সিমাস হিনি’র কবিতা
সিমাস হিনি। ১৯৩৯ সালের ১৩ এপ্রিল উত্তর আয়ারল্যান্ডের চৈমনিয়ারনের এক কৃষিজীবি পরিবারে সিমাস হিনি’র জন্ম। বাবা প্যাট্রিক হিনি একজন কৃষক। মাটিতে ফসল ফলানোর কাজ ছিল তাদের পারিবারিক ঐতিহ্য ও শত বছরের পেশা। সেই বাড়ির ছেলে সিমাস হিনি হয়ে ওঠলেন কবিতার চাষী। কোদাল দিয়ে মাটি নয়, কলম দিয়ে খাতা খুঁড়ে বের করে আনলেন অনবদ্য সব কবিতা। সহজ ভাষা, আইরিশ ঐতিহ্য ও আধুনিক কাব্যরীতির সংমিশ্রণে এক অনন্য কাব্যঢঙের সৃষ্টি করলেন। এবং হিনি সে সময়ের সক্রিয় কবিদের মধ্যে রচনার কৌশল ও প্রকৃতিগতভাবে ভিন্ন ধারার একজন কবি। ১৯৯৫ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। কিন্তু নোবেল সম্পর্কে তার ভাষ্য, ‘নোবেল পুরস্কার পাওয়া নিরাপদ ভূমিধসে আটকে পড়ার মতো’।
সিমাস হিনির কবিতাগুলি অনুবাদ করেছেন দিলারা রিঙকি।
ঘুড়ি
অন্য জীবন অন্য সময় অন্য দেশ থেকে উড়ে আসে বাতাস,
আমাদের জীবনকে ছুঁয়ে হালকা নীল, স্বর্গীয় অনুভূতি
ডানা ঝাপটায়, একটি শাদা ডানা, ফুরফুরে বাতাসের বিপরীতে।
আর হ্যাঁ, এটি একটি ঘুড়ি! যেন এক বিকেলে
আমরা সকলেই বেড়িয়ে পড়ি
কাঁটা-ঝোপঝাড় আর বুনো ঘাসের ভেতর
আবার দাঁড়াই, আকাশ থেকে নীল ছেঁকে নিতে থামি কিছুটা
ওই অ্যানাহোরিশ পাহাড়ের বিপরীতে
ওই মাঠের পেছনে আমাদের লম্বা লেজের ধূমকেতু ভাসাতে।
ঘুড়িটা ভাসে, আমি হেঁচকা টানে দিক ঘুরিয়ে দিই, গোত্তা খায় তীর্যকভাবে,
ঘুড়িটা নিজে নিজেই বাতাসে ভেসে বেড়ায়, যতক্ষণ-না
আমাদের উল্লাস নিচ থেকে অনেক উপরে ছড়িয়ে পড়ে।
ঘুড়িটা উড়ছে তো উড়ছেই, আমার হাতদুটো যেন এক নাটাই
হালকা ফুলের পাপড়ির মতো ছড়িয়ে দেয় নিজেকে অবিরাম
ঘুড়িটা আকাশ বেয়ে উঠতে থাকে উপরে এবং আরো উপরে
বুক ফুলিয়ে, পায়ে শেকড় না জড়ানো পর্যন্ত দীর্ঘ-লয়ে
বালকদের অবাক চোখ ও পুলকিত অন্তরে উড়তে থাকে ঘুড়িটা
যতক্ষণ না সুতা কেটে যায় এবং বিচ্ছিন্ন হয়, প্রাণহীন-
ঘুড়িটা পাক খেতে খেতে পড়ে যায়, যেন একা, একটি পতিত হাওয়া।
একজন চিত্রশিল্পী
তার রাগ-অভিমান নিয়ে আমি ভাবতে ভালোবাসি।
তার একরোখা জিদ পাথরশিলাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে,
সবুজ আপেলগুলো নিজস্বতা পায় তার তুলির শাসনে।
পথে সে পড়ে ছিলো নিজেই
আঘাতপ্রাপ্ত ক্ষতবিক্ষত কুকুরের মতো।
এ জীবন তার কাছে তীব্র ঘৃণার
এখান থেকে উত্তরণে
করণীয় সম্পর্কে সে প্রত্যাশার চেয়েও এগিয়ে
অথবা কল্পনার রঙ তাকে ছাপিয়ে
তুলির আঁচড়ে আঁচড়ে
প্রজন্মের কাছে পৌঁছে যায় নতুন শিল্পবিস্ময়
পথটি নিদারুণ কষ্টের, ধৈর্য্য তাকে
কষ্টসহিষ্ণু করে। সে জানে মহাশূন্যে
ঘূর্ণায়মান মূর্ত কি বিমূর্ত বিষয়গুলো
ক্যানভাসে রঙিন করাই তার কাজ। তার পেছনে
একটি আপেলগাছ, তারও পেছনে পর্বতমালা।
মারিয়ার জন্য
প্রিয়, আমি সম্পূর্ণ হবো তোমারই কাছে
গভীর সাধনায় তুমি এক ধারালো কোদাল
খননে ব্যস্ত আমার মস্তিষ্কের গভীরে;
ঘাস-বর্জ্যরে মাটি ও পশুমল
মিলেমিশে একাকার, তুমি তো তুমুল বৃষ্টি
যে বীজ বুনেছিল এক সৌরবর্ষ, তা আজ
অঙ্কুরিত হয়
আর কচিকাঁচা পাতারা উর্ধ্বমুখে মেলে ধরে ডানা;
সবাই অবশ্য
বেড়ে ওঠার সমান সুযোগটিও পায় না।
তাদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত দুর্বল চারাগুলো
নিড়ানী দিয়ে উপড়ে ফেলতে হয়,
তারপর সবলেরা বেড়ে ওঠে সুষম পুষ্টি শুষে নিয়ে।
আর এটাই হলো আমাদের এই বস্তুজগতে
এই যে উচ্ছ্বল স্রোতের জলবন্ধন
বেঁচে থাকার নির্মম নিয়ম।
শরতবৃষ্টির প্রথম প্রহরেই কী প্লাবিত হলো
আমার কাদামাটির দূর্গ…
প্রিয়, তুমি সম্পূর্ণ হও। তোমার ছোট ছোট
অসমাপ্ত রেখা, অপূর্ণ পরিধি
আমার অভ্যন্তরে নতুন পৃখিবী
চর্তুভুজাকৃতির চার দেয়াল আর একটি বৃত্ত
রাত্রিপার
অতি সাধারণ কিছু ঘ্রাণের ভেতর কেটে যায় ফ্রান্সের রাত্রি:
খড় আর গাছপালায় বৃষ্টিজল
বাতাসে ভেসে ভেসে নতুন এক উষ্ণতা
ঝাপটে পড়ে হুডখোলা গাড়িটিতে
নিয়ন আলোয় বিলবোর্ডগুলো নিষ্ঠুর একরোখা।
মনট্রিউয়াল, এবিভিলি, বিউভাইস-
তোমরা তিনজন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলে, এসেছিলে এবং চলেও গেছো
প্রতিশ্রুতি রেখে, ফলে রাস্তার নামকরণেও পাই তোমাদের।
একটাই যন্ত্রণা মিলেছে প্রতিটি পথের বিলম্বে
রক্তবীজগুলো অবশ্য তোমাদের কাজেরই প্রতিফলন।
একটাই অরণ্য আগুন ছড়িয়ে দিয়েছে সবখানে
ছোট ছোট ক্যাফের বাতিগুলো একে একে নিভে গেছে।
তখনো আমি অবিশ্রান্ত তোমাকে ভাবছি
দক্ষিণের হাজার মাইল পরে-
যেখানে ইতালির বিস্তর ভূমি ফ্রান্সের বিষন্নতা কুড়োচ্ছে।
সেখানেও সহজাত জাগরণ।
[লেখাটি সাহিত্য পত্রিকা-ওঙ্কার ২০১৫ ফাল্গুন সংখ্যায় প্রকাশিত]

আইরিশ কবি, নাট্যকার, অনুবাদক সিমাস হিনির জন্ম ১৩ এপ্রিল ১৯৩৯, আয়ারল্যান্ডের লন্ডনভেরি কাউন্টির ক্যাসলডাউসন ও টমব্রিজের মধ্যবর্তী মসবৌন খামারবাড়িতে। নয় সন্তানের সবার বড়। বাবা প্যাট্রিক হিনির একটি ছোট খামার থাকলেও তিনি মূলত গবাদিপশুর ব্যবসায় বেশি মনোযোগী ছিলেন। তাঁর মা মার্গারেট ক্যাথলিন নিকটবর্তী সম্ভ্রান্ত জ্যাককান পরিবারের সদস্য। এই পরিবারটি যত না ঐতিহ্যবাহী আইরিশ গ্রামীণ অর্থনীতির ধারক, তার চেয়ে বেশি সম্পৃক্ত শিল্পনির্ভর আধুনিক পৃথিবীর সঙ্গে। এই পরিবারের মালিকানাধীন কিছু ছোট কলকারখানা ছিল।
১৯৫৩-তে চলে এলেন বেলফাস্টে, কুইন্স ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য পড়বেন। টেড হিউজেসের একটি কাব্যগ্রন্থ হাতে এলে ভাবলেন, তিনিও তো এমন কবিতা লিখতে পারেন। শুরু তখনই। কিন্তু টেক্সট বই ছেড়ে বোহেমিয়ান জীবনে প্রবেশ করে নয়। ১৯৬১ সালে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘অসাধারণ ছাত্র’ বিবেচিত হন, পুরস্কারের টাকায় কেনেন লুই ম্যাকনিস, জে. এম. সিঙ্গে এবং অস্কার ওয়াইল্ডের বই। প্রথম শ্রেণির অনার্স ডিগ্রি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়লেন। পেশা হিসেবে নিলেন শিক্ষকতা। স্কুলেই ল্যাটিন ও আইরিশ ভাষাচর্চা শুরু করেন। বেলফাস্টের সেন্ট থোমাস সেকেন্ডারি ইন্টারমিডিয়েট স্কুলে শিক্ষকতার সময় স্কুলের প্রধান শিক্ষক লেখক মাইকেল ম্যাকলেভার্টি তাঁকে প্যাট্রিক কাভানাগের কবিতার সঙ্গে পরিচিত করান। ম্যাকলেভার্টির প্রেরণায় তাঁর কবিতার প্রকাশনা ১৯৬২ সালে। সিমাস হিনি পরবর্তীকালে তাঁর এই ‘প্রিয় শিক্ষক’ ‘প্রিয় পালক পিতা’ কবি মাইকেল ম্যাকলেভার্টির রচনাসংগ্রহ সম্পাদনা করেন। হিনির কবিতা ‘ফস্টারেজ’ এবং ‘সিংগিং স্কুল’ তাঁকে নিয়েই রচিত।
সিমাস হিনির প্রথম প্রধান কাব্যগ্রন্থ ডেথ অব অ্যা ন্যাচারালিস্ট ১৯৬৬ সালে বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা ফেবার অ্যান্ড ফেবার প্রকাশ করে। আগের বছর প্রকাশিত হয় প্রথম কাব্যগ্রন্থ এলিভেন পোয়েমস। তাঁর কবিজীবনের শুরুতে একে আরো অর্থবহ করে তোলেন স্কুল শিক্ষয়িত্রী ম্যারি ডেভলিস। দুজনের সম্পর্কের নৈকট্য বিয়েতে গড়ায়। ম্যারি পরিচিত হয়ে ওঠেন ম্যারি হিনি নামে। তিনিও লিখতে শুরু করেন, ধ্রুপদ পুরাণ নিয়ে তিনি লিখেছেন আইরিশ মিথস অ্যান্ড লিজেন্ডস। কবির পেশাগত জীবন, তাঁর কল্পলোক এবং কবিজীবনের প্রধান সহায় ম্যারিকে ঘিরেই তাঁর জীবন আবর্তিত। হিনি ছয় বছর কুইন্স ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করে সাহিত্য পড়াতে চলে যান হার্ভার্ডে। পাঁচ বছরমেয়াদি গৌরবজনক পদ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘প্রফেসর অব পোয়েট্রি’ হিসেবে ১৯৮৯-৯৪ অধিষ্ঠিত থাকেন। ‘গীতিময় সৌন্দর্য ও নৈতিক গভীরতাসম্পন্ন যে-রচনা নিত্যকার দৈব এবং যাপিত অতীতকালকে উদযাপিত করে’ – সেজন্য সিমাস হিনি নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পান ১৯৯৫ সালে।
৩০ আগস্ট ২০১৩ সালে সিমাস হিনি ৭৪ বছর বয়সে তাঁর দীর্ঘদিনের আবাসভূমি ডাবলিনে মৃত্যুবরণ করেন।