গল্প : গত যুদ্ধের ইতিহাস
১৯৪০ সাল।
আমরা তখন প্রেসিডেন্সী কলেজের ছাত্র। অর্থাৎ কলেজের খাতায় নাম আছে, ক্লাস করি রায়ের কেবিন কিংবা বেকার ল্যাবরেটরীর উত্তরের বিস্তৃত সবুজ মাঠে। নিজেরাই এক-একটি ক্ষুদে অধ্যাপক, প্রশ্ন এবং মীমাংসা নিজেরাই করি। বিষয়: দেশের স্বাধীনতা থেকে চেম্বার-লেনের ভুল পর্যন্ত। আমরা সকলেই তখন এক-একজন যুদ্ধবিশারদ।
কলেজের মাঠে বসে আড্ডা দিতে দিতে কখন যে সেদিন সন্ধ্যা নেমেছে, আকাশে তারা আর পথে পথে ইলেকট্রিকের আলো জ্বলেছে খেয়াল হয়নি।
খেয়াল হলো একটা প্লেনের আওয়াজে।
ধীরে ধীরে আমরা ক’ বন্ধু বেরিয়ে এলাম, লোহার ফটক খুলে দিলো দারোয়ান।
তারপর একে একে সবাই বিদায় নিলো, ঘন্টি বাজিয়ে একটার পর একটা ট্রাম চলে গেল, আর আমি অন্যমনস্কভাবে রেলিঙের ধারে টাঙানো পুরোনো বই দেখতে দেখতে কখন যে হ্যারিসন রোডের মোড়ে পানের দোকানটার সামনে এসে দাঁড়িয়েছি টের পাইনি।
পকেট থেকে সাতটা পয়সা বের করে দোকানীর কাছ থেকে একটা মেয়েলী গলা শুনলাম, দুটো পয়সা দেবেন?
ফিরে তাকালাম। ফিরে তাকিয়ে চমকে উঠলাম।
বছর তেরো-চোদ্দ বয়সের একটি ফর্সা মুখ। কাঠির মতো রোগা শীর্ণ চেহারা, কিন্তু চোখ দুটো কেমন করুণ গভীর। কপালে একটা খয়েরের কিংবা বিন্দির টিপ।
তার শরীরে জড়ানো ছাপা শাড়িটায়, চুলে আর মুখে, অল্প হলেও একটা সযত্ন প্রসাধনের চিহ্ন ছিলো।
আমি তার দিকে তাকিয়ে আছি দেখে সে হঠাৎ ফিক করে হেসে উঠেই গলায় যথাসম্ভব গাম্ভীর্য আনবার চেষ্টা করে বললে, ব্যান্ডেলে ফিরে যাবো, দু’টো পয়সা কম পড়ছে, দিন না দু’টো পয়সা!
বলে হাত পাতলো সে।
দেখলাম, তার হাতে বেশ কয়েক আনা পয়সা রয়েছে।
আমি ইতস্তত করছি দেখে সে আবার বললে, দু’টো পয়সা তো, দিন না…
বাড়তি পয়সা আমার কাছেও বিশেষ ছিলো না, তবু একটা আনিই দিলাম তাকে। আর পয়সাটা নিয়েই সে চলে গেল, হারিয়ে গেল ভিড়ের মধ্যে।
কিন্তু ঐ শীর্ণ ফর্সা মুখখানা মন থেকে মুছে ফেলতে পারলাম না। থেকে থেকেই মনের মধ্যে খোঁচা দিতে শুরু করলো।
সময় পেলেই সন্ধ্যের দিকে পানের দোকানটার সামনে এসে দাঁড়াতাম, ওকে খুঁজতাম। যদি আবার কোনো দিন দেখা পাই।
কিন্তু দিনের পর দিন কেটে গেল, খুঁজে পেলাম না। হয়তো ভুলেও গিয়েছিলাম।
হঠাৎ আবার দেখা হয়ে গেল একদিন, একটা সিনেমা-হাউসের সামনে।
ঠিক আগের মতোই ও এগিয়ে এলো, হাত বাড়ালো। বললে, দু’টো পয়সা দেবেন, ভাড়ার পয়সা কম পড়ে গেছে।
আমি হেসে ফেলে ওর মুখের দিকে তাকালাম। কিন্তু বেশ বুঝতে পারলাম, মেয়েটি আমাকে চিনতে পারেনি।
কোনো কথা না বলে দু’টো পয়সা ওর মুঠো-ভরা আনি দু-আনির ওপর রেখে দিলাম। আর সঙ্গে সঙ্গে আমার সঙ্গী বন্ধুটি প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো: ও কি রে, দিলি ওকে?
মেয়েটি ততক্ষণে ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেছে।
বন্ধুটিকে বললাম, দিলেই বা? দু’টো পয়সা তো?
সে হাসলো, বললে, ওকে চিনিস না? এক নম্বরের জোচ্চোর। সবাইকে ঐ এক কথা বলে পয়সা নেয়। সব মিছে কথা ওর।
বললাম, ফন্দিটা মিথ্যে হতে পারে, অভাবটা মিথ্যে নয়।
বন্ধু ঠাট্টা করলে, তেরো বছরের একটা পুঁচকে মেয়ে দেখেই দাতা কর্ণ হয়ে গেলি যে!
হেসে বললাম, তেরো বছর বয়েস বলেই ফন্দি আঁটতে হচ্ছে ওকে, বয়স বাড়লে কি আর এসব দরকার হবে!
কথাটা যখন বলেছিলাম, তখন অত হিসেব করে বলিনি।
কিন্তু মেয়েদের বয়েসটা যে অত বড় জিনিস তখন জানতাম না।
মাঝখানে কয়েকটা মাস, না একটা বছর কেটে গিয়েছিলো, জানি না। শুধু এটুকুই মনে আছে, পরীক্ষা শেষ হলো সেদিনই। আমরা ক’ বন্ধু একসঙ্গে বাসে উঠলাম, বাড়ি ফেরার পথে। চিৎকার হট্টগোল করে, বাসসুদ্ধ লোকের বিরক্তি উৎপাদন করে আমরা তখন প্রশ্ন আর উত্তরের জটিল তর্কে ডুবে আছি।
আর সেই সময়েই হঠাৎ এক গাছি কাচের চুড়ি পরা সরু আর ফর্সা একখানা হাত চোখের সামনে এগিয়ে এলো।
চমকে চোখ তুললাম। দেখি, সেই মুখ, তেমনি টানা-টানা করুণ গভীর এক জোড়া চোখ! শুধু শরীরে ঈষৎ পরিবর্তন। রুগ্নতার মধ্যেও কোথায় যেন একটা শ্রী ফুটে উঠতে চাইছে। কৈশোর যেন উঁকি দিতে চাইছে যৌবনের জানালায়।
আগের মতোই মুঠো-ভরতি আনি দু-আনির হাতখানা এগিয়ে দিয়ে সে দাঁড়িয়ে রইলো। কিন্তু কোনো কথা বললো না, কারণ দর্শালো না, অনুরোধ জানালো না।
দু’টো পয়সা দিতেই সে সরে গেল, গিয়ে দাঁড়ালো পাশের লেকের সামনে। আর কি আশ্চর্য, সকলেই কিছু-না-কিছু দিলো।
কিন্তু বাসের পাঞ্জাবী কনডাকটারের চোখ পড়তেই সে তাড়া করে এলো মেয়েটিকে। তাকে নেমে যেতে বললে ধমকের ভাষায়।
সেই শীর্ণ পাণ্ডুর মুখখানার এতটুকু পরিবর্তন হলো না, দু’টো তীব্র চোখ তুলে মেয়েটি কনডাকটারের দিকে তাকালে। তারপর ধীরে ধীরে নেমে গেল, বাস থামতেই। আর বিশাল চেহারার কনডাকটারটা যেন মুহূর্তে চুপসে গেল।
আমরা স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। আমরা গর্বিত বোধ করলাম।
এর পর তাকে প্রায়ই বাসে ট্রামে দেখতে পেতাম। নিত্যদিনের মতোই সে পয়সা-ভরা একটা মুঠো খুলে ধরতো চোখের সামনে। কেউ দু-চার পয়সা দিতো, কেউ দিতো না। যেন রুটিন-বাঁধা কাজ। সময় ধরে কয়েক সেকেন্ড সে সকলের সামনে দাঁড়াতো।
এমনি সময় একদিন একটা ঘটনা ঘটলো।
সন্ধ্যের সময় বাড়ি ফিরছি দোতলা বাসের হাওয়া খেতে খেতে। আ:, সে কি ঝড়ের মতো হাওয়া পুরনো দিনের সেই বাসে।
সেদিনও মেয়েটি এসে দাঁড়াচ্ছে এক-একজনের সামনে। এমন সময় একটা চিৎকার শুনলাম কনডাকটারের: পয়সা নেহি তো উতর যাও।
বিস্মিত হয়ে ফিরে তাকালাম।
জামা-কাপড়ে কালিঝুলি-মাখা একটি লোকের ওপর কনডাকটার তড়পাচ্ছে। আর লোকটা কাঁচুমাচু করে বলছে, পয়সা পড়ে গেছে পকেট থেকে, আমাকে আজ যেতে দাও সর্দারজী।
কিন্তু সর্দারজীর মন গলানো গেল না, সে আবার বললে, উতর যাও। লোকটাকে নামিয়ে দেবার জন্যে বোধ হয় হাতও বাড়িয়েছিলো।
এমন সময় মেয়েটি চিৎকার করে উঠলো: এই জানোয়ার!
সকলেই চমকে উঠলো, সকলেই বিস্মিত হলো। ভিক্ষে যার বৃত্তি, তার মুখ থেকে এমন একটা ধমক আসতে পারে কেউ ভাবিনি।
মেয়েটির সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। সে তেমনি তীব্র চোখে তাকিয়ে কনডাকটারের দিকে এগিয়ে গেল, তারপর দু-আনি এগিয়ে দিয়ে বললে, দাও, ওর টিকিট দাও।
মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, এরপর যেদিনই ও আসবে, হাত পাতবে, একটা আনি দেবো, কিংবা দু-আনি।
হয়তো দু-একবার দিয়েওছিলাম। তারপর কখন থেকে যে ওকে পয়সা দেওয়া বন্ধ করেছিলাম জানি না। তখন সারা কোলকাতায় ব্যাফল্ ওয়াল উঠছে, বিদেশী সৈন্যরা আসছে, বড় বড় মিলিটারী ট্রাকে পথঘাট সরগরম।
জিনিসপত্রের দামও তখন বাড়ছে তরতর করে। তাই হয়তো মেয়েটিকে অনেকেই নিরাশ করতে শুরু করলো। একটা আনির তখন কোনো দাম নেই বলেই একটা আনিরও তখন অনেক দাম।
সেইজন্যেই হয়তো মেয়েটিকে আর বড় একটা দেখতে পেতাম না।
১৯৪২ সাল।
মাঝখানে অনেকগুলো মাসে কেটে গেছে, মেয়েটিকে কোন দিনই দেখতে পাইনি। হয়তো হাত বাড়িয়ে দাঁড়ালেও কেউ ভিক্ষে দিতো না বলেই, কিংবা কে জানে, হয়তো ভিক্ষের চেয়েও বেশী কিছু দিতে চাইতো কেউ কেউ, তাই ও পথ থেকে সরে গিয়েছিলো সে।
কিন্তু একদিন হঠাৎ ওকে আবার আবিষ্কার করলাম।
ডালহৌসী স্কোয়ারের একটি আপিসে এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছি। দেখি কি, ছোট্ট একটি স্যুটকেস হাতে নিয়ে মেয়েটি ঢুকলো। প্রথমে ওর মুখটা দেখতে পাইনি, আমাদের দিকে পিছন ফিরে উলটো দিকের টেবিলে যারা বসে ছিলো তাদের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো সে, স্যুটকেস খুলে কি যেন দিলো, পয়সা নিলো। বেশ বুঝতে পারলাম, মেয়েটিকে ওরা সকলেই চেনে, মাঝে মাঝে নিশ্চয় আসে, টুকিটাকি ফেরি করে যায়। কারণ, ওকে দেখে প্রত্যেকেই মৃদু অভ্যর্থনা জানালো, কেউ বোধ হয় শুধু হাতে ফেরাতে চাইলো না।
মেয়েটি ঘুরে ঘুরে বন্ধুটির টেবিলেও এলো। আর তখনই ওকে স্পষ্ট দেখতে পেলাম, চিনতে পারলাম।
স্যুটকেস খুলে দাঁড়ালো মেয়েটি। প্যাকেট-বাঁধা পাঁপর, দাঁতের মাজনের শিশি, আরো দু-চারটে টুকিটাকি।
মেয়েটির মুখের দিকে, শরীরের দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম এবার। একটু যেন লম্বা হয়েছে আগের চেয়ে, একটু শ্রী বেড়েছে।
সে চলে গেল একসময়, আর চলে যাবার পরও যেন একটা রেশ রেখে গেল মনের ওপর। রীতিমতো খুশী হয়ে উঠলাম মনে মনে। খুশী হয়ে ওঠবারই তো কথা! যে এই সেদিনও ভিক্ষের ওপর নির্ভর করতো সে যে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছে, এ কি কম আনন্দের।
মেয়েটির পরিচয় জানার জন্যে তীব্র একটা আগ্রহ দেখা দিলো মনের মধ্যে।
বন্ধুটিকে প্রশ্ন করলাম, চিনিস ওকে?
— না তো! আসে মাঝে মাঝে, এটা-ওটা বিক্রি করে যায়।
বলতে গিয়েও বন্ধুটিকে ওর পুরোনো ইতিহাস বলতে বাধলো। না, যে নিজের মর্যাদা নিজে আহরণ করেছে, তার পিছনের পরিচয়টুকু জানিয়ে দিয়ে তাচ্ছিল্য দেখাবো না।
তবে আমার অভিমানের তারে মেয়েটি বোধ হয় ঘা দিয়ে গেল। বহুবার ঘা দিয়ে গেছে। আশ্চর্য, এতোদিন ওকে ভিক্ষে দিয়েছি, এতবার দেখা হয়েছে, তবু কোনোবারই আমাকে ওর চেনা মনে হয়নি। পৃথিবীর কোনো মানুষটাই যেন ওর পরিচিত নয়। কেউ রাস্তার মানুষ, ভিক্ষে দেওয়ার পর যার আর কোনো পরিচয় নেই। কেউ শুধুই খদ্দের, জিনিস কেনাবেচার পর যার সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক থাকে না।
মেয়েটির কথা ভেবে আমি বহুবার বিস্মিত হয়েছি। এ কেমন মানুষ, যে পিছনের দিকে তাকায় না? এ কেমন মানুষ, যে মিষ্টি হাসির প্রতিবাদটুকুও দেয় না! কিন্তু ভেতরে ভেতরে একটু শ্রদ্ধাও যে না করতাম তা নয়।
মনে হতো, ওর নিজের ভবিষ্যৎ ও নিজেই গড়ে নিতে জানে। গড়ে নিয়েছিল।
মাস কয়েক পরেই আরেক টুকরো রোমাঞ্চের শিস দুলিয়ে দিয়ে গেল মেয়েটি।
চমকে উঠেছিলাম, একেবারে সেই প্রথম দিনটির মতোই।
কালীঘাটের ট্রাম ডিপোর সামনে দাঁড়িয়ে আছি, ট্রামের অপেক্ষায়। হঠাৎ দেখি মন্দিরের দিক থেকে একটি মেয়ে হেসে হেসে হেলে-দুলে এগিয়ে আসছে, সঙ্গে একটি প্রায় সমবয়সী ছোকরা। মেয়েটির পরনে লালপাড় সাদা শাড়ি, কপালে ডগডগে সিঁদুরের ফোঁটা, সিঁথিতে চওড়া করে টানা সিঁদুর, আর হাতে মাটির সরায় বেলপাতায় লেপা সিঁদুর, ফলমূলের প্রসাদ। হয়তো কালীমন্দিরে পুজো দিয়ে ফিরছিলো সঙ্গের ছেলেটি যে ওর স্বামী তা বুঝতে অসুবিধে হলো না। একটা খাকির ময়লা ট্রাউজার্স ছেলেটির পরনে, গায়ে কলারওয়ালা নীল গেঞ্জি। বোধ হয় কোনো মোটর গ্যারেজে কাজ করে।
হাসতে হাসতে ওরা এগিয়ে এলো, ট্রামে উঠলো। দেখলাম মেয়েটির শরীরে অদ্ভুত পরিবর্তন এসেছে। সেই শীর্ণ কিশোরী মেয়েটি যেন যৌবনের পরিপূর্ণতার ঘাটে এসে পৌঁছেছে। সেই বিষণ্ন মুখে কি এক বিচিত্র উন্মাদনা।
ছোটবেলায় আমাদের বাড়ির সামনে একটা লেবুগাছ বসানো হয়েছিলো। রোজ ভোরবেলায় উঠেই তার কাছে ছুটে আসতাম, ভাবতাম গাছটা বুঝি রাতারাতি বড় হয়ে উঠেছে। কিন্তু না, ধীরে ধীরে সেটা কবে যে বড় হয়েছে, কোনো দিনই টের পাইনি। শুধু একদিন দেখলাম, সে গাছে ফুল ধরেছে, তারপর ফলও ধরলো একদিন। আর সেদিন কি আনন্দ যে হয়েছিলো গাছটায় লেবু ধরতে দেখে। ঠিক তেমনি আনন্দ হলো মেয়েটিকে দেখে, মনে হলো ও বুঝি সত্যি ওর গন্তব্যে পৌঁছে।
১৯৪৩ সাল।
ভুল ভেবেছিলাম। খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে বাতাসের শব্দ শুনতে চেয়েছিলাম। ভাবিনি, রাস্তায় রাস্তায় ব্যাফল ওয়ালের ধাক্কা খেয়ে অন্ধকার ঘরের নিভৃতে বাতাস ঢোকে না, ঢুকতে পায় না। ভাবিনি, পথে পথে চোখে ঠুলি আঁটা ব্ল্যাক আউটের রাতের ল্যাম্পপোস্টের আলো তার নীচেই অন্ধকার জমিয়ে রাখে।
তাই আবার একদিন দেখতে পেলাম মেয়েটিকে।
সাদা চাদরের মতো মুখ। বিষণ্ন, ক্লান্ত, পরাজিত। একটা সরু কালোপাড় ধুতি পরনে, মাথায় ঘোমটা কোলে একটি বাচ্চা শিশু—সিঁথির সিঁদুর মুছে গেছে।
কলেজ স্ট্রীটের মোড়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম ওকে। কি এক অজানা ব্যথায় বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো। কাছে এগিয়ে গেলাম, একটা আধুলি রাখলাম ওর পাতা হাতে।
ও চমকে চোখ তুললো। চোখ নামালো।
আমি ধীরে ধীরে বললাম, তোমার স্বামী?
ও আবার চোখ তুললো, চোখ নামালো। কিছুক্ষণ নিশ্চুপে দাঁড়িয়ে থেকে বললে, নেই।
বললাম, কি হয়েছিলো?
মেয়েটি কোনো উত্তর দিলো না, হঠাৎ ঝরঝর করে জল গড়িয়ে পড়লো ওর দু গাল বেয়ে।
আবার কি বলতে যাচ্ছিলাম, কে যেন শিস দিয়ে উঠলো। ফিরে তাকালাম। দেখি, দুটো অভদ্র দৃষ্টি ওকে লক্ষ্য করে কি যেন বলাবলি করছে।
আমি তাড়াতাড়ি একটা চলন্ত ট্রামে উঠে পড়লাম।
সে রাত্রে ঘুমোতে পারিনি। মনে হয়েছে, শুধু ওই মেয়েটিই নয়, আমি—আমরা সকলেই যেন হেরে গেছি, হেরে যাবো।
পরের দিনই আবার ওর খোঁজে গিয়েছিলাম। কিন্তু, না, আর সেই ল্যাম্পপোস্টের নীচে তাকে দেখতে পাইনি।
১৯৪৪ সাল।
দোলের দিন। চতুর্দিকে বর্বর উল্লাস। বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখছি, সামনের গলি দিয়ে হেঁটে চলেছে রঙমাতাল মানুষের দল।
হঠাৎ একটা হুড-খোলা গাড়ি ছুটে এলো, থামলো।
বেয়াদবির রঙে রাঙা জন পাঁচেক নেকড়ে-মানুষ। মাঝখানে একটি মেয়ে। সারা শরীর তার রঙে আর আবীরে মাখা। তার এক রাশ ফাঁপানো চুলে যৌবনের আগুন।
প্রথমটা চিনতে পারিনি। গাড়ি থেকে নেমে মেয়েটি দু হাতে ওর এলো চুলের রাশিকে খোঁপায় জড়ালে, শাড়ির প্রান্তে মুখের রঙ মুছলে। আর তখনই চিনতে পারলাম।
সেই মেয়েটি!
সমস্ত মন আমার বেদনায় বিষণ্ন হয়ে গেল। কিন্তু তার যেন কোনো দিকেই ভ্রুক্ষেপ নেই। হাসিমুখে কি একটা ঠাট্টা ছুঁড়লো সে, তারপরে আবার গাড়িতে উঠে বসলো। পরমুহূর্তেই গাড়িটা অদৃশ্য হয়ে গেল।
সেদিন আমি মনে মনে প্রার্থনা করেছিলাম, যেন মেয়েটিকে আর কোনো দিন দেখতে না হয়। যেন দেখা না হয়।
মনে মনে বলেছিলাম, প্রতি মুহূর্তে রাস্তায় এত এত দৈত্যকায় মিলিটারী ট্রাকের নীচে এত এত মানুষের এত মৃত্যু হচ্ছে, ওই মেয়েটিরও যেন এভাবেই মৃত্যু হয়। গোরা বা মার্কিন সৈন্যদের একটু বেহিসেবীপনার ফলে ও যেন মুক্তি পায়।
কিন্তু না, আমার প্রার্থনা শোনবার মতো সময় নেই তখন ঈশ্বরের। সারা পৃথিবীর যুদ্ধবিদ্ধস্ত মানুষের প্রার্থনা তখন শুনতে হচ্ছে তাঁকে।
তাই মেয়েটিকে আবার দেখতে হলো। কিন্তু এভাবে দেখবো, ভাবিনি কোনো দিন।
সাদার্ন অ্যাভেনিউয়ের কয়েকখানা প্রাসাদোপম বাড়িতে তখন বিট্রিশ আর মার্কিন সৈন্যদের বাস। লেকের ধারে সৈন্যশিবির। আমেরিকান নিগ্রো সৈন্যদের পৈশাচিক উল্লাসে কখনো নিস্তব্ধ রাত সচকিত হযে ওঠে, কখনো শেতাঙ্গ সৈনিকদের নির্লজ্জ বর্বরতায় আমরা স্তম্ভিত হয়ে যাই। যুদ্ধদিনের সেই মানুষগুলোকে দেখে বোধহয় বনের পশুও লজ্জা পেতো। তাই সন্ধ্যে ঘন হতে না-হতেই সকলে ফিরে আসতো তখন ঐ তল্লাট থেকে। একটা বীভৎস প্রেতনৃত্য চলতো তখন ঐ অন্ধকার গাছগাছালির জোৎস্না-ঢাকা ছায়ায়।
আমরা ক বন্ধু ফিরে আসছি তখন! রাত ন’টা হবে হয়তো। কিংবা আরো বেশী।
শ্বেতসৈনিকের দল চলেছে ফিরিঙ্গী বারবধূদের কোমর জড়িয়ে ধরে। কারো সঙ্গে শেতাঙ্গ নার্স, অথবা ওয়াকি মেয়ে।
হঠাৎ এক জায়গায় এসে থমকে দাঁড়ালাম। রাস্তার ধারে গাছের নির্জন ছায়া-ছায়া অন্ধকারে একা একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারে তার মুখ দেখা গেল না। কিন্তু সে যে বাঙালী, শাড়ির বদলে কোমরে বেল্ট বাঁধা লম্বা সেমিজটাকে প্রায় গাউনের ভাব দিলেও তা বুঝতে ভুল হলো না।
থমকে দাঁড়ালাম। সামনের ব্যারাক থেকে একটি টমি বেরিয়ে এলো, এসে দাঁড়ালো মেয়েটির সামনে। সিগারেট বের করে দিলো মেয়েটিকে। তারপর দুজনই সিগারেট ধরিয়ে এগিয়ে গেল লেকের ঘাস গাছ জলের অন্ধকারে। আর সেই মুহূর্তে, একটা ঠুলি-পরা ল্যামপোস্টের কাছে গিয়ে ওরা পৌঁছতেই আমি শিউরে উঠলাম।
মেয়েটিকে স্পষ্ট চিনতে পারলাম। আর সঙ্গে সঙ্গে সেই বিস্মৃত মুহূর্তের ছবিটা নতুন করে চোখের সামনে ভেসে উঠলো। সেই ক্লান্ত ম্লান বৈধব্যের কোলে একটি ছোট্ট শিশু। একটি পরাজিত মুখে মাতৃত্বের গৌরব! ক্ষণিকের জন্যে একটি প্রশ্ন জেগেছিলো মনে, জানতে ইচ্ছে হয়েছিলো সেই ছোট্ট শিশুটির কথা। কিন্তু সে প্রশ্নের সুযোগ জোটেনি।
সেই শেষ। তারপর আর কোনো দিন তাকে দেখিনি। কত বছর কেটে গেছে, তার কথাও ভুলে গিয়েছিলাম।
ইতিমধ্যে যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। স্বাধীনতা এসেছে। আরো কত কি। দিনে দিনে কত ইতিহাস রচিত হয়ে গেছে আমাদের চোখের সামনে।
কে জানতো, সেই মেয়েটিকে আবার একদিন মনে পড়বে!
১৯৫০ সাল।
সন্ধ্যার সময় চৌরঙ্গীর পত্রপত্রিকার স্টলের দিকে চলেছিলাম এক বন্ধুর সঙ্গে। ট্রাম-লাইন পার হয়ে খানিকটা আবছা অন্ধকার। এক রাশ বালি পড়ে আছে এক পাশে, হয়তো রাস্তা মেরামতের জন্যে জড় করে রাখা হয়েছে। আর তার ওপর কুস্তি লড়ছে দু’টো কালোকুলো ছেলে। বয়েস ছ-সাত বছরও নয়। খালি গা।
ধমক দিতেই ছেলে দুটো হাত-পায়ের বালি ঝেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। তারপর একজন হাত পাতলে, এটা বিড়ি দেন না বাবু!
হেসে ফেললাম তার ভাবে-ভঙ্গিতে।
হাতের সিগারেটে শেষ টান দিয়ে ছুঁড়ে ফেলতেই অন্য ছেলেটি ছুটে গিয়ে সেটা তুলে নিলো, বার তিনেক টান দিয়ে একমুখ ধোঁয়া ছাড়লে পরম তৃপ্তিতে।
বললাম, মারামারি করছিস কেন?
একজন দাঁত বের করে হাসলো, ও শালা বলছে ওর বাবা সাহেব!
আরেকজন বললে, ও শালার বাবা নেই বাবু। বলেই খিলখিল করে হাসলো।
সঙ্গের বন্ধু জিগ্যেস করলে, কে আছে তোদের? বাবা-মা আছে?
দু’জনে একই সঙ্গে বললে, কেউ নেই বাবু।
— কেউ নেই? সহানুভূতির স্বরেই বন্ধুটি প্রশ্ন করলে, মা?
ছোট ছেলেটা হেসে উঠলো, বললে, কি জানি বাবু, সে মা বেটীই জানে, বেঁচে আছে না মরে গেছে।
বললো এমন ভঙ্গীতে যেন মায়ের প্রতি ঘৃণাও নেই ছেলেটার। তার চেয়েও নৃশংস একটা নির্লিপ্ত ভাব।
কেন জানিনা, সেই বহুপরিচিত মেয়েটির কথা মনে পড়ে গেল। কপালে ডগডগে সিঁদুরের ফোঁটা, সিঁথিতে আগুনের মতো লাল রেখা। হাতে মাটির সরায় যাকে একদিন সিঁদুর বেলপাতা আর পুজোর প্রসাদ নিয়ে হাসতে হাসতে হেলে-দুলে স্বামীর পাশে পাশে ট্রামে উঠতে দেখেছিলাম। আবার একদিন যাকে শ্বেত-শান্ত বৈধব্যের কোলে একটি কালো-কুলো শিশুকে নিয়ে রাস্তার মোড়ে হাত পেতে দাঁড়াতে দেখেছিলাম।
আর মনে হয়েছিলো, ইতিহাস শুধু বইয়ের পাতায় নি:শব্দে পড়ে থাকে না, ইতিহাস আমাদেরই আশেপাশে, আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই ঘুরে বেড়ায়।
[১৩৬৮]
জন্ম: ২৮ ডিসেম্বর ১৯২২ – মৃত্যু: ২৯ জুলাই ২০১৮ ।একজন বাংলা উপন্যাসিক এবং গল্পকার। পিতা মহেশচন্দ্র চৌধুরী ও মাতা দুর্গাসুন্দরী দেবী। ১৯৮৮ সালে তার “বাড়ি বদলে যায়” উপন্যাসের জন্য তিনি সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পান।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই তার লেখা-লেখি শুরু হয় । তিনি আনন্দবাজার পত্রিকার সঙ্গে বহু বছর যুক্ত ছিলেন ,এমনকি তিনি পত্রিকার ‘রবিবাসরীয়’ বিভাগের সম্পাদক পদ অলঙ্কৃত করেন।