এই সাক্ষাৎকার সম্পূর্ণ কাল্পনিক।কোন কলমে কালি ভরে কে যে এই অপ্রত্যাশিত চিত্রনাট্য লেখেন! যখন যেমন যেভাবে পেয়েছি পিনাকীদাকে, তেমন কিছু কথাই আজ এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে দিলাম।
শ্যামলীঃ আচ্ছা পিনাকীদা, সংস্কৃত পণ্ডিতের বংশধর আপনি, তাই কি শুধু কাব্যের প্রতি এত টান তৈরি হল আপনার?
পিনাকীঃ এভাবে ভাবিনি জানেন… তবে আমার ঠাকুরদা ব্যোমকেশ বিদ্যারত্ন ছিলেন সংস্কৃত পন্ডিত। সে যুগে বিখ্যাত। বুঝতেই পারছেন বিদ্যারত্ন উপাধি তখনকার দিনে। বিরাট সম্মানের ব্যাপার। আমাদের আদি বাড়ি ছিল কাশীতে। এখনও ঠিকানা স্পষ্ট মনে আছে, বাঙালিটোলা দেবনাথপুরা। আমার বাবাও কিশোর বয়স অবধি কাশীতেই ছিলেন। আমার সুন্দরী ঠাকুমা তখনকার দিনের কালান্তক গুটি বসন্তে মারা যান। বাবার কাছে শুনেছি, তাঁর নশ্বর শরীর ছাই হয়ে যায় মণিকর্ণিকায়। বাবার তখন ন’বছর। এখনও কাশীতে আছেন আমাদের আত্মীয় পরিজন…
শ্যামলীঃ ২০১৬ তে আবার তো গেলেন কাশীতে…
পিনাকীঃ ২০১৬-র আগেও গিয়েছি। ১৯৭৯। আহা, সে এক অভিজ্ঞতা! আমার ফার্স্ট ইয়ার। ভিড়ে ঠাসা নাইন আপ দুন এক্সপ্রেসের কামরা। রিজার্ভেশন নেই। দুই বন্ধু সঙ্গে। মিহির নন্দন আর দীপংকর কুমার। জায়গা তো পাইনি। খবরের কাগজ পেতে ট্রেনের মেঝেতে বসে শুকনো পাঁউরুটি আর দানাদার চিবোচ্ছি। তার সঙ্গে হৈ হৈ করে গান, কবিতা আর গল্প। সে এক দিন ছিল বটে। উঠেছিলাম অবশ্য ‘বড়দা’ বীরেশ্বর ভট্টাচার্যের বাড়িতেই। হোটেলে থাকার পয়সা কোথায় তখন?
শ্যামলীঃ ও, আর ২০১৭ তে তো প্রসার ভারতীর ‘জাতীয় কবিতা উৎসবে’। তাই না?
পিনাকীঃ হ্যাঁ। ১২ জানুয়ারি, ২০১৭ তারিখে জাতীয় কবিতা উৎসব। প্রতিবারই এই অনুষ্ঠান হয়। এক একবার এক এক শহরে। সেইবারই বারাণসীতে। বাংলা ভাষা থেকে এবার আমাকে নির্বাচিত করা হয়েছে। অদ্ভূত অনুভূতি। ২০১৬-র ডিসেম্বরে শীতের দিনগুলো কেমন ঘোরের মতো কেটে গেল। সেই কাশী। সেবার দু’তিন দিন ঘুরেছি কাশীতে। অনেক কথা লিখেছিলাম ফিরে এসে। পারলে পড়বেন, মহীতোষের ‘ছন্নছাড়া’ পত্রিকায়। যেদিন বেনারস রওনা হব, অনেক ভোরের ফ্লাইট। আগের দিন রাতে ছিলাম দিব্যেন্দুর বেলঘড়িয়ার বাড়িতে। অনেক রাত অবধি কত গল্প। সব সেই ছেলেবেলার গল্প। দিব্যেন্দুকে জিগ্যেস করুন, ও বলতে পারবে।
শ্যামলীঃ আর কবিতার প্রতি প্রেম, তার জন্য এই যে এতদূর হেঁটে আসা, এর পিছনে কোনও জেনেটিক কারণ নেই বলতে চান?
পিনাকীঃ কী জানি। এভাবে ভাবিনি তো। কিন্তু আমি ছেলেবেলা থেকেই পাঠক। প্রচন্ড পড়ার নেশা। যা পাই, তা’ই পড়ি। বাবা ছিলেন আমার বইয়ের জোগানদার। ওই পড়তে পড়তেই মনে হতে লাগল, আমিও লিখব। যাদের লেখা পড়ি, পড়ছি, তাদের মতোই গল্প লিখব, কবিতা লিখব, ছড়া লিখব। লিখতেও শুরু করলাম। বাবা ছিলেন একমাত্র পাঠক আর উৎসাহ দিতেন প্রচুর। বাবা আমার লেখা সংশোধন করে দিতেন। তখন আমার কত আর বয়স! ওই কয়েক বছর এখনও স্বপ্নের মতো। বাবা অকালে চলে না গেলে…
শ্যামলীঃ তখন বোধহয় আপনার বছর দশেক বয়স…
পিনাকীঃ হ্যাঁ। বাবাকে আমি চোখের সামনে খুন হতে দেখেছি…।
শ্যামলীঃ আপনি একদিন বলেছিলেন, বাবার সঙ্গে সেই ছেলেবেলায় যখন কলকাতায় আসতেন…
পিনাকীঃ বাবা আমাকে নিয়ে আসতেন। হাত ধরে। স্টেশন থেকে বাবা একটা বই কিনতেন। আর আমাকে সেটা ধরিয়ে দিয়ে বইয়ের নামটা পড়তে বলতেন। আমি বানান করে পড়তাম দ-এ এ-কার তালব্য শ। ভাবলে কেমন লাগে!
শ্যামলীঃ সেই ‘দেশ’ পত্রিকায় পরবর্তীকালে আপনি চাকরি করেছেন…
পিনাকীঃ সে’ও এক স্বপ্নের মতো। কবিতা বিভাগে জয় গোস্বামী তখন সম্পাদক, আর আমি তখন তার সহকারী। আবার পাশাপাশি প্রবন্ধও দেখতে হত। নানারকম কাজ। খুব উপভোগ করতাম।
শ্যামলীঃ আপনার কাছেই শুনেছি, আপনার ‘বনলতা সেন’ বইটি পড়া নিয়ে ছেলেবেলার প্রতিক্রিয়া।
পিনাকীঃ (হেসে) হ্যাঁ। মনে আছে আপনার? বাড়িতে প্রথম দিন বইটি উলটেপালটে দেখছি। প্রচ্ছদে লেখা বনলতা সেন। তলায় লেখা জীবনানন্দ দাশ। কিছুতেই বুঝতে পারছি না তাহলে বইটার নাম কি? দুটোই তো লেখকের নাম! তাহলে কবিতার বইটার নামই বা কি, লেখকই বা কে! কত ছোট তখন। বাবা তখন প্রতি বছর পূজাবার্ষিকী কিনে দিচ্ছেন। আনন্দমেলা, শুকতারা। আহা!
শ্যামলীঃ খুব ছেলেবেলাতেই তো গল্প লিখেছেন শুকতারায়?
পিনাকীঃ হ্যাঁ। দুটো গল্প লিখেছিলাম। আমার ক্লাস টেনের দুই বন্ধু গৌতম আর বিশ্বনাথের উৎসাহে তখন বহু জায়গায় আমার লেখা ছাপা হত। তার মধ্যে ‘দেশ’ পত্রিকাও ছিল। সেগুলোকে তেমন আহামরি কিছু আর মনে হয় না এখন।
শ্যামলীঃ পারিবারিক কারণে কারখানায় চাকরি নিতে হয়েছে। সেই ছেলেবেলার পরে লেখালেখি থেকে তো মাঝখানে অনেকদিন বিচ্ছিন্ন ছিলেন, কষ্ট হত না?
পিনাকীঃ ঠিক কষ্ট নয়। আসলে বাবা চলে যাবার পর থেকেই আমি আরও পড়ার মধ্যে ডুবে যাই। যখন কিচ্ছু লিখিনি, তখনও পড়েছি। এই পড়ার নেশা আমায় আজও বাঁচিয়ে রাখে। সুদীপ এক-একদিন ফোন করে জিগ্যেস করে, পিনাকীদা কী পড়ছেন আজকে? আসলে আগে তো ভাল পাঠক হতে হবে। আমি আর তেমন কিছু লিখতে পারলাম কই?
শ্যামলীঃ ‘নয়ের দশকের কবি’—এই তালিকায় আপনার নাম তো প্রথম সারিতেই…
পিনাকীঃ (থামিয়ে দিয়ে বলেন) এইসব একদম বলবেন না। আমি নিজেকে কিন্তু কবি বলি না। বড়োজোর কবিতালেখক বলতে পারি। আমি কবি নই। কবি মানে রবীন্দ্রনাথ, কালিদাস, শেক্সপীয়র। সেই উচ্চতায় পৌঁছনোর যোগ্যতা কোথায় আমার?
শ্যামলীঃ কিন্তু আপনি তো প্রত্যক্ষ করছেন কবির যন্ত্রণা, অনুভব করছেন কবিতার বদলে যাওয়া ভাষা। এই যে নয়ের দশক, যখন আমরা স্কুলের গন্ডি ছাড়িয়ে সদ্য কলেজ, তখন তো গ্লাসনস্ত, পেরেস্ত্রৈকা, উত্তর-আধুনিকতা… সমস্ত পৃথিবী বিশ্বায়নের আওতায় ঢুকে পড়ছে…
পিনাকীঃ সে বড়ো আশ্চর্য সময়। আশির দশকে যেভাবে ছিলাম, নব্বইয়ের দশকের দ্রুত বদলের ফলে আমরা সবাই সময়ের অভিঘাতের মধ্যে পড়েছি। এর প্রভাব তো শুধু লেখকের ওপর পড়েনা। এর প্রভাব সর্বত্র। সমাজে-সংসারে। কবিতা সে সময়েও লেখা হত। আজও লেখা হচ্ছে। কিছু মানুষ সবসময় সর্বযুগে থাকবেন, যাঁরা কবিতা পড়বেন, কবিতা বুঝবেন এবং কবিতাকে ভালবাসবেন। আবার কিছু অকবিও থাকবেন। কিন্তু সব কিছু নিয়েই সভ্যতা এগিয়ে চলে। কিচ্ছু থেমে থাকে না।
জন্ম ’৭১, কলকাতা
বর্তমানে আজকাল প্রকাশনা বিভাগের অ্যাসিস্ট্যাণ্ট ম্যানেজার পদে কর্মরত।
১৯৯৮ সাল থেকে আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের এফ এম রেইনবো (১০৭ মেগাহার্তজ) ও এফ এম গোল্ড প্রচারতরঙ্গে বাংলা অনুষ্ঠান উপস্থাপক।
কলকাতা দূরদর্শন কেন্দ্রের ক্যাজুয়াল ভয়েস ওভার আর্টিস্ট।
২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে যাদবপুর ইউনিভার্সিটি কমিউনিটি রেডিওতে (JU ৯০.৮ মেগাহার্তজ) ‘এবং রবীন্দ্রনাথ’ শীর্ষক সাপ্তাহিক ধারাবাহিক অনুষ্ঠানের নিয়মিত গবেষক ও উপস্থাপক।
২০১৮ সালের জুলাই মাস থেকে ‘সানন্দা’ ও ‘আনন্দলোক’ পত্রিকায় ফ্রিলান্সার অ্যাডভার্টোরিয়াল কনটেন্ট লেখার নিয়মিত দায়িত্ব।
কর্মসূত্রে ‘আজকাল’, ‘আবার যুগান্তর’, ‘খবর ৩৬৫’ ও অন্যান্য বহু পত্র-পত্রিকায় ১৯৯৬ সাল থেকে ফিচার এবং কভারস্টোরি লেখার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা।
‘একদিন’ পত্রিকার বিভাগীয় সম্পাদক হিসেবে ‘নারী-শিশু-বিনোদন-স্বাস্থ্য’ বিভাগে দীর্ঘদিন কাজের সুযোগ।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাণিবিদ্যায় স্নাতকোত্তর এবং ‘ফ্রেশ ওয়াটার ইকোলজি’ বিষয়ে গবেষণা করে পি এইচ ডি ডিগ্রি।
একমাত্র প্যাশন গল্প লেখা।
‘গাংচিল প্রকাশনা’ থেকে প্রথম গল্প সংকলন ‘অসমাপ্ত চিত্রনাট্য’; সংকলনের গল্পগুলি বিভিন্ন সময়ে আনন্দবাজার পত্রিকা, সানন্দা, এই সময়, একদিন, উনিশ-কুড়ি, প্রাত্যহিক খবর, তথ্যকেন্দ্র পত্রিকায় প্রকাশিত।
পরবর্তী গল্পসংকলন
“প্রেমের বারোটা” রা প্রকাশন
“ব্রেক আপ চোদ্দ” রা প্রকাশন
প্রকাশিত উপন্যাস—“জলের দাগ” (রা প্রকাশন), “সুখপাখি”, “এবং ইশতেহার” (সংবিদ পাবলিকেশন)
কিশোর গল্প সংকলন – ‘পড়ার সময় নেই’ (সৃ প্রকাশন)
কিশোর উপন্যাস – ‘বিষচক্র’ (কারুবাসা প্রকাশনী) এবং ‘এক যে ছিল রু’ (কেতাবি প্রকাশন)
এছাড়াও গবেষণাঋদ্ধ বই ‘শান্তিনিকেতন’। প্রকাশক ‘দাঁড়াবার জায়গা’।
আরও একটি ফিচার-সংকলন ‘মলাটে দৈনিক’। প্রকাশক ‘দাঁড়াবার জায়গা’।