আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট
![কৃষ্ণা রায়](data:image/svg+xml;base64,PHN2ZyB4bWxucz0iaHR0cDovL3d3dy53My5vcmcvMjAwMC9zdmciIHdpZHRoPSIxMDAiIGhlaWdodD0iMTAwIiB2aWV3Qm94PSIwIDAgMTAwIDEwMCI+PHJlY3Qgd2lkdGg9IjEwMCUiIGhlaWdodD0iMTAwJSIgc3R5bGU9ImZpbGw6I2NmZDRkYjtmaWxsLW9wYWNpdHk6IDAuMTsiLz48L3N2Zz4=)
অপ্রত্যাশিত প্ল্যান থেকে জন্ম নেয়া একটি নভেলা। তৃষ্ণা বসাকের ভাবনা।
সেদিন কয়েকজন সৃষ্টিশীল মানুষ আড্ডা দিচ্ছিলেন ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে, আড্ডার শেষে একটি সবুজ রুমালের দেখা মিললো। একটি রুমাল কে বিড়াল করে দেবার জাদু তো প্রবাদের মত। এখানেও হলো তাই হঠাৎ পাওয়া সবুজ রুমাল টি পেয়েই সব ওলটপালট হয়ে গেল একদল সৃষ্টিশীল মানুষের ভাবনায়।জাদুর মতোই কোনো পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই ফেলে যাওয়া এক টুকরো রুমাল হয়ে গেলো ১২-ইয়ারি নভেলা ‘সবজে রুমাল রহস্য’।
পরপর লিখবেন ১২ জন। প্রথম পর্ব লিখলেন ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় এবং শেষ করবেন তৃষ্ণা বসাক। মধ্যে থাকবেন ১০ জন যথাক্রমেঃ
সোনালি, তপশ্রী পাল, ব্রততী সেন দাস, নিবেদিতা ঘোষ মার্জিত, নন্দিনী সেনগুপ্ত, শ্যামলী আচার্য, কৃষ্ণা রায়, ইন্দ্রনীল বক্সী, সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়, অমিতাভ দাস। আজ থাকছে কৃষ্ণা রায়ের লেখা রহস্য নভেলার অষ্টম পর্ব।
পরশু বিকেলের পর থেকে মণিকুন্তলার মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে গেছে। গোগোল ছেলেটি বেশ। আঙ্গুলের আলতো চাপ দিয়ে যত্ন করে কপালে কি যে সব কারিকুরি করছিল, মাথার ভারভার ভাবটা দিব্যি উধাও হয়ে গেল। আর কী নরম গলায় মণিকুন্তলার শারীরিক সমস্যার খুঁটিনাটি জেনে নিচ্ছিল। ভাল মন্দ লাগার কথাও। ঠিক দুগগা বাবুর মত। তাপসের বাবা নীরেন এমনিতে মানুষ ভাল হলে কি হবে বৌএর মনের খবর কোনকালেই বিশেষ রাখতেন না। অঙ্কের অধ্যাপক তার নিজের ছাত্র ছাত্রী আর বইপত্রের জগতেই দিব্য সবচ্ছন্দে ছিলেন। শহরের বাইরে কোথাও বেড়াতে যাবার কথা বললেই বাবুর মুখ ভার। কিন্তু ছোটবেলার বন্ধু দুগগা বাবুর কথা বিশেষ ফেলতে পারতেন না। দুগগা বাবু মাঝে মাঝে জোরজার করলে তবেই যা একটু এদিক ওদিক করা যেত । মানুষটা ঠিক বুঝতেন , সারাটা বছর চার-দেয়ালের মধ্যে থেকে সংসার খেলা, ছেলে মানুষ করা, আর আত্মভোলা ভাবুক স্বামীর সঙ্গে নিরন্তর সহবাস করা এক জন বুদ্ধিমতী ঘরোয়া মহিলা কতটা হাঁপিয়ে উঠতে পারে। স্ত্রী অকালে মারা যাওয়ায় সংসারের বাঁধন দুগগা বাবুর কিছুটা ঢিলেঢালাই ছিল। একমাত্র ছেলেকে কারশিয়াঙ্গে বোর্ডিং স্কুলে দিয়েছিলেন। বছরে বার দুয়েক বড়সড় ট্যুর করতেন, পাহাড়ে, পাহাড়ে । অফিসের কাজে মাঝে মধ্যে বিদেশ। চিন , শ্রীলঙ্কা, বার্মা , ইজিপ্ট, ইথিওপিয়া। প্রাচীন ইতিহাসের ভাল ছাত্র হয়েও আবগারি দপ্তরের অফিসার হয়ে জীবন কাটানোর জন্য মনে বেশ কষ্ট ছিল। সে জগতে কত রকমের অপরাধী নাকি ভাল মানুষের ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়ায়। সমাজের ওপরতলার কত কেষ্ট বিষ্টুও নাকি থাকে। সে সব ভরা রহস্যের কথা কতদিন বৌঠানের সঙ্গে গল্প করতেন। হ্যাঁ, বৌঠান বলেই ডাকতেন মণিকুন্তলাকে। ভারি সুন্দর বাঁশি বাজাতেন । দুগগা বাবু শহরের বাইরে গেলে মণিকুন্তলা বড় উদবিগ্ন থাকতেন। নীরেন কি টের পেতেন তাদের এই গোপন সখ্যের কথা? বোধ হয় পেতেন । না হলে সেবারে মিশর থেকে আনা অদ্ভুত আকারের আর বিচিত্র আঁকিবুঁকি ছাপ দেওয়া ফুলদানিটি মনিকুন্তলাকে উপহার দেওয়ার পর অত গুম হয়ে গিয়েছিলেন কেন? সাধারণত, বাইরে বেড়িয়ে ফেরার পর দুগগা বাবু এবাড়িতে এলেই মনিকুন্তলা রাতের খাবার না খাইয়ে ছাড়তেন না। সেবারে, খাবার টেবিলে বসে নীরেন বেশ শ্লেষের সঙ্গেই বন্ধুকে বলেছিলেন , কি রে! বেড়াতে গিয়ে শুধু বৌঠানের কথাই মনে পড়ে? আমার জন্য নিদেন পক্ষে একটা লাইটার গোছের অকিঞ্চিতকর জিনিস আনলেও তো পারতিস? না কি এ বাড়ির ফুলবাগানের মালির কাজ করাই তোর বেশি পছন্দের? হতবাক দুগগা বাবু কিছু বলার আগেই নীরেন হা হা করে হেসেছিলেন , মুখটা অমন করছিস কেন? আরে! ঠাট্টা বুঝিস না? মণির হাতের এই তেঁতুল-আমাদার চাটনিটা কেমন খেলি বল?
দুটো মানুষই চলে গেছে কতদিন হল। ফুলদানিটি আজো রয়ে গেছে। সেদিনের কথার পর মনিকুন্তলা কোনদিন ওটিতে ফুল রেখে গৃহসজ্জার চেষ্টা করেন নি। নীরেনও কোন প্রশ্ন করেন নি। তাঁর গোপন ভালবাসার দিনের সাক্ষ্যটি লোকচক্ষুর আড়ালেই ট্রাঙ্কে তোলা ছিল। বছরে একবার সেগুলোর ঝাড়পোঁছ হয়। সুচন্দ্রা সেদিন ওটা দেখে প্রশ্ন করেছিল। গত পরশু গোগোলকে সামনা সামনি দেখে আর পরিচয় পেয়ে পুরোনো দিনের কথা ভেবে এত প্রগল্ভ হয়ে পড়েছিলেন । সুচন্দ্রা খুব বুদ্ধিমতী । ও কি কিছু আন্দাজ করছে?
লিফটের কাছাকাছি এসে টুবু খুব আবাক হয়ে দেখে। আরে! এ কে ? ঠাম্মাই তো! কিন্তু , এখানে , কার সঙ্গে এল? লিফট থেকে বেরিয়ে ঠাম্মাই তো হেঁটে চলেছে। হ্যাঁ ডান পা-টা সামান্য কাত করে। ঠাম্মা ছাড়া এ আর কেউ না। কিন্তু সঙ্গের এই টল ডার্ক হ্যানডসাম লোকটি? ঠাম্মা একে চেনে মনে হচ্ছে। অফিসের কাজে দক্ষিণ কলকাতার এই পুরনো দিনের বাড়িটায় তাকে প্রায়ই আসতে হয়। এখানে অনেক ধরণের অফিস আছে। কিন্তু ঠাম্মা তো মা ছাড়া কোথাও আজকাল যায়না । টুবুর স্পেশাল বন্ধু তিতিরদেরও ফ্ল্যাট এখানে। অফিসের কাজের ফাঁকে যদি একবার তিতিরের সঙ্গে—-। তিতিরকে মা-র বিল্কুল না পসন্দ। তাই এখানে আসার কথাটা বলা যাবেনা । কিন্তু ঠাম্মা? তাড়াতাড়ি মোবাইলে মা কে ধরে। সুচন্দ্রা বিরক্ত গলায় বলে, এখন কেন টুবু,? জানোইতো এখন আমাদের গল্প- চক্রের স্পেশাল মিটিং চলছে।
এই এক জ্বালা! মাকে সব সময় সব কথা বলা যাবেনা। এত ব্যস্ত থাকে সারাদিন হাবিজাবি কাজে! আজকাল আবার বাংলা গল্প লেখা নিয়ে খুব মেতেছে।
– মা ঠাম্মা কোথায়?
– কোথায় আবার ? বাড়িতে। বোকা বোকা কথা এখন বোলো না টুবু।
– মা ঠাম্মাকে আজ রাস্তায় দেখলাম। ইচ্ছে করেই টিভোলি ম্যান্সনে আসার কথাটা চেপে গেল টুবু।
– বাজে বকা ছেড়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি এসো। আমার ফিরতে রাত হবে। ঠাম্মা একা থাকবে।
– মা আজ আমার অফিসের স্পেশাল ট্রেনিং আছে। ডেটা সায়েন্সের ওপর –, মিস করা যাবেনা।
যা বললাম , তাই করবে টুবু। আজ টিউশান-ট্রেনিং থাক, অন্যদিন ম্যানেজ করো। বাড়ি এসো আটটার মধ্যে। আগে তো বলোনি এই ট্রেনিং এর কথা?
টুবুর উত্তরের অপেক্ষা না করেই সুচন্দ্রা ফোন কেটে দেয়।
পুরু কাঠের দেয়াল ঘেরা ঘর। ভেতরে হাল্কা হলুদ আলো। ব্যাকগ্রাউন্ডে অচেনা ভাষায় একটানা মিহি সুরে গান বেজে চলেছে। কেমন ঘুম ঘুম পায় মণিকুন্তলার। গোগোল মিটিমিটি হাসে, বলো গ্রান্ডি, কেমন সারপ্রাইস দিলাম। মণিকুন্তলাকে ও বলেছে দিদা নয়, তুমি আমার গ্র্যান্ডি।
-এ কোথায় এলুম গোগোল দাদুভাই?
– জানবে , জানবে, তোমার জীবনে আজ এক বিশেষ দিন । বাড়ি গিয়ে তোমার হাতের সেই স্পেশাল নাড়ু খাওয়াবে। কথা দিয়েছ। কিছুটা প্যাক করে দিও কিন্তু।
– সে নিয়ে ভেবনা। তবে বেশি দেরি করিয়ে দিওনা ভাই। আমার পাহারাদার মাম্পি বেশি দেরি হলেই বৌমাকে ফোনে খবর দিয়ে দেবে।
- আরে গ্রান্ডি, ছাড়ো তো ওসব । সারা জীবন অনেক সংসার করলে। দাদুর কাছে খুব ছোটবেলায় তোমার কথা অনেক শুনেছি। তারপর এই কিছুদিন আগে, বাবা চলে যাওয়ার পর সব জিনিস্ পত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে দাদুর পুরোনো একটা ডায়েরি পেলাম। পাতায় পাতায় শুধু তোমার কথা। তাই ভাবলাম , তোমার জন্য আ্মি যদি কিছু করতে পারি। জান,আজ যে এখানে এসেছি, এখানে দাদুও আসতেন।এখানে যে জন্য এসেছি, এই ওল্ড স্ক্রিপ্ট এর কথাই ধরোনা, এই নিয়ে কেউ বিশেষ জানেই না। একে বলে নাড়ি-শাস্ত্র। কত হাজার বছরের পুরনো তামিল ভাষায় লেখা। এ হল তামিল ব্রাহ্ম লিপি। একটু বাদেই তোমার পাস্ট, প্রেজে্নট, ফিউটার সব জেনে যাবে। কেমন মজা বলত। হয়ত জানবে নেক্সট জন্মে তুমি আবার দাদুর বন্ধু হবে।
- তাই বুঝি?
- ইয়েস গ্রান্ডি। এসব নিয়ে দাদু কিছুটা চর্চা করতেন , বিশ্বাসও ছিল। আমিও দেখেছি বেশ ইন্টারেস্টিং বিষয় । গত তিন মাস মেডিটেশনের কোর্সটা করে বুঝেছি, এই দেশে্র এন্সেন্ট হেলথ আডভাইসগুলো জাস্ট দারুণ ।
- ধুর পাগলা! এখন কবে মরণ হবে সেটা জানাটাই জরুরি।
- আহ! এসব একদম বলবেনা। কাল দুপুরে তুমি কত যত্ন করে তোমার ট্রাঙ্কে রাখা কিউরিও দেখালে। সব দাদু গিফট করেছিল?
- -হ্যাঁ ভাই। তিনি বলেছিলেন , বৌঠান, সব তুমি রাখ। কোনদিন যোগ্য লোকের দেখা পেলে তাকে দিতে পার। এমনিতে এগুলো ছোট বড় ফুলদানী। কিন্তু এর গায়ে খোদাই করা আছে নাকি অনেক গোপন রহস্য। তোমার দাদু বলতেন এগুলো খুব সাবধানে রাখতে হবে। বৌমা জানেনা, আমাদের ওপরতলার প্রোফেসর মিত্রকে একবার কয়েকটা দেখিয়েছিলাম। উনি বলেছিলেন, এই সব লেখাজোখা নাকি বেশ জটিল। আরো স্টাডি করতে হবে। ওনার এক ছাত্রকে দেখানোর কথা বলেছিলেন, আমি বাপু রাজী হইনি। এখন তুমি এসে গেছ, আমি নিশ্চিন্ত।
- হ্যাঁ খুব ইন্টারেস্টিং ওই ছোট ফুলদানি গুলো। এক ঝলক দেখে তামিল ব্রাহ্মী লিপির কথাই মনে হল। কিছুদিন আমিও এ নিয়ে চর্চা করেছি তো । তাই এখানে এদের কাছে এলাম। এরা হয়তো পড়ে দিতে পারবে। ওগুলো সব এনেছ তো?
- সে কথা আর বলতে?
- কিন্তু গ্র্যান্ডি, দাদু এ গুলো মিশরে পেয়েছিলেন মানে দাঁড়াচ্ছে, প্রাচীন কালে তামিলদের সঙ্গে মিশরের নিশ্চয় ব্যবসার সম্পর্ক ছিল। কি বলো?
- আমি আর কী বুঝি বাবা? আমার তো কৌটোয় ঘেরা জীবন। তোমার দাদু যতদিন আসতেন । কত দেশ দেশান্তরের গল্প করতেন। এখন কারই বা আমার জন্য সময় আছে?
- ওহ! গ্রান্ডি, মাই বেব, ডোণ্ট ওরি ডিয়ার। এ শহরে এলেই তোমাকে সপ্তাহে একদিন করে দারুন দারুন জায়গায় নিয়ে যাব । জীবনের মানে খুঁজে পাবে। তুমি হোচ্ছ আমার দাদুর স্পেশাল ফ্রেন্ড। তুমি আমার কাছেও খুব স্পেশাল। দাদুর মত আমিও তোমাকে দেশ বিদেশ থেকে অনেক গিফট এনে দেব । দাদুর দেওয়া সেই স্পেশাল ফ্লাওয়ার ভাসটার মত হয়তো হবেনা। যেটা তুমি সেদিন আমায় দেখালে?
- তোমার ওটা চাই দাদুভাই?
- না, না, ওটা তোমার কাছে দাদুর স্মৃতি। আমি জানি। দাদুর ডায়েরিতে লেখাও আছে সে কথা।
আবেগে গোগোলের হাত চেপে ধরেন মণিকুন্তলা, তুমি ঠিক তোমার দাদুর মত। তিনিও এমন করে কতবার আমার মন ভাল করে দিয়েছেন। সারা জীবনে কোন সবাধীনতাই পেলাম না। এই আজ বাড়ি থেকে বেরনো নিয়ে ফিরে গিয়ে কত কী যে শুনতে হবে!
- -একী! চোখ থেকে জল পড়ছে কেন? ওহ ! গ্রানডি তুমি এই টুকুতেই কেঁদে ফেলছ। নাও চোখ মোছ।
পকেট থেকে হাত বাড়িয়ে সুগন্ধি রুমাল এগিয়ে দেয় গোগোল, “কুল বেবি। দেরি নিয়ে ভেবোনা, আমার আপয়েন্টমেন্ট করা আছে” ।
টুকটাক কথার ফাঁকেই মিষ্টি সুরেলা একটা পাখির ডাক শোনা গেল। মণিকুন্তলার বেশ লাগে রুমালের মিষ্টি গন্ধটা। আগে কখনো এই গন্ধ কোথাও পেয়েছেন? রুমালের কাপড়টা বেশ নরম। ঠিক যেন আগেকার ফ্ল্যানেলের কাপড়ের মত। শরীরটা কেমন অবশ অবশ লাগছে। ঠিক অবশ নয় , বেশ অন্যরকম লাগছে, । রুমাল দিয়ে চোখ মুখ মুছতে মুছতে খেয়াল হল, কাপরের রঙটা ভারি স্নিগ্ধ। ভোরের শিশির ছাওয়া মাঠের মত। –
ও গোগল দাদুভাই , এমন রুমাল কোন দোকানে পাওয়া যায় গো?
রোগা, লম্বা শান্ত চেহারার ছেলেটা মণিকুন্তলাকে দৃঢ হাতে ধরে, বলে, চলো গ্রান্ডি, আমাদের ভেতরে ডাক পড়েছে।
নীতা মন দিয়ে ম্যানিকিওর করছিল। এখন কিছুদিন গৃহবন্দী তাকে থাকতেই হচ্ছে। অভিরূপ সরকার লোকটা বহুত খ্যাচড়া । দিনের মধ্যে সাত বার ফোন করবে, ম্যাডাম ঘরে আছেন তো? দেখুন ,একটা বড়সড় ড্রাগ র্যাকেট ইস্টারন ইন্ডিয়া দিয়ে রেগুলার কলকাতায় আসছে। আপনি কিউরিও নিয়ে কারবার করেন , কত রকম লোকের সঙ্গে মেশামেশি করেন, সাবধানে থাকবেন।
ওহ! শিট! ড্রাগ র্যাকেটের সঙ্গে আমার কি সম্পর্ক ? মনে রাখবেন, আমার সার্কেলের লোকেরা সোসাইটির এলিট ক্লাশে বিলং করে।
– না আপারেন্টলি হয়তো নেই, তবু বলছি, আপনি “মলি”র কথা শুনেছেন তো?
- কে মলি? হোয়াট নন্সেন্স। আমি মলি টলি নামে কাউকে চিনিনা।
– আহা রাগছেন কেন ? অভিরূপ ফোনের ওপারে কুলকুল করে হাসেন, আরে! মলি মানে কিন্তু আপনার কোন বান্ধবী বা রিলেটিভের কথা বলছিনা। আচ্ছা , ম্যান্ডির কথা নিশ্চয় শুনেছেন ? কিংবা
এম-ডি-এম এ?
– নো। আবসলুটলি নো। প্লিজ জেরার নামে আজে বাজে প্রশ্ন করবেন না । আয়াম সিক অফ ইট।
-স্যরি, রাগ করবেন না। আজে বাজে প্রশ্ন করাটাই আমাদের কাজ। আমার বৌ ঝগড়ার সময় প্রায়ই বলে, হাজারটা নচ্ছাড়, লোচ্চা বদমাইশ আর একটা পুলিশ অফিসার তুল্যমূল্যে সমান। যাক গে, ওসব থাক, একটা কথা বলুন তো, কোন ব্র্যান্ডের পারফিয়ুম আপনার বেশি পছন্দের?
“কেন গিফট করবেন নাকি” ? নীতা চিবিয়ে চিবিয়ে বলে। মালটা এবার কোন দিক দিয়ে হ্যাজাবে কে জানে?
– করলে কি আর আপনি নেবেন ?
– মি সরকার, প্লিজ ডোন্ট ক্রশ ইয়োর লিমিট। শুনুন, থানা পুলিশের সামনে এসে এই নীতা কিন্তু কোন কালে ভয় পায়নি । কত দেখলাম!
ওকে আয়াম সো—- স্যরি। কিন্তু যতদূর জেনেছি আপনার পছন্দের পারফিউমের ব্র্যান্ড তো মাস্ক ডিয়ার , তাই না?
-আপনি যা খুশি ভাবতে পারেন। আই ডোন্ট বদার অ্যাট অল।
-এড়িয়ে যাবেন না নীতা ম্যাডাম। মৃত রাহুল ভাবনানীর পকেটে একটি ভাউচার ছিল। অরিজিনাল কস্তুরী মৃগ-নাভি এসেন্স , আই মিন মাস্ক ডিয়ারের একটি প্যাকেট ডেলিভারি করার কথা ছিল নীতা্ আহমেদের নামে। আর একটা কথা। ওর পকেটে ছিল আরো একটি বিশেষ তামিল ওষুধের নাম। আমাদের নারকোটিক ডিপারট্মেন্ট এর মতে সেটি নাকি এক ধরণের ম্যূড এলিভেটর। সেটাও কি আপনার জন্য? আপনি যা ম্যূডি দেখছি। আপনাদের স্পেশাল কাজ কম্মের সময় বোধহয়—
-মি সরকার, প্লীজ বী ডিসেন্ট ইন ইয়োর ল্যাঙ্গুএজ।
– ওয়ান্স এগেন স্যরি ম্যাম। আসলে রাহুল ভাবনানির ডেডবডির পাশে পড়ে থাকা রুমালের ফরেন্সিক রিপোর্ট বলছে ওরকম কিছু ম্যূড এলিভেটর সেটাতে লাগানো ছিল।
-ওহ! রিয়েলি?
হ্যাঁ! কাল একবার কষ্ট করে থানায় আসবেন । সেদিন কিন্তু আপনি সঠিক কথা বলেন নি। রাহুল ভাবনানির গাড়ি আদৌ খারাপ হয়নি। এই বিষয়ে আর কিছুটা ইনফরমেশন আপনি আমাদের দেবেন । টিল দেন গুড নাইট।
শালা! মেজাজটাই খিচড়ে গেল ইডিয়টটার সঙ্গে কথা বলে। এতগুলো কিউরিও ডেলিভারি এবারে আটকে গেল। আর এর মধ্যে থানায় যত রাবিশ আসাইনমেন্ট। ইস! গত কদিনের ঝামেলায় আঙ্গুল গুলোর কী যে অবস্থা হয়েছে। ফোন ছেড়ে আপন মনে বিড়বিড় করে নীতা।
মোবাইল স্ক্রিনে নতুন এক ভিডিও কল নীতাকে আবার সজাগ করে দেয়। গলফ ক্লাবে, থানার আশেপাশে দেখা সেই ছেলেটা না? ও কি নীতাকে কন্টিনিউয়াস ফলো করে যাচ্ছে ?
রাত দশটা বাজে। মাম্পিকে আজ এক্সট্রা টাকা দিয়ে রেখেছে, রাতে ও আজ শাশুড়ি মায়ের ঘরে শোবে। সুচন্দ্রা বেশ খুশি খুশি মনে বাড়ি ফেরে। আজ গল্পচক্রে আমন্ত্রিত এক পাবলিশার্স সুচন্দ্রার উপন্যাসটি ছাপবে বলে কথা দিয়েছে। তাপস বিকেলে অফিসের কাজে হায়দ্রাবাদ গেছে। ফিরবে কাল বিকেলে। আজ রাতে তাই মন দিয়ে উপন্যাসের বাকি অংশটা শেষ করা যাবে ।
দরজা খুলল মাম্পি। সুচন্দ্রা একটু কুন্ঠিত গলায় বল্ল, হ্যাঁরে , রাত হয়েছে, মা খেয়ে শুয়ে পড়েছেন তো? আর টুবু নিশ্চয়ই আমার জন্য বসে আছে। ও অবশ্য জানে, আজ আমার ফিরতে দেরি হবে।
মাম্পির মুখ কাঁদো, কাঁদো,” বৌদি, তোমার ফোন কেন বন্ধ ছিল? টুবু বাবু একবারও ফোন ধরেনি, এখনো বাড়িও ফেরেনি। আমাকে তুমি বোকোনা। দিদা আমার কোন কথা শোনেনা।“
এই শুরু হল, বাড়ি ঢুকলেই হাজার সমস্যা। একটুও রেহাই নেই। সেই উনি না খেয়ে বসে আছেন তো? ঠিক জানি, স্রেফ আমায় জব্দ করবেন বলে। জীবনের আসল সময়ে কিচ্ছুটি করতে দিলেন না, বড় ঘরের বৌএর এই করা মানায় না, ওই করা মানায় না এই সব বোগাস মধ্যযুগীয় ধ্যান ধারণার অজুহাতে—- নে , ওনার খাবার বেড়ে দে। আমি কাছে গিয়ে বসছি, তারপর না হয় চেঞ্জ করব—- সুচন্দ্রা নিজের মনে গজগজ করতে করতে ফোনের সুইচ অন করে টুবুকে বকার জন্য রেডি হয়।
-বৌদি, দাঁড়াও, ওপরের মিত্র বৌদিকে জানাতে হবে তুমি ফিরেছ বলে।
কেন ? তাঁকে আবার কেন? সুচন্দ্রা বিরক্ত হয়। ভদ্রমহিলা সুচন্দ্রাকে দুচোক্ষে দেখতে পারেনা।
-নাগো, দিদা ফিরছেনা দেখে আমি তো ওনার কাছে ছুটে গিয়েছিলাম। দিদা সেই বিকেল পাঁচটা নাগাদ কী নাকি এক আয়ুর্বেদিক ডাক্তার দেখাতে হবে বলে বেরিয়ে গেলেন । সেই গোগোল্ বাবুর সঙ্গে। গত কাল বিকেলে তুমি পার্লারে যাবার পরেই তিনি তো এই বাড়িতে এসে দিদার মাথায় কতক্ষণ হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন । খুব গল্পও করছিলেন দুজনে। কেন ? দিদা রাতে তোমায় বলেনি?
মানে? সুচন্দ্রার বুক হিম হয়ে যায়। টুবু তাহলে তখন —–
হঠাতই সুচন্দ্রার ফোন বাজতে লাগল। কাঁপা হাতে ফোন ধরে — ওপারে মিহি গান বাজছে অচেনা এক ভাষায়। সুরটা যেন কিছুটা কর্ণাটকী ঘরানার —
হ্যা– হ্যালো , সুচন্দ্রার গলার ভেতরে এখন কত কালের জমাট বাঁধা তৃষ্ণা—
ফ্ল্যাটের দরজা এখনো হাট করে খোলা। বন্ধ করার কথা মাম্পি বা সুচন্দ্রা কারুরই মনে পড়েনি। ওপরের মিসেস মিত্র ততক্ষণে নেমে এসেছেন। কড়া গলায় বলে উঠলেন , কী তোমার আক্কেল সুচন্দ্রা! বুড়ো মানুষটাকে এই ভাবে যার তার সঙ্গে—- নিজের মা হলে পারতে?
সুচন্দ্রার দু-কান এখন জুড়ে আছে সেই বিচিত্র ঝিম ধরা গান—-কবে কোথায় যেন শুনেছিল এই সুর!
![কৃষ্ণা রায়](https://irabotee.com/wp-content/uploads/2019/07/FB_IMG_1564334118375-150x150.jpg)
শিক্ষক,কথাসাহিত্যিক