ইরাকি অনুবাদ কবিতা
২০০৩ সালের কথা। মার্কিন হামলায় ইরাক তখন বিধ্বস্ত! ‘টেলিভিশনের পর্দায় সকলে দেখছিলেন যুদ্ধের ছবি, যুদ্ধের বাস্তব, বুশ-ব্লেয়ারের ইরাক অভিযান। সাধারণ চলচিত্রে চেনা জীবনছবিও আমাদের কাছে খানিকটা দূরের হয়ে যায়, কেননা আমরা জানি যে এটা শিল্পমাত্র। ওইসব যুদ্ধের ছবিও মূহুর্মূহু তেমনি অবাস্তব করে দিচ্ছিল ঘোর বাস্তবকে। যা দেখছি তা কি সত্যিই দেখছি? ছোটো-বড়ো বাড়িঘর চোখের সামনে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে আধুনিকতম শস্ত্রে, পথেঘাটে লুকিয়ে থাকছে শব, কিংবা আতঙ্কে দৌঁড়াচ্ছে সবাই : আর আমরা ঘরে বসে দেখছি তার চিত্ররূপ।’
ঠিক সেরকম একটি সময়ে সুপরিচিত ইরাকি কবির গুচ্ছকবিতার অনুবাদ (বলা উচিত, অনুবাদের নির্মাণ আর সৃষ্টি) শুরু করলেন কবি শঙ্খ ঘোষ। এ কি শুধু অনুবাদ? এ বিষয়ে শঙ্খ ঘোষের সংশয়হীন অভিপ্রায় আর অভিব্যক্তি স্মরণ করতে গিয়ে উৎসাহিতবোধ করছি। ১ ফেব্রুয়ারি, ২০১০ সালে লিখেছেন তিনি— কোনো-একটা ইংরেজি অনুবাদের ওপর নির্ভর করে, তার থেকে স্বাধীনতা না নেবারই সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি ঠিকই, তবু এর সেই ছায়াচ্ছন্নতা যাবার নয়। আর, সেকথাটুকু ছেড়ে দিলেও, কবিতাগুলির নিজস্ব চরিত্রেও আছে হয়তো একটা ছায়াভরা টানই। অনুবাদ নয়, এ সংগ্রহের নাম তাই ‘ইরাকি কবিতার ছায়ায়।’
ইচ্ছাপত্র
সময় যখন পালটে গিয়েছে এমনই একটা সময়ে
কবিদের কাছে দিয়ে দিই
গৌরবভার,
মসনদ, আর
রাজদণ্ডও, আর
স্বচ্ছ আমার শখের কাছে রেখে দিই।
দিনের খুঁটিনাটি
তার প্রথম ফুলটি ফুটিয়ে
নেমে আসছে নিঃসঙ্গ আলো
আমার বাড়ির জানলায়।
একে একে জাগিয়ে দিচ্ছে ঘড়িগুলিকে
চটপট খাইয়ে নিচ্ছে আমাকে আমার সকালবেলাকার খাবার
তারপর চলে যাচ্ছে ।
♦ ♦ ♦
ওয়াগনের জানলার ওপর এক ঝলক আলোয়
পড়ে নিই সময়।
সে নিয়ে যাচ্ছে আমার যতকিছু কাজকর্ম
আর পারিবারিক দায়।
কাজেই ভেবে দেখো—
এক ঝলক আলোতেই আমার
দিন শুরু করে দেওয়া ভালো।
কবি: ফারুক সালুম (১৯৪৮)। বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি পড়েছেন। ইরাকের তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রকের শিশুসাহিত্য বিভাগের ভূতপূর্ব ডিরেক্টর জেনারেল।
বীর
ওকে ওর নাম ধরে ডেকো না কখনো।
ও এখন আমাদের সকলেরই নাম নিয়ে পেয়েছে বিরাম।
কেউ যেন ঘর ছেড়ে বেরিয়ো না আজ
ফুল ছাড়া।
হয়তো-বা একদিন তোমারই ঘরের পাশ দিয়ে চলে যাবে।
কী দিয়ে সাজাবে তার বুক?
ওরই মতো কোনো এক দীপ্যমান তারা
গড়ে তোলো শহরে শহরে
প্রতিটি বাগানে, স্কুলে স্কুলে।
নিজের হৃদয়ে নাও টেনে
ফুসফুস ভরো ওরই ঘ্রাণে
কাছে এসে দাও আলিঙ্গন।
করে দাও পথ ওকে
প্রিয়তম আসনে বসাও।
যখন ও আসে, জেনে নাও কাজের গোপন কথাগুলি।
কীভাবে ও হলো এত বীর
কীভাবে-বা ছুঁয়ে দিল নক্ষত্রমণ্ডল, হলো জয়ী।
জেনে নাও কাজের গোপন কথা
কীভাবে মূত্যুর সঙ্গে দেখা হলো, কীভাবে মারলও তাকে,
এত-যে বুলেটধারা বর্ষণের মতো
কীভাবে দাঁড়াল তার মুখোমুখি।
ও যদি তোমার কাছে আসে, জেনে নাও
ওর কি বাসনা ছিল কিছু?
ফিরিয়ো না ওকে।
তোমার দিকে পথ
সূর্যে ছিল কমলার স্বাদ,
গাছে ছিল তীব্র সবুজাভা,
রাস্তার ঝলক ছিল কালো এক নদীর মতন,
যাব যে তোমার দিকে
পথ ছিল গানে গানে ভরা।
যাব যে তোমার দিকে
পথ ছিল রেলপাতা মাতাল ট্রেনের মতো
লক্ষ্য-অভিমুখী ।
যাব যে তোমার দিকে
কাগজের নৌকো এই পথ,
নীচে বয়ে যায় জল, উপরে বূষ্টির ধারা ঝরে—
কেবলই তোমার দিকে যেতে থাকে তবু।
কবি: সাইদা আল-মৌসবি (১৯৫০)। জন্ম বাগদাদে। ইরাকি মহিলাদের জন্য গঠিত ফেডারেশনের পরিচালিকা। কবিতার বই : ‘তালগাছের শিশু’ (১৯৭৮), ‘খেজুরগুচ্ছ’ (১৯৮৬)।
মাছ
আমার রক্ষীরা হলো অন্ধ ঘাস,
উদভ্রান্ত ময়ূর,
পচা আপেল খাবার লোভে উৎসুক ঘুঘু,
মেঘের প্রান্তে দিগন্ত থেকে ছড়িয়ে-দেওয়া ধুলো।
রক্ষীরা আসে আর যায়
জলের ওপর দিয়ে গড়িয়ে-যাওয়া তরুশাখার মতো।
আর আমি, একটা মাছের মতো
রক্ষীদের উপচে-পড়া ছায়ার মাঝখানে ঘুরতে থাকি।
প্রতিভা বিষয়ে
রাজকুমারেরা হাজির ছিল, ছিল না বাজারের ভিখারিরা।
যুদ্ধের পোশাক খুলে ফেলল তারা,
সখ্য করতে চাইল আমার দিনগুলির সঙ্গে।
আমিও তেমনি চাইলাম আমার দিনগুলিকে, আর ঝিমোতে লাগলাম।
আর কয়েকবছর পর, লোকে বলল
রাজকুমারেরা বুনে গেছে তোমার হাতের উপর এক
চিরহরিৎ শাখা।
তারপর তারা চলে গেল, আর এইবারে চলে এল ভিখারির দল।
কবি: ফারুক ইউসুফ (১৯৫৫) বাগদাদে জন্ম। কবিতার বই : ‘স্থিরতার কবিতা’, ‘রাজপুত্রদের দলের পরে আসেন দেবদূত’।
জন্ম ৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩২। কবি, সাহিত্য সমালোচক ও বিশিষ্ট রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ। তার প্রকৃত নাম চিত্তপ্রিয় ঘোষ। যাদবপুর, দিল্লি ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপনাও করেছেন। বাবরের প্রার্থনা কাব্যগ্রন্থটির জন্য তিনি ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ২০১৬ খ্রিঃ লাভ করেন ভারতের সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মান ,জ্ঞানপীঠ পুরস্কার। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে, উর্বশীর হাসি, ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ ইত্যাদি।
I don’t have the audacity to comment.Translation must have the feel for the language from which it has been translated.
These poems are not an exception to this.