সাবিত্রী সাঁঝের বাতি জ্বালিয়ে শঙ্খের ফুঁ দিচ্ছিলো।তার দর্মার বেড়া দিয়ে ঘেরা টিনের চালার হরপার্বতীর মন্দিরে।গ্রামগঞ্জের আকাশ বাতাস মুখরিত হয় প্রতিদিন সন্ধ্যার পর এই শঙ্খধ্বনি উলু কাঁসর ঘন্টার বাদনে।গোধূলির আজানের ধ্বনিতেও যেন করুনার সুর ফুটে ওঠে জগতাগাঁওয়ের আকাশে।সাবিত্রীর কয়েক বছর ধরে কেন জানিনা এই শঙ্খের ধ্বনি কেমন যেন করুণ সুরে তার কানে বাজে!মনে হয় যেন কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে প্রতি ঘর থেকে। সাবিত্রীর মনে হয়।জানেনা, অন্য কারো এরকম মনে হয় কিনা!টিনের চালা দিয়ে বর্ষার জল পড়ে,দুটো বর্ষা গেল পার হয়ে, পাল্টাতে পারেনি।বাবা মহাদেবের মাথার উপরে চাঁদোয়া সেই জলে মলিনাক্ত পচে গিয়েছে প্রায়, কিন্তু কি করবে?বাবা তো তাদের ওপর নজর করেনি এতোদিনে এই একটিবারে।যতো অভিযোগ আজ সাবিত্রীর এই বুড়ো বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে পড়ে। সাবিত্রীর বুকটা ধড়ফড় করে শুকিয়ে আসে।
নিত্য বছর মহাজনের টাকাই শুধতে পারেনা ঠিকমতন।ধারের ওপর ধার।দাদনের দেনায় জর্জরিত।সম্বৎসর খাবে কি? বাঁচবে কি করে?ছেলেপুলে মেয়ে বৌ নিয়ে।আজ পুরো টমাটোই বস্তা বস্তা ধরে রাগে দুঃখে রাস্তায় ফেলে দিয়ে এসেছে যতীন,মাথা গরম করে ঘরে ঢোকে সে।যতীন হাঁক পাড়ে,ও সাবী কোথায় গেলি?গোয়ালে চারে জাবনা দিতে গেছিলো সাবিত্রী,ওখান থেকেই হাঁক পাড়ে,বলি কি হয়েছে গো!আসছি গো, আসছি।
নে, সাবী আজ উপাস দিয়ে মর!টমাটর বেঁচতে পারলাম নি।যা দাম দেয় ফড়ের রা ওতে আমার চাষের পয়সাও আসবে নি।তো দিলাম ফ্যালায় বড়ো রাস্তায়।
ও মা সে কি গো।ও বেচে দুইটা পয়সা পেলি তো উপাস দিতি হতো না।তুমার এই মাথা গরমডা আমি মাইনতে পারি না।
ক্যান? শালা বাইন্চোতগুলানের,বেজন্মা গুলানের হাতে মাইগনা রক্ত জল করা ফসল তুলে দিবো!দিবোনা,ফ্যালায় দিলাম গরু ছাগল খাবে।
সাবিত্রীর শরীর হিম হয়ে আসে।আশায় মরে চাষা।এতো তাদের এখন প্রতি বছর রোজ নামচায় পরিণত হয়েছে।আমাদের নাকি কৃষিপ্রধান দেশ।কতো কী শোনা যায় ঐ ন্যাতাগুলানের কথায়। সাবিত্রীও বোঝে এই রাজনীতির ধরনধারন।এই দেশের আর্থ-সামাজিক কাঠামোর এই ঘুনেধরা অসুখের মেরামত করবে কে? বরং যুগযুগ ধরে ক্রমাগত ধ্বসেই পড়ছে।আর এদের ভোটের সাংখ্যাধিক্যে এই বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় অনেক স্বপ্ন দেখিয়ে এক এক করে নতুন সরকার আসছে আর ক্ষমতা ভোগ করে নিজেদের গুছিয়ে নিচ্ছে। কৃষকদের ভোট তো ক্ষমতা দখলের বড়ো অস্ত্র।যেহেতু এই কৃষি প্রধান দেশের শতকরা পঁচাত্তর ভাগ কৃষক।সাবিত্রীর মাথায় চক্কোর দিয়ে ওঠে।পড়ে যাচ্ছিলো,যতীন দৌড়ে এসে ধরে।
ও সাবী চিন্তে করিস না! মকবুলের কাছে যাচ্ছি আমাদের না খেয়ে থাকতি হবি না।ও ঠিক একটা ব্যবস্থা করে দিবে।
আগে মুঙ্গলীকে বেচে ছিলো চোখের জলে।মাঠের দুবিঘা মাটি বেচে দিয়ে বড় মেয়েটার মেয়ে দিয়েছিলো।বড় রাস্তার দিঘীর পাড়ের সাধের চারকাঠা জমি বেচে সাবিত্রীর অসুখ,বড় ছেলেটার কলেজের খরচ,নিজেদের খাই খরচা এবং আরও কিছু মিটিয়ে এসেছে এতোদিন।এখন এই বাস্তুভিটে আর তার সহায় সম্বল এই দুবিঘে চৌদ্দ পুরুষের জমি।শেষে এটিতে না হাত পড়ে।
যতীন অনেকটা রাতে চাল ডাল আটা তেল মশলাপাতি ইত্যাদি নিয়ে ঘরে ফেরে। সাবিত্রী শুয়েই ছিলো।বড়ছেলে মতীন মায়ের মাথার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলো তখন।নির্বাক ভারতবর্ষের এই প্রজন্ম!
চাষ করে হবেডা কি বল সাবী?যা দিয়ে তোদের পেতিপালন করছি, আর পারি না রে!লক্ষ্মী এক এক করে সব বেড়োয় যাচ্ছে!
ত করবেডা কী শুনি?
আমি লোক ধরছি। কথা হলো বেবাক।মকবুল ভাই কথা কইয়ে দিছে।মতীন আর আমি আরব এ যাবো।ছমাস অন্তর আইতে পারলেও যা টাকা আসবে তা দিয়া আমাদের চইলে যাবে।লখ্খীরে বেচতে হবে না।এবারে আর তুমার বুড়াবুড়িরে পুজা দিতে হবিনা।এবারে আর বাচ্ছিক কইরতে হবিনা।বুড়া আমাদের দেখলো না,আর আমরা দেখবো বুড়ারে!
না গো অমন কথা মুখে আনতি নাই। খুব কাঁপা গলায় বললো সাবিত্রী। তুমি এ ঘরবাড়ি বেঁচে রামনগরে হাটে গিয়া একটা দুকান কিনো।আমরা দুবিঘা থেকে বাঁচবার জন্য ঐ দুকাঠা জমি কিনা একখান বসত বাড়ি নিয়া বাঁচবো।চলো।তাই করি গা।চোদ্দোপুরুষরে বিসোজ্জন না দিলি আমরা বাঁচতে পারবো না!তোমাদের আমাদেরকে ফেলায় কোথাও অন্য দেশে যেতি হবে না।ওতে সব্বোনাশ ই ঘটে গো।
যতীনের ঐ নেতাদের কথাগুলি মাথায় ঘোরে- তেভাগা,কৃষক আন্দোলন কত কী!কত কি শিখিয়ে শিখিয়ে তাদের আরও মূমূর্ষু বানিয়ে ওরা আমাদের নতুন ভারতের,কৃষকদের স্বপ্নের ভারতের দিশা দেখায়।তবে ভোট এলে আরও বেশী ঐ স্বপ্ন ভেসে আসে।নেতারা শহর থেকে আসে আবার শহরে ফেরে।কিছু দুঃখ এখানে ছড়িয়ে,কিছু আশা দেখিয়ে।আর যতীন,সত্যেন,মকসুদরা গ্রামের মাটি কামড়ে পরে মরছে। সাবিত্রীর বাস্তববাদী কথায় যতীন চমকে ওঠে।আমাদের এই পুণ্যভূমি তে এই নারীজাগরন একদিন সত্যি সঠিক দিশা দেখাবে।যতীন চৌদ্দ পুরুষের আবেগ ছেড়ে ক্রমাগত বেড়িয়ে আসতে থাকে।বেড়িয়েই আসতে থাকে।তারপর…
রামগঞ্জের বাজারে যতীন এখন একজন নামকরা ফড়েরবাজ।আড়তদার। সাবিত্রীরা অল্প কিছু বছরের মধ্যেই লক্ষ্মীর অশেষ কৃপা লাভ করে।যতীন দালালের ঘরে বছরে একবার মহা সমারোহে ধুমধাম করে হরগৌরীর পূজা হয়। রামগঞ্জের বাজারের সবাই পাতপেড়ে খায় সেদিন।একদিন এই যতীন ঐ ফড়েরবাজদের কতো গাল দিয়েছিলো আর দিতো। সাবিত্রী রাতের আঁধারে শুয়ে ভাবতে থাকে।সেই এখন যতীন দালালের পয়মন্ত বৌ।
একটা সময় অবধি সায়েন্সের ছাত্র।দূরসঞ্চার বিভাগে কর্মজীবন শুরু টেলিগ্রাফিস্ট হিসেবে। জুনিয়র ইন্জিনিয়ার পদেও কিছু বছর। বর্তমানে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সংস্থায় (ভারত সরকারের) Accounts Officer হিসেবে কর্মরত।জীবন ও জীবিকার ভাঙ্গাগড়া অনেক দেখেছি।আমার ভেতরে তাই বয়ে চলে সাহিত্য নদীর ধারা অনবরত। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত অনেক লেখা।এই লেখার টানেই কবিতাকে নিয়ে চলে যাবো নগ্ন নির্জন দ্বীপে—এই আমার শখ।জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা শিলিগুড়ি শহরে, বর্তমান কর্মস্থল কলকাতা।