মায়া সভ্যতা
মায়ান সভ্যতা বা মায়া সভ্যতা। প্রায় চার হাজার বছর আগের একটি সভ্যতার নাম যে সভ্যতা প্রাচীন যুগে গড়ে উঠেছিল। যখনকার মানুষ কেবল আগুনের ব্যবহার বা আগুনে খাবার ঝলসে সিদ্ধ করে খেতে শিখেছিল, কিন্তু সেই যুগে মায়ানরা কি করে এত উন্নত সভ্যতা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছি তা বর্তমান বিশ্বের একটি বিস্ময় ! উন্নত আধুনিক সভ্যতার অনেক প্রাপ্তিই বা ধারণা মায়ান সভ্যতা থেকে পাওয়া যায়, অথবা চার হাজার বছর আগে তারা যা শিখেছিল, আবিষ্কার করেছিল আমরা সবে তা রপ্ত করেছি।
মায়ানদের ভৌগোলিক অবস্থান :
জন লয়েড স্টিফেনস এবং ফ্রেডরিক ক্যাথাউড ১৮৪০ সালে মায়াদের আবিষ্কার করেন। মায়ানরা ছিলো সাংস্কৃতিক দিক থেকে গতিশীল এবং মেসো আমেরিকার মধ্য অন্যতম পরাক্রমশালী জাতি। মায়াপানের প্রাচীন শহর “ইউকাতান” থেকে “মায়া” শব্দটি উৎপত্তি লাভ করেছে। আর এই ইউকাতানই হচ্ছে মায়ান সাম্রাজ্যের শেষ রাজধানী খ্রিষ্টপূর্ব (২০০০-২৫০ খ্রিষ্টাব্দ)। এ সভ্যতা টিকেছিল প্রায় ২০০০ বছর। প্রায় ১৫০০ বছর পূর্বে বর্তমান ইংল্যান্ডের দ্বিগুণ জায়গা জুড়ে মায়া সভ্যতা বিস্তৃতি লাভ করেছিল। গুয়েতিমালায় প্রায় ৫০ লাখ লোক বসবাস করতো বলে ধারণা করা হয়। তবে নতুন এক গবেষণা থেকে ধারণা করা হচ্ছে যে,জনসংখ্যা প্রায় এক থেকে দেড় কোটিও হতে পারে। আরেকটি গবেষণা থেকে জানা যায়,প্রায় এক থেকে পাঁচ কোটি মায়ানের বাস ছিলো ২১০০ বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত এলাকা জুড়ে।
মধ্য আমেরিকার এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে মায়া সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। গুয়েতেমালা, বেলিজ, সালভাদের, পশ্চিম হন্ডুরাস, কেন্দ্রীয় মেক্সিকোর তাবাস্কো জুড়ে এ সভ্যতা প্রসারিত ছিলো। তবে মায়ানরা এখনো পৃথিবীর বুক থেকে পুরোপুরিভাবে বিলুপ্ত হয়ে যায় নি। মধ্য আমেরিকায় এখনো প্রায় ৬০ লক্ষ মায়ান সগৌরবে বাস করছে।
মায়া সভ্যতার যুগসমূহ :
প্রি-ক্লাসিক যুগ, ক্লাসিক যুগ ও পোস্ট ক্লাসিক যুগ নিয়ে মূলত মায়া সভ্যতা গড়ে উঠেছিলো। খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০সাল থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ২০০ শতাব্দী পর্যন্ত ছিলো প্রি-ক্লাসিক যুগ। প্রি-ক্লাসিক যুগকে আবার “ওলমেক” যুগও বলা হয়।তবে এই তিনটি যুগের শুরুতে আর্কাইক (খ্রিষ্টপূর্ব ৭০০০-২০০০ সময়কাল) নামক একটি যুগ ছিলো বলে ধারণা করা হয়। ক্লাসিক যুগকে মায়া সভ্যতার স্বর্ণ যুগও বলা হয়।
কোডেক্স :
![](https://cdn.shortpixel.ai/client/to_webp,q_glossy,ret_img,w_839/https://bigganbortika.org/wp-content/uploads/2019/09/venustablecodex.jpg)
মায়ান জাতি নিজেদের মনের ভাব প্রকাশের জন্য কোনো বর্ণ বা অক্ষর ব্যবহার করত না। মূলত তারা চিত্রকর্মের মাধ্যমে মনের ভাব ফুটিয়ে তুলত। এরকম প্রায় ৮০০ এর ও বেশি চিত্রকর্ম রয়েছে। চিত্রকর্মগুলো তারা ফুটিয়ে তুলত “কোডেক্স”এ। কোডেক্স হচ্ছে গাছের ছাল-বাকল দিয়ে তৈরি এক ধরনের কাগজ। এসব কোডেক্সের মধ্যে বিখ্যাত কিছু জীবিত কোডেক্স হলো প্যারিস কোডেক্স, মাড্রিড কোডেক্স এবং ড্রেসডেন কোডেক্স। তবে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো “ড্রেসডেন কোডেক্স” নামক ৩৯ পাতার বইটি। এই কোডেক্সটি এটি বর্তমানে জার্মানের স্যাক্সন স্টেট লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত আছে। এ পর্যন্ত ৪ টি কোডেক্স অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।
বিংশ শতাব্দীর দিকে মায়া সভ্যতার আরেকটি কোডেক্স উদ্ধার করতে সক্ষম হয় জোসু সায়েঞ্জ। এটি “গ্রোলিয়ার কোডেক্স” নামে পরিচিত। এই কোডেক্সটি ডুমোর গাছের ছাল দিয়ে তৈরি। দশ পাতার এই কোডেক্সটি থেকে মায়াদের নানা আচার অনুষ্ঠান সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। এমনকি এই কোডেক্সটি থেকে মায়ান দেবতাদের সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবে জানা যায়। ধারণা করা হয় এটি ১৩শ শতকের মাঝামাঝি সময়কার নথিপত্র।
মায়ানদের পোশাক :
তারা মূলত জন্তু জানোয়ারের চামড়া ও পশম থেকে পোশাক তৈরি করত। গ্রীষ্মকালে মায়ান পুরুষরা খালি গায়ে থাকলেও শীতকালে পুরুষ ও মহিলা উভয়ই কম্বল দিয়ে তৈরি পঞ্চ জাতীয় পোশাক পরিধান করত। মায়ানদের পোশাক অনেকটা আজটেক সভ্যতার মানুষদের পোশাকের মতন ছিলো। বিবাহিত মায়নরা নিজেদের গায়ে উল্কি এঁকে রাখত বিবাহের চিহ্নস্বরূপ। মায়ান পুরুষরাও মহিলারাদের মত চুল লম্বা রাখতে পছন্দ করত। “কুয়েৎজাল পালক” নামক একটি বস্তু মায়াদের ধর্মীয় পোশাকে ব্যবহার করা হতো। জেড ও সামুদ্রিক খোল তারা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ও যুদ্ধে শিঙ্গা হিসেবে ব্যবহার করত।
![](https://cdn.shortpixel.ai/client/to_webp,q_glossy,ret_img,w_600/https://bigganbortika.org/wp-content/uploads/2019/09/image03-copy-2.jpeg)
মায়ানদের খাদ্যাভ্যাস :
মায়া সভ্যতা মূলত কৃষি নির্ভর ছিলো। তাদের প্রধান খাদ্য ছিলো ভূট্টা। ভূট্টা থেকে তারা বিভিন্ন ধরনের খাদ্য তৈরি করত। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ডালিয়া, টর্টিলা ও পনির জাতীয় খাদ্য। এমনকি তারা ভূট্টা পচিয়ে মদও তৈরি করত। মায়ানরা মনে করে ভূট্টা মানুষের সৃষ্টি। মায়ান জনগোষ্ঠী কাকাওয়ের বীজ অর্থাৎ চকলেট যে গাছ থেকে তৈরি সেই গাছের বীজকে মুদ্রার বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করত।
মায়ানদের তৈরি বর্ষপঞ্জিকা :
![](https://cdn.shortpixel.ai/client/to_webp,q_glossy,ret_img,w_960/https://bigganbortika.org/wp-content/uploads/2019/09/aztec-195134_960_720.jpg)
অন্যান্য সভ্যতার চেয়ে মায়া সভ্যতা ছিলো তুলনামূলকভাবে বেশ উন্নত। প্রি ক্লাসিক যুগে তারা উন্নতির চরম শিখিরে পৌঁছে ছিল। মায়ানরা জ্যোতির্বিদ্যা ও গণিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলো। ৩৬৫দিনকে কেন্দ্র করে একটি জটিল বর্ষপঞ্জিকা তৈরি করে তারা। আর “২০” সংখ্যাটিকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলে এক জটিল ব্যবস্থা। যেখানে “০” ছিলো তাদের নিজস্ব প্রতীক। ৩৬০ দিনকে এক বছর গণনা করা হতো এবং বাকি ৫ দিনকে তারা অমঙ্গলজনক হিসেবে বিবেচনা করতো। এটি Wayeb’ নামে পরিচিত। মায়া ক্যালেন্ডার অনু্যায়ী ২০১২সালে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কথা ছিলো।
মায়ানদের নিয়ে কিছু অদ্ভুত তথ্য :
১.মায়ান অভিজাত নারীরা দাঁতে বিন্দু এঁকে নকশা করতেন।
২.মায়ানরা বন্দী অথবা দাসদের মেরে ফেলার আগে গায়ে নীল রঙ করত।
৩.তাদের দীর্ঘতম ক্যালেন্ডারটি ছিল ২,৮৮০,০০০ দিনের যা শেষ হয় ২০১২ সালে।
৪.মায়ান সংস্কৃতি ও ভাষা মেক্সিকোর অনেক এলাকায় ও গুয়েতেমালায় প্রচলিত আছে।
৫.মায়া পুরাণ অনুসারে হুনাহপু এবং এক্সবালাংখুয়ে নামক দুই মায়া দেবতা নরকের দেবতাদের সাথে যুদ্ধ করে মানুষকে স্বর্গে নিয়ে যায়।
৬.মায়াদের মতে ভুট্টা ভগবানের সৃষ্টি নয়,মানুষই নাকি ভুট্টার জন্ম দিয়েছে।
৭.মায়ান সমাজে অনেক সময় শাস্তিস্বরূপ বন্দীর শরীরের চামড়া তুলে ফেলা হতো এবং মায়ানদের ধর্মযাজক সেই চামড়া পরে নৃত্য করত
৮.তাদের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক পণ্যের মধ্য অন্যতম ছিলো কোকো,লবণ, সমুদ্রখোসা,পাথরবিশেষ এবং কাঁচের মতো দেখতে একজাতীয় আগ্নেয়শিলা।
৯. আধুনিক সাল অনুযায়ী ৩১১৪ খ্রিষ্টপূর্ব মায়াদের উৎপত্তি হয়েছে বলে তারা নিজেরা মনে করেন।
১০.মায়ারা বিশ্বাস করেন যাদেরকে নরবলি দেওয়া হয়েছে শুধুমাত্র তারাই স্বর্গে যাবে।
![ইরাবতী ডেস্ক](https://irabotee.com/wp-content/uploads/2021/12/irabotee-cover-e1640636602578-150x150.jpg)