হিমালয়ের গহীনে : প্রকৃতি ও সংস্কৃতির মাঝে যাত্রা (পর্ব-১)
ছোটবেলা থেকেই ভ্রমণ কাহিনীগুলো প্রবলভাবে টানতো, লেখকের বর্ণনায় আর তাঁদের চোখে মুগ্ধ হয়ে দেখতাম পৃথিবীর সব অপরূপ সব স্থান। এ যেন পড়া নয় নিজ চক্ষে দেখা। সেই যে অন্নদাশংকর রায়ের পথে প্রবাসে কবে মাথায় ঢুকে পড়েছিলো তারপর আমাদের হাসনাত আবদুল হাই এর ট্র্যাভেলগ-এর জন্য প্রতি সপ্তাহে সংবাদ সাময়িকীর অপেক্ষা। এক সময় ভ্রমণ সাহিত্য আটপৌঢ়ে ভ্রমণ গাঁথার বাইরে কখন ভালোলাগার জায়গা করে নিলো টের পাইনি। হালের মইনুস সুলতানের লেখার মুন্সিয়ানায় আমি মুগ্ধ হয়ে যাই। বাংলাদেশের মানুষের প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক অ্যাডভেঞ্চারের কারণে আলাদা করে অ্যাডভেঞ্চারের কথা ভাবার প্রয়োজন পড়ে না কিন্তু প্রায় সমতল এ দেশটির এত কাছেই যে শুধু বৃহৎ পর্বতমালা আছে তাই নয় সুউচ্চ শৃঙ্গগুলো যে হাতের নাগালে। বিস্তৃত হিমালয় জুড়ে কত না অজানা প্রকৃতি আর সংস্কৃতির বৈচিত্রময়তা আছে তা বাঙালীর অজানা এখনো অথচ এই সর্বোচ্চ শৃঙ্গের আবিষ্কার কিন্তু একজন বাঙালীই করেছিলেন। সেই রাধানাথ শিকদার কিন্তু একেবারেই অন্তরালে। আমাদের দেশের পাহাড় ঘেরা শহর চট্রগ্রামে আমার জন্ম হলেও বুদ্ধি হবার পর প্রথম পাহাড়ের সাক্ষাৎ কলেজ জীবন শেষে বন্ধুদের সাথে চট্রগ্রাম, রাঙ্গামাটি গিয়ে। তখনকার সরু ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়ক পেড়িয়ে সীতাকুন্ডু পৌঁছে ঐ সব টিলা সদৃশ্য পাহাড় দেখে আমি যারপরনাই আহ্লাদ অনুভব করলাম। সবাই মিলে ঠিক করলাম চন্দ্রনাথ পাহাড়ে উঠবো। সে কি উত্তেজনা! সেইপথ আজ জনজঙ্গলে পূর্ণ। এখন চন্দ্রনাথ পাহাড়ে ওঠার নানান উপায় আর দোকানের উৎপাত। সেই যে পাহাড়ের মায়া গায়ে মাখলাম এখন অব্দি বহন করে চলেছি সযতনে সঙ্গোপনে। পৃথিবীর বহু পর্বতমালার সাথে পরিচয় আমার ঘটেনি কিন্তু ঘটেছে পর্বতমালার সেরা হিমালয়ের সাথে। বাবা-চাচার কাছে গল্প শুনতাম তাদের ছেলেবেলার কালিম্পঙ, কার্শিয়ঙ, দার্জিলিং, টয় ট্রেন আর ঘুম রেল ষ্টেশনের। কল্পনায় আঁকতাম ছবি। সন্ধ্যের আগে শরতের মেঘ আকাশে ভেসে উঠলে মনে হত ঐ বুঝি হিমালয়ের সব পর্বতমালা! নিজের মনের রঙে সাজাতাম সব। পরিণত বয়সে পৌঁছে জীবন আর জীবিকার খোঁজে উপেক্ষা করেছি পাহাড়। অবশেষে যখন যেতে তাগিদ অনুভব করলাম, ঠিক করলাম পর্বতমালার মাঝে সবার সেরা হিমালয়ের এভারেষ্ট হবে আমার পথ। আমি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পর্বতারোহী নই। আর চলিশ ছুঁই-ছুঁই বয়সে শারীরিক সক্ষমতা অনেক সহায়ক- তাও নয়, তবু মনের জোরই সম্বল। যখন সিদ্ধান্ত চুড়ান্ত করলাম এবারই যাব এভারেষ্ট বেইস ক্যাম্প। যাব যাব করে বহুদিন হলো ২০০০ এর শুরু থেকেই! সেই তখন অমরেন্দ্র চক্রবর্তী সম্পাদিত ‘ভ্রমণ ট্রেকিং’ বইটি আমি আমার বন্ধুর কাছ থেকে মেরে দেয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। বই চুরি করলে অপরাধ হয় না তাই বহু মানুষকে বহু চুরির অবাধ সুযোগ নিজে দিলেও এই একমাত্র বইটি আমি নিজে হস্তগত করেছি প্রকাশ্যে বন্ধুকে বলেই। হিমালয় জুড়ে সব পর্বতমালায় ঘুরে বেড়ানোর চমৎকার বিবরণ, তার মাঝে ‘এভারেস্ট হাইওয়ে’ আমাকে বিশেষ আর্কষণে বাঁধলো। ২০১২ এর শুরুতে সিদ্ধান্ত চুড়ান্ত করে বসলাম, বন্ধুবর সৌরভ মনসুর চাঁছাছোলা প্রশ্ন করে বসলো “তুই কি এভারেস্ট বেইস ক্যাম্প গিয়েছিস, এটা সবাইকে বলার জন্য যেতে চাস?” আমার উত্তর “না”। আমি আসলে কতদূর যেতে পারবো জানি না কিন্তু যাবার উদ্দেশ্য হল প্রকৃতির বিশালতায় হিমালয়ের সর্বোচ্চ চূড়াগুলো নিজ চোখে দেখতে চাই, শেরপাদের সংস্কৃতি আমি অনুধাবন করতে চাই। সৌরভ মনসুর বাংলাদেশের সবচাইতে বড় ট্যুর অপারেটর গাইড ট্যুরের সাথে জড়িত সে উৎসাহ দিলো তবে যা তুই। কিন্তু বড় বিপদসংকুল পথ। আমার যাত্রাকালে তিন বিখ্যাত বাঙালী পর্বতারোহী এম এ মুহিত, নিশাত মজুমদার ও ওয়াসফিয়া নাজরিন চূঁড়ায় উঠার জন্য ইতোমধ্যে রওনা হয়ে গেছে বেইস ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে। এর মাঝে আমার ফেইসবুকের মাধ্যমে ওয়াসফিয়ার সাথে যোগাযোগ হয়েছে। অনলাইন তথ্যভান্ডার ঘেঁটে যাবার প্রস্তুতি আমার চললো মার্চ মাসে। এপ্রিলের শুরুতেই আমাকে যেতে হবে দিল্লী ও কলকাতায় রবীন্দ্র সার্ধশত বার্ষিকীর রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে রবীবাবুর পাহাড় আর তার মানুষদের নিয়ে নাটক ‘মুক্তধারা’ মঞ্চায়নে, ফিরে এসে সময় পাবো না তাই খুঁজে বের করতে লাগলাম কি কি উপকরণ লাগবে আমার। কাঠমন্ডুতে আছে প্রচুর ট্যুর অপারেটর। তারা পুরো ট্যুরটাই অর্থের বিনিময়ে পরিচালনা করে থাকে। আমি এদের ক’জনের সাথে যোগাযোগ করলাম, পরে মনস্থির করলাম নিজেই যাব শুধু একজন পোর্টার সঙ্গী করে হিমালয়ের গহীনে ‘সাগরমাথা’ ভ্রমণে। এভারেষ্টকে নেপালীরা বলে সাগরমাথা আর আরেক ভাগীদার তিব্বতীয়রা গো মো গ্ল্যাংমা (Chomolungma) মানে পবিত্র মাতা। ঢাকা থেকে কাঠমন্ডুর যোগাযোগ খুব ভালো, প্রথমবার ২০০০ সালে আমি সড়ক পথে গিয়েছিলাম তারপর বহুবার আকাশ পথে।
বিমান বাংলাদেশের প্রতিদিন ফ্লাইট আছে আর ভাড়াও অন্যদের তুলনায় প্রতিযোগিতামুলক। এবার ভালো হলো কারণ ফ্লাইট সকালে থাকায় সারাদিন প্রস্তুতির সুযোগ পাওয়া যাবে কাঠমন্ডুতে। শুধু ইন্টারনেটে বুকিং দিয়ে গেছি কাঠমান্ডু থেকে লুকলা পর্যন্ত তারা এয়ার এ। ২৪ এপ্রিল মঙ্গলবার আমার যাত্রা ঢাকা থেকে শুরু হলো একটু বেশী আগেই কারণ হরতাল, তাই বিমানবন্দরে নির্ধারিত সময়ের বেশ আগেই পৌঁছে অপেক্ষা। নানান পরিচিত মানুষজনের সাথে দেখা, ভ্রমণের কারণ শুনেই চোখ কপালে তুলে তাকালো। বিমানের নানা বদনাম কিন্তু একেবারে ঠিক সময়ে ছাড়লো ঢাকা। বিমান বাংলাদেশের-এ ভ্রমনের বড় সুবিধা হলো উড়োজাহাজগুলো সুপরিসর, প্রাইভেট কেম্পানিগুলোর মতো বিরক্তিকর ক্ষুদ্র নয়। ক্যাপ্টেন মেহেদি চালাচ্ছিলেন বিমান। তার কাছে গেলাম ককপিটে। উনি সাদরে অভ্যর্থনা করলেন আর দূরের পর্বতমালার বর্ণনা দিতে লাগলেন। কেমন স্বপ্নময় সব পর্বত মেঘেদের উপর ভেসে আছে অপার রহস্য নিয়ে। পরবর্তীতে জানতে পারলাম গল্পের সূত্র ধরে উনি আমার দূর সম্পর্কের আত্মীয় বটে। কাঠমন্ডুর ফ্লাইট খুবই সংক্ষিপ্ত। ককপিট থেকে কটা ছবি তুলতেই দেখলাম বিমান নিম্নগামী। নিচে দেখা যাচ্ছে কাঠমন্ডুর ভীষণ অগোছালো বাড়িঘর। কাঠমন্ডু ভ্যালীর ত্রিভূবন বিমানবন্দরে অবতরণ করলাম। বাইরে কড়া রোদ অর্ভ্যথনা জানাল। কাঠমন্ডুতে অবতরণের ভিসা পাওয়া যায় সহজেই। যাতে আগে থেকে ভিসা করতে হয় না। ত্রিভূবন বিমানবন্দর গেলো দশ বছরে তেমন কোন উন্নতি লাভ করেনি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায়। তবে ভিসা পাওয়া গেল দ্রুততায়। বাইরে বেড়িয়েই ট্যাক্সিওয়ালাদের দৌরাত্ম। প্রি-পেইড ট্যাক্সি আছে কিন্তু ভাড়া বেশী। অনেক কমে একটা ট্যাক্সি ঠিক করলাম থামেল পর্যন্ত। ওঠার পরই ট্যাক্সিওয়ালার প্রশ্ন হোটেল ঠিক আছে তোমার? বুঝলাম কম ভাড়ার কারণ। আমি বললাম তোমার পছন্দ মত নিয়ে যাও, আমার পছন্দ হলে থাকব। মাত্র ৮০০ নেপালী রূপীতে মোটামুটি একটা হোটেলে উঠলাম। রিসিপশনে জিজ্ঞাসা করলাম তারা এয়ার এর অফিস কই। করিৎকর্মা ওরা বললো কত টাকায় তোমার নিকট রফা হয়েছে তার চাইতে আমরা কমে দেব আর তোমাকে কষ্ট করতে হবে না, পৌঁছে যাবে তোমার রুমে। চলে এল এলপাইন ক্লাব অব হিমালয়ার দ্বিপেন্দ্র বৎসালা। সজ্জন ব্যক্তি আমাকে সব যোগাড় করে দিলো দ্রুত। অতিরিক্ত খরচ হলো তিন ডলার মাত্র। অভিজ্ঞ পোর্টারও মিলে গেল দৈনিক ১২০০ নেপালী রূপীতে। থাকা খাওয়া তার, আমি দরিদ্র দেশের মানুষ পোর্টারই আমার গাইড হবে। দ্বিপেন ইন্সুরেন্স করতে মানা করলো, শুধু শুধু তোমার প্রায় ৫০০ ডলার বেরিয়ে যাবে। হোটেল থেকে বেরিয়ে তার অফিসে বসে গনগনে দুপুরে শীতল বিয়ারে চুমুক দিতে দিতে সব কাজ প্রায় শেষ। দীপেনের পরামর্শগুলো খুব কাজের ছিল। তবে তাঁকে আমার পোশাকগুলো দেখিয়ে দিলে পুরো ভ্রমণটা আরো আরামদায়ক হতো বটে। অভিজ্ঞতাহীনতায় আমি দেশ থেকে বেশ ভারী চামড়ার বুট নিয়ে এসেছি তা বুঝতে আমার ফেরার সময় হয়ে গিয়েছিল। কাঠমন্ডুতে বিশেষ করে থামেলে খাবারের নানান বৈচিত্রতা আছে। ডাল ভাত খুব জনপ্রিয় নেপালীদের মাঝে। পরবর্তী দিনে আমার কপালে কি খাবার আছে তাই ডাল ভাত আর সাথে মাছকেই সবচাইতে যৌক্তিক মনে করলাম আমি। এরপর পাহাড়ে ওঠার সামগ্রীর দোকানে দোকানে ঘোরাঘুরি। দুটো মাউন্টেন ষ্টিক কিনে ফেললাম। কত রকমের জিনিসপত্র যে লাগে পাহাড়ে উঠতে। অনভিজ্ঞ আমি প্রায় কিছু ছাড়াই উঠতে চলেছি এভারেষ্টর পথে। সন্ধ্যায় থামেল বেশ জমজমাট। খোলা বাগানের রেস্তোরাঁয় দেশী-বিদেশী লাইভ গানের জমজমাট পরিবেশনা।
চলবে …
কবি, অভিনয়শিল্পী।