ভারতের কোথায় কবে নববর্ষ
মনিকা মুখার্জী
বাংলা মাসের নামকরণ
ইংরেজী মাসের নামগুলি সাধারণত সংখ্যা নির্দেশক। কিন্তু বাংলা মাসের নাম হয় নক্ষত্রের নামে, যে নক্ষত্রের ওপর দিয়ে পৃথিবীর মানুষ চাঁদকে অতিক্রম করতে দেখে। এ নিয়মে বাংলা মাসের নাম, বিশাখা থেকে বৈশাখ, জেষ্ঠ্যা থেকে জৈষ্ঠ, উত্তরাষাঢ়া থেকে আষাঢ়, শ্রবণা থেকে শ্রাবণ, পূর্বভাদ্রপদ থেকে ভাদ্র, আশ্বিনী থেকে আশ্বিন, কৃত্তিকা থেকে কার্তিক, মৃগশিরা থেকে মার্গশীর্ষ (অগ্রহায়ণ বা চলতি অঘ্রানকে মার্গশীর্ষ বলা হত )। পুষ্যা থেকে পৌষ, মঘা, থেকে মাঘ, ফাল্গুনি থেকে ফাল্গুন এবং চিত্রা থেকে চৈত্র। বাংলা মাসের এই জাগতিক উপাদান বাঙালির গর্বের বস্তু।
নববর্ষ কি ভাবে পালিত হয় ভারতের বিভিন্ন জায়গায় তার বিবরণ
তামিলনাডুতে নববর্ষ পালন করা হয় পয়লা এপ্রিল। চৈত্রপূর্নিমায় নববর্ষ পালন হয় অন্ধ্রপ্রদেশে, কেরলে বিশু নামে নববর্ষ পালন হয় ১৪ই এপ্রিল। কেরলের দক্ষিণ অংশে আরো একটা নববর্ষ পালন হয় ওনাম নামে। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি হয় এই ওনাম।
কর্ণাটকের নববর্ষ যুগাদি পালিত হয় ১লা চৈত্র, আকাশের চাঁদ দেখে শুরু হয় যুগাদি। অসমে ১লা বৈশাখ পালিত হয় ‘বিহু’ নামে নববর্ষ। এটি অবশ্য পালিত হয় বছরে তিন বার। নতুন বছরে প্রথম দিনটিতে হয় বংগালি বিহু ,কার্তিক মাসে হয় কাঙালি বিহু, আর মাঘে হয় ভোগালি বিহু।
মেঘালয়, মিজোরাম ও নাগাল্যাণ্ডের বেশির ভাগ মানুষই খ্রীষ্টান। তাই নববর্ষ পালিত হয় এই তিন রাজ্যে ১লা জানুয়ারী। মণিপুরে ১লা বৈশাখই হয় নববর্ষ। পূর্বাঞ্চলে আর একটি পাহাড়ি রাজ্য ত্রিপুরা । এখানে বাইরের মানুষ যেমন আছেন, তেমনি উপজাতির সংখ্যা ও কম নয়। বাঙালি দের ১লা বৈশাখের পাশাপাশি ওখান্কার ‘লুসি’ ও টুকাই উপজাতি খ্রীষ্টান ধর্মে বিশ্বাসী হওয়ায় ১লা জানুয়ারী নববর্ষ পালন করে। পাঞ্জাবীরা ১লা বৈশাখের আগের দিন নববর্ষ শুরু করে, আসল উৎসব অবশ্য পরের দিন, ওরা একে বলে বৈশাখী। রাজস্থানে নববর্ষ পালিত হয় রাম নবমীর দিন। গুজরাতে নববর্ষ হয় অঘ্রাণ মাসের প্রথম দিন। পশ্চিমবঙ্গে ১লা বৈশাখ পালিত হয় নববর্ষের অন্যতম অনুষ্ঠান হালখাতা, দেব দেবীর মন্দির দর্শন ইত্যাদি দিয়ে। বাঁকুড়া ,মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, মালদা, পশ্চিম দিনাজপুরের আদিবাসীরা নববর্ষ পালন করে ১লা মাঘ। অনুষ্ঠানের নাম ‘মাগসিম’। ঐ দিন মাদলের শব্দে জেগে ওঠে সাওতাল পল্লীর মানুষ। প্রত্যেকেই হাতে একটি মুরগী নিয়ে হাজির হয় বট বা অশ্বত্থ গাছের তলায়। আরাধ্য দেবতাকে নিবেদন করে মুর্গীটিকে। অনেকে আবার কচিপাতা বা ফল ও নিবেদন করে। কৃষি কাজে যুক্ত যারা, তারা হাল , লাঙল ছুঁয়ে ফসল বোনার শপথ নেয়। মেয়েদের চুলের খোঁপায় থাকে রঙিন ফুল আর পাখির পালক। এরপর থাকে নিজস্ব ঘরানার নাচ গান, খানাপিনা।
বিশেষ-
তামিল ভাষায় নববর্ষ উত্সবের নাম ‘পুটুবর্ষ পিরাপ্পু’। এপ্রিল মাসকে তারা বলে ‘চিহিরাই’ মাস। অন্ধ্রপ্রদেশে খুব ভোরে উঠে লোকেরা কৃষ্ণা, কাবেরী আর গোদাবরীর জলে স্নান করে নতুন কাপড় পরে বেঙ্কটেশ্বর মন্দিরে পূজো দেয়। সেদিন নিমফুল, আম, গুড়, আর কাঁচালংকা দিয়ে চাট্নী বানায়, তার নাম ‘উগাদি পার্য্চাদি’। চাট্নীর তেতো, মিষ্টি, টক, ঝাল বাস্তব জীবনে ঐ সব উপকরণের প্রতীক হিসেবে বছরের প্রথম দিন থেকেই গ্রহণ করা হয়। বিহু উৎসবে অসমের ঘরে ঘরে তৈরী হয় পিঠে, চলে পিঠে উৎসব। চাল, তিল, নারকেল দিয়ে তৈরী সেই পিঠের নাম ‘খোলসাপুরি’। পিঠে খাওয়া আর নতুন জামাকাপড় পরে বাড়ি বাড়ি য়াওয়া আর সৌজন্য বিনিময় এই উৎসবের অঙ্গ।
মেঘালয়, মিজো ও নাগাল্যান্ডে ৩১শে ডিসেম্বর ই মানুষজন ঘর ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসে। গির্জায় গির্জায় চলে প্রার্থনা, আকাশে ঝলসে ওঠে আতসবাজির আলো, তারপর শুরু হয় ভোজন উৎসব।
অন্যদিকে মণিপুরে নববর্ষ উৎসব কিছুটা অন্যরকম। বৈষ্ণবধর্মী মণিপুরীরা সেদিন কোলাহল থেকে দূরে থাকতেই পছ্ন্দ করে বেশী। ১লা বৈশাখ নববর্ষ হলেও উৎসবের শুরুটা হয়ে যায় দোল উৎসবের মধ্য দিয়ে। নতুন বছরের প্রথম দিন পর্য্ন্ত চলে এই রঙের খেলা। বৈষ্ণবধর্মের মূলমন্ত্র পরধর্ম সহিষ্ণুতা, তাই স্ফূর্তির বাঁধন থেকে বেরিয়ে আত্মসংযমের সাহায্যেই মণিপুরীরা ১লা বৈশাখ পালন করে।
পাঞ্জাবীরা গুরুগোবিন্দর স্মরণ করে গুরুদ্বারের সরোবরে স্নান করে ‘গ্রন্থসাহেব’ পাঠ করে ১লা বৈশাখ সকাল থেকে, গুরুদ্বারগুলিতে চলে উপাসনা, দুপুরে চলে ভোজ। খাওয়া শেষ হলে সকলে একসংগে দৌড়ে যায় কৃষিখেতের দিকে, সেখানে ভরা ফসলের দিকে তাকিয়ে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে শুরু হয় প্রীতি ও সৌজন্য বিনিময়।পরের দিন থেকে শুরু হয় গম কাটার কাজ।
গুজরাতে – সবরমতী নদীর পাড়ে বসে মেলা, বজরা ভাসিয়ে শুরু হয় দৌড় প্রতিযোগিতা। নদীর জলে প্রদীপ ভাসিয়ে মৃতজনকে স্মরণ করে তারা। বেসনের খাবার তৈরী হয় বাড়িতে বাড়িতে। সন্ধেয় শুরু হয় নাচ গানের আসর,ব্যবসায়ীরা সেদিন খাতা পূজোরও আয়োজন করে।
ধর্মীয় উৎসবের পরেই নববর্ষ উৎসবটি অত্যন্ত জাঁকজমকের সংগে পালিত হয় প্রায় সর্বত্রই। বৈদিক গ্রন্থগুলিতে ও এই নববর্ষ উত্সব পালনের খবর পাওয়া যায়। নববর্ষের আগমনে অগ্নিপিতা ও পৃথিবীমাতাকে অর্ঘ্য দিয়ে শুরু হত নববর্ষের উৎসব।
গোটা বৎসরের ফসল দেবতার করুণার উপর নির্ভরশীল, তাই উত্সবের আন্তরিকতায় এতটুকু ঘাটতি নেই। গ্রামের সব্চাইতে সুন্দরী মেয়েটিকে অপূর্ব সাজে সাজিয়ে দেবতার বেদিমূলে নৈবেদ্য হিসেবে দেওয়া হত।
ভারতবর্ষের এই প্রাচীনতম উত্সবের নাম ‘মহাব্রত’। কারো মতে এটি হত গ্রীষ্মের আরম্ভে, অন্য মতে বর্ষার শুরুতে।
![ইরাবতী ডেস্ক](https://irabotee.com/wp-content/uploads/2021/12/irabotee-cover-e1640636602578-150x150.jpg)