মেডিকেল ইন্সিওরেন্স ছাড়া একটা বাইপাশ সার্জারী সামাল দিতে গিয়ে মঞ্জরী একেবারে জেরবার হয়ে গেছে। তিন বছরের বিবাহিত জীবনে কতটুকুই বা সঞ্চয় থাকে, তবে বেশীরভাগ টাকাটাই মঞ্জরীর দাদাই যুগিয়েছেন। তখন মঞ্জরীর এছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। অরবিন্দ ভাল কোম্পানীতে কাজ করে ঠিকই, সেখান থেকে যে কিছুটা সাহায্য পায়নি তা নয়। এদিকে পোস্ট অপারেশন কেয়ারও কিছু কম নয়, সব মিটিয়ে ঋণ পরিশোধের টাকা প্রতি মাসে সময়মত যোগান দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। যদিও দাদা কখনোই কোন তাগাদা দেন না তবুও অস্বস্তি যাবে কোথায়। সুখের কথা একটাই অরবিন্দ আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠছে।
একটা স্তর পযর্ন্ত লেখাপড়া শেখা, দু’একটা ডিপ্লোমা কোর্স করা, বিয়ের আগে অনেক মেয়েই করে থাকে। তখন একটা চাকরী বাকরী করার কথা মনে হয়। বিয়ের পর আর সেই ইচ্ছেটা ততটা থাকে না। মঞ্জরীর যেটা আসল ব্যাপার সেটা হল ওর গান, বছরে একবার কি দুবার রেডিওতে রবীন্দ্র সঙ্গীতের প্রোগ্রাম পায়। এছাড়া রবীন্দ্র জয়ন্তীর সময় স্থানীয় ভাবে এখানে ওখানে গান গাওয়ার আমন্ত্রণ পায়।এটাকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করার কথা কখনো ভাবেনি। এই জগতে টিকে থাকতে হলে বা নিজেকে একটা উচ্চতায় তুলে নিয়ে যেতে হলে পারদর্শীতা, প্রতিভা লড়াই ছাড়াও আনুষাঙ্গিক আরো কিছু ব্যাপার স্যাপার আছে যেগুলো প্রায়শই তার কানে আসে কিন্তু তার সঙ্গে সমঝোতার কথা কখনো ভাবতে পারেনা। তাই এটাকে শখ হিসাবেই রেখে দিয়েছে। কিন্তু এখন কিছু একটা না করলেই নয়।
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তিন চারটে খবরের কাগজ দেখে। অরবিন্দর জন্যে সকাল সন্ধ্যে দুজন আয়া আছে। সপ্তাহে দুদিন গানের টুউশনি করে। সে আর কতই বা। কাগজে দাগ দেয়, এ্যাপ্লিকেশন পাঠায়, কিন্তু সেভাবে কোন উত্তর আসে না। সেদিন বিজ্ঞাপনে ওয়াক ইন ইন্টারভিয়্যু, পাবলিক রিলেশন অফিসার নেবে। পোস্টটা শুধুমাত্র মেয়েদের জন্যে। পাবলিক রিলেশনের ওপর একটা ডিপ্লোমা কোর্স করা ছিল মঞ্জরীর। কোথায় যেন একটা আশার আলো দেখতে পেল। কনশার্নের নামটা দেখার পর আর কোন সন্দেহ রইল না, রূপশ্রীর বর ওখানে একটা উঁচু পদে আছে না! রূপশ্রীর সাথে স্কুলে কলেজে একসঙ্গে পড়েছে। এখনো যোগাযোগ রয়ে গেছে দুজনের মধ্যে। এই তো অরবিন্দের অপারেশনের সময় রোজই সন্ধ্যেবেলা ফোন করে খবর নিত। এমনিতে খুব ভাল মেয়ে, এখন শুধু একটা ফোনের মামলা।
সেদিন ইন্টারভিউ দিয়ে মঞ্জরী যখন বেরিয়েছে ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। রাস্তার ধারে একটা টেলারিং শপের টিনের শেডের তলায় এসে দাঁড়াল। সকাল দশ’টায় এসেছিল, এখন চারটে বেজে গেছে। বৃষ্টি মধ্যে বাসস্ট্যাণ্ডের দিকে যেতে হলে পুরোটাই ভিজে যাবে। জনা পাঁচেক মেয়ে এসেছিল, তার মধ্যে ওই হাঁটু ছেঁড়া জিনস পরা মেয়েটিকে দেখতে বেশ ভাল, তবে একটু আপস্টার্ট মনে হল। মঞ্জরীর এই একটা মুস্কিল, কোন একটা সুন্দরী মেয়ে থাকলে হীনমন্যতায় ভোগে, আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি দেখা দেয়। কারণ সে নিজে জানে যতই সাজগোজ করুক না কেন তার চেহারায় কোন চুম্বকীয় আকর্ষণ নেই। কারুর দৃষ্টি আকর্ষণ করবে সে ক্ষমতা তার নেই। যদিও রূপশ্রী আছে, তবুও ওই মেয়েটা মনের মধ্যে একটা কাঁটা পুঁতে দিয়ে গেছে।এদিকে বৃষ্টি সহসা ছাড়বে বলে মনে হয় না।
হঠাৎই একটা সাদা রঙের হোন্ডা সিটি একেবারে ফুটপাতের কাছে এসে পার্ক করল। সামনের দরজাটা খুলে ড্রাইভারের সীট থেকে মাথা নিচু করে মঞ্জরী উদ্দেশ্য ডাক দিল
– মিসেস রায় মুখার্জি, উঠে আসুন, এই বৃষ্টির মধ্যে আর কতক্ষণ দাঁড়াবেন?
প্রথমটা মঞ্জরী ঠিক বুঝতে পারেনি, ছাতাটা মাথায় দিয়ে এগিয়ে এসে চমকে গেল। আরে! এতো সঞ্জীবনবাবু। রূপশ্রীর বর, এই খানিক আগে যাঁর কাছে ইন্টারভিউ দিয়ে এল। এতখানি সংবেদনশীল বলে তো মনে হয়নি তখন। তবে কি মেয়েদের সম্পর্কে কোন দুর্বলতা আছে! রাস্তার মাঝখানে তাকে দেখে অযাচিত লিফটের অফার, এতো অভাবনীয়।
– আরে কি হল উঠে আসুন।
ছাতা বন্ধ করে গাড়ীর মধ্যে উঠে এলো মঞ্জরী। সামনের উইন্ডস্ক্রিন জলের ঝাপটায় ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে, পরমুহুর্তেই ওয়াইপার অনেকটা স্বচ্ছতা এনে দিলেও কিন্তু মঞ্জরীর মনের মধ্যের ঝাপসা ভাবটা কিন্তু কাটছে না। কোন কথা না বলে রুমাল দিয়ে মুখটা মুছছিল। চমক ভাঙ্গল সঞ্জীবনের কথায়
– আপনাকে কোথায় ড্রপ করব? ঘাড় ঘুরিয়ে সঞ্জীবনের দিকে তাকাল, ওয়াইপারের ওঠানামার মধ্যে দিয়ে সোজা রাস্তার দিকে তাকিয়ে সাবধানতার সঙ্গে ড্রাইভ করে চলেছেন। বাধ্য হয়েই প্রতিপ্রশ্ন করল
– আপনি কোথায় যাবেন?
– আমি তো এখন ফিরব না একটা সাইট দেখতে ঠাকুর পুকুরের দিকে যেতে হবে।
– আমি দমদমে যাব, আমাকে যেকোন একটা মেট্রো স্টেশনের সামনে নামিয়ে দিন।
– তাই কখনো হয়! রূপশ্রী জানতে পারলে যা তা বলবে। চলুন না গল্প করতে করতে দমদম পৌঁছে যাব। তারপর দমদম থেকে ঠাকুরপুকুর।
– সেদিন কিন্তু ওই গানটা অসাধারণ গাইলেন।
– কোন গানটা কোথায় গাইলাম?
– আরে বাবা রেডিওতে, ছিন্ন শিকল পায়ে নিয়ে পাখী যা উড়ে, ওটা আবার একটু শুনতে ইচ্ছে করছে।
– আপনি রেডিও শোনেন? রবীন্দ্রসঙ্গীত!
– হ্যাঁ। বিশ্বাস হচ্ছে না, আপনার পরের গানটা একসময় আমি স্টেজে গেয়েছিলাম রক্তকরবী নাটকে।
– বিশু পাগল? আপনি নাটক করতেন।
– না করার কি আছে। তাবলে এখন আর গাইতে পারব না। অনেক দিনের অনভ্যাস। শিল্পকে একবার ছেড়ে দিলে সে আর ফিরে আসে না। যাকগে আপনার গানটা ধরুন তো! অফিসের মধ্যে একবার মনে হয়েছিল, সেটা বাড়াবাড়ি হয়ে যেত। যতই হোক আরো অনেক ক্যান্ডিডেট ছিল। তবে আপনাকে যে এখানে পেয়ে যাব সেটা ভাবতেও পারিনি।
উইন্ডস্ক্রিনে আবার একটা জলের ঝাপটা গোটা কাঁচটা ঝাপসা হয়ে গেল। ওয়াইপারটা কি খারাপ হয়ে গেল, মঞ্জরী সামনের দিকে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না।
– দিদি দোকানে উঠে আসুন রাস্তায় জল জমে গেছে, শুনেছেন কোথায় বাজ পড়ল আর কত দূরে জমা জল পায়ে লেগে ভদ্রলোক মারা গেলেন।
একধাপ উঠে দাঁড়াল মঞ্জরী। অনেকদিন আগে কলেজে পড়াকালীন শর্টফিল্মের একটা ওয়ার্কশপ এ্যান্ডেন করেছিল। তারপর থেকেই সময় কাটাতে হলে মনে মনে একটা চিত্রনাট্য তৈরী করে ফেলে। তবে আজকেরটা নেহাতই মামুলি। ইচ্ছাপূরণের গল্প হলেও এরকমটা হয় নাকি। সাঁ সাঁ কত গাড়ী যাচ্ছে, কেউ এই বৃষ্টির মধ্যে গাড়ীর দরজা খুলে লিফট দিতে চায়? পাঁচের দশকের চিত্রনাট্যেও এতখানি অবাস্তব কেউ লিখত না।
অনেক আশা নিয়ে সকাল দশটায় এসে, সেই থেকে বসে ছিল মঞ্জরী, ডাক পড়ল সাড়ে তিনটের পর সবার শেষে। প্রথমেই একটা ফরম ফিল আপ করতে হয়েছিল। তাতে নিজের নাম ও অন্যান্য কলাম গুলি ফিল আপ করে জমা দিয়েছিল। চিফ ম্যানেজারের চেম্বারে ঢোকার পর মঞ্জরীর ফরমটা টেবিলে পড়ে থাকতে দেখেছিল। তবুও তার নাম জিজ্ঞাসা করা হল। সঞ্জীবনবাবু সেটা লিখলেন সামনে পাতা ওলটানো একটা ডেট ক্যালেন্ডারে।দিন-বদলের সঙ্গে পাতা ওল্টানোর সাথে সাথে মঞ্জরী যে অতীতে চলে যাবে তা তখনই বুঝতে পেরছিল । আর কিছু জিজ্ঞাসা করা হয়নি। তবু সে দাঁড়িয়েছিল, কানে মোবাইল ফোন লাগিয়ে জিজ্ঞাসু চোখে সঞ্জীবনবাবু তাকাতে, ডুবন্ত মানুষের কুটো ধরার মতন, রূপশ্রীর নামটা একবার বলেছিল। চোখের ভ্রুকুটি কপালের কুঞ্চন দেখে পরবর্তী নির্দেশের জন্যে আর অপেক্ষা করেনি।
ব্যাগের মধ্যে মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। আয়া, পাঁচটা বাজচ্ছে, ও চলে যাবে।
এক কাজ করো, তুমি তালা দিয়ে চাবিটা লেটার বক্সে ফেলে দিও, দেখো কেউ যেন না দেখে। না আর অপেক্ষা করা যাবে না। তিনগুণ বেশী ভাড়া হলেও উবার’এর সন্ধান করে চলল সে ফোনে।
গল্পকার ও ঔপন্যাসিক । ফিচার লেখেন মাঝে মাঝে মজার সব বিষয় নিয়ে । আনন্দবাজার পত্রিকা , দেশ , বর্তমানের মতো প্রথম শ্রেনীর কাগজে গল্প লিখেছেন । অবগুণ্ঠন , শতানীক , শ্রমণের মতো ছোট কাগজেও তাঁর অবাধ বিচরণ । তাঁর বেশ কিছু বই রয়েছে ।প্রথম জীবনে চুটিয়ে নাটক করেছেন । প্রাক্তন পুলিশ কর্মী সুব্রত বসু বর্তমানে পুরো দমে লেখক । বহু সংকলনে তাঁর গল্প প্রকাশিত ।