| 7 অক্টোবর 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প

অনুবাদ গল্প: বেদনার ভাষ্যকার । ঝুম্পা লাহিড়ী

আনুমানিক পঠনকাল: 24 মিনিট

অনুবাদ : কমলিকা মিত্র / পায়েল সেনগুপ্ত
মি. এবং মিসেস দাস, টিনাকে টয়লেটে নিয়ে কে যাবে তাই নিয়ে চায়ের দোকানে তর্ক জুড়ে দিলেন। শেষে, মি. দাস যখন মনে করিয়ে দিলেন যে, আগের রাতে তিনি মেয়েকে চান করিয়েছেন, তখন মিসেস দাস রাজি হলেন। রিয়ারভিউ আয়নায় তাকিয়ে মি. কাপাসি দেখলেন, মিসেস দাস আস্তে আস্তে পিছনের সিট থেকে তাঁর কামানো, অনেকাংশে অনাবৃত পা দুটো টেনে টেনে বড়সড় সাদা অ্যামবাসাডারটা থেকে বেরুলেন। টয়লেটে যাওয়ার সময় তিনি ছোট মেয়ের হাত ধরলেন না।
তাঁরা কোনারকের সূর্যমন্দির দেখতে যাচ্ছিলেন। শনিবার দিন্টা ছিল শুকনো, উজ্জ্বল। মধ্য জুলাইয়ের গরমের সঙ্গে সামুদ্রিক হাওয়া মিশে দিনটা ঘুরে বেড়ানোর পক্ষে আদর্শ। সাধারণত মি. কাপাসি এত তাড়াতাড়ি রাস্তায় থামেন না। কিন্তু সকালে হোটেল স্যান্ডি ভিলার সামনে থেকে এই পরিবারটিকে তাঁর গাড়িতে তোলার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ছোট মেয়েটি বায়না ধরেছিল। হোটেলের পোর্টিকোর তলায় ছেলেমেয়েসহ দাস দম্পতিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রথমেই যে জিনিসটা মি. কাপাসি লক্ষ্য করেছিলেন, তা হলো তাদের অল্প বয়স।হয়ত বছর তিরিশও হবেনা। টিনা ছাড়াও তাদের আরও দুটি ছেলে, রনি এবং ববি, দেখে মনে হচ্ছিল, তাদের মধ্যে বয়সের পার্থক্য খুম কম। চকচকে রুপোর তারে দুজনেরই দাঁত ঢাকা। পরিবারটিকে দেখে যদিও ভারতীয় মনে হচ্ছিল, কিন্তু তাঁরা বিদেশীদের মতো কাপড় পরেছিলেন। বাচ্চাদের পরনে কড়কড়ে, উজ্জ্বল রঙের জামা এবং স্বচ্ছ ভিসরওয়ালা টুপি। বিদেশী পর্যটকদের সঙ্গে কাজ করতে মি. কাপাসি অভ্যস্ত। তিনি ইংরেজী বলতে পারেন বলে বিদেশী পর্যটকদের দায়িত্ব তাকেই নিতে হত। গতকাল স্কটল্যান্ডের এক বয়স্ক দম্পতিকে তাঁর গাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন। দুজনেরই মুখ দাগ ভর্তি এবং সাদা তুলোর মত চুল এতই পাতলা যে, তার নীচে তাঁদের রোদে পোড়া মাথাটা দেখা যাচ্ছিল। সেই তুলনায় দাস দম্পতির তামাটে, অল্পবয়েসী মুখ আরো আশ্চর্য করেছিল তাঁকে। আলাপ করার সময় মি. কাপাসি নমস্কারের ভঙ্গিতে দুহাত জোড় করেছিলেন, কিন্তু মি. দাস আমেরিকান কায়দায় এমনভাবে হাত মিলিয়েছিলেন যে, মি. কাপাসি নিজের কনুই পর্যন্ত তার জোর অনুভব করেছিলেন। মিসেস দাস তাঁর ঠোঁট একদিকে একটু বেঁকিয়ে হেসেই কাজ সেরেছিলেন, আর কোন আগ্রহ দেখাননি। 
তাঁরা যখন চায়ের দোকানে অপেক্ষা করছিলেন, তখন রনি– যাকে দেখে দুই ছেলের মধ্যে বড় মনে হচ্ছিল– একটা খুঁটির সঙ্গে বাঁধা ছাগল দেখে কৌতুহলে আচমকা পিছনের সিট থেকে নেমে পড়ল। 
”হাত দিয়ো না,” মি. দাস সবাধান করলেন। তিনি তাঁর ভ্রমণ-সংক্রান্ত বই থেকে মুখ তুলে তাকালেন। বইটার প্রচ্ছদে হলুদ অক্ষরে INDIA লেখা। দেখে মনে হচ্ছিল, বইটা বিদেশে প্রকাশিত। তাঁর কন্ঠস্বর কেমন যেন দ্বিধান্বিত এবং একটু তীক্ষ্ণ, যেন তা তখনো পরিনত হয়নি। 
”আমি ওকে একটা চুয়িং গাম দিতে চাই,’ ছেলেটা এগোতে এগোতে চেঁচিয়ে বলল। 
মি. দাস গাড়ি থেকে বেরিয়ে পা ছাড়ানোর উদ্দেশ্যে মুহূর্তের জন্য মাটিতে উবু হয়ে বসলেন। 
তাঁর গোঁফদাড়ি পরিষ্কার ভাবে কামানো। দেখতে অবিকল রনির সংস্করণ। চোখে উজ্জ্বল নীল রঙের ভিসর। পরনে শর্টস, স্নিকার্স এবং টি-শার্ট। তাঁর গলায় ঝোলানো প্রচুর বোতাম এবং দাগওয়ালা ক্যামেরাটায় একটা দারুণ টেলিফোটো লেন্স লাগানো। ওই যন্ত্রটিই তাঁর সঙ্গের একমাত্র জটিল বস্তু। রনিকে ছাগলটার কাছে ছুটে যেতে দেখে তিনি ভুরু কোঁচকালেন।, কিন্তু ছেলেকে থামানোর তাঁর কোনও উদ্দেশ্য আছে বলে মনে হল না। ”ববি, দেখো, তোমার ভাই যেন কোন বোকামি না করে।”
”আমার ইচ্ছে করছে না,” ববি নিজের জায়গা থেকে না নড়ে বলল। সে কাপাসির পাশের সাইট বসে গ্লাভ কম্পার্টমেন্টের গায়ে আটকানো গণেশঠাকুরের একটা ছবি দেখছিল।
”চিন্তা করার কিছু নেই,” মি. কাপাসি বললেন। ”ওরা বেশ শান্তশিষ্ট।” 
কাপাসির বয়স ছেচল্লিশ। চুল পাতলা হতে শুরু করেছে এবং ইতিমধ্যেই সম্পূর্ণভাবে রুপোলি হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তার মাখনের মতো ত্নক এবং নিভাঁজ কপাল (যাতে তিনি সময় পেলে পদ্মফুলের তেলের মলম লাগান) দেখে সহজেই কল্পনা করা যায় যে,তাঁকে অল্প বয়সে কেমন দেখতে ছিল। তিনি ধূসর রঙের ফুলপ্যান্ট এবং জ্যাকেটের মতো শার্ট পরেছিলেন। শার্টটা কোমরের কাছে সরু, হাতা ছোট এবং কলার বড় এবং ছুঁচোলো। শার্টের সিন্থেটিক কাপড়টা পাতলা কিন্তু টেকসই। কাপড় এবং কায়দা, দুটোই কাপাসি নিজের পছন্দমতো বলে দিয়েছিলেন। ট্যুরে যাওয়ার সময় এটাই এটাই তার পছন্দের ইউনিফর্ম। কারণ,স্টিয়ারিং হুইলের পিছনে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকলেও, এই ধরণের কাপড়ে বেশি ভাঁজ পড়ে না। উইন্ডশিল্ডের মধ্যে দিয়ে তিনি দেখলেন, রনি ছাগলটার চারপাশে চক্কর কাটল, তারপর চট করে সেটার গায়ে একবার হাত দিয়েই গাড়িতে ফিরে এল। 
”আপনি কি ছেলেবেলাতেই ভারত ছেড়েছিলেন?” মি. দাস পিছনের সিটে ফিরে এসে বসার পর কাপাসি জিজ্ঞেস করলেন। 
”ওঃ, মিনা এবং আমার দুজনের জন্মই আমেরিকায়,” মি. দাস হঠাৎ আত্মবিশ্বাসের সুরে বললেন। ”ওখানেই জন্ম, ওখানেই মানুষ। আমাদের মা বাবারা এখন এখানে থাকেন। ওঁরা রিটায়ার করেছেন। বছর দুয়েক অন্তর আমরা তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে আসি।” তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে ছোট মেয়েকে গাড়ির দিকে ছুটে আসতে দেখলেন। মেয়েটার সরু বাদামি কাঁধের ওপর তার সানড্রেসের চওড়া বেগুনি ফিতের ফুলগুলো পতপত করছিল। সে তার বুকের কাছে হলুদ চুলওয়ালা একটা পুতুল ধরে ছিল। পুতুলটা দেখে মনে হচ্ছিল যেন, কোনও শাস্তিস্বরূপ একটা ভোঁতা কাঁচি দিয়ে সেটার চুল ছেঁটে ফেলা হয়েছে। ”টিনা এই প্রথম ভারতে বেড়াতে এল, তাই না টিনা?”
”আমাকে আর বাথরুম যেতে হবে না,” টিনা ঘোষনা করল।
”মিনা কোথায়?” মি. দাস জিজ্ঞেস করলেন।
মি. কাপাসির একটু অদ্ভূত লাগল যে, মেয়ের সঙ্গে কথা বলার সময়ও মি. দাস তাঁর স্ত্রীর নাম ধরলেন। টিনা আঙুল দিয়ে দেখাল চায়ের দোকানে কয়েকজন কর্মী, যাদের গায়ে কোনও শার্ট ছিলনা, মিসেস দাস তাদের একজনের কাছ থেকে কিছু কিনছিলেন। তিনি গাড়ির দিকে ফিরে আসার সময় তাদের একজন একটা জনপ্রিয় হিন্দি গানের কলি গেয়ে উঠল। কিন্তু মিসেস দাস গানের কথা বুঝতে পারলেন বলে মনে হল না। কারণ, তিনি লোকটির গান বিরক্ত বা অস্বস্থি, কিছুই প্রকাশ করলেন না। কাপাসি মিসেস দাসকে লক্ষ্য করলেন। তাঁর লাল-সাদা চেক-কাটা স্কার্টটা হাঁটুর ওপর এসে থেমে গিয়েছে। পায়ে সহজেই গলিয়ে পরার মতো চৌকো কাঠের হিলতোলা জুতো। ছেলেদের শার্টের নীচে পরার গেঞ্জির মতো ব্লাউজ, বুকের কাছে স্ট্রবেরী ফলের আকারে ক্যালিকো-আপ্লিকের কাজ করা। মহিলা উচ্চতায় খাঁটো, থাবার মত ছোট-ছোট হাত, আর গোলাপি নখের রং লিপ্সস্টিকের সঙ্গে মিলিয়ে করা। গড়ন একটু গোলগাল। স্বামীর চুলের চেয়ে সামান্য লম্বা করে ছাঁটা চুলের একপাশে সিঁথি কাটা। তিনি গোলাপি আভাওয়ালা বড় গাঢ় বাদামি রঙের সানগ্লাস পরেছিলেন। সঙ্গে বাটির আকারের, প্রায় নিজের দেহের মতো চওড়া একটা ঘাসের ব্যাগ, যার ভিতর থেকে একটা জলের বোতল উঁকি দিচ্ছিল। একটা ঠোঙা থেকে মুড়ি-বাদাম-লংকা মাখা খেতে খেতে ধীরেসুস্থে হাঁটছিলেন। কাপাসি মি. দাসের দিকে ফিরলেন। 
”আপনারা আমেরিকায় কোথায় থাকেন?”
”নিউ ব্রুন্সুউইক, নিউ জার্সি।”
”নিউইয়র্কের পাশে?”
”ঠিক তাই। আমি ওখানে মিডল স্কুলে পড়াই।”
”কী বিষয়?”
”বিজ্ঞান। প্রতি বছর ছাত্রছাত্রীদের নিউ ইয়র্ক শহরের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম দেখাতে নিয়ে যাই। এক দিক দিয়ে বলতে পারেন যে, আপনার আর আমার মধ্যে অনেক মিল আছে। আপনি কতদিন ধরে ট্যুর গাইডের কাজ করছেন, মি. কাপাসি?”
”পাঁচ বছর।”
মিসেস দাস গাড়িতে এসে দরজা বন্ধ করে ”কতক্ষণ লাগবে যেতে?” জিজ্ঞেস করলেন।
”এই ধরুন আড়াই ঘণ্টা,” কাপাসি উত্তর দিলেন। 
শুনে মিসেস দাস অধৈর্যভাবে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। যেন তিনি সারা জীবন ধরে অবিরাম ঘুরেই বেড়াচ্ছেন। ইংরেজীতে লেখা মুম্বইয়ের একটা চলচ্চিত্র পত্রিকা দিয়ে নিজেকে হাওয়া করলেন। 
”আমি ভেবেছিলাম যে, সান টেম্পল পুরীর থেকে মাত্র আঠারো মাইল উত্তরে,” মি. দাস ট্যুরবইটায় টোকা মেরে বললেন। 
”কোনারক যাওয়ার রাস্তাটা বেশ খারাপ। আসলে বাহান্ন মাইলের রাস্তা,” কাপাসি বোঝালেন। 
মি. দাস মাথা নাড়লেন। তাঁর ঘাড়ের পিছনে ক্যামেরার স্ট্র্যাপটা ঘষে যাচ্ছিল। সেটা সরিয়ে ঠিক করলেন। 
ইঞ্জিন চালু করার আগে কাপাসি পিছনে হাত দিয়ে দেখে নিলেন, পিছনের দরজা দুটোর ইংরেজির ‘এল’ অক্ষরের মতো লকগুলো ঠিক আটকেছে কিনা। গাড়ি চলতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে ছোট মেয়েটি তার দিকের লকটা নিয়ে খেলতে শুরু করল। চেষ্টা করে সেটাকে আগেপিছে নড়াতে লাগল। কিন্তু মিসেস দাস তাকে থামানোর জন্য কিছুই বললেন না। তিনি পিছনের সিটের একপাশে একটু হেলে বসে ছিলেন। কাউকে তাঁর মুড়িমাখা খেতে বললেন না। তাঁর দুদিকে রনি এবং টিনা বসে ক্যাটকেটে সবুজ রঙের চুয়িংগাম চিবোচ্ছিল। ‘দেখো,’ গাড়িটা গতি বাড়ানোর সময় ববি বলে উঠলো। সে আঙুল দিয়ে রাস্তার ধারের লম্বা গাছগুলো দেখাল। ‘ওই দেখো। বাঁদর।’ রনি চেঁচিয়ে উঠলো। ‘আবিব্বাস!’
চকচকে কালো মুখ, রুপোলি শরীর, সোজা সোজা ভুরু আর মাথায় ঝুঁটিওয়ালা বাঁদরগুলো দল বেঁধে গাছের ডালে বসে ছিল। তাদের লম্বা ধূসর লেজগুলো সারি সারি দড়ির মতো পাতার ফাঁক দিয়ে ঝুলছিল।গাড়িটার দিকে তাকিয়ে কেউ কেউ কালো চামড়ার মতো হাত দিয়ে নিজেদের গা চুলকোচ্ছিল বা পা দোলাচ্ছিল। 
”আমরা ওদের হনুমান বলি,” কাপাসি বললেন। ”ওদের এখানে খুব দেখতে পাওয়া যায়।”
কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে একটা হনুমান লাফ দিয়ে রাস্তার মাঝখানে এসে পড়ল। কাপাসিকে আচমকা ব্রেক কষতে হল। আরেকটা গাড়ির হুডে লাফিয়ে উঠল, তারপর আবার লাফিয়ে চলে গেল। কাপাসি হর্ন বাজালেন। বাচ্চারা উত্তেজিত হয়ে জোরে শ্বাস নিয়ে মুখে হাত চাপা দিল। মি. দাস বললেন, তারা কখনো চিড়িয়াখানার বাইরে কোনো বাঁদর বা হনুমান দেখেনি। তিনি কাপাসিকে গাড়িটা থামাতে বললেন যাতে হনুমানগুলোর ছবি তুলতে পারেন। 
মি. দাস তাঁর টেলিফোটো লেন্স ঠিক করতে করতে, মিসেস দাস তাঁর ঘাসের ব্যাগ থেকে একটা রং-হীন নেলপালিশ বের করে তর্জনীর নখে লাগাতে শুরু করলেন। 
ছোট্ট মেয়েটা একটা হাত বাড়িয়ে আবদার করল, ”আমাকেও মা। আমাকেও লাগিয়ে দাও।”
”বিরক্ত কোরো না,” মিসেস দাস বললেন। নখের ওপর ফুঁ দিয়ে মেয়ের দিক থেকে একটু ঘুরে বসলেন। ”তুমি আমারটা নষ্ট করে দিচ্ছ।”
তখন মেয়েটা পুতুলের জামার বোতাম খুলতে আর লাগাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। 
”হয়ে গিয়েছে,” লেন্সের ঢাকা আটকে মি. দাস বললেন।
ধুলোময় রাস্তার ওপর গাড়িটা দৌড়োতে দৌড়োতে গিয়ে বেশ ঝাঁকুনি খেল। মাঝে মাঝেই সকলে সিট থেকে লাফিয়ে উঠছিলেন। কিন্তু মিসেস দাস তার মধ্যেই নখ রং করতে থাকলেন। যাত্রার স্বাচ্ছন্দ্যের আশায় কাপাসি অ্যাক্সিলেটরের ওপর চাপ কমিয়ে দিলেন। গিয়ার শিফটের দিকে হাত বাড়ানোর সময় সামনের সিটে বসা ছেলেটি তার রোমহীন পা দুটো সরিয়ে নিল। কাপাসি লক্ষ্য করলেন যে, এই ছেলেটি তার ভাইবোনের চেয়ে একটু বেশী ফ্যাকাশে। ”বাবা, এই গাড়িটাতেও ড্রাইভার উলটো দিকে বসেছে কেন?” ছেলেটি জিজ্ঞেস করল।
”এখানে সকলে ওদিকেই বসে, ক্যাবলা,” রনি বলল। 
”ভাইকে ক্যাবলা বোলো না,” মি. দাস বললেন। কাপাসির দিকে ফিরে তিনি বললেন, ”আমেরিকায়, জানেন তো…ওদের একটু গুলিয়ে যায়।”
”হ্যাঁ হ্যাঁ আমি জানি,” কাপাসি বললেন। যথাসম্ভব সাবধানে তিনি গিয়ার বদলালেন। সামনে একটা টিলা আসছে দেখে গতি বাড়ালেন, ‘আমি ‘ডালাস’ এ দেখেছি স্টিয়ারিং হুইল বাঁ দিকে থাকে।’
”ডালাস কী?” কাপাসির সিটের পিছনে নগ্ন পুতুলটাকে পেটাতে-পেটাতে টিনা জিজ্ঞেস করল। 
মি. দাস বোঝালেন, ”একটা টিভি শো। এখন আর দেখানো হয়না।”
এক সারি খেজুর গাছের পাশ দিয়ে যেতে যেতে মি. কাপাসি ভাবলেন, এরা সব ভাইবোনের মতো। দাসদম্পতি বড় বোন এবং বড় ভাইয়ের মতো আচরণ করেন, মা বাবার মতো নয়। মনে হচ্ছিল যেন, বাচ্চাদের দায়িত্ব শুধু সেইদিনের জন্যই তাঁদের দেওয়া হয়েছে। নিজেদের ছাড়া অন্য কিছু বা অন্য কারও দায়িত্ব তাঁরা নিয়মিত সামলান, ভাবতে অসুবিধে হচ্ছিল। মি. দাস তার লেন্স এবং ট্যুর বইয়ে টোকা মারছিলেন। মাঝে মাঝে বুড়ো আঙুলের নখটা সশব্দে বইয়ের পাতার ওপর দিয়ে টানছিলেন। মিসেস দাস তখনো নখে রং লাগিয়ে বায়না ধরছিল। এক্সময় মিসেস দাস এক ফোঁটা পলিশ ছোট মেয়ের নখে লাগিয়ে বোতল্টা তাঁর ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলেন। 
”গাড়িটা এয়ারকন্ডিশনড্‌ নয়?” নখে ফুঁ দিতে দিতে তিনি জিজ্ঞেস করলেন। টিনার দিকের জানলাটা ভাঙা ছিল। নামানো যাচ্ছিল না। 
”খুঁতখুঁত কোরো না,” মি. দাস বললেন। ”এমন কিছু গরম নেই।”
”আমি তোমাকে বলেছিলাম একটা এয়ারকন্ডিশনড্‌ গাড়ি নিতে,” মিসেস দাস অনুযোগ করলেন। ‘কেন এগুলো করো বলো তো, রাজ?’ স্রেফ কয়েকটা ফালতু টাকা বাঁচাতে? কত টাকা বাঁচাচ্ছো এভাবে? ক’পয়সা?’
‘ডালাস’ নয়, কিন্তু অন্য আমেরিকান টিভি অনুষ্ঠানে অভিনেতারা যে ভঙ্গিতে উচ্চারণ করেন, এঁরাও ঠিক সেই ভাবে কথা বলছেন, ভাবলেন কাপাসি। 
‘আচ্ছা আপনার একঘেয়ে লাগেনা, মি. কাপাসি? রোজ সকলকে একই জিনিস দেখাতে? মি. দাস তাঁর জানালাটা পুরোপুরি নামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন। ‘আরে, আপনি কি একবার গাড়িটা থামাবেন? আমি এই লোকটার একটা ছবি তুলতে চাই।’
কাপাসি গাড়িটা রাস্তার একপাশে দাঁড় করালেন। একটা লোক খালি পায়ে, মাথায় একটা নোংরা পাগড়ি বেঁধে একটা গরুর গাড়ির মধ্যে ধানগমের বস্তার ওপর বসে ছিল। মি. দাস তার ছবি তুললেন। লোকটা আর গরু দুটো সকলেই শীর্ণকায়। পিছনের সিটে বসে মিসেস দাস অন্য একটা জানলা দিয়ে আকাশের দিকে তাকালেন। সেখানে প্রায় স্বচ্ছ মেঘ একে অন্যের পাশ কাটিয়ে ভেসে যাচ্ছিল। 
‘সত্যি কথা বলতে কী, আমার বেশ ভালই লাগে,’ পুনরায় যাত্রা শুরু কোরে কাপাসি বললেন। ‘সান টেম্পল আমার খুব প্রিয় জায়গা। সেই দিক দিয়ে দেখতে গেলে এতে আমার সুবিধেই হয়। আমি তো শুধু শুক্র-শনিবার ট্যুর করি, বাকি সপ্তাহ আমার অন্য কাজ থাকে।’
‘তাই বুঝি। কোথায়?’ মি. দাস জিজ্ঞেস করলেন।
‘আমি এক ডাক্তারের অফিসে কাজ করি।’
‘আপনি ডাক্তার?’
‘আমি ডাক্তার নই। একজন ডাক্তারের সাথে কাজ করি। দোভাষী, হিসেবে।
‘ডাক্তারের দোভাষীর কীসের প্রয়োজন?’
‘তার অনেক গুজরাতি রুগি আছে। আমার বাবা গুজরাতি ছিলেন, কিন্তু এ অঞ্চলের অনেকেই গুজরাতি বোঝে না। ডাক্তারও না। তাই তিনি আমাকে তাঁর অফিসে কাজ করতে বললেন, তাঁর রুগিদের কথা বোঝানোর জন্য।‘
‘বাহ, ইন্টারেস্টিং! আমি এরকম কিছু আগে শুনিনি,’ মি. দাস বললেন। 
কাপাসি কাঁধ ঝাকালেন। ‘অন্য যে কোন কাজের মতোই।’
‘কিন্তু খুব রোমান্টিক,’ মিসেস দাস তাঁর এতক্ষণের নীরবতা ভেঙে স্বপ্নালু গলায় বললেন। তাঁর গোলাপি-বাদামি সানগ্লাস খুলে মাথার ওপর টায়রার ভঙ্গিতে বসালেন। সেই প্রথমবার, রিয়ারভিউ আয়নাতে তাঁর এবং মি. কাপাসির চোখাচোখি হল। ফ্যাকাশে, একটু ছোট ঘুমজড়ানো চোখগুলো একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল। 
মি. দাস ঘাড় উচু করে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। ‘এতে আবার রোমান্টিক কী আছে?’
‘জানি না। তবে কিছু একটা আছে।, ‘ তিনি কাঁধ ঝাঁকালেন। মুহুর্তের জন্য ভুরু কোঁচকালেন। ‘একটা চুইং গাম নেবেন, কি কাপাসি?’ তিনি সপ্রতিভ হয়ে বললেন। তাঁর ঘাসের ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে সবুজ-সাদা ডোরাকাটা কাগজে মোড়া একটা ছোট চৌকো চুয়িং গাম বার কোরে কাপাসিকে দিলেন। 
কাপাসি সেটা মুখে পোরার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মুখের ভেতর একটা ঘন, মিষ্টি, তরল পদার্থ চুয়িং গাম ফেটে বেরিয়ে আসল। 
‘আপনার কাজের সমন্ধে আরও কিছু বলুন, মি. কাপাসি,’ মিসেস দাস বললেন। 
‘আপনি কী জানতে চান বলুন ম্যাডাম?’
‘তা জানিনা,’ মিসেস দাস আবার কাঁধ ঝাঁকালেন। মুড়িমাখা চিবোতে চিবোতে ঠোঁটের কোণ থেকে এক ফোঁটা সরষের তেল চেটে নিলেন।
‘কোনও একটা ঘটনার উদাহরন দিন।’ তিনি সিটে হেলান দিয়ে বসে, এক ফালি রোদের মধ্যে মাথা হেলিয়ে চোখ বন্ধ করলেন। ‘আমি কল্পনা করতে চাই কী ঘটতে পারে।’ 
‘ঠিক আছে। এই সেদিনই একজন লোক গলা ব্যথা নিয়ে এসেছিল।‘
‘সে কি সিগারেট খেত?’
‘না। খুবই অদ্ভুত ব্যাপার। তার অভিযোগ ছিল যে, তার মনে হচ্ছিল যেন গলায় লম্বা-লম্বা খড়ের টুকরো আটকে গিয়েছে। আমি ডাক্তারকে বলার পর তিনি লোকটাকে সঠিক ওষুধ লিখে দিলেন।‘
‘বাহ, কী ভাল।’
‘হ্যাঁ,” কাপাসি সামান্য ইতস্তত হয়ে সায় দিলেন। 
‘এই রুগিরা তা হলে আপনার ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে, ‘মিসেস দাস বললেন। তিনি আস্তে আস্তে কথা বলছিলেন। যেন নিজের মনে ভাবনাগুলো আওড়াচ্ছেন। ‘দেখতে গেলে, ওরা ডাক্তারের চেয়েও আপনার ওপর বেশি নির্ভরশীল।’
‘মানে?তা কী করে হতে পারে?’
‘যেমন ধরুন, আপনি ডাক্তারকে বলতে পারেন যে, ব্যথাটা খড়ের মতো নয় জ্বালার মতো। রুগি কখনো জানতে পারবে না যে, আপনি ডাক্তারকে কী বললেন। এটাতো খুব বড় দায়িত্ব।’
”হ্যাঁ, আপনার কাজটা খুবই দায়িত্বের কাজ, মি. কাপাসি, ‘মি. দাস সায় দিলেন।
কাপাসি নিজের কাজটাকে কখনও এরকম প্রশংসাযোগ্যা ভাবেননি। তাঁর কাছে কাজটাকে প্রতিদানহীন মনে হত। মানুষের ব্যাধির, বেদনার ব্যাখ্যা করার মধ্যে তিনি মহৎ কিছুই খুঁজে পেতেন না। হাড় ফুলে যাওয়া, পেটের এবং নাড়িভুঁড়ির অসংখ্য খিল ধরে যাওয়া, লোকের হাতের তেলোয় কোনও দাগের মাপ, আকার বা রং পালটে যাওয়া লক্ষণগুলোর পুঙ্খানুপুনঙ্খভাবে ব্যাখ্যা করার মধ্যে তিনি রোমান্টিক কিছু দেখতেন না। ডাক্তারের বয়স ছিল প্রায় তার অর্ধেক। বেলবটম ফুলপ্যান্টের প্রতি ডাক্তারটির একটু দুর্বলতা ছিল। কংগ্রেস পার্টিকে নিয়ে মাঝে মাঝে কৌতুকহীন রসিকতা করতেন। তাঁরা একসঙ্গে একটি জরাজীর্ণ ছোট্ট হাসপাতালে কাজ করতেন। সেখানে মাথার উপর একটা ঘূর্ণায়মান সিলিং ফ্যানের কালো হয়ে যাওয়া গরম পাখা হাওয়া দেওয়া সত্ত্বেও, কাপাসির পরিপাটি করে তৈরী করা জামাকাপড় তাঁর গায়ে সেঁটে যেত। 

আরো পড়ুন: ঝুম্পা লাহিড়ী’র গল্প সেক্সি

এই কাজটা ছিল তার ব্যার্থতার চিহ্ন। যৌবনে তিনি ছিলেন বিদেশি ভাষার একনিষ্ঠ ছাত্র। তাঁর অভিধানের সংগ্রহ রীতিমতো সম্ভ্রম জাগাত। স্বপ্ন দেখতেন কূটনীতিবিদ এবং অন্যান্য উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের জন্য দোভাষীর কাজ করবেন। মানুষে মানুষে, দু’দেশের মধ্যে সমস্যার সমাধান করবেন। সেইসব তর্কে ইতি টানবেন, যেখানে দু’পক্ষের বক্তব্য একমাত্র তাঁর পক্ষেই বোঝা সম্ভব। তিনি স্বশিক্ষিত ছিলেন। মা-বাবা তাঁর বিয়ের বন্দোবস্ত করার আগে তিনি সন্ধ্যাবেলা একের পর এক নোটবইয়ে নানা শব্দের ব্যুৎপত্তির তালিকা তৈরী করতেন। একসময় তাঁর বিশ্বাস ছিল যে, সুযোগ পেলে ইংরেজি, ফরাসি, রুশ, পর্তুজিজ এবং ইতালীয় ভাষায় কথোপকথন চালাতে পারবেন। হিন্দি, বাংলা, ওড়িয়া, এবং গুজ্রাতি তো বলাই বাহুল্য। এখন শুধু ইউরোপীয় শব্দবন্ধ তাঁর মনে আছে। এলোমেলো সব কথা, যেমন পাত্র বা চেয়ারকে কী বলা হয়। বিদেশী ভাষা বলতে একমাত্র ইংরেজীটাই তিনি এখন সাবলীলভাবে বলতে পারেন। কাপাসি জানতেন যে, সেটা কোন অসামান্য প্রতিভা নয়। মাঝে মাঝে তার আশংকা হত যে, তাঁর ছেলেমেয়ে শুধুমাত্র টিভি দেখেই তার চেয়ে ভাল ইংরেজি শিখে গিয়েছে। যাই হোক, ভাষাটা তার ট্যুরের কাজে সাহায্য করে। 
তাঁর বড় ছেলে যখন সাত বছর বয়স, তখন টাইফয়েড হয়। সেই সময়েই কাপাসির ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ এবং তখনই তিনি দোভাষীর কাজটা নিয়েছিলেন। সেই সময় তিনি এক গ্রামার স্কুলে ইংরেজি পড়াতেন। চিকিৎসার ক্রমবর্ধমান খরচ মেটানোর জন্য তাঁর ভাষার জ্ঞান কাজে লাগাতে শুরু করেছিলেন। শেষে ছেলেটা তার মায়ের কোলেই মারা যায়। জ্বরে তার গা-হাত-পা পুড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু তারপরও তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য টাকার প্রয়োজন ছিল। তারপর আরও ছেলেমেয়েও হয়েছিল। নতুন বড় বাড়ি, ভাল স্কুল, ভাল টিউটর, ভাল জুতো আর টিভি, এবং আরও অসংখ্য নানা উপায়ে তিনি স্ত্রীকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। যাতে তিনি ঘুমের মধ্যে না কাঁদেন। তাই ডাক্তার যখন গ্রামার স্কুলের চেয়ে দ্বিগুণ মাইনে দেওয়ার প্রস্তাব দিলেন, তখন তিনি সেই প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলেন। কাপাসি জানতেন যে, স্ত্রী তাঁর কাজ সম্বন্ধে খুব উচ্চ ধারণা পোষণ করেন না। কাজটা তাকে পরলোকগত ছেলের কথা মনে করিয়ে দেয় এবং তিনি এও জানতেন যে, অন্যদের প্রাণ বাঁচাতে তাঁর ক্ষুদ্র সামর্থ্য অনুযায়ী যে সাহায্য করেন, তা তার স্ত্রী বিদ্বেষের চোখে দেখেন। কখনো কাজের সমন্ধে বলতে গেলে, তাঁর স্ত্রী ‘ডাক্তারের আসিস্টেন্ট’ কথাটি ব্যবহার করতেন। যেন ব্যাখ্যা করার কাজটা কারও তাপমাত্রা নেওয়া বা বেডপ্যান বদলে দেওয়ার সমতুল্য। তিনি কখনও কাপাসিকে রুগিদের কথা জিজ্ঞেস করতেন না বা বলতেন না যে, কাজটা বেশ দায়িত্বপূর্ণ। 
তাই মিসেস দাসকে তাঁর কাজ সমন্ধে এত উৎসুক দেখে কাপাসি আত্মসন্তুষ্টি অনুভব করলেন। মিসেস দাস তাঁর কাজে যে বুদ্ধি, বিচারশক্তির প্রয়োজনীয়তা আছে সে কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, যা তাঁর স্ত্রী কখনও করেন না। 
তিনি ‘রোমান্টিক’ কথাটিও ব্যবহার করেছিলেন। মিসেস দাস তাঁর স্বামীর সঙ্গে কোনও রকম রোমান্টিক আচরণ করেননি।, কিন্তু কাপাসির সঙ্গে কথা বলার সময় কথাটি ব্যবহার করেছিলেন। কাপাসি ভাবলেন, তাঁর এবং তাঁর স্ত্রীর মতো দাসদম্পতিও পরষ্পরের পক্ষে অনুপুযুক্ত কিনা। তাঁদেরও হয়তো, তিন ছেলেমেয়ে এবং দাম্পত্য জীবনের একদশক ছাড়া আর কোনও মিল নেই। তাঁর নিজের বিয়ের ব্যর্থতার চিন্থ তিনি এদের মধ্যেও দেখতে পেয়েছিলেন। সেই খিটখিট করা, সেই নিস্পৃহতা, সেই দীর্ঘস্থায়ী নীরবতা। মিসেস দাসের তার সম্পর্কে আচমকা আগ্রহবোধ করা, যে আগ্রহ তিনি তার ছেলেমেয়ে বা স্বামী কারও প্রতিই প্রকাশ করেননি, তা কাপাসিকে মৃদুভাবে আচ্ছন্ন করল। মিসেস দাস যেভাবে ‘রোমান্টিক’ কথাটা বলেছিলেন, তা ভেবে কাপাসির মোহগ্রস্থতা বেড়ে গেল। 
গাড়ি চালাতে-চালাতে কাপাসি রিয়ারভিউ আয়নায় নিজেকে দেখতে লাগলেন। বাদামি সুটটা হাঁটুর কাছে একটু ঝুলে থাকে। সেটা না পরে ধূসর রঙের সুটটা পরায় আশ্বস্ত বোধ করলেন। কিছুক্ষন অন্তর অন্তর তিনি আয়নায় মিসেস দাসের দিকে তাকালেন। শুধু তাঁর মুখের দিকেই না, তাঁর বুকের কাছে স্ট্রবেরি ফলটার দিকে, তাঁর গলার সোনালি-হলুদ কোটরের দিকেও তাকালেন। তিনি ঠিক করলেন যে, মিসেস দাসকে আর-একজন রুগি এবং আরও একজন রুগির কথা বলবেন। সেই যে অল্প বয়সি মেয়েটি শিরদাঁড়ায় বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার ভাব অনুভব করত। সেই যে ভদ্রলোকের জন্মদাগ থেকে চুল গজাতে শুরু করেছিল। একটা ছোট, ডিম্বাকৃতি প্লাস্টিকের ব্রাশ দিয়ে চুল আঁচড়াতে-আঁচড়াতে মিসেস দাস কাপাসির কথা মন দিয়ে শুনলেন। প্রশ্ন করলেন, আরো উদাহরণ শুনতে চাইলেন। বাচ্চাগুলো চুপচাপ বসে ছিল, গাছের ওপর আরও হনুমান দেখার চেষ্টা করছিল। মি. দাস তাঁর ট্যুর-বইয়ে ডুবে ছিলেন। তাই মনে হচ্ছিল যেন কাপাসি এবং মিসেস দাসের মধ্যে কোনও ব্যক্তিগত কথোপকথন চলছে। এইভাবে আধঘন্টা কেটে গেল। তারপর তাঁরা দুপুরের খাবারের জন্য রাস্তার ধারের এক রেস্তোরাঁয় থামলেন যেখানে চপ এবং ওমলেট স্যান্ডউইচ পাওয়া যায়। সাধারণত কাপাসি যাত্রার এই অংশটা উপভোগ করেন। কারণ, এখানে তিনি গরম চা খেতে খেতে শান্তিতে বসতে পারেন। কিন্তু আজ তিনি এখানে পৌছে হতাশ হলেন। দাস পরিবার একসঙ্গে একটা সাদা-কমলা টাসেল ঝোলানো ম্যাজেন্টা রঙের ছাতার নীচে একটা টেবিলে গিয়ে বসলেন। তিনকোনা টুপি পরা যে বেয়ারারা ঘুরছিল, তাদের একজনকে ডেকে খাবারের অর্ডার দিলেন। মি কাপাসি অনিচ্ছুকভাবে পাশের একটা টেবিলের দিকে এগোলেন। 
‘মি. কাপাসি, দাঁড়ান। এখানে জায়গা আছে,’ মিসেস দাস ডাকলেন। তিনি টিনাকে নিজের কোলে বসিয়ে কাপাসিকে তাঁদের সঙ্গে বসার জন্য জোর করলেন। সুতরাং তাঁরা একসংগে বসে বোতলে ভরা আমের রস, স্যান্ডউইচ, পেঁয়াজি এবং আলুর পকোড়া খেলেন। দুটো ওমলেট শেষ স্যান্ডউইচ শেষ করার পর মি. দাস সকলের খাওয়ার ছবি তুললেন। 
‘আর কতক্ষণ?’ ক্যামেরায় ফিল্মের নতুন রোল ভরতে ভরতে তিনি কাপাসিকে জিজ্ঞেস করলেন। 
‘এই ধরুন আধঘন্টা।’ 
ততক্ষণে বাচ্চারা আশপাশের গাছের হনুমানগুলো দেখার জন্য টেবিল থেকে উঠে পড়েছিল। অতএব মিসেস দাস এবং মি. কাপাসির মধ্যে বেশ কিছুটা ফাঁকা জায়গা তৈরী হয়েছিল। মি. দাস ক্যামেরাটা তাঁর মুখের কাহে ধরে একটা চোখ টিপে বন্ধ করলেন। তাঁর মুখের এক কোণ দিয়ে জিভটা উঁকি মারছিল। ‘তোমাদের দেখতে অদ্ভুত লাগছে। মিনা, তুমি মি. কাপাসির দিকে আর-একটু সরে যাও।‘
মিসেস দাস একটু সরে আসলেন। কাপাসি তাঁর গায়ে সুবাস পাচ্ছিলেন। কেমন যেন হুইস্কি আর গোলাপজলের মিশ্রণের মতো। তাঁর হঠাৎ দুশ্চিন্তা হল যে, মিসেস দাস হয়তো তাঁর গা থেকে সিন্থেটিক শার্টের তলায় জমা ঘামের গন্ধ পাবেন। তিনি এক ঢোকে আমার রস শেষ করে তাঁর রুপোলি হাত বুলিয়ে নিলেন। চিবুকে এক ফোটা রস পড়েছিল। তিনি ভাবলেন মিসেস দাস সেটা দেখতে পেয়েছেন কিনা। 
মিসেস দাস সেটা দেখেননি। ‘আপনার ঠিকানাটা কী, মি. কাপাসি?’ তিনি তার ঘাসের ব্যাগে কিছু খুঁজতে-খুঁজতে বললেন।
‘আপনি আমার ঠিকানা চান?’
‘ফোটোর কপি যাতে আপনাকে পাঠিয়ে দিতে পারি,’ মিসেস দাস বললেন। তাঁর ফিল্ম পত্রিকা থেকে চট করে এক ফালি কাগজ ছিঁড়ে তিনি কাপাসিকে দিলেন। লেখার জন্য জায়গা কমই ছিল। কারণ, চিরকুটটায় ভর্তি লেখা, তার সঙ্গে একটা ইউক্যালিপটাস গাছের তলায় একজোড়া নায়িকার আলিঙ্গনের ফোটো। 
কাপাসি সযত্নে পরিষ্কার করে,তাঁর ঠিকানা লিখলেন। কাগজটা কুঁচকে গেল। মিসেস দাস তাঁকে চিঠি লিখবেন, ডাক্তার অফিসে তাঁর দোভাষীর কাজের কথা জিজ্ঞেস করবেন। তিনিও স্বচ্ছন্দে উত্তর দেবেন। বেছে-বেছে সবচেয়ে মজার ঘটনার কথাই লিখবেন, যা পড়ে মিসেস দাস তাঁর নিউ জার্সির বাড়িতে সশব্দে হেসে উঠবেন। একসময় তাঁরা নিজেদের বিয়ের আশাভঙ্গের কথা লিখবেন। এভাবেই তাদের মধ্যে বন্দুত্ব গড়ে উঠবে, আর শ্রীবৃদ্ধি হবে। তাঁর কাছে তাঁদের দুজনের একটা ছবি থাকবে। ম্যাজেন্টা ছাতার তলায় বসে পেঁইয়াজি খাওয়ার ছবি। কাপাসি ঠিক করলেন যে, তিনি ছবিটা তাঁর রুশ ব্যকরণের বইয়ের পাতার ভিতর ঢুকিয়ে রাখবেন। তাঁর মন ঝড়ের গতিতে এগিয়ে চলল। কাপাসি একটা মৃদু, সুখপ্রদ চাঞ্চল্য অনুভব করলেন। 
অনেকদিন আগে, মাসের পর মাস অভিধানের সাহায্যে অনুবাদ করার পর অবশেষে কোন ফরাসি উপন্যাসের কয়েকটি লাইন বা ইতালীয় সনেট পড়তে পারলে, নিজের অজ্ঞতার বাধা কাটিয়ে শব্দগুলো একের পর এক বুঝতে পারলে তিনি ঠিক এইরকম তৃপ্তি পেতেন। সেই সব মুহুর্তে কাপাসির মনে হত যে, পৃথিবীতে সবকিছুই ঠিক ঠাক চলছে। সব পরিশ্রমের পুরষ্কার পাওয়া যায়, জীবনের সব ভুলের অর্থ মিলে যায় যাত্রার শেষে। মিসেস দাসের যোগাযোগ করার প্রতিশ্রুতি কাপাসিকে একই আশ্বাস দিল। 
ঠিকানা লেখার পর কাপাসি মিসেস দাসকে কাগজটা ফেরত দিলেন, কিন্তু দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর দুশ্চিতা শুরু হল যে, তিনি হয় নামের বানান ভুল লিখেছেন, না হয় তাঁর পোস্টাল কোডের সংখ্যাগুলো উলটো করে ফেলেছেন। তাঁর আশঙ্কা হল, চিঠিটা হারিয়ে যেতে পারে, ফোটোটা কখনও তাঁর কাছে পৌছাতে নাও পারে। এমনও হতে পারে, হয়তো সেটা ওড়িশাতেই দিশেহারা হয়ে ঘুরবে, কাপাসির থেকে খুব দূরে নয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাপাসি তার হদিশ পাবেননা। তিনি ভাবলেন আর-একবার কাগজটা চেয়ে নিশ্চিত হন যে, নির্ভুল ঠিকানাই লিখেছেন। কিন্তু মিসেসে দাস ইতিমধ্যে কাগজটা তাঁর অগোছালো ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলেছিলেন।
আড়াইটার সময় তাঁরা কোনারক পৌছোলেন। জীবনের মহান অধীশ্বর সূর্যের প্রতি উৎসর্গ করা মন্দিরটা বালুশিলা দিয়ে একটা বিশাল রথের আকারে তৈরি। প্রতিদিন আকাশের এপার থেকে ওপার যাত্রা করার সময় সূর্যদেব সৌধটির তিন দিকে তাঁর আলো ফেলেন। বেদির উত্তর এবং দক্ষিণ দিকে চব্বিশটি প্রকান্ড চাকা খোদাই করা। গোটা জিনিসটাই সাতটি ঘোড়া টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এমন গতিতে, যেন স্বর্গের মধ্যে দিয়ে ছুটে চলেছে। মন্দিরের দিকে এগোতে-এগোতে কাপাসি বললেন যে, মন্দিরটা ১২৪৩ থেকে ১২৫৫ সালের সময়কালে বারোশ কারিগর মিলে তৈরি করেছিল। গঙ্গা সাম্রাজ্যের মহান সম্রাট রাজা প্রথম নরসিংহদেব মুসলমান সৈন্যদের পরাজিত করার স্মারকরুপে মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন।
‘মি. দাস তাঁর ট্যুর-বই পড়ে বললেন, ‘ এখানে লিখেছে যে, মন্দিরটি আন্দাজ একশো সত্তুর একর জমির ওপর অবস্থিত।‘
‘জায়গাটা মরুভুমির মতো লাগছে,’ রনি বলল। তার চোখ মন্দিরের চারপাশে বিস্তীর্ণ বালিতে ঘুরছিল। 
‘একসময় এর এক মাইল উত্তরে চন্দ্রভাগা নদী বইত। এখন শুকিয়ে গিয়েছে,’ কাপাসি ইঞ্জিন বন্ধ করে বললেন। 
তাঁরা গাড়ি থেকে বেরিয়ে মন্দিরের দিকে হাঁটা লাগালেন। মন্দিরের সিঁড়ির দু’পাশে যে সিংহজোড়া সিঁড়ির শোভাবর্ধন করে, তার সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুললেন। তারপর কাপাসি তাঁদের রথের একটা চাকার কাছে নিয়ে গেলেন। কোনও মানুষের চেয়ে উঁচু চাকা, ন’ফিট ব্যাস। 
‘চাকাগুলো আমাদের জীবনচক্রের চিহ্নস্বরূপ,’ মি. দাস পড়লেন। 
‘এগুলো সৃষ্টি, সংরক্ষণ এবং উপলব্ধির চক্রকে চিত্রিত করে। বাহ! ‘ তিনি পাতা ওল্টালেন। ‘প্রতিটি চাকা আটটি মোটা এবং সরু পাখিতে বিভক্ত। অর্থাৎ একটি দিন আটটি সমান ভাগে ভাগ করা। পরিধিতে পশুপাখির ছবি খোদাই করা। চাকার পাখিতে যে সজ্জফলক আছে, সেখানে বিলাসবহুল ভঙিমায় নারীমুর্তি খোদাই করা, প্রধানত কাম বিষয়ক।‘ 
তিনি অসংখ্য আলিনঙনবন্ধ নগ্ন দেহের কারুকার্যখচিত সারিরি কথা বলছিলেন। ভালবাসার বিভিন্ন ভঙিমায়, পুরুষের গলা জড়িয়ে থাকা নারীদেহ, তাদের জানু চিরকালের জন্য তাদের প্রেমিকের ঊরুদেশে জড়ানো। এ ছাড়াও আছে নিত্যনৈমিত্তিক জীবনের দৃশ্য, শিকার, ব্যাবসা, তীর-ধনুক দিয়ে হরিণবধ, তলোয়ার হাতে যোদ্ধাদের সারি। 
মন্দিরে প্রবেশ করা আর সম্ভব ছিলনা। কারণ, অনেক বছর আগেই ভিতরের অংশটি ইটপাথরের টুকরোয় ভরে গিয়েছিল। কিন্তু এর চারদিকে ঘুরে, ধীরে ধীরে দেখতে দেখতে তাঁরা বাইরের অংশটির প্রশংসা করলেন, যেমন কাপাসির নিয়ে আসা অন্যান্য পর্যটকরাও কোরে। মি. দাস ছবি তুলতে তুলতে এগোচ্ছিলেন বলে পিছনে পড়ে গিয়েছিলেন। বাচ্চারা নগ্ন মূর্তির দিকে আঙুল দেখিয়ে সকলের আগে ছুটল। তাঁরা বিশেষভাবে নাগমিথুনদের দেখে কৌতুহলী হয়েছিল। কাপাসি তাদের বললেন যে, সেই অর্ধ্মানব-অর্ধসর্পিল দম্পতিরা সমুদ্রের সবচেয়ে গভীর অংশে থাকে। তাঁদের মন্দিরটা ভাল লেগেছে দেখে কাপাসি খুশী হলেন। মন্দিরটা মিসেস দাসের আকর্ষণীয় লেগেছে দেখে বিশেষভাবে সন্তুষ্ট হলেন। মিসেস দাস তিন-চার পা এগিয়েই থেমে যাচ্ছিলেন। প্রেমিক প্রেমিকাদের যুগলমুর্তির দিকে, হাতিদের শোভাযাত্রার দিকে, অনাবৃতবক্ষ নারী-বাদ্যকারিণীদের ঢোল বাজানোর দিকে নীরবে তাকিয়ে ছিলেন। 
কাপাসি এর আগে অসংখ্যবার মন্দিরে এসেছেন, কিন্তু সেদিন নগ্ন নারীমুর্তিগুলোর দিকে তাকিয়ে মনে হল, তাঁর স্ত্রীকেও কখনও সম্পূর্ণভাবে নগ্ন অবস্থায় দেখেননি, এমনকী তাঁদের ঘনিষ্ঠ মুহুর্তেও, তাঁর স্ত্রী ব্লাউজের হুকগুলো লাগিয়ে রাখেন, কোমর ঘিরে সায়ার দড়ি বেঁধে রাখেন। তিনি কখনও সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাঁর স্ত্রীর পায়ের পিছন দিকটি দেখেননি, যেভাবে তিনি এখন মিসেস দাসের পা দুটি দেখছিলেন। মিসেস দাস যেন শুধু তাঁর জন্য হাটছিলেন। তিনি যে পর্যটকদের এখানে নিয়ে আসেন, তাদের মধ্যে আমেরিকান এবং ইউরোপিয়ান মহিলাদের অনাবৃত হাত-পা তিনি এর আগে অসংখ্যবার দেখেছেন। কিন্তু মিসেস দাস তাদের সকলের চেয়ে আলাদা। অন্য মহিলারা শুধু মন্দিরেই আগ্রহী হল। গাইডবইয়ে নাক চুবিয়ে রাখেন বা ক্যামেরার লেন্সের পিছনে চোখ আটকে রাখেন। মিসেস দাস শুধু মন্দিরই নয়, কাপাসির প্রতিও আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। 
কাপাসি মিসেস দাসের সঙ্গে একলা থাকার জন্য, তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত কথোকপথন আবার শুরু করার জন্য অধীর হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু তিনি মিসেস দাসের পাশ হাঁটার সাহস পাচ্ছিলেন না। মিসেস দাস তাঁর সানগ্লাসের পিছনে হারিয়ে গিয়েছিলেন। আর-একটা ছবির জন্য তাঁর স্বামীর অনুরোধ অগ্রাহ্য করে, ছেলেমেয়েদের এমনভাবে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন যেন তাদের চেনেন না। বিরক্ত করার ভয়ে কাপাসি আগে-আগে হাঁটছিলেন। প্রতিবারের মতো এবারো মুগ্ধ হয়ে দেখছিলেন ব্রোঞ্জের তৈরী সুর্যদেবতার তিনিটি মানবাকৃতি অবতার। মন্দিরগাত্রে, নিজস্ব স্থান থেকে বেরিয়ে এসেছে প্রাতঃকাল, মধ্যান্থ এবং অপরানহে দেবতাকে প্রণাম জানানোর জন্য। তাঁদের মাথায় অলংকৃত শিরোভূষণ। ঢুলু ঢুলু, টানা টানা চোখ বুজে আছে, অনাবৃত ঊর্ধাঙ্গে কারুকার্যখচিত শৃংখল এবং তাবিজ জড়ানো। ধূসর-সবুজ পায়ের কাছে আগের পর্যটকদের নিবেদন করা জবাফুলের পাপড়ি ছড়ানো। মন্দিরের উত্তর দিকের দেওয়ালে শেষ মুর্তিটি কাপাসির সবচেয়ে প্রিয়। সুর্যের এই মুর্তিটির মুখে ক্লান্তির ছাপ। সারাদিনের পরিশ্রমের পর পা মুড়ে ঘোড়ার ওপর বসে আছেন। এমনকি ঘোড়ার চোখও যেন ক্লান্তিতে ডুবে আসছে। তাঁর শরীরের চারপাশে জোড়ায় জোড়ায় ছোট মাপের নারীমূর্তির ভাস্কর্য। তাদের নিতম্ব একদিকে হেলানো। 
‘ইনি কে?’ মিসেস দাস জিজ্ঞেস করলেন। কপাসি চমকে উঠে দেখলেন যে, মহিলা তাঁর পাশ এসে দাঁড়িয়েছেন। 
‘ইনি অস্তাচল-সুর্য’ কাপাসি বললেন। ‘অস্তগামী সুর্য।’
‘তার মানে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সূর্য ঠিক এখানেই অস্ত যাবে?’ মিসেস দাস তাঁর চৌকো হিলতোলা জুতো থেকে একটা পা বের কোরে পায়ের আঙুল অন্য পায়ের পিছনে ঘষলেন। 
‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’
মিসেস দাস এক মুহুর্তের জন্য তাঁর সানগ্লাস উঠিয়ে এবার চোখে পরলেন। ‘নিট’। 
কথাটির অর্থ সম্বন্ধে কপাসি নিশ্চিত ছিলেন না, কিন্তু তাঁ মনে হল যে, এটি মিসেস দাসের সন্তোষসূচক প্রতিক্রিয়া। তিনি আশা করলেন, মিসেস দাস সূর্যের সৌন্দর্য, সূর্যের শক্তি উপলব্ধি করতে পারবেন। হয়ত তাঁরা তাদের চিঠিতে এই নিয়ে আরও আলোচনা করবে এবং মিসেস দাস তাঁকে আমেরিকার কথা বলবেন। একদিক এই যোগাযোগ তার স্বপ্নপূরণ করবে। দুই দেশের মধ্যে ভাষ্যকারের কাজ করার স্বপ্ন। তিনি মিসেস দাসের ঘাসের ব্যাগটি দেখলেন। ব্যাগটার মধ্যে তাঁর ঠিকানাটো গুটিসুটি মেরে পড়ে আছে ভেবে উৎফুল্ল হলেন। মিসেস অত হাজার মেইল দূরে চলে যাবেন ভেবে তাঁর ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে পড়ল। তীব্র আকাঙা হল মিসেস দাসকে জড়িয়ে ধরার। অন্ততঁ এক মুহুর্তের জন্য, তাঁর প্রিয় সূর্যকে সাক্ষী রেখে মিসেস দাসের সংগে আলিঙনাবব্ধ হতে। কিন্তু মিসেস দাস ইতিমধ্যে হাঁটতে শুরু করে দিয়েছিলেন।
‘আপনার আমেরিকায় কবে ফিরবেন?’ কাপাসি তাঁর কণ্ঠস্বর শান্ত রাখার চেষ্টা করলেন। 
‘দশ দিনের মধ্যে।‘
কাপাসি মনে মনে হিসেব করলেন। ফিরে গিয়ে সব গুছিয়ে নিতে এক সপ্তাহ, ফোটো তৈরি হয়ে আসতে আরও এক সপ্তাহ, চিঠি লিখতে কয়েকদিন, ভারতে চিঠি পৌঁছোতে দু’সপ্তাহ। তাঁর হিসেব অনুযায়ী, বিভিন্ন জায়গায় দেরি হলেও, আন্দাজ ছ’সপ্তাহের মধ্যে তিনি মিসেস দাসের চিঠি পাবেন। 
সাড়ে চারটের একটু পরে, হোটেল স্যান্ডি ভিলায় ফেরার পথে দাস-পরিবার চুপচাপ ছিলেন। বাচ্চারা একটি সুভেনিরের দোকান থেকে গ্র্যানাইট পাথরের তৈরি রথের চাকার কয়েকটি ক্ষুদ্র সংস্করণ কিনেছিল, সেগুলোই নেড়েচেড়ে দেখছিল। মি. দাস বই পড়ছিলেন। মিসেস দাস তাঁর ব্রাশ দিয়ে টিনার চুলের জট ছাড়িয়ে দুটি ঝুঁটি বেঁধে দিচ্ছিলেন। 
তাঁদের হোটেলে নামিয়ে দেওয়ার কথা ভেবে কাপাসি শংকিত বোধ করতে শুরু করলেন। মিসেস দাসের চিঠির জন্য ছ’সপ্তাহের অপেক্ষা শুরু করার জন্য তিনি তখনো প্রস্তুত হননি। মিসেস দাস টিনার চুলে ইলাস্টিকের ব্যান্ড জড়াচ্ছিলেন। রিয়ারভিউ আয়নায় তাঁর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখতে দেখতে কাপাসি ভাবার চেষ্টা করলেন কীভাবে আরও একটু দেরিতে ফেরা জায়। সাধারণত তিনি একটা শর্টকাট নিয়ে পুরীর দিকে গাড়ি ছোটান। বাড়ি ফেরার জন্য, চন্দন সাবার দিয়ে হাত-পা ধুয়ে, সন্ধ্যেবেলা খবরের কাগজ এবং তাঁর স্ত্রী নীরবে তাঁকে যে চায়ের কাপ ধরিয়ে দেন সেটি উপভোগ করার জন্য অধীর হয়ে থাকেন। স্ত্রীর সেই নীরবতায় তিনি অনেকদিনই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছেন। কিন্তু আজ সেই নীরবতার কথা ভেঁবে তাঁর দম বন্ধ হয়ে আসল। তখনই তিনি উদয়গিরি এবং খন্ডুগিরির পাহাড় দেখতে যাওয়ার প্রস্তাব দিলেন। সেখানে এক গিরিসংকটের দু’পাশে কয়েকটি মঠের মতো সন্যাসীদের বাসস্থান যেন মাটি ফুঁড়ে উঠে এসেছে। ‘জায়গাটা কয়েক মেইল দূরে, কিন্তু দেখলে ভাল লাগবে।’ বললেন মি. কাপাসি। 
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, এখানে লেখা আছে জায়গাটার কথা,’ মি. দাস বললেন। ‘কোন জৈন রাজা বা ঐরকম কেউ নাকি বানিয়েছিলেন।‘
‘তা হলে কি আমরা যাব?’ রাস্তার একটা বাঁকের কাছে থেমে কাপাসি জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওখানে যাওয়ার রাস্তাটা বাঁ দিকে।‘
মি. দাস স্ত্রীর দিকে ঘুরে তাকালেন। দু’জনেই কাঁধ ঝাঁকালেন।
‘বাঁ দিকে, বাঁ দিকে,’ বাচ্চারা বলে উঠলো। 
কাপাসি গাড়ি ঘোরালেন। খুশিতে তাঁর প্রায় আত্মহারা লাগছিল। একবার পাহাড়ে পৌঁছনর পর তিনি মিসেস দাসকে কি বলবেন বা করবেন তা জানতেন না। হয়ত বলবেন তাঁর হাসিটা কত সুন্দর। হয়ত তাঁর স্ট্রবেরী শার্টের প্রশংসা করবেন, যা তাঁকে ভীষনভাবে মানিয়েছিল। হয়তো, মি. দাস ফোটো তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লে তিনি মিসেস দাসের হাত ধরবেন। 
তাঁর অত চিন্তা করার দরকার ছিলনা। ঘন নিবিড় গাছের নীচ দিয়ে খাড়া পথ বেয়ে পাহাড়ে পৌঁছানোর পর মিসেস দাস গাড়ি থেকে নামতে হলেন না। হনুমানের দল সারা পথ জুড়ে পাথরের ওপর এবং গাছের ডালে বসে ছিল। তাদের পিছনের পা’গুলো সামনের দিকে টানটান করে কাঁধ পর্যন্ত ওঠানো, হাত হাঁটুর ওপর রাখা। 
‘আমার পা দুটো ক্লান্ত হয়ে পড়েছে,’ সিটে আরো গা এলিয়ে বসে মিসেস দাস বললেন। ‘আমি এখানেই থাকছি।’
‘ওই বাজে জুতোগুলো পরতে গেলে কেন?’ মি. দাস বললেন। ‘তোমার তাহলে ফোটো উঠবেনা।‘
‘ধরে নাও আমি ওখানেই আছি।’
‘কিন্তু ফোটোগুলোর মধ্যে কোনও একটা এবার ক্রিসমাস কার্ডের জন্য ব্যবহার করা যেত। সূর্যমন্দিরে আমাদের পাঁচজনের একটাও ফোটো তোলা হয়নি। মি. কাপাসি এখানে একটা তুলে দিতে পারেন।’
‘আমি আসছিনা। আর এমনিতেও। ওই বাঁদরগুলোকে দেখলে আমার অস্বস্থি হয়।‘
‘কিন্তু ওরা তো কোনও ক্ষতি করেনা,’ মিস দাস বললেন। তিনি মি. কাপাসির দিকে ফিরলেন। ‘তাই না?’
‘ওরা যতক্ষন না বিপজ্জনক, তার চেয়ে বেশি ক্ষুধার্ত,’ কাপাসি বললেন। 
‘ওদের খাবারের লোভ দেখাতে যাবেন না, তাহলে ওরাও আপনাকে বিরক্ত করবে না।’
মি. দাস ছেলেমেয়েদের নিয়ে গিরিসংকটের দিকে এগুলেন। ছেলেরা তাঁর পাশে, মেয়ে তাঁর কাঁধের ওপর। কাপাসি তাদের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তারা এক জাপানি পুরুষ এবং মহিলার মুখোমুখি হলেন। জাপানি দুজন ছাড়া সেখানে আর কোন পর্যটক ছিলনা। জাপানিরা শেষ ফটোর জন্য থেকে, তারপর কাছেই একটা গাড়িতে বসে চলে গেলেন। গাড়িটা সেই দৃষ্টির বাইরে চলে গেল, কয়েকটা হনুমান মৃদু উল্লাসধ্বনি করে ডেকে উঠলো, তারপর তাদের চ্যাপ্টা কালো হাত-পায়ে হেঁটে রাস্তা দিয়ে এগিয়ে গেল। এক জায়গায় কয়েকটা হনুমান মি. দাস এবং বাচ্চাদের ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। টিনা উৎফুল্ল হয়ে চিৎকার করে উঠল। রনি তার বাবাকে ঘিরে গোল গোল হয়ে ছুটতে শুরু করল। ববি নিচু হয়ে মাটি থেকে একটা মোটসোটা কাঠি তুলে নিল। কাঠিটা বাড়িয়ে ধরতেই একটা হনুমান এগিয়ে এসে সেটা ছিনিয়ে নিয়ে মাটিতে কয়েকবার পেটাল। 
‘আমি ওদের সংগে যাই,’ কাপাসি নিজের দিকের দরজাটা খুলে বললেন। 
‘গুহাগুলো সম্পর্কে অনেককিছু বলার আছে।’
‘না, এক মিনিট দাঁড়ান,’ মিসেস দাস বললেন। তিনি পিছনের সিট থেকে নেমে কাপাসির পাশে এসে বসলেন। ‘রাজের কাছে ওই বোকা বোকা বইটাতো আছেই।’ কাপাসি এবং মিসেস দাস একসঙ্গে উইন্ডশিল্ডের মধ্যে দিয়ে দেখলেন, ববি এবং হনুমানটা কাঠিটা দেওয়া-নেওয়া করতে লাগলো। 
‘সাহসী ছেলে, কাপাসি মন্তব্য করলেন। 
‘সেটা খুব একটা আশ্চর্যের ব্যাপার নয়, ‘মিসেস দাস বললেন।
‘না?’
‘ও ওর নয়।‘
‘আমি ঠিক বুঝলাম না।‘
‘রাজের। ও রাজের ছেলে নয়।’
কাপাসির মনে হল যেন তাঁর গায়ে কাঁটা দিল। যে পদ্মফুল তেলের মলমটি তিনি সবসময় সঙ্গে রাখেন, সেটার জন্য পকেটে হাত ঢোকালেন। কপালে তিন জায়গায় এক ফোঁটা করে মলম লাগালেন। তিনি জানতেন যে মিসেস দাস তাঁকে দেখছেন, কিন্তু মুখ ফেরালেন না। মি. দাস এবং বাচ্চাদের ঘিরে হনুমানের সংখ্যা বাড়ছিল। কাপাসি সামনে তাকিয়ে দেখলেন যে, মাঝেমধ্যে ছবি তোলার জন্য থেমে, খাড়া পথটা ধরে উঠেতে উঠতে, তাঁদের দেখ ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। 
‘আপনি কি অবাক হলেন?’ যে সুরে মিসেস দাস প্রশ্নটা করলেন, তাতে কাপাসি বুঝলেন যে, তাঁকে খুব সাবধানে উত্তর দিতে হবে। 
‘এরকম একটা কথা তো কেউ ধরে নেয় না,’ কাপাসি ধীরে ধীরে বললেন। লোটাস-অয়েলের টিনটা পকেটে ঢুকিয়ে রাখলেন। 
‘না, নিশ্চয়ই না। এবং বলাই বাহুল্য, কেউ জানেও না। কেউই না। আটটা বছর ধরে আমি কথাটা গোপন রেখেছি।‘ মিসেস দাস দাঁত চিবুক বেঁকিয়ে কাপাসির দিকে তাকালেন। যেন তাঁকে নতুন কোন পরিপ্রেক্ষিতে দেখার চেষ্টা করছেন। ‘কিন্তু আজ আপনাকে বলে দিলাম।‘
কাপাসি মাথা নাড়লেন। তাঁর গলাটা হঠাৎ ভীষণ শুকনো লাগছিল। কপালটা মলম লাগানোড় পর উষ্ণ এবং সামান্য অবশ লাগছিল। তিনি ভাবলেন মিসেস দাসের কাছে এক চুমুক জল খেতে চাইবেন কিনা। তারপর ঠিক করলেন, চাইবেন না। 
‘আমাদের খুব অল্প বয়সে পরিচয় হয়,’ মিসেস দাস বললেন। তিনি তাঁর ঘাসের ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে এক প্যাকেট মুড়ি বের করলেন। ‘খাবেন?’
‘না, ধন্যবাদ।‘
মিসেস দাস একমুঠো মুখে পুরে সিটে আর-একটু গা এলিয়ে বসলেন। কাপাসির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিজের জানালার বাইরে তাকালেন। ‘আমরা কলেজে থাকতেই বিয়ে করেছিলাম। যখন হাই স্কুলে ছিলাম, তখনই ও প্রোপোজ করে। বলা বাহুল্য আমরা একই কলেজে পড়েছিলাম। সেই সময় আমরা আলাদা থাকার কথা কল্পনা করতে পারতামনা। এক দিনের জন্য না, এক মিনিটের জন্যও না। আমাদের মা-বাবারা ভীষণ ভাল বন্ধু ছিলেন। একই শহরে থাকতেন। সারা জীবন আমাদের শনি রবিবার দেখা হয়েছে। হয় আমার বাড়িতে, না হয় ওর। আমাদের ওপরের ঘরে খেলতে পাঠিয়ে আমাদের মা-বাবারা আমাদের বিয়ে নিয়ে ঠাট্টা–ইয়ারকি করতেন। একবার ভাবুন, তাঁরা কখনও আমাদের ধরতে পারেননি। যদিও আমার মনে হয় যে, এক দিক দিয়ে গোটা ব্যাপারটাই সেট আপ ছিল। সেই শনি-রবিবারের রাতগুলোয়, যখন আমাদের মা-বাবারা নিচে বসে চা খেতেন,তখন আমরা যা যা করতাম…আমি আপনাকে অনেক গল্প শোনাতে পারি, মি. কাপাসি।’
কলেজে সর্বক্ষণ রাজের সাথেই থাকার জন্য, তাঁর বেশি ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল না, মিসেস দাস বললেন। কোনও সমস্যাপূর্ণ দিনের শেষে রাজের সঙ্গে কথা বলার কেউ ছিলনা। কেউ ছিলনা যার সঙ্গে চিন্তা-ভাবনা ভাগ করে নেওয়া যায় । তাঁর মা-বাবা তখন পৃথিবীর অন্য প্রান্তে থাকতেন। এমনিতে তিনি কখনো মা-বাবার খুব ঘনিষ্ঠ হতে পারেননি। অত অল্প বয়সে বিয়ে করার পর তিনি সবকিছু সামলাতে গিয়ে কেমন বিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন। অত তাড়াতাড়ি বাচ্চা হওয়া, তার দেখাশোনা করা, দুধের বোতল গরম করা, কবজিতে সেই বোতলের তাপমাত্রা পরীক্ষা করা। রাজ সোয়েটার এবং কর্ডের প্যান্ট পরে বেরিয়ে যেত। ছাত্রদের পাথর এবং ডাইনোসর সম্পর্কে পড়াত। রাজকে দেখে কখনও বিরক্ত বা ব্যস্ত মনে হত না। প্রথম বাচ্চাটি হওয়ার পর তিনি যেমন মোটা হয়ে গিয়েছিলেন, সে তেমন হয়নি। 
সবসময় ক্লান্ত বোধ করায় তিনি কলেজের যে দু’একজন বান্ধবী ছিল, তাদের সঙ্গে খাওয়া দাওয়া করা বা ম্যানহাটনে কেনাকাটা করার নিমন্ত্রণ ফিরিয়ে দিতেন। ধীরে ধীরে তাঁকে তারা ফোন করা বন্ধ করে দিল। ফলে সারাদিন তিনি বাচ্চাটার সঙ্গেই ঘরে পড়ে থাকতেন। বাচ্চাটার খেলনাগুলো চারপাশে ছড়িয়ে থাকত, হাঁটার সময় হোঁচট খেতেন। কোনওটার উপর ভুল করে বসে পড়তেন। সবসময় ক্লান্ত, সবসময়ই বিরক্ত লাগতো। রনি জন্মাবার পর তাঁরা খুব কম বেড়াতে যেতেন। কাউকে বাড়িতে নিমন্ত্রণ করতেন তার চেয়েও কম। রাজের কোন অসুবিধে হত না। সে পড়ানোর পর বাড়ি ফিরে এসে টিভি দেখতে এবং রনিকে কোলে বসিয়ে নাচাতে পছন্দ করত। রাজের এক পাঞ্জাবী বন্ধু নিউ ব্রুন্সউইক এলাকায় কয়েকটি চাকরীর ইন্টারভিউয়ের জন্য আসছিল। মিসেস দাসের সঙ্গে একবার তার দেখা হয়েছিল, কিন্তু তিনি তাকে মনে করতে পারছিলেননা। সে এক সপ্তাহের জন্য তাদের সঙ্গে থাকতে আসবে শুনে প্রচণ্ড রেগে গিয়েছিলেন। ববিকে তিনি গর্ভে ধারণ করেন এক দুপুরে।, রাবারের খেলনা ছড়ানো একটা সোফার ওপর। বন্ধুটি তার আগেই জানতে পেরেছিল যে, লন্ডনের এক ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে সে একটি চাকরি পেয়েছে। রনি তাঁর প্লে-পেন থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য কান্না কান্না জুড়েছিল। মিসেস দাস কফি তৈরী করতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় বন্ধুটি তার পিছনে স্পর্শ করে তারপর নীল সুট পরা শরীরের দিকে টেনে নেয়। মিসেস দাস কখনও কোন প্রতিবাদ করেননি। বন্ধুটি নিঃশব্দে ত্বরিতগতিতে তাঁর সংগে সহবাস করেছিল। এমন এক নৈপুণ্যের সঙ্গে, যার অভিজ্ঞতা তাঁর আগে কখনও হয়নি। রাজ সবসময় ভালবাসার পরে যে অর্থপূর্ণ অভিব্যক্তি এবং হাসির ওপর জোর দিত,বন্ধুটির সেসব বালাই ছিলনা। তার পরের দিন রাজ বন্ধুটিকে জে এফ কে -তে পৌঁছে দিয়েছিল। বন্ধুটি এক পঞ্জাবি মেয়েকে বিয়ে করেছে, তারা এখনও লন্ডন থাকে। প্রতি বছর তাদের সঙ্গে দাস-দম্পতির ক্রিসমাস কার্ডের আদান প্রদান হয়। দু’পক্ষই খামে তাদের পরিবারের ফোটো গুঁজে দেয়। বন্ধুটি জানেনা যে ববি তার সন্তান। কোনওদিন জানবেও না। 
অবশেষে মিসেস দাস কথা বলা শেষ করে কাপাসির দিকে ফিরলেন। ‘ক্ষমা করবেন, মিসেস দাস, কিন্তু আপনি আমাকে এই কথাগুলো জানালেন কেন?’
‘দয়া করে আমাকে মিসেস দাস বলা বন্ধ করুন। আমার আটাশ বছর বয়স। আপনার ছেলেমেয়েই হয়ত আমার বয়েসি।’
‘না, ঠিক তা না।‘ কাপাসি ভেবে অস্বস্তি বোধ করলেন যে, মিসেস দাস তাঁকে এক পিতা হিসেবে ভাবছেন। মিসেস দাসের প্রতি তাঁর মনে যে অনুভুতি জন্ম নিয়েছিল, যে জন্য তিনি গাড়ি চালানোর সময় রিয়ারভিউ আয়নায় নিজেকে দেখছিলেন, তা সামান্য ফিকে হয়ে গেল। 
‘আমি আপনাকে বললাম আপনার বিশেষ দক্ষতার জন্য।‘ মিসেস দাস মুড়ির প্যাকেটের মুখটা না মুড়েই সেটা ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলেন।
‘বুঝতে পারছেন না? আট বছর ধরে আমি কথাটা কাউকে জানাতে পারিনি। কোন বন্ধুকে না। রাজকে তো নয়ই। ও কিন্তু সন্দেহ করেনা। ও ভাবে যে আমি ওকে এতটাই ভালবাসি। আপনার কিছু বলার নেই এই ব্যাপারে?’
‘কী ব্যাপারে?
‘যে জন্য আমি এইমাত্র আপনাকে এতগুলো কথা বললাম।আমার জীবনের গোপন কথা। আমার কতটা খারাপ লাগে এ-ব্যাপারে সেই কথা। আমার বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে রাজের দিকে তাকিয়ে আমার ভীষন খারাপ লাগে। সবসময় ভীষন খারাপ লাগে মি কাপাসি। আমার ভীষন ইচ্ছে হয়, জিনিষপত্র ছুড়ে ফেলে দেওয়ার। একদিন আমার ইচ্ছে হয়েছিল আমার যা যা আছে আছে সব জানলা দিয়ে বাইরে ফেলে দেওয়ার। টিভি, বাচ্চাগুলো, সবকিছু। আপনার কি মনে হয়না এটা অস্বাস্থ্যকর?’
কাপাসি চুপ করে থাকলেন। 
‘মি. কাপাসি, আপনার কি কিছুই বলার নেই? আমি ভেবেছিলাম যে এটাই আপনার কাজ।’
‘আমার কাজ পর্যটকদের ট্যুরে নিয়ে যাওয়া মিসেস দাস।‘
‘ওই কাজটা নয়। আপনার অন্য কাজ–দোভাষীর কাজ।‘
‘কিন্তু আমাদের মধ্যে তো ভাষাগত বাধা নেই। দোভাষীর দরকারটা কোথায়?
‘আমি তা বলতে চাইনি। আমি হয়তো আপনাকে কিছুই বলতাম না। আপনি কি বুঝতে পারছেন না যে, আমার আপনাকে এই কথাগুলো বলার অর্থ কী?
‘কি অর্থ?’
‘এই যে, আমি সবসময় মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। আট বছর, মি. কাপাসি। আট বছর ধরে আমি এই বেদনা সহ্য করছি। আমার আশা ছিল যে আপনি আমার বেদনা লাঘব করতে পারবেন। আমার কথার সঠিক উত্তর দিতে পারবেন। কোন প্রতিকার বাতলে দিতে পারবেন।‘ 
কাপাসি মিসেস দাসের দিকে তাকালেন। লাল চেক-কাটা স্কার্ট, স্ট্রবেরি টি-শার্ট পরা, এমন এক মহিলা, যা তার স্বামীকে ভালোবাসেনা, যে ইতিমধ্যেই জীবনের প্রতি সব ভালোবাসা হারিয়ে ফেলেছে। তার স্বীকারোক্তি কাপাসিকে বিষাদগ্রস্থ করল। আরও বিষন্ন লাগলো যখন মি. দাসের কথা ভাবলেন। কাঁধের উপর টিনাকে বসিয়ে আমেরিকায় তাঁর ছাত্রছাত্রীদের দেখানোর জন্য পাহাড়ের গা কেটে তৈরি করা প্রাচীন মঠের কক্ষের ছবি তুলছেন। অসন্দিগ্ধ, অপরিজ্ঞাত যে, তাঁর একটি সন্তান তাঁর নিজের নয়। মিসেস দাস তাকে এমন সাধারণ, তুচ্ছ, গোপন করার ব্যখ্যা করতে বলেছেন এই ভেবে মি. কাপাসি অপমানিত বোধ করলেন। ডাক্তারের অফিসে রুগিদের সঙ্গে তার কোন মিল নেই। তারা নিষ্প্রভ চোখে, মরিয়া হয়ে আসে। সহজে ঘুমোতে বা নিঃশ্বাস নিতে বা প্রস্রাব করতে পারেনা। সবচেয়ে বড় কথা নিজেদের বেদনাকে কথায় প্রকাশ করতে পারেনা। তা সত্বেও, কাপাসির মনে হল, মিসেস দাসকে সাহায্য করা তাঁর কর্তব্য। হয়তো তাঁর মিসেস দাসকে বলা উচিত যে, তিনি যেন মি. দাসের কাছে সব কথা স্বীকার করেন। তিনি মিসেস দাসকে বোঝাবেন যে সততাই সবচেয়ে ভাল উপায়। মিসেস দাস যে খারাপ লাগার অনুভুতির কথা বলছিলেন, সততাই তা কমাতে পারে। হয়ত তিনি এই আলোচনার মধ্যস্থতা করার প্রস্তাব দেবেন। তিনি ঠিক করলেন যে, সবচেয়ে সোজাসুজি প্রশ্ন দিয়ে কথা শুরু করবেন যাতে সমস্যার গভীরে যাওয়া যায় । তাই তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার সমস্যাটা কি সত্যিই বেদনা, নাকি অপরাধবোধ?’
মিসেস দাস ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে ফিরে তাকালেন। তাঁর শীতল, গোলাপি ঠোঁটের ওপর সর্ষের তেল ঘন হয়ে লেগে ছিল। তিনি কিছু বলবেন বলে মুখ খুললেন, কিন্তু কাপাসির দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তিনি যেন কোনও বিশেষ সত্য উপলব্ধি করে থেমে গেলেন। কাপাসি চূড়ান্তভাবে দমে গেলেন। সেই মুহুর্তেই তিনি বুঝতে পারলেন যে, তিনি যথার্থভাবে অপমান করারও যোগ্য নন। মিসেস দাস গাড়ির দরজা খুলে, তাঁর চৌকো কাঠের হিলের ওপর সামান্য টাল খেতে খেতে হাঁটতে শুরু করলেন। ঘাসের ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে মুঠোভর্তি মুড়ি খেলেন। মুড়িগুলো তাঁর আঙুলের ফাঁক দিয়ে গলে পড়ে রাস্তার ওপর আঁকাবাঁকা চিন্থ রেখে গেল। একটা হনুমান গাছ থেকে লাফিয়ে পড়ে সাদা ছোট্ট দানাগুলো রসিয়ে-রসিয়ে খেল। তারপর আরও মুড়ির খোঁজে মিসেস দাসের পিছনে হাঁটতে শুরু করল। তার জাতভাইরাও যোগ দিল। কিছুক্ষনের মধ্যেই, আন্দাজ আধ ডজন হনুমান মিসেস দাসের পিছন পিছন যেতে লাগলো। তাদের মখমলের মতো লেজগুলো মাটিতে লুটোচ্ছিল। 
কাপাসি গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালেন। তিনি চিৎকার করতে চাইছিলেন, কোনওভাবে মিসেস দাসকে সাবধান করতে চাইছিলেন। কিন্তু তাঁর ভয় হল যে, হনুমানগুলো তাঁর পিছনে আসছে জানলে মিসেস দাস নার্ভাস হয়ে পড়বেন। হয়ত তাঁর ভারসাম্য হারিয়ে ফেলবেন। হয়তো ওরা তাঁর ব্যাগ বা চুল ধরে টানাটানি শুরু করবে। কাপাসি দ্রুত পদক্ষেপে রাস্তা দিয়ে এগোলেন। হনুমানদের তাড়ানোর জন্য মাটি থেকে ডাল তুলে নিলেন। মিসেস দাস কোনদিকে কিছু খেয়াল না করে মুড়ির চিন্থ তৈরী করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। ঢালুর শেষপ্রান্তে, এক শ্রেণিবদ্ধ কক্ষের সামনে পাথরের এক সারি বেঁটেমোটা থাম আছে। মি. দাস সেখানে মাটির ওপর হাঁটু গেড়ে বসে ক্যামেরার লেন্স ফোকাস করছিলেন। বাচ্চারা খিলানে ঢাকা পথে একবার দেখা দিচ্ছিল, আবার লুকিয়ে পড়ছিল। 
‘অপেক্ষা করো’, মিসেস দাস ডাকলেন। ‘আমি আসছি’
টিনা লাফাতে শুরু করল। ‘মা আসছে!’
‘বাহ’, মি. দাস ক্যামেরা থেকে মুখ তা তুলেই বললেন। ‘ঠিক সময়ে এসেছ। মি. কাপাসিকে বলছি আমাদের পাঁচজনের একটা ফোটো তুলে দিতে।‘
কাপাসি তাঁর হাঁটার গতি বাড়ালেন। হনুমানগুলোকে ছত্রভঙ্গ করতে ডালটা হাওয়ায় নাড়ালেন। 
‘ববি কোথায়?’ থেমে গিয়ে মিসেস দাস জিজ্ঞেস করলেন।
মি.দাস ক্যামেরা থেকে চোখ তুললেন। ‘জানি না তো। রনি, ববি কোথায়?’
রনি কাঁধ ঝাঁকালো। ‘এখানেই তো ছিল।’
‘কোথায় ছেলেটা?’ মিসেস দাস কড়া স্বরে আবার জিজ্ঞেস করলেন। ”কী হয়েছে কী তোমাদের সকলে?” 
তাঁরা রাস্তার এদিক-ওদিক গিয়ে ববির নাম ধরে ডাকতে শুরু করলেন। ডাকাডাকির জন্যই প্রথমে ছেলেটার চিৎকার শুনতে পাননি। যখন কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে একটা গাছের তলায় তাকে খুঁজে পেলেন, তখন এক ডজনেরও বেশী হনুমান ঘিরে ধরে তাদের লম্বা কালো আঙুল দিয়ে তার শার্ট ধরে টানছিল। মিসেস দাসের ফেলা মুড়ি হনুমানগুলো হাতে কোরে তার পায়ের কাছে জড়ো করেছিল। ছেলেটে ভয়ে সিঁটিয়ে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে ছিল। চমকে যাওয়া চোখে ঝরঝর করে চোখের জল গড়িয়ে পড়ছিল। তার অনাবৃত পা ধূলোময় হয়ে গিয়েছিল। যে কাঠিটা সে একটা হনুমানকে দিয়েছিল, সেটা দিয়ে হনুমানটা সমানে তার পায়ে আঘাত করার ফলে পায়ে লালা দাগড়া-দাগড়া দাগ হয়ে গিয়েছিল। 
‘বাবা, বাঁদরটা ববিকে মারছে, ‘ টিনা বলে উঠল।
মি. দাস তাঁর হাতের তালু দুটো শর্টসের সামনে মুছলেন। ঘাবড়ে গিয়ে ভুল করে ক্যামেরার শাটার টিপে ফেললেন। ফিল্মের ঘরঘর শব্দে হনুমানগুলো উত্তেজিত হয়ে ববিকে আরও জোরে মারতে লাগল। ‘আমাদের এখন কি করা উচিত? ওরা যদি হামলা করতে শুরু কোরে?’ 
‘মি. কাপাসি,’ কাপাসিকে একপাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মিসেস দাস চিৎকার করে উঠলেন। ‘কিছু একটা করুন, দয়া করে, কিছু একটা করুন।’
কাপাসি তাঁর বা হাতের ডালটা দিয়ে হনুমানগুলোকে তাড়ালেন। যেগুলো থাকলো, সেগুলোকে ‘হুস-হুস’ করলেন, ভয় পাওয়ানোর জন্য মাটিতে পা দিয়ে সজোরে আঘাত করলেন। জন্তুগুলো আস্তে আস্তে মাপা মাপা পদক্ষেপে পিছি হটল। বাধ্য, কিন্তু আদৌ পরাস্ত নয়। কাপাসি ববিকে কোলে তুলে যেখানে তার মা-বাব এবং ভাইবোন দাঁড়িয়ে ছিলেন, সেখানে নিয়ে এলেন। তাকে কোলে নেওয়ার সময় তার লোভ হচ্ছিল ছেলেটার কানে কানে একটা গোপন কথা বলে দেন। কিন্তু ববি হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল, ভয়ে কাঁপছিল। পায়ের কোনও কোনও জায়গায় ছড়ে রক্ত পড়ছিল। কাপাসি তাকে তার মা-বাবার কাছে পৌছে দেবার পর মি. দাস তার টি শার্ট থেকে ধূলো ঝেড়ে ভিসরটা সোজা করে দিলেন। মিসেস দাস তার ঘাসের ব্যাগ থেকে একটা ব্যান্ড-এড বার কোরে ববির পায়ে লাগিয়ে দিলেন। রনি ভাইকে এক টুকরো তাজা চুইং গাম দিতে চাইল। ‘ও ঠিক আছে। শুধু একটু ভয় পেয়ে গিয়েছে। তাই না ববি?’ মি. দাস ববির মাথা চাপড়ে দিলেন। 
‘বাব্বাহ, এখান থেকে বেরোই, চলো,’ মিসেস দাস বললেন। তিনি তার স্ট্রবেরি টি-শার্টের ওপর হাত দুটো ভাঁজ করলেন। ‘এই জায়গায় আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।” 
‘হ্যাঁ, হোটেলে ফিরে যেতেই হবে, নিশ্চয়ই,’ মি. দাস সায় দিলেন। 
‘বেচারা ববি,’ মিসেস দাস বললেন। ‘একবার এখানে আয়। মা তোর চুলটা ঠিক করে দেবে।’ আবার তার ঘাসের ব্যাগে হাত ঢুকালেন। এবার চিরুনিটা বার করে ববির স্বচ্ছ ভিসরের চারপাশে আঁচড়াতে শুরু করলেন। চিরুনিটা টান মেরে বের করার সময় মি. কাপাসির ঠিকানা লেখা কাগজটা বেরিয়ে হাওয়ায় উড়ে গেল। কাপাসি ছাড়া কেউ সেটা লক্ষ্য করলেন না। কাপাসি দেখলেন যে, কাগজটা হাওয়ার দাপটে অনেক ওপরে উঠে গেল। যে গাছগুলোর ডালে হনুমানের দল বসে গম্ভীরভাবে নীচের দৃশ্য দেখছিল, কাগজটা তত উঁচুতে উড়ে গেল। কাপাসিও দৃশ্যটি দেখলেন। তিনি জানতেন যে দাস-পরিবার এই ছবিটিই চিরকাল তাঁর মনে থেকে যাবে। 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত