| 2 সেপ্টেম্বর 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

শিলালিপি

আনুমানিক পঠনকাল: 11 মিনিট

                 

    আজ ঘুম থেকে উঠেই হঠাৎ সাধুদার কথা মনে পড়ল। বেশ কয়েকদিন ওকে দেখিনি। আমার চোখ এড়িয়ে গেলেও নিজে থেকেই এসে দেখা দিয়ে যায় সাধুদা। ‘হ্যালো এনি নিউজ?’ এই বাঁধা প্রশ্ন থাকে ওর মুখে। কী জানি, কী হল লোকটার। যতই হোক, বয়স তো হয়েছে ঢের। সাধুদার আসল নাম স্বাধীন। স্বাধীনতার সালে জন্মেছিল বলে আরও অনেক বাবামা’র মতই আবেগ থেকে ছেলের নাম রাখা হয়েছিল স্বাধীন। কালেদিনে সেই স্বাধীন যে কীভাবে সাধু হয়েছিল, কেউ জানে না সেটা। আমিও ওর স্বাধীন নামটি জেনেছি অনেক পরে। আর সত্যি বলতে কী, সাধুদার অতীত বা বর্তমান সম্বন্ধে আমি কিছুই জানি না, জানার কথাও না আসলে। আমার বাড়ির কাছাকাছি দোকানে ক্যুরিয়ের করতে গিয়ে প্রথম দেখি সাধুদাকে। তাও নয় নয় করে তিন বছর হল। একজন বয়স্ক মানুষ, খাদির ফুল হাতা পাঞ্জাবি আর ধুতি, শীতকালে একটা খাদিরই প্রিন্স কোট, গলায় মাফলার থাকলেও, বয়স্কদের মত মাংকি ক্যাপ কখনো পরতে দেখিনি। পায়ে কেডসের মত জুতো, চোখে মোটা ডিপ্লোম্যাট ফ্রেমের চশমা আর এর সঙ্গে মাথায় একটা গলফ প্লেয়ারদের মত টুপি পরে থাকে সবসময়, এটাই আমার চোখ টেনেছিল। আসলে ওই টুপি আর সাধুদা একাত্ম হয়ে গেছিল। আমি তো ইয়ার্কি করে টোপিবালে বলেও ডেকেছি ওকে মাঝেমাঝে।

   সেই প্রথম দিনের কথায় আসি। সম্ভবত কোন লেখা বা বই পাঠানোর ছিল সেদিন। মানুষটি যেখানে পাঠাব, সেখানের পিন নম্বর খুঁজতে বসল বই খুলে। তারপর কাঁপা হাতে ঠিকানা লিখল দু তরফের। বই খামে ভরল…এইসব কাণ্ডে এতবেশি সময় নিচ্ছিল যে আমি অধৈর্য হয়ে পড়ছিলাম। আমার রাজকার্য ছেড়ে এসেছি এদিকে। এরপর ওজন টোজন করে আমার হাতে বিল দিল যতক্ষণে, ততক্ষণে আমার অবস্থা শোচনীয়। আমার তাড়া দেখে সাধুদা নিজে থেকেই বলল যে, আমায় আর আসতে হবে না, কিছু পাঠানোর থাকলে ফোন করে দিলেই নিজে এসে নিয়ে যাবে। এই বন্দোবস্তে আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। এরই মধ্যে লক্ষ্য করলাম, সাধুদার কথা, স্বরনিক্ষেপ অত্যন্ত পরিশীলিত। আর স্বর উঁচু পর্দায় যায় না কখনোই। এককথায় যাকে বলে, এলিট গোত্রীয়। একদিকে মলিন পোশাক আর তার ক্যুরিয়ের সংস্থার অবস্থা দেখে বোঝা যাচ্ছে আর্থিক ভাবে খুব বেশি স্বচ্ছলতায় নেই সে। কিন্তু তার ব্যবহারে রয়েছে আভিজাত্য। এরপর যখনই ওকে ডেকেছি, আমার কাছ থেকে পাঠানোর বস্তু নিয়ে গেছে সাধুদা। নিজেই খামে ভরে, ঠিকানা লিখে পাঠিয়ে দিয়েছে যত্ন করে। একবার তো এমনও হয়েছিল, কোন সম্পাদকের জরুরী ভিত্তিক চাহিদায় কিছু লেখা পাঠাতে হত পরের দিনই। এদিকে আমি প্রিন্ট করাচ্ছি পাতার পর পাতা আর সাধুদা ওদের পার্সেল নিয়ে যাওয়ার লোকটিকে ধরে বসিয়ে রেখেছে। সে চলে গেলে সেদিন আর আমার লেখা পাঠানই হত না। সেই পার্সেল বাবু যাওয়ার সময় আমাকে বলে গেছিল, ‘ম্যাডাম সাধুদার কথায় আপনার জন্য আমাদের এক্সপ্রেস ওয়েট করল, সাধুদা চা-শিঙাড়া খাওয়াল ততক্ষণে, নইলে আমি কখন চলে যাই! আর ওপর মহলে এরকম ঘটনা ঘটেছে জানলে আমার চাকরি চলে যাবে’। যাই হোক, বাড়ি ফেরার পথে সাধুদা হাত তুলে যেত। কখনো বা সময় থাকলে এসে গল্পগাছাও করত। আগেই বলেছি, তার মুখের প্রথম কথাটিই ছিল, ‘হ্যালো, এনি নিউজ?’ গল্প করার বিষয় বলতে একজন বয়স্ক মানুষের অবধারিত ভাবে প্রথমেই আসে তার শারীরিক সমস্যার কথা। সেসব তো ছিলই। আর্থারাইটিসের কারণে বাঁ পা ঘষটে ঘষটে হাঁটত সাধুদা, ধীরে ধীরে যখন চলে যেত আমার কাছ থেকে, খুব খারাপ লাগত। সামান্য কিছু বাড়তি টাকার জন্য এমন একজনকে কষ্ট করে আসতে হচ্ছে আমার কাছে। আর আমি এমন অপদার্থ, এমন তালেবর, বিশ্ব ব্যস্ত একজন যে কিনা বাপের বয়সী মানুষটার কষ্টের কারণ হচ্ছি! সেদিন সাধুদাকে একটু যেন বিষণ্ণ দেখলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘শরীর খারাপ নাকি?’ উত্তর দিতে গিয়ে একটু যেন আনমনা হয়ে গেল প্রথমটায়। কোথাও থেকে নিজেকে ফিরিয়ে নিয়ে এসে বলল, ‘আর কী! বয়স হয়েছে তো। কখন চলে যেতে হবে ডাক এলে। শুধু আফসোস থেকে যাবে একটাই। এত যে জীবন সংগ্রাম, এত মানসিক ঘাত প্রতিঘাত সইতে হল, তার কোন ছাপই এই পৃথিবীতে রেখে যেতে পারলাম না!’ এতদিন সাধুদাকে দেখেছি, কথা বলেছি, তার কথাবার্তায় রুচি আর শিক্ষার প্রমাণ থাকত ঠিকই। কিন্তু আজকের মত এত গভীর উচ্চারণ তার কাছ থেকে আর কোনদিন শুনিনি। আমি চুপ করে দেখছিলাম, সাধুদার পা ঘষটে চলে যাওয়া, সামনে দাঁড়ানো টোটোয় একটু লেংচে ওঠার দৃশ্য, আর তারপরে সাধুদার ছবি চোখের সামনে না থাকলেও তার বলা কথাগুলো আমার সামনে কীভাবে যেন ঘুরপাক খাচ্ছে। ছাপ থেকে যায় কিছুক্ষণ অন্তত, তুমি অতটাও জান না গো সাধুদা!

  সেদিন রাতে ঘুম এল ছাড়া ছাড়া। ছাপা শাড়ি পরা একটা মেয়ে এসে যেন ডাকল আমাকে! এত রাতে একটা অচেনা মেয়ে কেন ডাকবে আমাকে? চোখ খুলে দেখি কেউ নেই যথারীতি। এপাশ ওপাশ করতে করতে আবার আধো তন্দ্রার মধ্যে স্বপ্ন এল। সেই মেয়েটাই আবার। আমাকে একটা ছোট ঘরে ডেকে নিয়ে গেল। দরজা জানলা বন্ধ করে আমারই সামনে ফ্যানে শাড়ির আঁচল জড়িয়ে ঝুলে পড়ল। আর আমি যেন পাথর হয়ে সমস্ত ঘটনা দেখার জন্যই এখানে এসেছি। দেখেই যাচ্ছি একদৃষ্টে। মেয়েটার জিভ বেরিয়ে এসেছে মুখ থেকে, পাদুটো হাওয়ায় অল্প অল্প দুলছে, শরীর কাঠ। আধো অন্ধকার ওই ঘরে কোন আসবাব নেই। শুধু একটা ঘড়াঞ্চি ঘরের মাঝখানে দাঁড় করানো রয়েছে। যেটা বেয়ে ও ওপরে উঠেছিল, আর ঝুলে পড়ার আগে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছিল। দেওয়ালে কীসব সাঙ্কেতিক চিহ্ন আঁকা রয়েছে। হয়ত ঘরটি রঙ করার কথা ছিল। আমি ওর পায়ের তলা দেখতে পাচ্ছি। ফর্সা পায়ের নীচটা খানিকটা লালচে আর দু পায়ের গোড়ালিতেই কালশিটে দাগ, ঠিক দাগ নয়, দেওয়ালের মতই সাঙ্কেতিক কোন চিহ্ন। শূন্যে দুলছে এমন এক কাঠ হয়ে আসা শরীরের পায়ের তলায় আরেক পাথর শরীরের এক জোড়া পা মাটিতে অনড় হয়ে রয়েছে- এমন এক দৃশ্য দেখে ধড়মড় করে ঘুম ভেঙে বিছানা ছাড়লাম। মেয়েটি কি ‘মোমো’ খেলত? তাই ওই পরিণতি হল? তাই বা কী করে সম্ভব? যে পরিবেশ বা পোশাক ওর, ‘মোমো’ গেমসের কল্পনাও তার দ্বারা হবে না নিশ্চিত। সারাদিন কাজে প্রায় ভুলতে বসেছিলাম সেই দুঃস্বপ্নকে। সন্ধে আটটা নাগাদ সাধুদা এল। আজ বেশ মুডে আছে দেখলাম। সাধুদার ওখানে গেলে আরকজন বয়স্কা মহিলাকেও মাঝেমাঝে দেখতে পাই। সে ওর দিদি। আর অবাক কাণ্ড, দুজনেই বিয়ে করেনি। বুড়োবুড়ি ভাইবোনের সংসারে কে যে কাকে দেখে! সাধুদা বলতে শুরু করল, ‘বুঝলে তুমি আমায় যে লেখাগুলো পাঠাতে দাও, আমি ওগুলো চোখ বুলিয়ে দেখি। কবিতা লেখ দেখলাম। তোমার কবিতা আমি ঠিক ধরতে পারি না। কিন্তু গদ্যগুলো বেশ সাবলীল। সব অবশ্য পড়া হয় না’। আমি তো বিস্ময়ে অভিভূত। আমার প্রথম পাঠক তাহলে এই সাধুদাই! একদিন মনে আছে, কী যত্নে একটা উপন্যাসের প্রিন্টের অতগুলো পাতা গুছিয়ে, ভাগে ভাগে স্টেপল করে দিচ্ছিল সাধুদা। তখনও জানতাম না আমার প্রথম পাঠকের হাত দিয়েই লেখাগুলো ছাপতে যায়! সেই সূত্রে আমি ওকে বললাম, ‘ওই উপন্যাস যদি প্রকাশিত হয়, তবে তোমায় আমি পড়াব ঠিক’। সাধুদা এবার নিজের কথায় ফিরল। ‘বুঝলে এই রোগ আমারও ছিল কৈশোর, যৌবনে। আমি অবশ্য কবিতাই লিখতুম। সেই সব লেখা পড়ে অনেকেই বলেছে, এগুলো নাকি রবীন্দ্রনাথের কবিতার মত হয়ে যাচ্ছে। আমি ওঁকে বাদ দিয়ে কী লিখব বল তো? ওঁর প্রভাব আমি ঝেড়ে ফেলতে চাইনি আদৌ।‘ আমি এবার একটু খোঁচালাম। ‘কবিতা লিখতে যখন, তখন নিশ্চই প্রেম ট্রেম করেছ এককালে। পুরুষ মানুষ নাকি প্রেমে না পড়লে কবিতা লিখতেই পারে না শুনেছি। আর বিয়েই বা করনি কেন তোমরা? এই বয়সে একজন কেউ পাশে থাকলে অতটাও ফাঁকা লাগত না।’ একটু যেন লজ্জা পেল বলে মনে হল। চশমার আড়ালে চোখদুটো কেঁপে উঠল। মুখ নামিয়ে হাসি হাসি মুখে বলল, ‘তা প্রেম ছিল বটে। সেযুগে তো আর একালের মত প্রেম করার এত অঢেল সুযোগ পাওয়া যেত না। মনে মনেই জাল বিছিয়ে চলত প্রেম। এক আধবার দেখা পেলেই বর্তে যেতুম তার’। ‘তাহলে বিয়ে করলে না কেন তাকে? তোমার বাড়িতে আপত্তি করেছিল নাকি মেয়ের বাড়িতে?’ এই প্রশ্নে সাধুদা যেন আবার উদাস হয়ে গেল। আমি বুঝলাম খুব স্পর্শকাতর জায়গায় হাত দিয়ে ফেলেছি। উঠে দাঁড়াল। যাওয়ার আগে বলে গেল, ‘সে কাহিনি আরেক দিন। প্রকাশে আমার আপত্তি নেই তেমন, বিকাশ হবার ছিল না যা, নিয়তি নির্ধারিত ছিল যা, তাই মেনে চলেছি’।

   এইরকম হেঁয়ালির মধ্যে রেখে চলে যাওয়া সাধুদার ধরণ। ভাবিয়ে দেয়। হয়ত দুই পরিবারের সামাজিক, অর্থনৈতিক বা বংশমর্যাদা অথবা জাতপাতের প্রভেদ ছিল। সে সময়ে এই সব কারণে কত প্রেম যে শেষ হয়ে গেছে অকালে! থাক, ওর নিজস্ব ব্যথার জায়গাটাকে আর খোঁচাব না, ঠিক করলাম। নিজে থেকে যদি কোনদিন বলে শুনব। এরপর নিজস্ব বৃত্তে, কাজের চাপে কেটে গেল কয়েকটা দিন। সাধুদার কথা মনে ছিল না। ক্যুরিয়েরও করতে হয়নি এই সময়টায়। তাছাড়া আজকাল তো মেল-এই কাজ হয় সব। ফলে প্রায় দিন পনের-কুড়ি সাধুদার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। কী হল কে জানে। শরীর খারাপ হওয়াও আশ্চর্য কিছু না এই বয়সে। ফোন করলাম। নট রিচেবল বলল আবার। একদিন ওর দোকানে গিয়ে দেখা করে আসতে হবে দেখছি! যথারীতি আমার যাওয়ার সময় করে উঠতে আরও কয়েকদিন কেটে গেল। আর গিয়ে শুনলাম, সাধুদা হারিয়ে গেছে! অ্যালজাইমার হয়েছিল নাকি? কই তার কোন লক্ষণ তো ওর কথায় টের পাইনি। একদিনে তো এই রোগ হয় না! তাহলে? ওর দিদিও বলল, ‘কী জানি, সেটাই তো বুঝতে পারছি না। সব জায়গায় খোঁজাখুঁজি করেছি, এমনকি হাসপাতাল, থানা, মর্গেও। কোন ট্রেস নেই তার। অথচ পায়ের জন্য আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই বলে বাড়ি আর দোকান ছাড়া কোথাও যেত না ও’। আমি রীতিমত শকড্‌। এর থেকে যদি শুনতাম সাধুদা মারা গেছে, সেও মেনে নেওয়া সহজ হত। কিন্তু একটা আস্ত জলজ্যান্ত মানুষ যদি নিজে ইচ্ছে করে হারিয়ে যায়, তাহলে তাকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। আর যেটুকু শুনলাম পকেটে টাকা পয়সাও বিশেষ ছিল না। ধর্মভীরুও সে ছিল না কোনদিন যে, মঠে মন্দিরে পড়ে থাকবে সব ছেড়ে। নিয়ম মত দোকান, বাড়ি, দুটো ঝোলভাত খাওয়া, টাইমে টাইমে কয়েকটা ট্যাবলেট- এছাড়া রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে নিয়ম করে রবীন্দ্র রচনাবলীর এক খণ্ড টেনে বিছানায় পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়া- এর বাইরে সাধুদাকে কেউ কখনো যেতে দেখেনি। আর ওকে গুমখুন করেও কারুর লাভ নেই। সম্পত্তি টম্পত্তি অর্থাৎ থাকার মধ্যে এক পুরনো দোতলা বাড়ি, যার একতলায় ভাড়াটে আছে বহুবছর ধরে, সেই আয়ও তাদের সুরাহা। তবে সবই দিদির নামে, ওর নিজের কিছুই নেই। তাহলে? 

  এরপর স্বাভাবিক নিয়মে সাধুদাকে সবাই ভুলতে শুরু করল। ওর দিদি সাধুদার থেকে একটু বেশি গম্ভীর ছিল, এখন যেন আরও বিষণ্ণ দেখায়। সাধুদা নেই, ফলে আমাকে ওদের দোকানে যেতে হয় প্রয়োজনে। একদিন দেখলাম ওর দিদি এক ছোকরাকে রেখেছে সাধুদার কাজগুলো করার জন্য। দিদি আমাকে ডেকে বলল, ‘এবার থেকে তুমি এই ছেলেটিকে ডেকে নিতে পার কিছু পাঠানোর হলে’। আমি হ্যাঁ, না কিছু না বলেই চলে এসেছি। সাধুদাকে মুছে দিল তাহলে ওরা! আর ওই ছোকরা কি আমার প্রথম পাঠক হওয়ার যোগ্য? আমি ওর হাতে কিছুতেই আমার লেখা তুলে দেব না। ভরসাও যেমন নেই, ইচ্ছেও নেই। নিজেই খামে ভরে দিয়ে যাব বরং দোকানে। সেদিন বাড়ি এসে ভাবছিলাম সাধুদার সেই না বলে যাওয়া কাহিনীর সম্ভাব্য রূপ কেমন হতে পারে! কী ছিল সেই কারণ, যার জন্য ওরা কেউ বিয়ে করেনি? ওর দিদিকে জিজ্ঞেস করলে হয়ত জানা যাবে, কিন্তু মন সায় দেয় না। তার চেয়ে থাক না হয়। পৃথিবীতে কত কিছুই তো অজানা রয়ে গেল! অনেকদিন পরে রাতে আবার সেই ছাপা শাড়ি পরা মেয়েটি এল। কিন্তু সেদিন তো সে মরে গেছিল! তাহলে? কী বলতে চায় আবার আমাকে? সেই একই শাড়ি পরে আছে আজও। আমাকে ডেকে নিয়ে গেল একটা শোওয়ার ঘরে। খাটের ওপর একটা বাচ্চা ঘুমোচ্ছে। বছর দুয়েক বয়স হবে। ওর পাশে একজন বৃদ্ধা পাশ ফিরে বাচ্চাটার দিকে মুখ করে শুয়ে আছেন। মা হলে তো এই বয়সী হত না। এরপর দেখি মেয়েটা বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিল। পরম মমতায় আদর করছে ওকে। ঘুমন্ত শিশুকে দুধ খাওয়াতে চাইছে যেন! বাচ্চাটা ওর বুকের চাপে কেঁদে উঠল একবার… কান্না শুনে দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকল আরও একজন বয়স্ক মানুষ, বাচ্চাটাকে কোলে তুলে পিঠ চাপড়াতে লাগল আর ঘুমন্ত মহিলার উদ্দেশ্যে বলল, ‘দিদি মন্তু কাঁদছে আর তুই ঘুমোচ্ছিস!’ ঘুমের মধ্যেই আমার শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল এই দৃশ্য দেখে। এই দুজনকে আমি চিনি। সাধুদা আর ওর দিদি!

  পরদিন আমি আর থাকতে পারিনি। যদিও ওদের বিয়ে না করার কারণ যেন আমার চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে দেখা দিয়েছিল, তবুও এই কল্প কাহিনিতে বিশ্বাস করতে পারিনি। সাধুদার দিদিকে গিয়ে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম। ওর দিদি সংক্ষেপে যা জানাল, সেটা এরকম- ওদের আরও এক বোন ছিল, যে অল্প বয়সে এক দুশ্চরিত্র ছেলের সঙ্গে পালিয়ে যায়। আর তারপর ছেলে কোলে নিয়ে আবার ফিরে আসে দাদা দিদির কাছে। ততদিনে ওদের বাবা মা আর বেঁচে নেই কেউ। শুধু তাই নয়, সেই বোন একদিন রাতে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে। আর সেই সময়ে একটা ফুলছাপ ছাপা শাড়িই সে পড়েছিল, আমার স্বপ্নে দেখা ঘটনার মত। আত্মহত্যার আগে তার মাথায় কিঞ্চিৎ গন্ডগোল দেখা দিয়েছিল। সারাদিন বিড়বিড় করত আর দেওয়ালে আঁকিবুঁকি কাটত। বাড়ি থেকে বেরিয়েও যেত হুটহাট। ওকে তাই একটা ছোট ঘরে বন্ধ করে রেখে দিত ওর দাদা-দিদি। দেওয়ালে এতই হিজিবিজি কেটে রেখেছিল যে, ঘরে রঙ করাবে বলে মিস্ত্রী ডেকেছিল ওরা। ঘড়াঞ্চি রেখে যাওয়াই কাল হল শেষপর্যন্ত। এর ফলে তার বাচ্চাকে মানুষ করতে গিয়ে দুই ভাই বোন তাদের প্রেম, সংসার, শখ, আহ্লাদ সব ত্যাগ করেছিল। এখন সেই ভাগ্নে চাকরি নিয়ে বাইরে থাকে। মামা মাসিকে প্রায় ভুলেই গেছে। এখানে আসে না তেমন। ফোন করলেও বিরক্ত হয়। মাসে মাসে টাকা পাঠাত কিছুদিন, এখন আর সেও পাঠায় না। সাধুদাকে এখন খুব জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে, ওর নিজের স্টাইলে- ‘এনি আদার নিউজ সাধুদা? আমি তোমার সব গল্প জেনে ফেলেছি। এবার যেখানে ইচ্ছে থাক! তুমি সত্যিই স্বাধীন হলে এবার। আর নিজের ছাপ কোথাও রাখতে পারলে না ঠিকই কিন্তু সেই দেওয়াল গুলো আজও লাইভ ‘মোমো’ খেলার চিহ্ন ধরে রেখেছে।’                       

     গতানুতিক ছন্দে দিন কাটছিল। সাধুদার কথাও ভুলতে বসেছি প্রায়। দেড় বছর কেটে গেছে ওর হারিয়ে যাওয়ার পরে। আমরা সবাই মোটামুটি সাধুদাকে মৃতই ভেবে নিয়েছি। নেতাজীর অন্তর্ধানের পরে আজও হয়ত কেউ কেউ আশা করে যে, উনি ফিরবেন। জীবিত থাকার বয়সসীমা পেরিয়ে গেলেও একজন অতি মানবের ফেরার কাহিনি ঘিরে থাকে অনেক জল্পনা, অনেক আশাপূরণের সঙ্কেত। সাধুদা সামান্য কেউ, তার ফেরার প্রবণতা আছে কিনা, সে নিয়ে কেউ ভাবেনি। ঠিক যেভাবে দেখেছিলাম আরেক কাহিনি। আমাদের পাড়ায় এক বৃদ্ধ অ্যালজাইমারে ভুগতেন। একদিন সকাল বেলায় নিখোঁজ হলেন। তাঁর ছেলেরা অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু কোন সন্ধান পায়নি বাপের। সাত বছর বাদে শাস্ত্র মতে তাদের মায়ের শাঁখা সিঁদুর মুছে দেওয়া হয়েছিল। তখন কারুর কোন শোক ছিল না যদিও সেই চিহ্ন বিসর্জনের জন্য। সাত বছর ধরে একটু লাল রঙ মাথায় নিয়ে, সাদা-লাল চুড়ি হাতে নিয়ে একজন বৃদ্ধা যেন সধবার সাজে অভিনয় করে গেছেন। বিসর্জনের পরে নিজের রূপে ফিরলেন মনে হয়েছিল। সাধুদার জন্য সাত বছর কেউ চিহ্ন বয়ে বেড়াবার নেই। কবেই তার ছাপ মুছে গেছে। সে ফিরলেও কারুর আহ্লাদ হবে না জেনেও, একদিন সাধুদা ফিরল। আরেকটু বুড়ো হয়েছে। জামাকাপড়ে কোন বদল হয়নি। আরও একটু ধীরে ধীরে হাঁটছে, গলার স্বর যেন একটু বসেছে, এটুকুই যা পরিবর্তন। বাড়ি ফিরেও কোথায় গেছিল, কেনই বা গেছিল, কী করে চলল এতগুলো দিন, সেই সমস্ত প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেনি। বলেছে, সব ভুলে গেছে নাকি! আমার বিশ্বাস হয়নি যদিও। ভুলেই যদি যেত, তাহলে আবার বাড়ির ঠিকানা মনে করে ফিরল কী করে?      

 সাধুদা দোকানে বেশিক্ষণ থাকে না এখন। সেই ছেলেটাই কাজকর্ম করে, যেমন করত। কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে আজকাল। আগের মত হেসে, হাত তুলে আর জিজ্ঞেসও করে না- এনি নিউজ? মানুষটা ফিরে এলেও যেন নিজেকে কোথাও রেখে এসেছে। শুধু সাধুদার মত এক অবয়ব ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছে। আমি ভেবেছিলাম, আর আগের মত আমাদের গল্পগাছা হবে না কোনদিন। কিন্তু একদিন হঠাৎ করেই এসে হাজির হল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেমন আছ?’ আগের মত শরীরের ব্যথাবেদনা নিয়ে সাতকাহন শোনাল না। চুপ করে বসে রইল। আমি কিছুক্ষণ বাদে আবার খোঁচালাম, ‘কোথায় ছিলে বল তো এদ্দিন? আমার কাছে লুকিও না। খুলে বল সব।’ সাধুদা হঠাৎ কাশতে শুরু করল। কাশি আর থামে না…শেষপর্যন্ত জলটল খাইয়ে বললাম, ‘এবার বাড়ি যাও। ডাক্তার দেখাও। তোমায় কিছু বলতে হবে না আর!’ সাধুদা বিড়বিড় করে কী বলতে লাগল, আর ওভাবেই চলে গেল বকবক করতে করতে। মনটা খুব খারাপ হল দেখে। কী আর করা! আমার হাতে তো কিছু নেই যে, সাধুদাকে আবার আগের মত করে দেব। এরপর আবার দীর্ঘ দিন ওকে দেখতে পাইনি। মাস তিনেক বাদে ওদের দোকানে গিয়েও সাধুদাকে দেখতে পেলাম না। ওর দিদি বলল, ‘ভাইয়ের মাথার ঠিক নেই, বাড়িতেই রেখে আসি, বাইরে তালা বন্ধ করে। একদিন এস না! দেখা করে যেও ওর সঙ্গে। কবে আছে কবে নেই… কেউই তো আর ওর খোঁজ করে না, তুমি ছাড়া’ দিদিরও গলা বুজে এল কথা বলতে গিয়ে। সেদিনই ঠিক করেছিলাম সত্যিই একদিন যাব ওর সঙ্গে দেখা করতে। হয়ত সেটাই হবে আমাদের শেষ দেখা!

 পরের সপ্তাহে দিনের বেলায় গেলাম সাধুদার বাড়ি। সন্দেশ নিয়েছিলাম ওর জন্য, যদি খায়… দিদি দরজা খুলল। বাহুল্যবিহীন ঘর। পুরনো বাড়ির অন্দরসজ্জায় মলিন ছাপ। ড্যাম্প ধরা দেওয়ালের কোথাও কোথাও প্লাস্টার চটে গেছে। একতলার ঘরে দিনের বেলাতেও আলো জ্বালাতে হচ্ছে। আমি চারপাশে চোখ বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলাম ‘সাধুদা কই?’ মিষ্টির প্যাকেট দিদি নিল না হাতে, বলল, ‘এস, আমি নিয়ে যাচ্ছি ওর কাছে, ওকেই দিও প্যাকেটটা। খুশি হবে।‘ দিদির সঙ্গে বাড়ির ভেতরে গেলাম। একটা খোলা উঠোন পেরিয়ে বাড়ির পেছন দিকে চলে এসেছি। সেখানে একটেরে একটা ঘর রয়েছে। দিদি ওদিকেই নিয়ে গেল। দরজা খুলতেই ভ্যাপসা গন্ধ নাকে লাগল। দিদি বলল, ‘এই সেই অভিশপ্ত ঘর। বন্ধই পড়ে থাকত এতকাল। কিন্তু সাধু এখন এই ঘরেই থাকবে বলে জেদ ধরেছে। তাই বাধ্য হয়ে এখানেই রেখেছি ওকে। ঘরের দরজা জানলা খুলতে দেয় না, আলো জ্বালতে দেয় না। এমনকি নিজেও বাথরুম করতেও ঘর থেকে বেরতে চায় না। আমি সকালে রোজ জোর করে স্নান, পায়খানা করিয়ে আনি। কখনো কখনো তো ঘরেই পেচ্ছাপ করে ফেলে। কে পরিষ্কার করে বল এত? আমারও তো বয়স হল, আর পারি না আমি। সাধু, এই সাধু- দেখ কে এসেছে তোর সঙ্গে দেখা করতে…’ আধো অন্ধকারে চোখ সয়ে এলে এই প্রথম সাধুদাকে টুপি ছাড়া দেখলাম। একটা লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরে আছে। গালে অনেকদিনের না কামানো দাড়ি। ছোট্ট ঘরটার একপাশে একটা সরু তক্তপোষ পাতা, ওখানেই সাধুদা শোয় বোঝা গেল। আর সারা ঘরে কিচ্ছুটি নেই। এই ঘরের সঙ্গে আমার স্বপ্নে দেখা ঘরটির কিছু মিল আছে। আর ঘরের দেওয়াল প্রায় কালচে হয়ে গেছে, ফলে পুরনো দিনের কোন সাঙ্কেতিক চিহ্ন আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। তবে নতুন রকমের কিছু চিহ্ন আঁকা হয়েছে, টাটকা দাগ বোঝাই যাচ্ছে। আর চারকোল দিয়ে সেই দাগ সাধুদাই কেটে চলেছে, এমনকি এখনো। আমি যে এসেছি হুঁশ নেই কোন। দিদি ওর গায়ে হাত দিয়ে ডাকল, তবে পেছন ফিরে তাকাল ফ্যালফ্যাল করে।       

 সাধুদা আমাকে চিনতে পেরেছে ওর চোখ দেখে বোঝা গেল। আমি সন্দেশ হাতে দিলাম। বেশ খুশিই হল মনে হল। আমাকে বসতে বলল, দিদিকে বলল, ‘একটু চা করে আন তো!’ দিদি বেরিয়ে গেলে আমাকে বলল, ‘দেখছ এই দেওয়ালের ড্রইং গুলো? আমি করেছি’। আমি বললাম, বাঃ! খুব ভাল। কিন্তু কী বোঝাতে চেয়েছে আমি বুঝতে পারছি না যে!’ সাধুদা খুব উত্তেজিত হয়ে উঠল, চঞ্চল পায়ে দেওয়ালের দিকে গেল এবার। জানলা খুলে দিল নিজেই। আর বলতে শুরু করল, ‘এই যে দেখছ এটা, এর মানে এক রকম, আর ওটার মানেও আলাদা। এগুলো অনেকটা শিলালিপির মত, একধরণের সাইন ল্যাংগুয়েজ। আমি এই ভাষা শিখতেই নিরুদ্দেশ হয়েছিলাম এত বছর। এ যে সে কাজ নয়, বুঝলে? সাধনার ব্যাপার। চুপি চুপি বলি তোমায় দিদি আসার আগেই। ইথিওপিয়ান কান্ট্রিতে ছিলাম এতকাল। সে এক গভীর জঙ্গল- গুরুর আদেশে এক গুহার ভেতরে কাটাতে হয়েছে বছরের পর বছর। নাওয়া খাওয়া ভুলেছি, আলো সহ্য করতে পারি না তাই। ওই গুহার দেওয়াল চিত্রর মানে উদ্ধার করেছি ধীরে ধীরে। খুব কষ্টের কাজ। এখনকার গিজ্‌ আর অ্যামহেরিক যেভাবে লেখা হয়, বাঁ দিক থেকে ডানদিকে, পুরাকালে সেগুলো লেখা হত ডান থেকে বামে। ফলে তুমি যেন এক আয়না দেখছ, এইভাবে পড়তে হবে এই স্ক্রিপ্টকে। এছাড়াও অনেক কিছুর হেরফেরও রয়েছে, যেমন ধর ‘I’ এর হাত ছোট হয়েছে কখনো, কখনো বড়, ‘L’ এর ক্ষেত্রেও তাই। আবার কিছু বর্ণ গোলাকার ছিল বেশি, এর বাইরেও আরও হাজার রকম ছোটখাটো হেরফের তো রয়েইছে। ফলে এই লিপির পাঠ উদ্ধার করা নেহাত সহজ কর্ম ছিল না। সে যাই হোক, এবার আমার আসল কাজ শুরু। এই দেওয়ালে এই সব চিহ্ন লিখে রেখে যেতে হবে, বুঝলে? ছাপ রেখে যেতে হবেই আমায়। নইলে এত সংগ্রাম, এত আয়োজন সব ব্যর্থ হয়ে যাবে যে!’  এরপর আবার দুম করে জানলা বন্ধ করে দিল সাধুদা। বিড়বিড় করতে করতে দেওয়ালে আঁক কাটতে থাকল এক মন দিয়ে। আমার উপস্থিতি ভুলেই গেল বেমালুম। সন্দেশ পড়ে রইল চৌকির ওপর। দরজায় তখন এক কাপ চা হাতে দিদি এসে দাঁড়িয়েছে। ওর দুগাল বেয়ে জল গড়িয়ে নামছে নিঃশব্দে।  

 

 

 

 

 

 

 

4 thoughts on “শিলালিপি

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত