| 7 অক্টোবর 2024
Categories
এই দিনে প্রবন্ধ সময়ের ডায়েরি সাহিত্য

অদ্বৈত মল্লবর্মণ ও তিতাস একটি নদীর নাম

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

আজ ১৬ এপ্রিল। অদ্বৈত মল্লবর্মণের মৃত্যুবার্ষিকী।  ইরাবতী পরিবার বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করছে তাঁকে। পাঠকদের জন্য রইল আশরাফ উদ্দীন আহমদের একটি প্রবন্ধ


।। আ শ রা ফ উ দ্ দী ন আ হ্ ম দ।।

বাংলাসাহিত্যে চিরপরিচিত একটা নাম অদ্বৈত মল্লবর্মণ (১৯১৪-১৯৫১) তৎকালীন ভারতবর্ষের ত্রিপুরা রাজ্যের ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার (দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে আনুমানিক দুই-আড়াই মাইলের মধ্যে) গোকর্ণ বা গোকর্ণঘাট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। অদ্বৈতের পিতার নাম অধরচন্দ্র মল্লবর্মণ এবং মাতার নাম সারদা দেবী। অদ্বৈতের অপরিণত বয়সে বাবা-মা দুজনই (স্বর্গবাসী হন) অর্থাৎ দেহত্যাগ করেন। আর একমাত্র অগ্রজার নাম তরঙ্গময়ী (যে অল্প বয়সে বিধবা হয়)। আরো দুটো ভাই ছিল, যারা অপরিণত বয়সে মারা যায়। ১৯৩৩ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এডওয়ার্ড হাইস্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন অদ্বৈত, কুমিল্লা জেলার ভিক্টোরিয়া কলেজে আই এ প্রথম বর্ষের ছাত্রাবস্থায় ১৯৩৪ সালে কলিকাতায় জীবিকার সন্ধানে পাড়ি জমান, মাসিক ‘ত্রিপুরা’ পত্রিকায় সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে আরম্ভ হয় তার কর্মজীবন, কুমিলার ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার আরেক কৃতমান সাহিত্যিক জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী (১৯০৬-১৯৫৬) কথা মনে পড়ে, ‘বারো ঘর এক উঠোন’-এর এই লেখক ১৯৩৪ সালে জীবিকার সন্ধানে কলিকাতায় চলে যান, কিন্তু দুজনের সঙ্গে কতোটুকু ঘনিষ্ঠতা ছিল জানা না গেলেও দুজনই যে একই অঞ্চলের মানুষ সে কথা তো ভুলে গেলে চলবে না। তবে দুজনের মধ্যে একদিকে বেশ মিল ছিল, তা হলো দুজনই ছিলেন অনেক বেশি লাজুক প্রকৃতির এবং নির্লিপ্ত আর নির্জনতাপ্রিয় মানুষ। অদ্বৈতের মতো জ্যোতিরিন্দ্রও দারিদ্র্য আর অভাব নিয়ে জন্মেছিলেন, কলিকাতা গিয়েও প্রথম জীবনে টিউশনিই ছিল তার একমাত্র পেশা, দীর্ঘ সময় এই টিউশনি তার জীবিকার একমাত্র পথ ছিল, যদিও অনেক পরে তিনি সাংবাদিকতার পেশাকে জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করেন। তার ‘বারো ঘর এক উঠোন’ উপন্যাসে বস্তিজীবনের কাহিনী বিধৃত, কারণ তিনি দীর্ঘদিন ক্ষুদ্র পরিসরের মেসবাড়ির জীবন অতিবাহিত করেছেন এবং সেখানকার কত বাস্তব জীবনকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন, আর দেখেছেন মানুষের বিচিত্র ঘটনা-উপঘটনা এবং তাদের সংগ্রামমুখর পথচলা। অদ্বৈতের সঙ্গে আরেক জায়গায়ও মিল দেখতে পাওয়া যায়। তা হলো দুজনই নিম্নবিত্তের মানুষদের হাসি-কান্না ভালোবাসা সংগ্রামকে কাছাকাছি দেখে, শুধু উপলব্ধি থেকেই নয়, বাস্তবজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে সাহিত্য রচনা করেছেন এবং তা বহুগুণ সফলকাম হয়েছে এবং পরিশেষে বলতেই হয়, দুজনেই নিজ দেশ বা জন্মভূমি কুমিল্লার ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আর ফিরে আসেননি। যদিও এখানে বলা হয়ে থাকে, মন্বন্তর-মহামারী-দাঙ্গা-দেশভাগের কারণে তারা জন্মভূমির মায়া ত্যাগ করেন, ফিরে আসেননি, কথাটা কতটুকু সত্য সে বিষয়ে অনেক প্রশ্ন আছে, তারপরও বলতেই হয় ঘরের ছেলে যদি ঘরে ফিরে আসে মা কি তারে ফিরিয়ে দিতে পারে। অনেক রকমের কথা বলা যায়, আসলে তাদের ফিরে আসা, না আসা সেটা স্রেফ একটা ধোঁয়ায় আচ্ছাদিত প্রশ্ন। আমরা বলতে পারি যে, সাহিত্য রচিত হয় মধ্যবিত্তের হাতে কিন্তু তার বিকাশ হয় বড় শহরে, অবিভক্ত বাংলার রাজধানী তখন কলিকাতা, আর তাই সবারই স্বপ্ন ছিল বড় শহরে থেকে নিজেকে খানিকটা ওপরে তুলে ধরা, হয়তো এ কারণে কলিকাতায় একবার যে গেছে সে কি আর ফিরে আসে গণ্ডগ্রামে! আমরা জানি কবি জীবনানন্দ দাশও তিলোত্তমা কলিকাতার প্রেমে পড়ে সাতচলিশের পরে আর নিজ জেলা বরিশালে ফিরে আসেননি। তাহলে অকারণে দেশভাগকে দোষ দেয়ার কোনো ন্যায়সঙ্গত কারণ নেই। অদ্বৈত মল্লবর্মণ মাসিক ‘ত্রিপুরা’য় সাংবাদিকতা শুরু করলেও তিনি আর থেমে থাকেননি, একে একে তারপর ১৯৩৬ সালে যোগ দেন ‘নবশক্তি’ পত্রিকায়। ১৯৪২ সালে ‘নবশক্তি’ বন্ধ হলে ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকা, ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকাতেও কাজ করেন সাংবাদিক হিসেবে। ১৯৪৫ সালে ‘দেশ’ পত্রিকায় সাগরময় ঘোষের একান্ত আগ্রহে যোগদান করেন, ‘দেশ’ পত্রিকায়। যোগ দেয়ার আগে কিছুদিন খণ্ডকালীন সাংবাদিক হিসেবে ‘নবযুগ’ ‘কৃষক’ এবং ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় চাকরি করেন। ১৯৪৮ সালে য²া রোগে আক্রান্ত হওয়ার আগে পর্যন্ত ‘দেশ’ পত্রিকায় সঙ্গে চাকরি সূত্রে জড়িত ছিলেন তিনি। ১৯৫১ সালের ১৬ এপ্রিল কলিকাতার নারকেলডাঙ্গার ষষ্ঠীতলার বাড়িতে মাত্র সাঁইত্রিশ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই মহান সাহিত্যিক অদ্বৈত মল্লবর্মণ।

তার শ্রেষ্ঠ রচনা ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, মাসিক ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকায় ১৩৫২ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ-ভাদ্র ও আশ্বিন সংখ্যায় ধারাবাহিকভাবে প্রথম লেখনের বৃহদাংশ মুদ্রিত হয়, দীর্ঘ তিন বছর (১৯৪৩-১৯৪৫) অবধি মাসিক মোহাম্মদীতে চাকরি করেন, আবুল কালাম শামসুদ্দীনের সহায়তায় অদ্বৈত মল্লবর্মণ সম্পাদকের সহকারী হিসেবে যোগ দেন। কিন্তু এক সময় শুধু মতবিরোধের কারণে ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকার চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। তার পরিণাম ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসের ওপর পড়ে অর্থাৎ কি এক অজানা কারণে পাণ্ডুলিপিটি হারিয়ে যায়। ১৯৫১ সালের ১৬ এপ্রিল মাসে মৃত্যুবরণের ঠিক আগে তিনি নতুন করে আবার ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ রচনার পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করেন। পুনঃলিখিত পাণ্ডুলিপি পুঁথিঘর থেকে প্রকাশিত হয় ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে, পরবর্তী সময়ে ‘রাঙামাটি’ উপন্যাসটি ‘চতুষ্কোণ’ পত্রিকায় বৈশাখ ১৩৭১ থেকে চৈত্র ১৩৭১ বাং সময়ের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়, ‘শাদা হাওয়া’ উপন্যাসটি ‘সোনারতরী’ পত্রিকায় ১৩৫৫ বাং শারদ সংখ্যায় প্রকাশ পায়। অদ্বৈত মল্লবর্মণের মৌলিক তিনটি উপন্যাস ছাড়াও চিত্রশিল্পী ভ্যান গঘকে নিয়ে রচিত আরভিং স্টোনের উপন্যাস ‘লাস্ট ফর লাইফ’ যার বাংলা নামকরণ করেন ‘জীবনতৃষ্ণা’ নামে, অনুবাদিত এই উপন্যাসটি বাংলাসাহিত্যে এক অমূল্য সম্পদ, কলিকাতার ‘দেশ’ পত্রিকায় ১৯৫০ সালে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হয়। প্রথম জীবনে হাতেখড়ি কবিতা দিলে হলেও তৃণমূল পর্যায়ে ব্যাপক অনুসন্ধান করে দেশজ বা লোকজ সাহিত্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেন নিজেকে, মাত্র সাঁইত্রিশ বছরের জীবনে তার রচিত আরো রচনা- রিপোর্টাজ-চারটি ছোটগল্প, ছয়টি কবিতা চব্বিশটি প্রবন্ধ/নিবন্ধ এবং তিনটি চিঠি আবিষ্কৃত হয়েছে এ যাবৎকাল। চীনা জীবনকে নিয়ে লেখা ‘গুড আর্থের’ সাহিত্যিককে উদ্দেশ্য করে তিনি যে লেখেন ভারতের চিঠি ‘পার্ল ব্যাককে, তাতে তার সৃষ্টির পরিচয় পাওয়া যায় সুস্পষ্ট, এটিই তার জীবদ্দশায় প্রকাশিত একমাত্র গ্রন্থ, যা অদ্বৈত দেখে যেতে পেরেছিলেন। জোসেফ দাস নামে একজন ভারতীয় অনুবাদক, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসটি স্প্যানিশ ভাষায় অনুবাদ করেন। আর ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেন কল্পনা বর্মণ। অদ্বৈত মল্লবর্মণ মেকি রোমান্টিকতার রঙ দিয়ে নিম্নবর্গের জীবনযাপনকে শিল্পায়িত করার চেষ্টা করেননি, প্রাকৃত জীবনের গভীরে প্রোথিত ছিল মল্লবর্মণের শিল্প-চৈতন্যের শেকড়, স্বপ্নবিলাস বা জীবনবিলাস তার লেখায় আচ্ছন্ন হতে পারেনি, প্রতি মুহূর্তে জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন, যে জীবন সর্বসাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে, তারপরও একটা জীবন পেয়েছে প্রাকৃতিক উপায়ে এটাই এদের কাছে বড় পাওয়া, পশ্চাৎপদ এবং অশিক্ষিত একটা সম্প্রদায়ের কাছে এর চেয়ে আর কি বা চাওয়ার আছে, অদ্বৈত তার লেখনীর মাধ্যমে তাদের ভেতরের জীবনটাকে আলোর সামনে তুলে ধরেছেন, হয়তো এখানেই তার কৃতিত্ব।

নদী এবং নদীর সম্পদ মাছ নিয়ে বাংলাসাহিত্যে অনেক উপন্যাস-ছোটগল্প রচিত হলেও ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ অন্যতম একটা সৃষ্টি, যা বাংলা সাহিত্যকে অনেক ওপরে তুলে ধরতে সহায়তা করেছে মানতেই হয়। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ (১৯৭৩) উপন্যাসটিকে অনন্য সাধারণ নিপুণতার সেলুলয়েডের পর্দায় তুলে ধরেন আরেক অনন্য গুণী প্রতিভা শিল্পী পরিচালক ঋত্বিক ঘটক, তিতাস পাড়ের ব্রাত্যজন-মালোদের জীবনবৃত্তান্ত অদ্বৈত মলবর্মণ যে কাঠামো বৈশিষ্ট্যে লেখনীর মাধ্যমে এই উপন্যাসে চিত্রিত করেছেন, সেই পট বা স্টাইল থেকে একচুলও সরে না গিয়ে ঋত্বিক তাকে চলচ্চিত্রায়িত করতে প্রয়াসী হয়েছেন এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না, আত্মপ্রত্যয়ী-নির্ভীক এবং বাস্তববাদী ঋত্বিক এই ছবিতে তিতাস পাড়ের গ্রাম-প্রকৃতি গ্রামবাসীদের সমাজ-সংসার জীবন-জীবিকা যাবতীয় প্রকট মালিন্য ও দৈন্যদশাকে উপস্থাপন করতে যেমন প্রয়াসী হয়েছেন, তেমনভাবে তিতাস পাড়ের ওই ব্রাত্যজনদের মহৎ মানবিক গুণাবলিকে তুলে ধরতে এতটুকুও তাচ্ছিল্য করেননি। বরং তার এই পরিশুদ্ধ শিল্পকর্মের জন্য তিনি বাংলা চলচ্চিত্রে অনেক সুনাম কুড়িয়েছেন এবং চলচিত্রকে প্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছেন।

তিতাস নদীকে ঘিরে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর জীবন কাঠামো কিভাবে পরিচালিত এবং নিয়ন্ত্রিত হয় তারই বৈচিত্র্য বিন্যাস করেছেন অদ্বৈত ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসের মধ্য দিয়ে, এ উপন্যাসে লেখকের শিল্পসৌন্দর্যবোধের উদ্বোধন বিস্ময়কর, কোথাও তিনি এতটুকু ফাঁক রাখেননি। জীবনকে যেভাবে দেখেছেন ঠিকঠিক সেইভাবেই নিপুণ কারিগরের মতো তুলে এনেছেন, মানুষের প্রতি তার এই ভালোবাসা, এই মেলবন্ধন পুরোপুরি দেখতে পাওয়া যায় এই উপন্যাসে। প্রেম ও লিবিডো বিষয়ে তার বিস্তারিত বর্ণনা রস ব্যঞ্জনাময়, বসন্তের হোলি উৎসবে স্ত্রীর আবির প্রলিপ্ত হস্তস্পর্শে কিশোরের মস্তিষ্ক কোষে অবচেতন গহŸরে পূর্ব স্মৃতির প্রতিক্রিয়াজাত যে দৃশ্য সংঘটিত হয় তা অদ্বৈত শব্দরূপ দিয়েছেন শিল্পিত ভঙ্গিতে। উপন্যাসের ব্যবহৃত ভাষা অদ্বৈতের জীবনযাপনের অভিজ্ঞতার ভাষা, তিতাসের স্রোতের মতো ভাষাতেও এসেছে মৃদু সঙ্গীত, দারিদ্র্যে জীর্ণশীর্ণ-হতশ্রী মালো পরিবারে জন্মেছিলেন বলেই জীবনকে এত কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে এবং হয়েছে বলেই তার হাতে তিতাস একটা মোক্ষম মাত্রা পেয়েছে, যে মাত্রার বলে বলীয়ান হয়ে তিতাস ছুটে গেছে তার আপন গন্তব্যে, আপন ইন্দ্রজালে। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসটি চার খণ্ডে সজ্জিত এবং প্রতি খণ্ডে আবার দুটো করে অনুচ্ছেদ আছে, প্রতি অনুচ্ছেদে কাহিনীকে সুবিন্যস্ত করেছে বিভিন্ন চরিত্র, চরিত্রগুলো কথা বলেছে মালোপাড়ার নিঃস্ব-রিক্ত সর্বহারা মানুষের, কখনো হাসি-কান্না আবার কখনো ভালোবাসা-গালগল্পে নিজেদের সিক্ত করে রেখেছে, মানুষের জন্য মানুষের এমন ভালোবাসাবাসি, পূজা-পর্বণ হোলি-মেলায় এত আনন্দ এত উৎসব, যা কষ্টের মধ্যেও কিছু সময়ের জন্য ঢেকে রেখেছে মানুষকে, মানুষ যেন একটু হাঁফ ছেড়ে নিজেকে স্বাধীন ভেবেছে, এখানেই হয়তো তিতাসকে নিজের মতো ভেবে বুকে জড়িয়ে নিয়েছে।

প্রথম খণ্ডের দুটো অনুচ্ছেদ- তিতাস একটি নদীর নাম এবং প্রবাস খণ্ড। দ্বিতীয় খণ্ডের দুটো অনুচ্ছেদ- নয়াবসত এবং জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ। তৃতীয় খণ্ডের দুটো অনুচ্ছেদ- রামধনু এবং রাঙা নাও। চতুর্থ খণ্ডের দুটো অনুচ্ছেদ- দু’ রঙা প্রজাপতি এবং ভাসমান। দারিদ্র্যপীড়িত জীবনের ইতিবৃত্ত থেকে সুবল-কিশোর আর বাসন্তী যেভাবে কাহিনীকে আচ্ছাদিত করে রেখেছে, সেখান থেকেই পাঠক তিতাসের রস আস্বাদন করে, তিলকচাঁদ-সুবল-কিশোরের প্রবাসজীবন সুখকর হয়নি, তিতাস বক্ষে নববধূকে দস্যু কর্তৃক অপহৃত হয়েও অস্বাভাবিকভাবে বেঁচে যাওয়া কিশোরের স্ত্রী কিভাবে গোকর্ণঘাটে পুত্র অনন্তকে নিয়ে বসতি স্থাপন করেছে তা এ খণ্ডে বর্ণনা করা হয়েছে। গোকর্ণঘাট গ্রামে নতুন করে পুত্র অনন্তকে নিয়ে সংসারধর্ম শুরু করে কিশোরের স্ত্রীর। শুধু মালো সম্প্রদায়েরই নয়, তিতাস তীরের মুসলিম সম্প্রদায়ের জীবনচিত্রও বিশ্বস্ত ভঙ্গিতে রূপায়িত করেছেন অদ্বৈত, হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের সৌহাদ্যপূর্ণ জীবনাচারণ এবং তাদের অসাম্প্রদায়িক ভাবনা-চেতনা মূর্ত হয়ে উঠেছে তিতাসে, মালোপাড়ার মাতব্বর রামপ্রসাদের সঙ্গে শরীয়তুল্লাহ-বাহারুলার অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায় একটি অসাম্প্রদায়িক জনজীবনের চিত্রই চিত্রায়িত করেননি, জীবনের অনেকখানিক ভেতরে পৌঁছে গেছেন, মালো সম্প্রদায় আর কৃষক সম্প্রদায়ের জীবনযাপনের পদ্ধতির উৎস ও প্রকৃতি বর্ণনা করেছেন রামপ্রসাদ আর বাহারুলার প্রেক্ষণবিন্দু থেকে, দ্বিতীয় খণ্ডের জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ’ অনুচ্ছেদটি মালো সম্প্রদায়ের বিবিধ উৎসব ও জীবনাচার-বিষয়ক, জন্ম-মৃত্যু ও বিবাহ প্রসঙ্গে মালোপাড়ায় জন্ম বা মৃত্যু অথবা জীবনের যে সাড়া মেলে সেই অভিজ্ঞতার ভাষা দিয়ে পরিবেশন করেছেন অদ্বৈত। ধীবর বা জেলে গড়ে ওঠে সমুদ্রকে কেন্দ্র করে, তারাই মূলত মাছ শিকারী, কিন্তু এ কথাও তো সত্য যে কৈবর্ত জনজীবন পূর্ণতা পায় নদীকে কেন্দ্র করে, নদীকেন্দ্রিক বা ধীবর-কৈবর্তজন নিয়ে বাংলাসাহিত্যে অনেক উপন্যাস রচিত হলেও ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ স্বতন্ত্র একটা রচনা, তিতাসের সঙ্গে মালোজীবনের যে নিবিড় সম্পর্ক সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় তার সমর্থন মেলে, ‘নদীসূত্রে প্রথিত অদৃষ্ট তিতাসের কাহিনীতে মূল বোধ হিসেবে কাজ করেছে’।

তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসের তৃতীয় খণ্ডের প্রথম অনুচ্ছেদটি ‘রামধনু’ এই অনুচ্ছেদে নিঃস্ব বালক অনন্তের অসহায়-উদাস ও কল্পনাপ্রবণ মনোদৃষ্টিকেই কেবল উপস্থাপন করেননি, সে সঙ্গে তিতাস তীরের জনজীবনের জীবনঘনিষ্ঠ চিত্র অঙ্কিত করেছেন, চিত্রায়িত করেছেন কৃষক আর ধীবরের প্রেমময় সৌহার্দ্যময় নিবিড় সম্পর্ককে। এই খণ্ডের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ ‘রাঙা নাও’, তিতাসের স্থানিক রঙ-রূপ এবং বৈশিষ্ট্য মূর্ত হয়ে উঠেছে, নৌকাবাইচকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এর অবয়ব, নৌকাবাইচের সঙ্গে তিতাস-তীরবর্তী জনজীবনের রয়েছে গভীর সম্পর্ক। চতুর্থ খণ্ডের প্রথম অনুচ্ছেদ ‘দুরঙা প্রজাপতি’ বাসন্তীর হৃদয়ের বেদনাভার উপস্থাপনের মাধ্যমে এ অনুচ্ছেদের ঘটনাংশ উন্মোচন করেছেন অদ্বৈত। মালোদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের অবলুপ্তির সঙ্গে তাদের জীবনে যে নিদারুণ বিপত্তি নেমে আসে তা অত্যন্ত হৃদয়স্পর্শী ভঙ্গিতে পরিবেশন করেছেন চতুর্থ খণ্ডের ‘ভাসমান’ অনুচ্ছেদে। অকস্মাৎ তিতাসের বুক ফুঁড়ে জেগে ওঠে নতুন চর, সে চর দিন দিন জাগতে থাকে, আয়তনে বাড়ে। এর ফলে মালোদের ধনাগম-উৎস বন্ধ হয়ে যায়, সর্বনাশের গতি হয় তীব্রতর, অবশেষে চরের দখল নিয়ে শুরু হয় আরেক প্রতিযোগিতা, আরেক নতুন যুদ্ধ, এই প্রতিযোগিতায় মালো সম্প্রদায় থাকে নির্বিকার-ভাবলেশহীন, রামপ্রসাদ চর দখলের জন্য মালোদের উজ্জীবিত করে তুলতে চায়, কিন্তু তারপরও সে ব্যর্থ হয়। তারপরও চর দখল নিয়ে লড়াই হয় জোতদারের সঙ্গে রামপ্রসাদের, এবং পরিণতি হিসাবে বরণ করে নেয় মৃত্যুকে, চরের অধিকার থেকে মালোদের সঙ্গে ভূমিহীন কৃষকেরা বঞ্চিত হয়, উপন্যাসের অন্তিম পর্যায়ে মহামারীর মতো মৃত্যু এসে মালোদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়, সমস্ত প্রতিক‚লতার সঙ্গে যুদ্ধ করে কোনো রকমে টিকে থাকে বাসন্তী আর কিশোরের বৃদ্ধ বাবা রামকেশব, অনন্ত কুমিল্লার মতো শহুরে পরিবেশে শিক্ষিত হয়ে গড়ে উঠলেও গোকর্ণঘাটের মালো সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্ক অবিচল। অনন্তবালা চলে যায় আসামে। পাঠক জানে এই উপন্যাসে প্রধান চরিত্র বা কেন্দ্রীয় চরিত্র বলে কোনো চরিত্র নেই, তিতাসকে কেন্দ্র করেই তিতাসের বুকের প্রতিটি চরিত্র আবর্তিত, নদীর সঙ্গে নদীপ্রেমিক বা জনপদের যে সম্পর্ক ফুটে উঠেছে তা অদ্বৈতের মতো সাহিত্যিকের পক্ষেই সম্ভব। এই উপন্যাস প্রসঙ্গে অশোক মিত্র লিখেছেন, ১৯৫১ সালের ১৬ এপ্রিল চলে গেলেন অদ্বৈত (মাত্র সাঁইত্রিশ বছরের জীবন তার) মানিকের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’তেই তখনো নিমজ্জিত ছিলুম বলে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ শুনে মনে হয়েছিল মল্লবর্মণ হয়তো মানিকবাবুর অনুসরণে লিখেছেন, আর সে কারণে ওই উপন্যাসটির প্রতি অতটা উৎসাহিত হয়নি, মৃত্যুর বেশ অনেক দিন পরেই গ্রন্থটি পড়ে আমার মনে হলো মল্লবর্মণের বাইরের জগৎ-পরিধি-ব্যাপ্তি, সমাজচিত্রণের গভীরতা যেন মানিকবাবুর থেকেও অনেকখানিক বেশি এবং সাবলীল। যে সমাজ ও প্রকৃতি সম্বন্ধে এবং মানুষ নিয়ে অদ্বৈত লিখেছেন, তা অনেকটা গভীরভাবেই জানেন, মালোভাষার ব্যবহার মনে হলো আরো বেশি মাটিঘেঁষা, সেখানে মাটির গন্ধ অনেকখানিক পাওয়া যায়’। সাহিত্যিক অদ্বৈত মল্লবর্মণ মালোদের নিজস্ব একটা সংস্কৃতি বা লোকসাহিত্যের যে ভাণ্ডারের গল্প পাঠককে বলেছেন, ‘পূজা-পর্বণে হাসি-আনন্দে এবং দৈনন্দিন জীবনের আত্মপ্রকাশের ভাষাতে তাদের সংস্কৃতি ছিল বৈশিষ্ট্যপূর্ণ, মালো ভিন্ন অপর কারো পক্ষে সেই সংস্কৃতির ভেতরে প্রবেশ করার বা তার থেকে রস গ্রহণ করার পথ সুগম ছিল না। কারণ মালোদের সাহিত্য উপভোগ আর সবার চাইতেও স্বতন্ত্র’। অদ্বৈতের রচনা সংগ্রাহক ও গবেষক দেবীপ্রসাদ ঘোষ লিখেছেন, ‘অন্য কবি-সাহিত্যিক যখন তাদের লেখার ভালোমন্দ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের দরোজায় কড়া নাড়ছেন, (হয়তো একটু স্বীকৃতির আশায়) তখন অদ্বৈত তা থেকে সম্পূর্ণ দূরে ছিলেন, এমন কি রবীন্দ্র-মৃত্যু পরবর্তী ‘দেশ’র আড্ডায়ও তিনি যোগ দেননি, এই নির্লিপ্ত মানুষ একদিন তার অতি প্রিয় কৈশোরের অনুজপ্রতীম মতিউল ইসলামকে যে লিখেছেন, ‘সাধনা যাহা করিবেন নীরবে-নীরবেই করিবেন’, আপনার প্রতিভাও একদিন নিশ্চিত সুধীজন সমাজে আদৃত হইবে’।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত