অপ্রত্যাশিত প্ল্যান থেকে জন্ম নেয়া একটি নভেলা। তৃষ্ণা বসাকের ভাবনা।
সেদিন কয়েকজন সৃষ্টিশীল মানুষ আড্ডা দিচ্ছিলেন ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে, আড্ডার শেষে একটি সবুজ রুমালের দেখা মিললো। একটি রুমাল কে বিড়াল করে দেবার জাদু তো প্রবাদের মত। এখানেও হলো তাই হঠাৎ পাওয়া সবুজ রুমাল টি পেয়েই সব ওলটপালট হয়ে গেল একদল সৃষ্টিশীল মানুষের ভাবনায়।জাদুর মতোই কোনো পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই ফেলে যাওয়া এক টুকরো রুমাল হয়ে গেলো ১২-ইয়ারি নভেলা ‘সবজে রুমাল রহস্য’।
পরপর লিখবেন ১২ জন। প্রথম পর্ব লিখলেন ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় এবং শেষ করবেন তৃষ্ণা বসাক। মধ্যে থাকবেন ১০ জন যথাক্রমেঃ
সোনালি, তপশ্রী পাল, ব্রততী সেন দাস, নিবেদিতা ঘোষ মার্জিত, নন্দিনী সেনগুপ্ত, শ্যামলী আচার্য, কৃষ্ণা রায়, ইন্দ্রনীল বক্সী, সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়, অমিতাভ দাস। আজ থাকছে নন্দিনী সেনগুপ্ত’র লেখা রহস্য নভেলার ষষ্ঠ পর্ব।
পর্ব ৬
-‘হ্যাঁ, একটা কাগজ দাও। কলম আছে আমার কাছে। ব্যাপারটা এঁকে বোঝাই তোমাকে!’ জ্যোতিপ্রকাশ সিনহার ভঙ্গিতে পেশাদারি শিক্ষকের সংকল্প প্রকাশিত হয়। উনি সুচন্দ্রার অনুরোধে আজ রবিবারের বিকেলে এসেছেন ওদের বাড়িতে। সুচন্দ্রা বাধ্য ছাত্রীর মত মোড়াটা এগিয়ে নিয়ে বসে সেন্টার টেবিলের কাছে। তাপসও একটু ঝুঁকে পড়ে দেখতে থাকে।
-‘এই যে, এই জায়গাগুলো দেখছো, এই ত্রিভুজাকৃতি চিহ্ন’ –
-‘হ্যাঁ, তিরচিহ্নের মত!’ সুচন্দ্রা বলে, ‘ওইগুলো দেখেই একদৃষ্টিতে আমার এম আর এন মনে হয়েছিল, কারণ এই জায়গাগুলো গাঢ় রঙের সুতোয় সেলাই করা।’
-‘হ্যাঁ, হঠাৎ দেখলে তাই মনে হবে বৈকি, কিন্তু এই অংশটা সুমেরীয় লিপি, মানে ঐ লিপিতে যেরকম কুয়েনিফর্ম চিহ্ন থাকে, সেরকম চেহারা বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু আরও একটা চিহ্ন, এই যে মাছের মত নকসা, এটা আবার সিন্ধুলিপি ছাড়া কোথাও দেখা যায়না। সেই জন্যই আমি বলছি যে নকসাটা সম্ভবত এমন একটা কোনো সিল থেকে নেওয়া হয়েছিল যেটা হরপ্পা এবং মেসোপটেমিয়ার মধ্যে যে ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল, সেই ব্যবসার কাজে ব্যবহৃত হত। তবে একটাই খটকা…’ জ্যোতিপ্রকাশবাবু কলমটা নিয়ে মাথায় টোকা মারেন।
‘খটকা?’ সুচন্দ্রা একরাশ প্রশ্ন নিয়ে তাকায়।
-‘হ্যাঁ, মাছের নকসা সাধারণত সিমেট্রিকাল হয় সিন্ধুলিপিতে, কিন্তু এখানে একটা অ্যাসিমেট্রি দেখছি, মানে হাল্কা আরও দাগ দেখছি আমার তোলা ছবিতে, এটা কেন? আচ্ছা, রুমালটা আরেকবার নিয়ে আসবে? একটু খুঁটিয়ে দেখবো।’
রুমালটা বিছিয়ে রাখা হয় সেন্টার টেবিলে। নাহ, জ্যোতিপ্রকাশবাবুর তোলা ফটোতে মাছের নকসার গায়ে লেগে থাকা কিছু হাল্কা রেখা দেখা যাচ্ছে, সেটা রুমালে দেখা যাচ্ছেনা। অদ্ভুত!! অথচ উনি তো এই রুমাল থেকেই ছবিটা তুলেছেন।
‘যাকগে, ওটা যখন দেখা যাচ্ছেনা, তাহলে আর ওটা নিয়ে ভেবে লাভ নেই। হতেই পারে, আমার পুরনো ক্যামেরা, লেন্সের গায়ে দাগছোপ ধরে অমন হয়েছে।’ – জ্যোতিপ্রকাশবাবু একটু রিল্যাক্সড ভঙ্গিতে সোফায় বসেন। ‘হ্যাঁ, যেটা বলছিলাম- এই যে কুয়েনিফর্ম চিহ্ন, এগুলো কিন্তু রোমান অক্ষরে অনুবাদ করা সম্ভব। যেমন, তোমার এই রুমালে যে চিহ্ন আছে, মানে এই যে ত্রিভুজাকৃতি বার্লিদানার ছবি যেগুলো মাছের গায়ে লেগে রয়েছে চারটে, এটার অর্থ ‘বি’।
‘বি?’- সুচন্দ্রা অবাক চোখে তাকায়? ‘এতগুলো তিরচিহ্ন? এগুলোর মানে শুধুই বি?’
‘এখন তো তাই বলবো’ – জ্যোতিপ্রকাশবাবু একটু হাসেন। আসলে দেখো এই মাছের নকসা, আবার মতান্তরে অনেকে এটাকে আকাশের তারাও বলে। সিন্ধুলিপি তো কোনো ভাষা নয় সেই অর্থে, সাঙ্কেতিক চিত্র। এখন এরকম নকসাওয়ালা সিল যার কাছে ছিল, হতেই পারে যে তিনি একজন ব্যবসায়ী যিনি হরপ্পা থেকে মেসোপটেমিয়া গিয়েছিলেন ব্যবসার কাজে এবং হয়ত সেখানেই থাকতে থাকতে তাদের একজন হয়ে গিয়েছিলেন। সেজন্য এই সুমেরীয় কুয়েনিফর্ম লিপি ছিল তার সিলে, আবার নিজের শিকড়ও বিস্মৃত হননি- যে কারণে এরকম মিশ্র চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। ও হ্যাঁ, তখনকার সমাজে কিন্তু নারীরা স্বাধীন ছিলেন। এমনও হতে পারে যে ব্যবসায়ী একজন নারী ছিলেন।’
‘ওরেব্বাস! এরকমও হতে পারে?’ সুচন্দ্রা হাঁ হয়ে যায়।
‘পারে।’ – জ্যোতিপ্রকাশবাবু ঘাড় নাড়েন।
‘আচ্ছা, একটা প্রশ্ন ছিল আমার। রুমালের চারপাশে এই যে সেলাই, এটাকে আমরা মাছের কাঁটা নকসা বলি। এটার সঙ্গে কি এই মোনোগ্রামের কোনো সম্পর্ক আছে?’ সুচন্দ্রা রুমালের ধারগুলো আরও খুঁটিয়ে দেখতে চায়।
-‘হ্যাঁ, আমি দেখেছি। দেখো, সেলাইয়ের নকসার নাম মাছের কাঁটা হলেও সুমেরীয় লিপিতে এটাকে কুয়েনিফর্ম চিহ্নই বলবো। না, এর বিশেষ ভ্যারিয়েশান চোখে পড়ছেনা। আসলে কুয়েনিফর্ম চিহ্নের প্রধান চরিত্র বা নায়ক হল বার্লিদানা। প্রচুর বার্লির ফলন হত মেসোপটেমিয়া অঞ্চলে। স্টেপল ফুড ছিল মানুষের। কাজেই লিপির উদ্ভব যখন হল, তখন বার্লিদানাকে একক হিসেবে নিয়ে নানা প্যাটার্ন বানিয়ে লেখালেখি শুরু হল। তবে এটাও কিন্তু সেই অর্থে কোনো ভাষা নয়। শুধু লিপি।’
– ‘তার মানে এই বার্লিদানার ডিজাইন দিয়ে অনেককিছু লিখে ফেলা সম্ভব সুমেরীয় লিপিতে, তাই তো?’
– ‘সম্ভব!’ জোরালো গলায় বলেন জ্যোতিপ্রকাশ… ‘যেমন এই যে আলাদা দুটো বার্লিদানা যেগুলো এই মাছের ছবির নিচে আছে, এটাকে রোমান লিপিতে ‘জি’ বলা যেতে পারে।’
সুচন্দ্রা ভাবতে থাকে, তার মানে রুমালের নকসার যে অংশ পড়া যাচ্ছে সেটা হল জি আর বি। সুচন্দ্রাকে ভাবনায় তলিয়ে যেতে দেখে জ্যোতিপ্রকাশ একটু গলা খাঁকারি দিয়ে তারপর একটু মুচকি হেসে বলেন ‘হ্যাভ আই আর্নট আ কাপ অফ টি?’ সুচন্দ্রা জিভ কাটে- ‘ইসস… দেখুন তো কী ভুল। এখুনি দিচ্ছি। চা ভিজিয়ে এলাম তো। আসলে আপনি এত ভালো বলেন, অবাক হয়ে শুনছিলাম।’
সুচন্দ্রা চা, জলখাবারের ট্রে এনে রাখে। রুমালটা সরিয়ে রাখতে যাবে, তখনি জ্যোতিপ্রকাশবাবু বলেন, ‘এক মিনিট! সুচন্দ্রা, তুমি রুমালটা একবার এই টেবিল ল্যাম্পের জোরালো আলোর সামনে ধরো দেখি!’
সুচন্দ্রা তাই করে। বৃদ্ধ চোখ পিটপিট করে কী যেন দেখেন। তারপর বলেন, ‘এবার রুমালটা আবার টেবিলে বিছিয়ে দাও। দিয়ে ঘরের সব আলো নিবিয়ে দাও।’ সুচন্দ্রা অবাক হয়, কিন্তু তাইই করে।
‘এবার দ্যাখো!’ ওরা সবাই অবাক হয়ে দেখে অন্ধকারে রুমালের মধ্যে জ্বলজ্বল করে ফুটে উঠেছে একটা স্বস্তিক চিহ্ন।
‘ফ্লুয়োরেসেন্ট কালারে আঁকা!’ অস্ফুটে বলে সুচন্দ্রা।
‘ইয়েসস!’ তীব্রস্বরে বলে ওঠেন জ্যোতিপ্রকাশ সিনহা… ‘নাহ, আমার ক্যামেরা বুড়ো হয়নি, বুড়ো হয়েছে আমার চোখ, রুমালটা দেখে বুঝিনি আরও কিছু হিডন চিহ্ন থাকতে পারে। ক্যামেরা ঠিক ধরেছে একটা অংশ। ঐ স্বস্তিকের একটা বাহু মাছের গায়ে লেগে আছে দেখে আমার ওটাকে অ্যাসিমেট্রি মনে হয়েছিল। আসলে মাছের নকসা ঠিক আছে। এটা একদম আলাদা একটা নকসা, যেটা আলোতে দেখা যায়না।’
-‘এই জন্য কবি বলিয়াছিলেন’- তাপস ফুট কাটে, ‘চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে!’
‘কিন্তু স্বস্তিক চিহ্ন মানে কি ওটার সঙ্গে নাৎসি যোগ আছে কিছু?’ সুচন্দ্রা কাঁপা কাঁপা গলায় বলে।
‘নাহ, একদম নয়!’ জ্যোতিপ্রকাশবাবু চায়ে দীর্ঘ চুমুক দিয়ে বেশ জোরের সঙ্গে বলেন। ‘এই স্বস্তিকা সিন্ধুলিপি থেকেই নেওয়া; রুমালের চারদিকের আউটলাইনের সঙ্গে সমান্তরাল করে আঁকা হয়েছে স্বস্তিকার ভুজগুলি। সেই সময় থেকেই পবিত্র চিহ্ন বলে মানা হত। নাৎসি হলে স্বস্তিকের বাহু রুমালের আউটলাইনের সঙ্গে সমান্তরাল হবেনা, কোণাকুণি হবে এবং সেই স্বস্তিকের চারপাশে একটা বৃত্ত থাকবে।’
-‘আচ্ছা, বুঝলাম।’ সুচন্দ্রা মুখে বললেও এটা বুঝতে পারেনা এরকম অদ্ভুত চিহ্নসম্বলিত রুমাল কে রেখে গেলো! কেনই বা রেখে গেলো! তবে রুমালটা আসবার পর থেকে সত্যিই পজিটিভ জিনিস ঘটে চলেছে। তবে কি রুমালের বিশেষ কোনো সম্মোহনী শক্তি আছে? পবিত্র চিহ্নযুক্ত লক্ষ্মীমন্ত রুমাল… এদিকে আবার কুয়েনিফর্মে ‘জি’ এবং ‘বি’ লেখা.. নাহ… ভাবনাগুলো যে আরও জট পাকিয়ে যাচ্ছে তার।
‘হ্যালো!’ ঘুমের মধ্য থেকে জেগে উঠে ফোন ধরে নীতা।
-‘কবসে ফোন লগা রহা হু! কাঁহা গয়ি থি?’
-‘জাহান্নুম মে!’
-‘মজাক মত কর। বো লছমি কিধর হ্যায়?’
-‘আরে তেরা ম্যানেজার নে গলদ পতা দর্জ কর দিয়া, ম্যায় কেয়া করু? লছমি তো মুঝে ভি চাহিয়ে!’
-‘কেয়া তুঝে ইনসব চীজো মে বিসোয়াস হ্যায়?’
-‘হাঁ, হ্যায়। পানি কে বিনা মছলি মর গই। উসকে পাস লছমি নহি থি!’
-‘ঠিক হ্যায়! পতা লগানা পড়েগা।’
-‘হাঁ। পতা লগা। লেকিন কুছ দিনকে লিয়ে জ্যাদা ফোন মত কর।’ – উত্তরের অপেক্ষা না করে ফোন কেটে দিয়ে নীতা আবার ঘুমোবার চেষ্টা করে। ফোনটা রেখে দিতে গিয়ে লক্ষ্য করে আবার বেশ কটা মিসড কল। ট্রুকলারে লেখা জিডিবি। নীতার ঘুমটা চটকে যায়।
——
সুচন্দ্রা শপিং মল থেকে ট্রলি নিয়ে বেরোতেই বাড়ির ড্রাইভার অধীর দৌড়ে আসে…
-‘বউদি, বাজারগুলো আমাকে দিন। কিন্তু…’ অধীর মাথা চুলকোয়… ‘একটা ব্যাপার হয়েছে!’
সুচন্দ্রার বেশ গরম লাগছে ঠাণ্ডা দোকানঘর থেকে বেরিয়ে। ভেবেছিলো সঙ্গে সঙ্গে গাড়িতে উঠে যাবে। এখন অধীর আবার কী সমস্যা এনে হাজির করলো!
‘বউদি, গাড়িতে স্টার্টের একটা সমস্যা হচ্ছে।‘
সুচন্দ্রা চোখ কপালে তোলে… ‘সেকি! আগে বললেনা কেন?’
‘আজ্ঞে, আজ্ঞে… অধীর তোতলায়, ‘ঠ- ঠিক বুঝতে পারিনি বউদি!’
-‘এখন এত বাজার নিয়ে…’ সুচন্দ্রা কী করবে ভেবে পায়না।
‘দিন না বউদি, দুটো তো মোটে স্টপেজ, আমি হেঁটে গিয়ে দিয়ে আসছি বাড়িতে।’
সুচন্দ্রা ট্রলির দিকে তাকায় একবার। তারপর চোখ সরু করে অধীরের দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বলে, ‘সার্ভিসিং করতে কতক্ষণ লাগবে?’
‘আজ্ঞে, ঘণ্টাখানেক তো লাগবেই!’
‘ঠিক আছে, তোমাকে যেতে হবেনা এখন। তুমি বাজারগুলো গাড়িতে তোলো আপাতত। একঘণ্টা পরে বাড়িতে নিয়ে এসো বাজার!’ — ট্রলি থেকে শুধু ডিপ ফ্রিজে রাখবার জন্য মাছের আর সসেজের প্যাকেটদুটো তুলে নিয়ে একটা থলিতে ঝুলিয়ে সুচন্দ্রা হাঁটা লাগায়।
নাহ, হাতের বোঝা বেশি ভারি নয়। তবে গরম বেশ। সুচন্দ্রা ঘিঞ্জি ফুটপাথের ভিড় এড়িয়ে রাস্তার ধার ঘেঁষে হাঁটে। হঠাৎ ঘ্যাঁচ করে পাশে এসে একটা গাড়ি ব্রেক কষে দাঁড়ায়। ‘আরে সুচন্দ্রাদি যে! কোথায় চললেন?’
-‘আরে দুর্গাদাস! কী কাণ্ড! তারপরে… তোমার যে সেদিন আসবার কথা ছিল আমাদের বাড়ি আড্ডায়। এলেনা তো!’
-‘না, সেদিন একটা কাজ পড়ে গেলো। কোথায় যাচ্ছেন? লিফট দিই?’
-‘দেবে? আচ্ছা, দাও’… দোনোমনা করে সুচন্দ্রা উঠেই বসে গাড়িতে। দুর্গাদাস নিজেই গাড়ি চালাচ্ছে। গাড়িতে আর কেউ নেই। সুচন্দ্রা সামনে ড্রাইভারের পাশের সীটে বসে। দুর্গাদাস সিট বেল্ট লাগাতে সাহায্য করে।
-‘আচ্ছা, তুমি তো বেশ ভালো বাংলা বলো দেখছি। তাহলে মেসেঞ্জারে বা ফেসবুকে স্ট্যাটাসে সবসময় ইঞ্জিরি কেন?’
-‘আসলে আমি শুধু বলতেই পারি। অল্প অল্প পড়তেও পারি। ছোটবেলা থেকে বিদেশে থাকার জন্য সেভাবে বাংলা লিখবার অভ্যেস হয়নি একেবারেই।’
সুচন্দ্রার হঠাৎ মনে পড়লো, ‘আচ্ছা, তোমাকে ফেসবুকে দেখতে পাচ্ছিনা কেন কদিন? তুমি কি অ্যাকাউন্ট ডিঅ্যাকটিভেট করেছ?’
-‘হ্যাঁ!’ মুচকি হাসলো দুর্গাদাস, ‘আসলে আমি একটা মেডিটেশান কোর্স করছি। কোর্স শেষ না হওয়া অবধি সোশ্যাল মিডিয়াতে আসবো না। খুব অসুবিধে হয়।’
-‘ওও.’.. সুচন্দ্রা মুচকি হাসে…
-‘এসির টেম্পারেচার কমিয়ে দিই দিদি? মনে হচ্ছে গরম লাগছে আপনার!’
‘আরেন্না। প্রায় এসে গেছি, নামবো সামনেই। আমার বাড়ি কাছেই। আসবে? চা খেয়ে যাও এককাপ! নাকি কফি?’
-‘আজ নয়। আরেকদিন আসবো … ঠিকানা তো আছেই আমার কাছে’… দুর্গাদাসের কণ্ঠস্বরে একটা অদ্ভুত দৃঢ়ভাব। সুচন্দ্রা আর জোর করেনা; সিট বেল্টের নিচে শাড়ির আঁচলটা আটকে গেছে। কপালের ঘাম মুছতে পারছেনা সে। রুমাল পেছনের সীটে ব্যাগের মধ্যে। থাকগে, নেমেই যাবে একদুমিনিটের মধ্যে। ঘামটা বেশি হয় এই বয়েসে। দুর্গাদাস ইঙ্গিত করে উইন্ডস্ক্রিনের সামনে একবাক্স পেপার ন্যাপকিনের দিকে। সুচন্দ্রা একটা টিস্যু তুলে নেয়। মিষ্টি গন্ধ একটা। বিদেশি জিনিস নিশ্চয়ই। মুখটা মুছে নেয় আলগোছে। ঠিক তখনি চোখের কোণ দিয়ে দেখতে পায় টিস্যুর এক কোণে একটা মাছের নকসার মত, যেমনটা তার সবুজ রুমালে আছে।
-‘ব্যস, ব্যস, এসে গেছি। না, থ্যাংকস দেবো না। একদিন আসা চাই কিন্তু!’ গাড়ি থেকে নামতে নামতে পেপার ন্যাপকিনের টুকরোটা দলা পাকিয়ে মুঠোয় ধরে রাখে সুচন্দ্রা। রাস্তায় ফেলে দেয়না।
-‘মিথাইলেনেডাইঅক্সিমিথামফিটামাইন!- কেটে কেটে বলেন ডাক্তার সান্যাল।
-‘সেকি! এমডিএমএ? এক্সট্যাসি?’ চমকে ওঠেন অভিরূপ সরকার।
-‘ইয়েস! এক্সট্রিম ডিহাইড্রেশান, ভিক্টিম বুঝতে পারেনি নিজে। হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে।’
-‘খুবই চিন্তার কথা। আসলে এই ড্রাগ গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল দিয়ে কলকাতায় ঢুকবার চান্স বেশি বলে আমরা ঐদিকটা সিল করছি। কিন্তু ওয়েস্টার্ন করিডরও সেফ নয়। নাহলে এলো কীভাবে?’
-‘ঠিক। অবশ্য পোস্টমর্টেম নিয়ে এখন কিচ্ছু বলছি না। তাহলে আবার মিডিয়া ঝাঁপিয়ে পড়বে।’
-‘একদম না। হাল্কা ইন্টারোগেট করে আপাতত যাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, তারা তো সবাই সন্দেহের তালিকার বাইরে নয়। এছাড়া সম্পত্তির পরিমাণ খারাপ নয়, শরিকি ঝামেলাও আছে কিছু। যাকে সন্দেহ করা হচ্ছে, সেই মক্ষীরানির অ্যালিবাই খুব স্ট্রং। কাছেই একটা হোটেলে বিজনেস মিটিং করছিল, তিনজন সাক্ষী আছে। ভিকটিম নিজেই তাকে ফোন করে ডাকে গাড়ি খারাপ হয়ে গেছে বলে। ভিকটিমের ফোনের কল রেকর্ড দেখেছি আমরা। এখন দেখতে হবে মোটিভ কি? খুন করে লাভ কার হল?’
– ‘পারিবারিক গণ্ডগোল কিছু? বউ এই এক্সট্রা ম্যারিটাল ব্যাপারে ক্ষেপে গিয়ে’…
– ‘নাহ, বউ গোবেচারা পর্দানসীনা টাইপ। মিডিয়া কম খুঁচিয়েছে কদিন ধরে? কিচ্ছু বার করতে পারেনি’…
– ‘হ্যাঁ, এই উইমেন্স লিবের যুগে এটা আশ্চর্য!’
– ‘আসলে ওরা একটু কনজারভেটিভ সিন্ধী পরিবার। হয়ত সেই জন্য…’
– ‘সিন্ধী? তার মানে সেই সিন্ধু নদের পাড়ে ওদের পূর্বপুরুষ থাকতো?’
– ‘তাইই হবে। তবে এই পরিবার তো প্রায় তিন পুরুষ ধরে কোলকাতায়। ভিক্টিমের কাকা গঙ্গাধর ভাবনানি প্রচুর সমাজসেবা করেছেন এককালে, বিপত্নীক ছিলেন, সন্তানাদি ছিলনা, ব্যবসাপাতি বেশিটা এই ভাইপোকে দিয়ে যান। সেইজন্য পারিবারিক জেলাসির ফ্যাক্টরটা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায়না।’
– ‘সেটাও ঠিক। তবে যাইই হোক, আসল কথা মিডিয়াকে পোস্টমর্টেম নিয়ে ড্রাগের কথাটা জানানো হচ্ছেনা এখন।’
– ‘একদম নয়। আগে থেকে বললে রাঘববোয়ালগুলো বেরিয়ে যাবে জাল কেটে।’
– ‘কিন্তু কী বলা হবে? কিছু তো একটা বলতে হবে। মুখ বন্ধ রাখার জন্য…’
– ‘হ্যাঁ, সেটা আমি ভেবেছি। চাউর করতে হবে যে এটা খুন নয়। স্বাভাবিক মৃত্যু। ময়নাতদন্তে অস্বাভাবিক কিছু পাওয়া যায়নি। ঘুমের মধ্যে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু।’
– ‘এক্সেলেন্ট প্ল্যান অভিরূপ!’
– ‘হ্যাঁ, এটা ছাড়া আর উপায় নেই। তাহলে যারা পেছনে আছে, একটু হলেও গা ছাড়া দেবে এবং আমাদের জাল গুটিয়ে আনতে সুবিধে হবে।’
-‘দ্যাখো বউমা। কে এসেছে!’
দরজা ঠেলে ড্রয়িংরুমে ঢুকে দুর্গাদাসকে দেখে একটু অবাক হয় সুচন্দ্রা। বলেছিল বটে আসবে। কিন্তু সেটা যে একসপ্তাহের মধ্যেই সেটা বলেনি। কিন্তু শাশুড়িমায়ের এত উচ্ছ্বাস দেখে সুচন্দ্রা একটু ধন্দে পড়ে। বউমার ফেসবুকের বন্ধুকে নিয়ে …
-‘বুঝলে তো, সেই যে খোকার বাবার বন্ধু দুগ্গাবাবুর কথা বলি না তোমাদের, সেই যে গো, মিশরের পিরামিড দেখতে গিয়েছিলেন, শুধু তাই নয়, কত যে দেশ ভ্রমণ করেছিলেন’… কলকল করে বলতে থাকেন তিনি। সুচন্দ্রার মাথায় ঢোকেনা প্রথমে সেই দুগ্গাবাবুর সঙ্গে দুর্গাদাসের কী সম্পর্ক!
-‘এ হলো গোগোল! দুগ্গাবাবুর নাতি! বুঝলে বউমা? তা হ্যাঁ রে, তোর কি আমায় মনে আছে? এই বাড়ি খুঁজে বের করলি কীভাবে? বাবা ঠিকানা বুঝিয়ে দিয়েছে বুঝি? হ্যাঁ, তোর বাবার সঙ্গে খোকার যোগাযোগ আছে বটে!’
-‘তোমার নিজের নামই তো দুর্গাদাস। আবার তোমার দাদুর নামও দুর্গাদাস!’ সুচন্দ্রা বিস্ময় গোপন করেনা; মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়… ‘এ তো হিজবিজবিজ ব্যাপার একদম!’
-‘একটু বুঝিয়ে বলি, আমার নাম গোগোল। আমার মায়ের দেওয়া।’ দুর্গাদাস ধীরে ধীরে অনুচ্চ স্বরে বলতে থাকে, … ‘দাদুর নামটা আমি মিডল নেম হিসেবে ব্যবহার করি। বিদেশে এরকম হয়। দাদুর নাম নাতিরা ব্যবহার করে। ফেসবুকে আমার নিজের নাম অ্যাবাউট সেকশানে দেওয়া আছে। আমার অফিসিয়াল নাম গোগোল দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়।’
ভূতাত্বিক নন্দিনী সেনগুপ্ত কবিতা কিম্বা গল্প কোনোটাই নিয়ম করে লেখেন না। মনের তাগিদ এলে তবে লেখেন। কবিতায় মানুষ আর প্রকৃতি মিলেমিশে থাকে। ২০১৬ সালে প্রকাশিত প্রথম কবিতার বই ‘অরণ্যমেঘবন্ধুর দল’ বিশেষ সমাদৃত হয়েছে। কবিতা ছাড়াও গল্প, প্রবন্ধ ইত্যাদি প্রকাশিত হয় বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এবং ওয়েবম্যাগে। মৌলিক লেখা ছাড়াও ইংরেজি এবং জার্মান ভাষার লেখালেখি অনুবাদ করা বিশেষ পছন্দের কাজ। দ্বিতীয় বই ‘শান্তি অন্তরিন’ সিরিয়ার কবি মারাম- আল- মাসরির কবিতার অনুবাদ সদ্য প্রকাশিত হয়েছে। লেখালেখি ছাড়াও লিটল ম্যাগ সম্পাদনা এবং কবিতা ক্লাব ইত্যাদি নানা সাংগাঠনিক কাজে জড়িত।