আজ ২৯ নভেম্বর কবি ইন্দ্রনীল সেনগুপ্তের শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।
তারাজন্মের দিকে
হাত ছুঁয়ে ডুবে যাই ডুব জলে.
ভাসানের খেলা শেষ হলে
মৃত্যু আসে পুনর্জন্মের মতো
তারাজন্ম হয়;
রত্নাকর আকাঙ্ক্ষা ঢেকে ফেলে বল্মীক
শালবীথির পরতে পরতে।
দীর্ঘপথ জলজ অন্ধকারে পাড়ি
সে সব অতিকথন;
দীর্ঘ মৃত্যুর মত বেঁচে থাকা,
বারবার চোরাবালি পেরিয়ে যাওয়া,
ডুবসাঁতারে এমন বেঁচে থাকা যেন মানুষ ছিলাম না কখনো;
অতিকায় কূর্মের মত শরীর ডুবিয়ে
পূর্বজন্মের স্মৃতির মতো স্রোতের কলকল,
মানুষের কোলাহল, হ্রেষারব, উলুধ্বনি
শুনে বেঁচে থাকা
তোমার হাত ছুঁয়ে ফের ডুবে যাই
তারাজন্মের দিকে।
নাগাল এড়িয়ে তবু
এমন চলে যায়, যার থাকার কথা ছিল;
থেকে যায় ব্যাকরণ, শ্রুতি, তীব্র বিলাপ;
পুরনো ছন্দের মতো কবিতা টবিতা হয়
লালাবাই গান গায় এক বিষণ্ন পাখি।
আমাদের শোকতাপ নিয়ে এভাবে যাপন;
প্রদীপের স্বল্পালোকে লেখা হয় গাথা টাথা
সমাপ্ত হয় জমানো শস্যেরা, ভাঙে গোলাঘর;
বারবার নির্মাণের সংজ্ঞা ছিঁড়ে ফেলে পাখি।
নীল মৃত্যুর নাগাল এড়িয়ে তবুও থেকে যায়
কিছু আলগা খুনসুটি চিরন্তন,
থেকে যায় ইথারে সে অহংকারী গ্রীবার চলন।
কোন শীর্ষে নিয়ে যায় শানিত তরবারি
হিংস্র অঙ্গার দেখো পোড়ায় গ্রহতারা,
কোথায় উৎপত্তি আর কোনখানে থামে গতি,
কোথায় উড়ে যায় নরঘাতী ছাই?
যতটা উচ্চারিত, তারও চেয়ে গভীর গোপনে,
শব্দহীন মৃত্যু শুধু বক্রহাসি হাসে,
পাশার চাল দেয় আর
জীবনের ঘুঁটি কেবল আবর্তিত হয়,
অদৃশ্য অতল গহ্বরগামী।
ধিকিধিকি আগুন যত আক্রান্ত পালকে,
ততোধিক বিদ্বেষবিষ জমে আছে বুকে,
একপাশে দীপ জ্বলে, অন্যত্র আন্ধার;
কোন পথে যায়, মানুষ নিজস্ব বিচার।
জলের ওপরে
জলের ওপরে কেউ টোকা মেরে যায়,
তাই জল কেঁপে ওঠে বিষণ্ন শরতে
ঈষৎ স্মৃতির মত মনে পড়ে মুখ,
প্রিয়তম প্রেম;
বাকি সব ভুলে যাওয়া
ফেলে আসা যাবতীয় প্রাচীন সড়ক।
শরৎ আসলে এক পরিমার্জনাকাল
ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ মাঝে মাঝে মেঘ
ঋতু পরিবর্তনের এক তপ্ত সকাল।
এইসব মেঘগুলো ঘরবাড়ি হয়ে যায় আকাশের গায়ে,
প্রশস্ত বাগিচাও দেখা যায়
সাদা গাছপালা বেঁকেচুরে উঠে গেছে।
আমাদের বাড়ির সামনে হরি সংকীর্তন
আকুল স্বরে ডেকে চলে কেউ
হরে কৃষ্ণ হরে;
খঞ্জনির আওয়াজ ছাপিয়ে মাঝে মাঝে প্যান্ডেলের ঢাক,
জলের ওপরে কেউ পর পর টোকা মেরে যায়।
কবি
আনতশির সমর্পণে যাব কার কাছে?
গাছের কোটরে বীভৎস রক্তাক্তশিলা
ঐ কি দেবতা?
অসহায় গ্রাসে কী প্রবল উত্তাপে গলে যেতে থাকি
নিজের ভেতরে নিজে সহস্রধারা ঝরে পড়ি;
ঝর্ণাধারায় সিক্ত সে সন্ন্যাসী দেখ তুমি
এই প্রবঞ্চনা আমি তো বুঝি;
কবি নয় সমর্পিত যাবতীয় পাথরের কাছে
কী যে প্রবল যন্ত্রণা ভুগি আমি।
কবির তো দুরূহ জীবন,
অহরহ শ্মশানগামিতা
তার কোন দেবতা থাকে না;
থাকে না অন্ধকার,
আশরীর প্রজ্বলিত কবি
চলে যেন জ্বলন্ত মশাল।
তার কিছু থাকে না নেবার, ফেলে দেবার
না হারানো, না প্রাপ্তি, না কোন নিরুদ্দেশ।
আশিরনখ সমর্পণে যাবে কেন কবি?
কোন দেবতার পায়ে ছোঁয়াবে মাথা?
কবির নিজের থেকেও বড় কোন দেবতা আছে নাকি?
সমর্পণে যায় না কোন কবি,
যে গেছে বিচ্যুত সে
ডেকো না, আর ডেকো না।
একলা ঘরে
বাইরে হাওয়ায় উড়ে যায় শুকনো পাতা,
কাগজ, প্লাস্টিকের ঠোঙ্গা, পানীয়ের ক্যান;
রাত্তির নেমেছে – কোথাও আলো নেই তেমন,
শেষ আলো মালগাড়ির গার্ডের হাতে,
চলে গেছে হিউস্টনের দিকে;
আলো জ্বলে দূরের টাওয়ারে লাল চোখ,
ঘুরে যায় কেবল ঘুরে যায়
কোন এক সন্ধানী আলো – সম্ভবত বিমান বন্দরে।
আলো জ্বলে মোমবাতির মতো কম্পমান,
দোতলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে নামে নীচে,
হয়তো কোন একাকী বৃদ্ধ নেমে আসেন,
ডিনার সারবেন বলে!
এটা কল্পনা, পাড়াটা নিঝুম, সারিসারি বাড়ি;
কারপার্কগুলোতে অজস্র গাড়ি।
ভাবছো একাই দুঃখী তুমি,
দীর্ঘশ্বাস ছাড়লে ফাঁকা ঘরে,
চাঁদের আলো এসে পড়েছে জানালা দিয়ে,
খাটের স্প্রিংগুলো নড়ে উঠলো
মেতে উঠলো তোমার দুঃখের সঙ্গতে;
যেন এক সঙ্গীত;
অথচ ভেবেছিলে তুমি একা।
নিজের মুখোমুখি
কত কথা বলে যায় প্রবল বাতাস-
মনে হয় রোদ্দুর দেখেনি কখনো সে
যে আবদ্ধ ছিল এক পাতার কুটিরে;
প্রতিদিন বয়ে যেত এলোমেলো হাওয়া
বৃষ্টিও ঝরে যেত পাতার ওপর
এমনই ছিদ্রহীন ছিল বনাঞ্চল।
দেখিনি যদিও কোন অদ্ভুত চলন;
তবু তার হুঙ্কার ছুঁয়ে যেত মন,
তবু তার হাহাকার আমার জীবন,
তবু তার উল্লাস আমার মরণ।
এইবার মুখোমুখি হয়েছি তাহার,
কেটে গেছে জীবনের অনেক সময়,
এইবার আমি আর উন্মুক্ত সে
একসঙ্গে হেঁটে যাই জীবনের পথ।