর্মিষ্ঠা-যযাতির এই গল্পে। যাকে কিনা বলে পুরো মসালা মুভি!!! টলিউড বলিউড সব ঝাঁপিয়ে পড়বে জানলে। চূড়ান্ত রোমান্টিক । গা ছমছমে । রগরগে। কষ্টের । চলুন, সিনেমাটা, থুড়ি, গল্পটা শুরু করা যাক্।
দেবাসুরের যুদ্ধ । দৈত্যদের গুরু শুক্রাচার্য্য সঞ্জীবনী বিদ্যার সাহায্যে মৃত দৈত্যদের বাঁচিয়ে তুলতেন। অথচ দেবতাদের গুরু বৃহস্পতি তা পারতেন না। এইখানে এট্টু নিজের একটা ধারণা ভাগ করে নি। lord of the rings– এই বিখ্যাত হলিউডি মুভিতেও এইরকম দুই গুরু ছিলেন দুই যুযুধান দলের, সেখানেও এই রকম দেবাসুরের যুদ্ধ ছিল, সেই যুদ্ধে মানুষ আর প্রকৃতিও জুড়ে গেছিল। ঠিক আমাদের পুরাণের গল্পগুলোর মতোই কিন্তু । তাই না? যাক্ গে, আবার নিজেদের গল্পে ফিরি।
তা এই শুক্রাচার্য্যের কাছ থেকে এই মরা বাঁচানোর বিদ্যে শিখতে হবে। তাই বাছা হল বৃহস্পতির পুত্র কচকে। কচ কেন? না সে অল্পবয়সী, সেইটেই প্রধান গুণ বলে বিবেচিত হল, কেননা, শুক্রাচার্য্যের একটি কন্যা আছে, দেবযানী । নবীন যুবকের সাহচর্যে সে মুগ্ধ হবে, তাকে সন্তুষ্ট করতে পারলেই তো কেল্লাটি ফতে হবে। এই পরিকল্পনা করে কচ রওনা দিলেন শুক্রাচার্য্যের বাড়ি । যেখানে রয়েছেন নিষ্পাপ সরল মনের দেবযানী, বেচারি জানেনই না, তাঁকে কেন্দ্র করে, তাঁর মনকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলার blueprint তৈরি হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই । আর তার বাস্তব প্রয়োগ করতে আসছেন সুদর্শন কচ।
কচ এলেন। দেখলেন । এবং নিজের কাজ প্রবলবেগে শুরু করে দিলেন । অর্থাৎ দেবযানীর মনোরঞ্জন । নাচ গান করে বাজনা-টাজনা বাজিয়ে একাক্কার। দেবযানী যা বলছেন, কচ তৎক্ষণাৎ পালন করছেন। গাছের একেবারে মগডালের ফলটি পেড়ে দেওয়া, রঙিন সব ফুলের গুচ্ছ নিয়ে আসা সববব। একটি মেয়ে, যে বাবার সঙ্গে একাই থাকে, সঙ্গী নেই; সে এমন একটি সুন্দর ছেলেকে যদি কাছে পায়, যার এত গুণ, মিষ্টি মিষ্টি করে কথা বলে, সর্বদা ফিটফাট,  সাজে-সজ্জায় নিপুণ,  যা বলা হয় তাই শোনে; তার প্রেমে না পড়ে উপায় কী! দেবযানীও পড়লেন, প্রেমে। তিনিও কচকে পাওয়ার আশায় নির্জনে তাঁকে গান শোনাতে লাগলেন, তাঁর সেবা করতে আরম্ভ করলেন। ওহে দুর্বলহৃদয় কন্যারা, কোনো পুরুষ যদি হঠাৎ করে খুব ভালো ব্যবহার করতে শুরু করে, সহজে গলে যেও না! তার পিছনে অনেক কথা লুকিয়ে থাকতে পারে!
যাক্,  দেবযানীকে ভোলাতে পারলে কি হবে, দৈত্যরা বুঝে গেল কচের উদ্দেশ্য, তাদের হৃদয় তো আর দেবযানীর মত কোমল নয়। তারা কচকে পাকড়াও করে স্রেফ কুচি কুচি করে কেটে কুকুরকে খাইয়ে দিল। দেবযানী কচের দেরি দেখে মনের শূন্যতা অনুভব করলেন, বুঝলেন কচকে ছাড়া বাঁচা কঠিন! সুতরাং মেয়ের জন্য শুক্রাচার্য্য কচকে বাঁচিয়ে দিলেন সেই মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যা দিয়ে। আবার মরল কচ। আবার বাঁচল। তৃতীয় বার দৈত্যরা কচকে মেরে পুড়িয়ে তার ভস্ম মদের সঙ্গে মিশিয়ে শুক্রাচার্য্যকে খাইয়ে গেল। আর এইখানেই ভুল চাল চেলে ফেলল ওরা।
 দেবযানীকে শুক্রাচার্য্য অনেক বুঝিয়েও কচকে পাওয়ার ইচ্ছে থেকে নিরস্ত করতে পারলেন না। বাবার সামনেই দেবযানী বললেন, কচকে ছাড়া বাঁচতে পারব না। প্রেমকে স্বীকার করতে মেয়েরাও পারে। অনেকে বলেন, পুরুষ হল সত্যিকারের প্রেমিক। নিজের প্রেমকে সবার সামনে মেনে নিতে দ্বিধা করে না। অথচ জীবনের অভিজ্ঞতা বলে, রামায়ণ  মহাভারতের নানা কাহিনীও বলে পুরুষের প্রেম দীর্ঘদিন থাকে না, পুরাতন প্রেমকে সরে যেতে হয়। আবার দুর্বলচিত্ত ভিরু বলা হয় যাদের, তারা প্রবল প্রতাপের সামনেও নিজের ভালোবাসার কথা দ্বর্থ্যহীন ভাবে বলতে পারে। যেমন বলেছিলেন কাশী রাজকন্যা অম্বা। ভীষ্ম যখন ভাইয়ের বিয়ে দেওয়ার জন্য কাশীরাজার তিন মেয়েকে স্বয়ংবর সভা থেকে অপহরণ করে নিয়ে এলেন, তখন যে ভীষ্মের সামনে সমস্ত শক্তি ম্লান হয়ে যায়, তাঁর সামনে অম্বা বললেন তাঁর পূর্বরাগের কথা, মহারাজ শাল্বের সঙ্গে। তিনি বললেন যে তিনি মনে মনে শাল্বকেই পতি রূপে নির্বাচন করেছেন। এই কথা বলতে এতটুকু কুন্ঠিত হন নি তিনি, অথচ সব জেনে ভীষ্ম যখন তাঁকে শাল্বরাজার কাছে পাঠিয়ে দিলেন, পরাক্রমশালী ভীষ্ম অসন্তুষ্ট হতে পারেন ভেবে শাল্ব অম্বাকে প্রত্যাখ্যান করলেন।
দেবযানীর গল্পে ফিরি আবার। মেয়ের ভালোবাসার কথা শুনে বিচলিত শুক্রাচার্য্য আবার প্রয়োগ করলেন সঞ্জীবনী বিদ্যার । কচ বেঁচে উঠলেন, তবে শুক্রাচার্য্যের পেটের ভেতর। কচকে বাঁচাতে গেলে শুক্রাচার্য্যের প্রাণ যায়!!! তাও তো দেবযানী হতে দিতে পারেন না। তাই শেষ পর্যন্ত এইভাবে কচের উদ্দেশ্যে সফল হল। শুক্রাচার্য্য কচকে সঞ্জীবনী বিদ্যা শেখালেন। শুক্রাচার্য্যের পেট চিরে কচ বেরিয়ে এলেন আর সদ্য শেখা সঞ্জীবনী বিদ্যা প্রয়োগ করে গুরুকে বাঁচিয়ে তুললেন ।
 এইবার তো কাজ হাসিল হয়ে গেছে, সুতরাং গুরুগৃহে থাকার দিনও অচিরেই ফুরিয়ে এল। এবার দেখুন, দেবযানী কচকে propose করলেন। সরাসরি বললেন তুমি মন্ত্রপাঠ করে যথাবিহিত ভাবে  আমার পাণিগ্রহণ কর; অর্থাৎ সোজা কথায় আমাকে বিয়ে কর। কিন্তু কচের তো অনুরাগ তৈরি হয় নি, কচ তো যা করেছেন জেনেবুঝেই করেছেন, সুতরাং নানা অছিলা দেখিয়ে কচ দেবযানীর কাতর অনুনয় প্রত্যাখ্যান করলেন। বেচারি দেবযানী বারবার বললেন, যে তুমি জানো, তোমাকে আমি কতখানি ভালোবেসেছি, স্নেহ করেছি। আমার তো কোনো অপরাধ নেই। আমাকে ত্যাগ করো না। কিন্তু হায়, নিষ্ঠুর কচের মনে দেবযানীর ভালোবাসার আহ্বান কিছুই দাগ কাটতে পারল না। তখন ক্রুদ্ধ দেবযানী অভিশাপ দিলেন কচকে, যে সঞ্জীবনী বিদ্যা শিক্ষার জন্য কচ এমনভাবে ব্যবহার করলেন দেবযানীর সঙ্গে, সেই বিদ্যা কচ কারুর উপর প্রয়োগ করতে পারবেন না।
 আর কচ কি বললেন? কচ ভয়ানক রূঢ়তার সঙ্গে দেবযানীর প্রেমকে কাম বানিয়ে দিলেন। দেবযানী কামপ্রণোদিত হয়েই নাকি অভিশাপ দিয়েছেন। তাই তিনিও বললেন যে দেবযানীর ঋষিপুত্রের সঙ্গে কখনো বিয়ে হবে না।আর সঞ্জীবনী বিদ্যার প্রয়োগ তিনি করতে না পারলে কি হবে, শেখাতে তো পারবেন! এই বলে তৎক্ষণাৎ সেখান থেকে বেরিয়ে এলেন। নিজে পরিস্থিতি সামলাতে না পারলে একটি মেয়েকে ‘তোমার কাম অতিরিক্ত, তাই তোমার এমন নির্লজ্জ ব্যবহার নির্লজ্জ উক্তি’, একথা অনেক মেয়েকেই শুনতে হয়, এখনও। দেবযানীও স্তব্ধ হয়ে শুনলেন!
তবে, দেবযানীর দুঃখ ফুরোয় নি এখনও। বাকি আছে আরোও যন্ত্রণা।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত