মাই ড্যাডি
আমার বাবা বেশিদিন বাঁচেননি। মাত্র ঊনষাট বছরে কলকাতার নামী হাসপাতালের গাফিলতি তে মারা যান। ছোট থেকেই আমাদের মতবিরোধ ছিল প্রবল ও দৃশ্যমান। আর যে টুকু দৃষ্টির বাইরে সেটুকু আমার নিজের থাক। আজ বাবার মৃত্যু দিন।
“মাই ড্যাডি স্ট্রংগেস্ট” বলার সুযোগ পাইনি কখনো। সুযোগ পাইনি বন্ধুদের দেখিয়ে দেওয়ার, “দেখ, আমার বাবাও…”। আমার বাবা কখনো এত রোজগার করেনি যে আমরা সখ করে কিনব ভেলভেটের জামা কিম্বা লাল লিপস্টিক। মেলায় ধুলো মাখামাখি আনন্দের আইসক্রিম দিতে পেরেছে। বছরের বিশেষ দিন গুলোতে ছাপোষা সরকারি কেরানি লোকটা গ্রেট ইষ্টার্নে নিয়ে এসেছে সস্তা জামা পরা দু’ভাইবোনকে খাওয়াতে। তার সাধ ছিল, কিন্তু সে গ্রেট ড্যাডি হয়ে স্কোডা চালাতে পারেনি।
আমার বাবাকে নিয়ে কখনো গর্ব করতে পারিনি আমরা। প্রয়োজনের তুলনায় বেশি কথা বলা হইচই প্রিয় একটা সাধারণ লোক যে তার অসাধারন ইচ্ছে গুলোকে চাপা না দিয়ে অপব্যয় করেছে আর আমরা তার বিষয়ী না হওয়ার গ্লানি বুকে কেবলই তাকে দোষারোপ করেছি। একজন রাজ্য সরকারি কর্মচারী পঁচিশ তিরিশ বছর আগে মহাদোষ করেছিলেন। তার সাধ্য অনুযায়ী তার আকাঙ্খাগুলোকে রাখতে পারেননি। কখনো গাড়ি চড়ে ফেলতেন ভাড়া করে সারাদিন, আর জুটতো আমাদের বকুনি। এতো অমিতব্যয়িতা! তিনি মেয়ের জন্মদিনে নিজে হাতে ভেটকি মাছ রান্না করে খাওয়াতেন, একশটা গোলাপ এনে মেয়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলতেন, সাজা। তিনি জীবনটাকে গোলাপের মত সাজাতে চাইতেন নানা দুর্মূল্য সখে, আর তত আমাদের যুক্তিবোধ তাকে একঘরে করে দিত, রক্তাক্ত করত। আমরা বুঝতে চাইনি যে সাধারণ হয়ে থাকার গ্লানি তিনি নিতে পারতেন না। আবার অসাধারণত্বের উপায় তার অসাধ্য ছিল।
আমাদের নিয়ে তুমুল মজা করার স্মৃতিই আছে আমাদের দুই ভাইবোনের ছোটবেলা জুড়ে। বাবা মানে ঢাকী বিদায়ের টাকা-চাল ডাল দেওয়ার আগে”বাজাও তো দেখি” বলে ছেলে মেয়েকে নিয়ে নাচ। বাবা মানে রক্ষণশীল পাড়ায় প্রথম আমাকে জিন্স কিনে দেওয়া পরার জন্য, ও পাড়ায় তার আগে কেউ পরতো না। বাবা মানে নিয়মের বাইরের সব আর জীবন ভর্তি করা ভুলে আর আমাদের বকুনিতে।
আমরা একটা মানুষকে, তার ইচ্ছা গুলোকে বুঝিনি, বুঝতে চাইনি। আজ যখন আমি দেখি কোথা থেকে ভিতর থেকে কেউ নাড়া দিয়ে যায়, সাধারণ জীবনের বাইরে একটা স্বপ্ন দেখতে অন্য কিছু করার। যখন বন্ধু কবিরা বলেন, কিস্যু লিখতে পারো না। অনেক মঞ্চ অধরা থাকে, তখনও চোখ জুড়ে থাকে নানা স্বপ্ন, নানা কাজের ইচ্ছে, সাধ্যের বাইরের ইচ্ছে… কখনো মিউচুয়াল ফান্ড ভেঙে করে ফেলি “চিত্রাঙ্গদা”, কখনো দুঃসাধ্য অপব্যয় করে ফেলি নিজের একটা প্রোডাকশনের জন্য। এই যে সাধ্যের বাইরের অদম্য জেদ, এই যে বড় কিছুর স্বপ্ন দেখা নিজের পরিস্থিতি কে অস্বীকার করে, সে বোধহয় আমার রক্তের মধ্যে লুকিয়ে থাকা পাগলামো।
২৫শে বৈশাখ নাচের প্রোগ্রাম হত, আর প্রতি বছর সে সময় ওইদিন কালবৈশাখী এসে উড়িয়ে নিয়ে যেত স্টেজ, ঝড়ের মধ্যে ভয় পাওয়া ছয় বছরের আলতা আঙুল বাবাইকে বুকে নিয়ে বাবা ছুটত। তুমুল বৃষ্টি নেমে যেতো। আঙুল থেকে আলতা ধুয়ে তখন শার্টের উপরে রঙের ধারা।
আজো বৃষ্টি পড়ে বাবা। আজো একটা রেললাইন ধরে আমি ছুটি। ট্রেন আসে না। আলতা গড়াতে থাকে, যেন আঙুল চুঁইয়ে রক্ত। গোলাপ পাপড়ি, নতুন জিন্সের গন্ধ, দুর্গাপুজোর ঢাক বাজতে থাকে ঝাপসা বৃষ্টিতে, আর আমি আমার স্বপ্নে ছেলের বকুনি খেতে খেতে দৌড়োই, হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ি, ভিজতে থাকি অসহায়। শুধু আজকে আমার কোনো আফসোস থাকেনা….”my daddy strongest” না বলতে পারার।
জন্ম ২১ মার্চ,১৯৭৮। নৃবিদ্যায় স্নাতকোত্তর। ছোট বড় লিটিল ম্যাগাজিন থেকে বিভিন্ন সংবাদপত্র, পত্রিকা ও ওয়েবজিনে নিয়মিত লিখেন। আবৃত্তি ও উপস্থাপনায় সমান জনপ্রিয়।