| 13 মার্চ 2025
Categories
গল্প সাহিত্য

বোবা গল্পটা যদি ফিরে আসে

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

 

এই যে দেখেন আমার সাইজ কীভাবে ৩৬ হতে ৩২ বত্রিশ করে ফেলেছি! মেয়েটার কথা শুনে চমকে গেলো খালিদ। বহুদিন পর তাকে দেখল। অবশ্য সরাসরি কোনোদিনও তাদের দেখা হয়নি। ছবিতে দেখেছে। তবুও মনে হয়েছিল অনেক চেনা। পাপড়িকে চিনতে পেরেছে। কিন্তু সে এমনভাবে তাকাল যে চিনতেই পারছে না। মেয়েটা আবার বলল, চেয়ে দেখেন-আমি কেমন করে এতদিনে আমাকে কেমন ফিট করে ফেলেছি। আপনি যেমনটা চেয়েছিলেন ঠিক তেমন।

খালিদ এখনো তার মুখের দিকে তাকাচ্ছে না। একবার চোখে চোখ রেখেই চোখ ফিরিয়ে এনেছে। এখন মাথা নীচু করে বসে আছে। সামনে একটা চেয়ারে বসে সামনে ঝুঁকে আছে পাপড়ি। পাপড়ির কথা তার মাথায় ঢুকছে না। কীসের সাইজ, কীসের কী? বুঝতে পারছে না খালিদ। কিন্তু তার বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। পাপড়িকে সে জনম জনম ধরে চিনবে এটাই তো কথা ছিল। তাকে কখনো ভুলে যাবে না, এটাই তার প্রতিজ্ঞা ছিল। তবে তাকে ভুলে গেলো কেন? এখন চিনতে পারছে না কেন?

পাপড়ি সামনে বসে আছে। একটুও নড়ছে না। এমনভাবে বসেছে যে, একটু নড়লেই সারা পৃথিবীটা নড়ে উঠবে। ভুমিকম্পে আন্দোলিত হবে এই শহর, এই দেশ, এই পৃথিবী। খালিদও চুপ। অফিসের কাজে মনোনিবেশ করেছে।এমনভাবে মাথা নীচু করে বসে আছে যে, পুরো মাসের কাজ এই মুহুর্তেই শেষ করতে হবে। মেয়েটাও নাছোড়বান্দা। সে বসেই আছে। টেবিলের উপর রাখা হাতদুটো একটু পর পর কচলাচ্ছে। মাথা নীচু করেও খালিদ এটা দিব্য দেখতে পাচ্ছে। অনিন্দ্য সুন্দর হাত। এক হাতে ঘড়ি অন্য হাতে একটা চিকন ব্রেসলেট। ঘড়িতে এখন বাজে এগারটা কুড়ি। এই সময়ে প্রতিদিনই খালিদ খুব ব্যস্ত থাকে। আজও ভীষণ ব্যস্ত থাকার কথা ছিল। কিন্তু এখন, এই মুহুর্তে কাজে মন বসাতে পারছে না। চোখের সামনে এমন একটা মেয়ে বসে থাকলে কাজে মন বসানো যায়? আর প্রথমেই সে যে প্রশ্ন করেছে সেটা শোনার পর কারো সাথে সহজেই কথা বলা যায় না।

কীসের সাইজ? কীসের ফিট? কেন ফিট?

অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর মেয়েটা আবার কথা বলতে শুরু করল।
-আপনি কি আমাকে চিনতে পারছেন না?
খালিদ এবারও চুপ। কী বলবে সে? এখন কি সে বলবে, তাকে চিনতে পারছে না? তাকে তো সে চিনে। একটা সময় তার সাথে একটু কথা না বলে সে থাকতে পারতো না। একদিন কথা না বললে সে অস্থির হয়ে যেত। অথচ আজ তাকে চিনতেই পারছে না। এভাবে তো তাকে ভুলে যাওয়ার কথা ছিল না। পাপড়িকে ভীষণ ভালেবাসত খালিদ। পাপড়িও হয়ত ভালবাসত। কিন্তু কখনোই মুখ ফুটে বলেনি সে কথা। খালিদ অসংখ্যবার জানতে চেয়েও কোনো উত্তর সরাসরি পায়নি।

অপেক্ষা ছিলো তাদের দুজনের মূল অস্ত্র। সময়ের কাছে ছেড়ে দিয়েছিল সব। কিন্তু সময় তাদেরকে কাছে রাখার বদলে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। এতটা দূরে সরিয়ে দিয়েছে যে, একজন আরেকজনের মুখ আর কখনোই দেখবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। এতটা সময় পর আবার তারা মুখোমুখি কিন্তু মুখে কোনো কথা নাই। না দেখা সম্পর্কের হাত ধরে যে সময় চলে গিয়েছিল তাদের অজান্তে সেটা বুঝে উঠার আগেই তারা অনুভব করলো হয়ত তারা এক অপরের প্রেমে নিমজ্জিত। ভাসমান কচুরিপানার মত ঢেউয়ের সাথে দোল খাওয়া সম্পর্কের সাথে তারা এগিয়ে গেছে বহুদিন। খালিদের অফিসের ঠিকানায় একটা কুরিয়ার আসে। পাপড়ি পাঠিয়েছে। একটা সুন্দর ডায়রি, একটা কলম, একটা কার্ড আর একটা চিঁরকুট। কুরিয়ারটা পেয়ে সেদিন খালিদের সে কী আনন্দ সেটা দেখার মত বিষয় ছিলো। ছাত্রজীবনে প্রেম অনেকবার উঁকি দিয়েছিলো কিন্তু কখনো প্রেমের নৌকায় পা দেয়া হয়নি। বন্ধুদের প্রেম প্রেম খেলা দেখে কাটিয়ে দিয়েছিল ভার্সিটি জীবন। তাই সেই চিরকুটটা পেয়ে তার সেদিনের সেই চমকটা বাঁধিয়ে রাখতে চেয়েছিলো। তারপর একদিন খালিদও পাপড়িকে একটা শাড়ি পাঠায়। গাঢ় নীল শাড়ি। শাড়ির পাড়ে লাল আর বেগুনি ছোট ছোট ফুল। জমিনে একটা মুক্ত আকাশ। সেই আকাশে বন্দি খালিদের মন। শাড়িটার দিকে তাকালে আকাশ আর মেঘের কাব্যের বুণনে পাপড়ির মুখ। শাড়ি পরিহিত পাপড়ি যেন অপাঠ্য গদ্য।

কিছুদিন পর পাপড়ি সেই শাড়ি পরা একটা ছবি পাঠায় তাকে। সেই ছবিটা খালিদের রোজ একশবার দেখেও প্রাণ ভরে না। বারবার দেখত। কিছুক্ষণ পর পর দেখত। দেখত আর ভাবত। স্বপ্নে ভেসে যেত তার সোনালী সময়। কোন এক জৈষ্ঠ্যের দিগন্ত ঝলসে যাওয়া সন্ধ্যায় পাপড়ির সাথে পরিচয়। মেয়েটা অনেক হেয়ালি স্বভাবের। কোনোকিছুই স্বাভাবিকভাবে নেয় না। হেসে উড়িয়ে দেয় সব। হাসিতে ভাসিয়ে দেয় সকাল বিকাল রাত। খালিদ বুঝতে পারে না এসব। সে বুঝতে চায়। সে পাপড়ির কাছে সম্পর্কের সংজ্ঞা জানতে চায়। পাপড়ি বলে না কিছুই। এমন অনেক সময় কেটে গেছে নিজেদের কথা বলে। কারো সাথে কারো দেখা নাই। মুখোমুখি হয়নি কোনোদিন। কিন্তু বুকের ভেতর স্বপ্ন অগাধ- দেখা হবে, কথা হবে। হাতটা একটু ছুঁয়ে দিয়ে শত বছর কাটিয়ে দেবে। চোখের দিকে তাকিয়ে যুগের সন্ধিক্ষণে নতুন নতুন স্বপ্ন নির্মাণের বাসনা বুকের ভেতর বাড়তে থাকবে।

পাপড়িও স্বপ্ন দেখত-এমন একটা পাগলাটে মানুষের সাথে জীবনটা কাটিয়ে দেবে। পাগলের সাথে আরেক পাগলের মেলবন্ধন গড়ে উঠে। খালিদকে তার খুব পছন্দ। যদিও বয়সে বড় তবু তার সাথে কথা বলতে ভালো লাগে। তার কণ্ঠ যখন ইথারে ভেসে আসে সেই অদৃশ্য কথাগুলোতেও যেন খালিদের স্পর্শ পায়। পাপড়ি ,খালিদের স্পর্শে নিজেরে মধ্যে শিহরণ খুঁজে পায় । আন্দোলিত হয় তার দেহ মন। সেই কথায় খালিদের অস্তিত্ব অনুভব করে পাপড়ি। পাপড়ি স্বপ্ন দেখে, সেও একদিন খালিদের কাছাকাছি যাবে। খালিদকে জড়িয়ে ধরবে। ভালোবাসায় রাঙিয়ে দেবে তাদের ভুবন। খালিদের বুকে মাথা রেখে আকাশ দেখে শত সহস্র বছর পাড়ি দেওয়ার সাহস বুকের ভেতর আগলে রাখে। পাপড়ির বয়স কম। উচ্ছল, প্রাণবন্ত একটা পাখির মত উড়ে বেড়ায়। খালিদ তাকে, তার বুকের ভেতর বন্দি করতে চায়। দুজনের সম্মতিতে- তারা সিদ্ধান্ত নেয় তাদের প্রথম পরিচয় ০৬/০৬ তারিখে হওয়ায় কোনো এক বছরের ০৬/০৬ তারিখে তারা দেখা করবে। এভাবেই কেটে যায় তাদের একটা বছর। তারপর আরেক বছর। পরের বছরের ০৬/০৬ তারিখ উপলক্ষে খালিদ একটা ড্রেস কিনে পাঠায়। অনেক ঘুরাঘুরি করে একটা পছন্দসই জামা পেয়ে সে খুব খুশি। জামার ভেতর পাপড়ির দেহটা দেখে প্রাণ পায়। পাপড়ি, জামাটা দেখে নিশ্চয় খুশি হবে।তবে কিনতে গিয়ে একটা ঝামেলায় পড়ে যায় খালিদ। সেটা হলো জামার সাইজ। আগে কখনো মেয়েদের জামা কেনেনি। যদিও এর আগে শাড়ি কিনেছিলো। কিন্তু শাড়ি কিনতে হলে তো সাইজ প্রয়োজন পড়ে না। যে ড্রেসটা পছন্দ হলো সেটা হাতে নিয়ে বারবার দেখছে। পাশ থেকে সেলসগার্ল খুব কোমল স্বরে ডাকলো-
-স্যার, ম্যাডাম কি ফর্সা? ফর্সা হলে ম্যাডামকে ভীষণ মানাবে। এটা কি দেব স্যার? খালিদ কিছু বলল না। চুপ করে দাড়িয়ে আছে। এটা কিনবে কিনা ভাবছে। পাপড়িকে দেওয়া ঠিক হবে কিনা ভাবতে ভাবতেই সেই মেয়েটা আবার ডাকল। খালিদ বলল, আমি এটাই নিতে চাই। আমাকে এটাই দিন।
সেলসগার্ল বলল-
-স্যার, কোন সাইজটা দিবো?

সাইজ! কোন সাইজ নেবে খালিদ। সে তো পাপড়ির সাইজ জানে না। জানা সম্ভবও না। তাকে সরাসরি দেখেইনি কোনোদিন। এখন তো ভীষণ ঝামেলায় পড়ে গেলো খালিদ। পাপড়িকে জিজ্ঞেস করাও যাবে না। এক তো তাকে সারপ্রাইজ দেবে আর এমন একটা কথা কোন মেয়েকে সরাসরি বলা যায় না।যদিও পাপড়ির সাথে খালিদের সম্পর্ক অনেক গাঢ় তবুও এমন একটা কথা বলতে দ্বিধা লাগছে ভীষণ। পেছনে সেলসগার্ল দাড়িয়ে আছে। তার হাতে সেই জামাটা। সে আবার বলল-
-স্যার, জামাটা দেব?

কী বলবে খালিদ? এখন কি সে বলবে- যার জন্য নিতে চায় তার সাইজ তার জানা নাই! বললে মেয়েটা কী ভাববে! তবে পাপড়ির ছবি দেখে খালিদের মনে হয়েছে পাপড়ি হাল্কা পাতলা হবে। কিন্তু ছবিতে তার বিশ্বাস নাই। আজকালকার মেয়েরা ছবি তোলার ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন। যেভাবে ছবি তুললে তাকে হাল্কা পাতলা দেখাবে সেভাবেই সে ছবি তুলবে। মোটা দেখালেও এডিট করে পাতলা বানায়। তাই ছবির উপর আস্থা রাখতে পারছে না। অনেক ভাবনার পর খালিদ জিজ্ঞেস করল-
-আপনাদের এখানে কোন কোন সাইজ আছে?
-স্যার ৩২ থেকে শুরু করে ৪৪ পর্যন্ত যে কোন সাইজ এভেলেবল। নতুন প্রোডাক্ট তো। আপনার কোন সাইজ লাগবে?

এখন খালিদ করবে কী? কোন সাইজটা নেবে? দেখা গেলো এমন এক সাইজ নেবে যেটা সে পরতেই পারলো না।
মেয়েটা আবার জানতে চাইল-
-স্যার কোন সাইজটা দেব?
কিছু না ভেবেই খালিদ বলে ফেলল-
-আমাকে ৩২ সাইজই দিন।
-ওকে স্যার। একটু অপেক্ষা করুন।

জামার প্যাকেটটা নিয়ে শো রুম থেকে বের হয়ে আসল। এখন কুরিয়ারের অফিসে যেতে হবে। আজই পাঠাতে হবে। নয়ত ০৬/০৬ তারিখের আগে সে পাবে না। কুরিয়ারে বুকিং দিয়ে একা একা হাঁটতে লাগল। সূর্যটা ডুবে গেছে। জৈষ্ঠ্যের সন্ধ্যায় একটু কোমল হাওয়া মনটাকে ভরিয়ে দিচ্ছে। পূব আকাশে তরমুজের চিলতের মত একটা চাঁদ উঁকি দিয়েছে।

চাঁদের সাথে হাসতে হাসতে এগিয়ে যাচ্ছে খালিদ। সে হাঁটে, তার সাথে সাথে চাঁদও এগিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর রাস্তায় বাঁক নেয়। চাঁদকে পেছনে ফেলে হাঁটতে থাকে সে। কিছুদূর যাওয়ার পর পেছনে তাকিয়ে দেখে চাঁদটাও তার পেছন পেছন আসছে। এমন একটা খেলা ছোটবেলায় খুব খেলেছে। এখন এই বয়সে খেলা তেমন মানায় না। এখন তো আর বাচ্চা নয়। তাহলে কি সে পাপড়ির প্রেমে পড়ে গেছে। প্রেমে পড়লে নাকি মানুষ এমন বাচ্চামি করে। প্রেমে পড়লে নাকি মানুষ বোকা হয়ে যায়। যে প্রেমে পড়ে সে ভাবে, সেই একমাত্র চালাক। আসলে সেই সবচেয়ে বোকা। খালিদ একা হাঁটছে আর হাসছে। এতক্ষণ চুপিচুপি হাসলেও এখন বোকার মত জোরে জোরে হাসছে। রাস্তার এ পাশটায় একটু অন্ধকার থাকায় কেউ হয়ত দেখছে না। সে হাঁটছে আর ভাবছে, আচ্ছা পাপড়ি জামাটা পেয়ে খুশি হবে তো? জামার রঙটা তার পছন্দ হবে? যদি পছন্দ না হয়? পছন্দ হলেও যদি সাইজে না হয়! তখন?
সে তো আর পাপড়ির বডির সাইজ জানে না। এমন একটা প্রশ্ন তো করাও যায় না। যদি সে জিজ্ঞেস করতো,
– আচ্ছা তোমার বডির সাইজ কত?
অথবা
– তুমি কোন কত মাপের জামা পরো?
কিংবা
-তোমার মাপ কত?
উত্তর কী আসত?
অবশ্যই খুব বাজে ধরণের উত্তর আসত।
– আপনাকে তো খুব ভালো মানুষ মনে করেছিলাম। কিন্তু আমার ধারণা আপনি পাল্টে দিলেন। ছিঃ।
অথবা
– আপনি এমন একটা প্রশ্ন করতে পারলেন? কীভাবে পারলেন আপনি?
কিংবা
-মাপ দিয়ে কী করবেন, শুনি? আমার স্মার্টনেস মাপতে চান? কেন মাপতে চান? আপনার কত সাইজ পছন্দ? সাইজ মত না হলে পছন্দ করবেন না? ছিঃ। আপনাকে খুব ভালো মনে করেছিলাম। কিন্তু আমার ধারণা পাল্টে দিলেন। আসলেই সব পুরুষ মানুষ একই। ভাবতে গিয়ে রাস্তার পাশে রাখা ইটের টুকরায় হোঁচট খায় খালিদ। এখন নিজের মধ্যে ফিরে আসে। পাপড়িকে তার বডির সাইজ জিজ্ঞেস না করাতে নিজেকেই সে নিজে ধন্যবাদ জানায়। মেয়েটাকে সে ভালোবেসে ফেলেছে। তাকে একটু সময়ের জন্য ভুলে থাকা হয়ত তার হবে না। কিন্তু পাপড়িকে যে সে ভালোবাসে এটা বলাও যাবে না। তার মধ্যে একটা ছাড়া ছাড়া ভাব আছে। বয়স কম৷ সারাক্ষণ উচ্ছলতায় থাকে৷ হয়ত খালিদের মত এতকিছু ভাবেনি। তাই খালিদও চুপিচুপি সামনে আগায়।

পাপড়িকে আগলে রাখার একটা মনো বাসনা বুকের ভেতর বেড়ে উঠতে থাকে। মাঝেমধ্যে স্বপ্নে পাপড়িকে হারানোর ভয় খালিদকে কাবু করে ফেলে। তার ভয় হয়, যদি কোনদিন পাপড়ি তাকে ছেড়ে চলে যায় তবে সে বাঁচবে কী করে? অথচ, এখনও সে বেঁচে আছে। পাপড়ি কিংবা পাপড়ির ভালোবাসা ছাড়া এখনো দিব্যি বেঁচে আছে। কতটা বোকা ছিল সে! পাপড়িকে ড্রেসটা পাঠানোর পর একটা তীব্র মাত্রার প্রতিক্রিয়া আসে। সেই প্রতিক্রিয়া সহ্য করার ক্ষমতা তাকে বিধাতা দেন নি। এমন একটা প্রতিক্রিয়া সে আশা করেনি।

-আপনি কি মনে করেছেন? একটা ড্রেস দিলেই পটে যাবো? গদগদ হয়ে আপনার কাছে চলে আসবো? এই তো? আপনি কি ভেবেছেন, আপনাকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি? ভালোবাসা এত্ত সহজ? নিজেকে কী মনে করেন? খালিদ চুপচাপ সব কথা শুনতে থাকে। বলার কিছু নাই। এমন একটা সময় কিছুই বলা যায়না। কয়েক সেকেন্ড চুপ থাকার পর পাপড়ি আবার তার জেদ ঝারা শুরু করলো।

-আপনাকে খুব কাছের মানুষ মনে করেছিলাম। কিন্তু আপনি এতটা নীচ ভাবতে পারিনি। আপনি কিভাবে ভাবলেন যে, আপনার দেয়া ড্রেস আমি গায়ে জড়াবো। তখন না হয় মজা করে আপনার পাঠানো শাড়ি পরেছিলাম। সেটা আমার ভুল ছিলো। এমন ভুল আর করতে চাই না। আশাকরি আপিনিও আর এমন ভুল করবেন না। খালিদ নির্বাক। কী বলবে? বলার মত মুখ আছে? এতটা বোকা সে! এত সহজে মানুষকে ভালোবাসার মতো বোকা তো সে নয়। তবুও কেন এই ভুলটা করলো? সে কি একাই এর জন্য দায়ী? খালিদের আকাশ মেঘে ঢেকে যায়। নিজের কাছে নিজেই ছোট হয়ে নিজের ভেতর গুটিয়ে যায়। অন্যের কাছে ছোট হলে ক্ষমা চেয়ে হয়ত পরিত্রাণ পাওয়া যায়, কিন্তু নিজের ভেতর অনুশোচনার আগুন জ্বলতে থাকলে সেই আগুন নেভানোর সাধ্য আছে কার?

-আপনি আমার বডির সাইজ জানার জন্য এই ড্রেসটা পাঠিয়েছেন, তাই না? বললেই হতো। আমি বলে দিতাম আর আপনি মনে মনে যৌনসুখ উপভোগ করতেন। এবার খুব খারাপ লাগছে খালিদের। এতটা বলা ঠিক হচ্ছে না পাপড়ির। খালিদ এতকিছু ভেবে ড্রেসটা পাঠায়নি। তার মন জানে। তার অস্তিত্ব জানে। খালিদের মনের ভেতর যে পবিত্রতা সেটা কেউ না জানলেও খালিদ তো জানেই। এটাই তার সম্বল। তাই এটা নিয়ে আর বাড়াবাড়ি করবে না। পাপড়িকে ভুলে যাবে। সারাজীবনের জন্য ভুলে যাবে। আবার নতুন করে জীবন সাজাবে। আর কখনোই এভাবে কারো সাথে সম্পর্কে জড়াবে না। অনেক শিক্ষা হয়েছে।

কিন্তু পাপড়িকে একটা কথা বলতে খুব ইচ্ছা করছে। বলার সাহস নাই তার। পাপড়ি যখন তাদের বন্ধুত্বের কথা ভুলে গেছে তাহলে খালিদও সব ভুলে যাবে। তাদের ঐতিহাসিক ০৬/০৬ তারিখের সব। এতদিনর সব কথা। স্মৃতির পাতা এমনভাবে সাজাবে যাতে পাপড়ির কোন কথাই সেখানে স্থান না পায়। আজ খালিদের সামনে সেই পাপড়ি। কিন্ত ভিন্ন আঙ্গিকে। আজ বহু বছর পর সে খালিদের সাথে দেখা করতে এসেছে। এবার খালিদ মুখ তুলে তাকালো তার দিকে। ড্রেসটা চেনা চেনা। হ্যাঁ, ঐ ড্রেসটাই তো। সেই চেনা হাসি। খালিদের পছন্দ মত ছোট্ট টিপ, ঠোঁটে হাল্কা লিপস্টিক। চুলগুলো এসি রুমের ভেতরেও উড়ছে।

পাপড়ির ঠোঁটে হাসি। কেন সে হাসছে? হাসির কি হলো? পাপড়ি জানে, খালিদের মতো পবিত্র পুরুষ আর জীবনে পাবে না। খালিদ যখন অবাক হয় তখন তাকে আরো বেশি পবিত্র লাগে। শিশুসুলভ মুখটা দেখে হাসি কি আটকানো যায়? পাপড়ির হাসির মানে বুঝতে পারে না খালিদ। আনমনে ক্যালেন্ডারের দিকে তাকাতেই দেখে আজ জুন মাসের ৬ তারিখ। তাহলে কি সেও এতটা বছর সব মনে রেখেছিল? এই যে দেখেন, এত বছরের আমাদের স্মৃতি সব আগের মতোই আছে। শুধু একটা কিছু পাল্টে গেছে। খালিদের জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে,
“কী”
প্রশ্ন শোনার আগেই পাপড়ি বললো,
-সবকিছু আগের মতো থাকলেও সাইজটা কিন্তু ৩৬ থেকে ৩২ করে ফেলেছি। এটাই বা কম কি বলেন?পাপড়ি হাসছে। হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে। পাপড়ির শরীরটা দুলছে। সাথে সাথে খালিদের চারপাশটা সরলদোলকের নিক্তির মতো এদিক ওদিক দোল খাচ্ছে। খালিদ এবারও চুপ। সে পাপড়ি শরীর বেয়ে গড়িয়ে পড়া হাসিতে স্নানের নেশায় মত্ত হয়ে আছে।

 

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত