নারীর নিজের মুক্তির জন্য, নিজের স্বাধীনতার জন্য নিজের উপর নিজেকে আস্থা রাখতে হবে, লড়াইটা নিজেকেই করতে হবে। নারীবাদ বলি কী নারী স্বাধীনতা বা নারী মুক্তি- অর্জন না করলে পাওয়া যাবে না। নরওয়ে নারী-পুরুষের সমতার জন্য একটি পারফেক্ট দেশ বলা চলে। তারপরও এই দেশেও তেমন নারীর সাক্ষাৎ মেলে যে নিজে ডাক্তার হয়েও ডাক্তার স্বামীর ভয়ে তটস্ত থাকে।স্বামী শুধু স্যান্ডউইচ দিয়ে লাঞ্চ করতে চায় না বলে স্ত্রীকে সাথে স্যুপও বানাতে হয়। আর এই স্যুপ বানানোটা ভালোবেসে বানানো না রীতিমতো আতঙ্কিত হয়ে বানানো। এর জন্য নিজের অফিসিয়াল কাজ শেষ কোথাও বসে দু’দণ্ড জিরায় না, পাছে বাসার কাজে দেরী হয়ে যায়। অথচ নরওয়ের সমাজে স্বামী-স্ত্রী সপ্তাহের দিনগুলো ভাগাভাগি করে রান্নাসহ ঘরের যাবতীয় কাজ করার নিয়ম। দেখা যাচ্ছে, আইন থাকলেও সব নারী তা যথাযথ নিতে পারছে না। এমন শিক্ষিত নারীকে কে নারী-স্বাধীনতা এনে দেবে বা তার কাছে নারী স্বাধীনতা বা নারীমুক্তির সংজ্ঞা কী কে জানে! ’ইরাবতীর কথা’ ধারাবাহিকে ইরাবতীকে নারীর অনেক না বলতে পারা কথায় ও রূপে সাজিয়েছেন বিতস্তা ঘোষাল আজ থাকছে ইরাবতীর কথা ধারাবাহিকটির ১৬ পর্ব।
চোখ খোলার পর ঐহিক আর প্রান্তিকে দেখে বিষন্ন ভাবে হাসল ইরাবতী। প্রান্তি তাকে বলল, অসীম কাকু ভোররাতে জানিয়েছে তোমাকে এই হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে। এখন কেমন আছো মা?
ভালো আছি। উঠে বসল ইরাবতী।
আর কিছু বলার আগেই নীল ঘরে ঢুকলো। ইরাবতী তার দিকে চেয়ে বোকার মতো হাসার চেষ্টা করল।
ঐহিক আর প্রান্তি নীল ঢোকা মাত্র বেরিয়ে গেল। নীল ইরাবতীর সামনে এসে দাঁড়ালো। তুমি কী বরাবরই এমন অবাধ্য? আমার তোমাকে শান্ত একটা মেয়ে মনে হয়েছিল।তবে তুমি মারাত্মক জেদি এটা আমি বুঝতে পেরেছিলাম বলেই, ওখানে সাদা পোশাকের পুলিস রেখে দিয়েছিলাম।অসীম জানতো।সেই আমাদের ইনফর্মার।আমাদের জানিয়েছিল, তোমাকে মারার চক্রান্ত হয়েছে।
মানে? ইরাবতী অবাক হল।
নীল গম্ভীর স্বরে বলল, ইরাবতী, তোমাকে বলেছিলাম, এটার মধ্যে না জড়াতে। তবু তুমি যখন জড়ালে, তখন আমার তোমাকে পাহারা দেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।
কিন্তু ওই লোকগুলোর কী হল? ওরা কী ধরা পড়েছে?
সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে নীল বলল, টিভি সিরিয়্যালে সব রহস্যের কী সহজে সমাধান হয়ে যায়, তাই না? কিন্তু বাস্তবটা অতটা সহজ নয়। বেশি জানার চেষ্টা না করে প্রান্তির কথা একটু ভাবা উচিত ছিল। এই প্রচেষ্টা যেন আর দু’বার না হয়। তাহলে আমার আর কিছু করার থাকবে না। এখন এখান থেকে বেরিয়ে সোজা বাড়ি যাবে। তোমার রেস্টের দরকার।
নীলের গলার স্বর অদ্ভুত রকম গম্ভীর। ইরাবতী বুঝতে পারলো না, আদৌ লোকগুলো ধরা পরেছে কিনা! অথচ অনুভব করল, একটা ভয়ঙ্কর কিছু ঘটতে চলেছিল তার সঙ্গে। এতটা রিস্ক তার নেওয়া ঠিক হয়নি এটাও যেমন তার মনে হল, তেমনি অন্য কোনো স্বর যেন তার গভীর থেকে উঠে এসে বলল, ঠিকই করেছ। তুমি তো শুধু প্রান্তির মা নও, ওই বাচ্চাগুলোয় তো তোমাকে মা’ই ভাবে।
কিন্তু নীল কী তাকে প্রচ্ছন্নভাবে হুমকি দিয়ে গেল? সেকী তাহলে জানে সব!
সবাই চলে যাবার পর সন্ধ্যের মুখে বেদভ্যাস এলেন মেয়েকে দেখতে। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, তুমি তোমার মতো ভেবেছ ওদের কথা। কিন্তু তোমার ভাবার বাইরেও একটা অলিখিত কথা চলে, যার নির্দেশ আমরা টের পাই না। তাই জন্যেই প্রশাসন, আইন, পুলিস তৈরি হয়েছিল সেই কোন আদি কালে। তাদের উপর বিশ্বাস নাই থাকতে পারে, কিন্তু তাদের অন্ধকারে রেখে নিজের হাতে সব সমস্যা দূর করে দেব, এই ভাবনাটা নিছক ছেলেমানুষী। বারবার তাই বলি আবেগের সঙ্গে বুদ্ধি আপ্লাই করো, নইলে কোনো কাজই পারফেক্ট হবে না।
তুমি কী আমার উপর রেগে গেছ বাবা?
না। তবে তুমি আরেকটু ম্যাচিওর হয়েছ এটা ভেবেছিলাম। দেখলাম এখনো তুমি দেখতে বড় হলেও বুদ্ধিতে প্রান্তির থেকেও কম।
ইরাবতী খানিকক্ষণ চুপ করে বেদভ্যাসের হাতটা নিজের বুকের মধ্যে ধরে রাখল। তোমাকে কে খবর দিল? প্রান্তি না ঐহিক?
বেদভ্যাস হাসল। তোমার মনে আছে, রঞ্জিতকে? ডিজি হয়েছিল।
হ্যাঁ বাবা। আমাদের বিয়েতেও তো এসেছিলেন। তোমার বন্ধু ছিলেন।
হুম। ওর ছেলে যে এখন পুলিসের বড় কর্তা হয়ে হেড কোয়াটারে এসে গেছে জানতাম না।
কার কথা বলছ?
নীল। ওই রঞ্জিতকে বলেছে। ফেসবুক না কী একটা বলল, সেখানে তোমার সঙ্গে আমার ছবি দেখে বাবাকে জানিয়েছে। বহু আগে যখন তুমি খুব ছোটো ছিলে ওদের বাড়ি গেছিলাম, ওদের খুব ইচ্ছে ছিল তোমার সঙ্গে ছেলের বিয়ে দেওয়ার। সেতো হল না। বেদভ্যাস থামলেন।
ইরাবতী বুঝতে পারল না নীলের সঙ্গে তার নিয়ে না হওয়ায় বাবার মনে আক্ষেপ আছে কিনা! এ সম্পর্কে একটা কথাও সে কোনো দিন শোনেনি বাবার মুখে।
বেদভ্যাস যেন তার মনের কথাগুলো পড়ে ফেললেন। তিনি বললেন, বিয়েটা সাত জন্মের। কাজেই কার সঙ্গে শেষ অবধি বাঁধা পড়বে, সেটা কারোর পক্ষেই বোঝা সম্ভব নয়। তবে, আমি মনে করি, প্রকৃত বন্ধু পাওয়া খুব ভাগ্যের। স্বামীর তুলনায় তারা অনেক বেশি সুখে দুঃখে পাশে থাকবে, যদি তার সঙ্গে টেবিল ডিসট্যান্স রাখা যায়।
ইরাবতীর সেই মুহূর্তে মনে হল, বেদভ্যাস তাকে এক সঙ্গে দুটো আদেশ দিল। নীলের সঙ্গে বন্ধুত্ব গভীর রাখলেও যেন কখনোই মাখামাখি সম্পর্ক না হয়, আর ঐহিককে সে কখনো ছেড়ে না যায়।
সে চুপ করে থাকল। তার অবাক লাগল নীল তাকে বা তাঁর বাবাকে চেনে একথা আগে কখনো কেন বলেনি ভেবে।তবে কী বিয়েটা হয়নি বলে! আর তখনি তার মনে পড়ল, নীল এখনো বিয়ে করেনি। জিজ্ঞেস করায় একবার বলেছিল, যার সঙ্গে বাবা মা ভেবে রেখেছিল, সে অন্য কাউকে বিয়ে করেছে। তাই আর … পরমুহূর্তে হেসে বলেছিল, যে চাকরীতে আছি, তাতে বিয়ে করলে নিত্য অশান্তি অবধারিত। তার থেকে এই বেশ ভালো আছি।
বেদভ্যাস মেয়েকে আদর করে বাড়ি ফিরে গেলেন। ইরাবতী এখন রুমে একা শুয়ে।আজকের দিনটা ডাক্তার ভরতি রাখলেন অবসারভেসনের জন্য।
একটু আগে নার্স এসে নার্ভ শান্ত রাখার ওষুধ দিয়ে গেছে।
ইরাবতী বলেছিল, ঘুমের ওষুধ দেবেন না, মাথায় কষ্ট হয় খুব। উত্তরে রম্ভা নামে সুন্দরী মেয়েটি জানিয়েছে, এখন কোনো পেশেন্টকে ঘুমের ক্যাপসুল দেওয়া যায় না। মর্ডান মেডিক্যা্ল সায়েন্স নার্ভ শান্ত রাখার মেডিসিন প্রেস্ক্রাইবড করে।
সেই ওষুধ খাবার কিছুক্ষণ পর থেকে ইরাবতীর চোখের পাতা বুজে আসছে। ঘুমে তলিয়ে যাবার আগে মনের মধ্যে কিছুদিন আগে কোথাও একটা পড়া কতগুলো শব্দ ঘুরপাক খেতে লাগল।
মানুষ চেনা সবচেয়ে দুঃসাধ্য কাজ। অথচ বিভিন্ন সম্পর্কের পথ ধরে সেই ‘মানুষের’ কাছেই হেঁটে যেতে হয়। যে মানুষ বিশ্বাসের নিটোল পাত্রখানি ভেঙে খানখান করে দিল— সেই মানুষটার কাছেই গিয়ে দাঁড়াতে হয় নিজের ভাঙাচোরা মনটা নিয়ে।পৃথিবীর সব শব্দ শোনা যায় না। তাই বুঝতে পারি না কে কখন কোথায় কীভাবে ভেঙে খানখান হয়ে গেছে। অথচ এ জীবন তো শুধুই ভালবাসবার…
বিতস্তা ঘোষালের এই ধারাবাহিকটির আগের পর্বগুলো ও অন্যান্য লেখা পড়তে ক্লিক করুন।
![বিতস্তা ঘোষাল](https://irabotee.com/wp-content/uploads/2019/05/IMG_20190529_160333-1-150x150.jpg)
কবি,কথাসাহিত্যিক,সম্পাদক ও প্রকাশক