| 1 সেপ্টেম্বর 2024
Categories
কবিতা সাহিত্য

কবিতা: জুলাই বিপ্লব । শেলী জামান খান

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

 

আমার কাছে মানুষের চেয়ে বড় কোন মতবাদ নেই, জীবনের চেয়ে বড় কোন শ্লোগান নেই

 

আমার কাছে মানুষের চেয়ে বড় কোন মতবাদ নেই।

জীবনের চেয়ে বড় কোন শ্লোগান নেই

 

আমি ঈশ্বরের কাছে বহুবার প্রার্থনা করেছিলাম,

হে ঈশ্বরবিশ্বময় এই যে নরহত্যা চলছেতুমি তা বন্ধ কর

ঈশ্বর শোনেনি!

হয়তো তিনি কালাবোবা এবং অক্ষম

অথবা ঈশ্বর বলে আদৌ কেউ নেই

 

হে ক্ষমতার ঈশ্বরীতাইতোমার  কাছেই মিনতি করছি,

আমাদের ক্ষমা কর

আমাদের এবার অব্যাহতি দাও।

আমাদের শোক করার জন্য একটু সময় দাও

রক্তাক্ত লাশের উপর দাড়িয়ে জয়ের পতাকা ওড়ানো  ক্ষনিকের জন্য হলেও বন্ধ কর!

 

আমাদের সন্তানের রক্তে স্বাধীনতার পতাকার রং ধূসর হয়ে গেছে।

হাতটা ধুয়ে নাও। 

তবুও,  রক্তের দাগ এবং গন্ধটা হয়তো থেকেই যাবে!

লেডি ম্যাকবেথের মতএই গন্ধ হয়তোআমৃত্যু তোমাকে তাড়িয়ে বেড়াবে

অথবাতুমি এরও উর্ধ্বে,

কোনকিছুই তোমায় আর স্পর্শ করে না। 

 

জানিতোমার বুকে প্রতিশোধের আগুন এখনও দাউ দাউ জ্বলছে!

এই আগুন নেভাতে আরও কত নরবলী দিতে হবে

আরও কতবার তোমায় করতে হবে রক্তস্নান?

আরও কতটা ঋণ শোধ করলে আমরা ঋণ মুক্ত হবো

আরও কতটা নতজানু হলে আমাদের তুমি মুক্তি দেবে

 

রাজাকার গালিটা আমাদের বুকে শেলের মত  বিঁধেছিল। 

পক্ষপাতের অভিশাপে অভিশপ্ত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ,

স্বাধীনতা হয়েছে প্রশ্নবিদ্ধ,

জয়বাংলা শ্লোগানটিও করেছো কুক্ষিগত

 

তবুও দোহাই তোমাকে

একটু সবুর কর

আমাদের একটু সময় দাও।

প্রিয়জনের লাশ গুলো

সৎকার করতে দাও!

ওদের বুকের রক্ত ধুয়েমুছে,

সাদা কাফনে জড়িয়ে মাটির গভীরে ঘুম পারাতে একটু সময়তো লাগবেই

 

মা বুক চাপড়ে কাঁদছে,

বাবা আহাজারি করছে,

ভাইবোনগুলো ওদের রেখে যাওয়া জামাকাপড় বুকে জড়িয়ে গন্ধ শুঁকছে!

একটু সময়তো তাদের দিতেই হবে!

 

এই টগবগে তরুনরা দেশটাকে বড় ভালোবাসতো।

তারা বোনেরমায়েরপিতার মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছিল। 

একটা সুন্দর আগামি চেয়েছিল।

তারা হয়তো,  বিশ্ব জয়ের স্বপ্নটাও দেখতো।

 

তাদের চাওয়াটা খুব বেশী ছিল না!

তাও তুমি মেনে নিতে পারলে না?

একবার পরপারে চলে গেলে,

এই পাওয়া আর নাপাওয়ায়  কীবা এসে যায়?

দোহাই তোমার

ওদের মৃত্যুকে প্রশ্নবিদ্ধ কোর না আর

 

২০২৪রক্তাক্ত জুলাই,  তোমারও পরিচয় হল

বাহান্ন আর একাত্তরের সাথে!

তুমিও জেনে গেলে,

আমাদের পিতৃপুরুষরা কেন রক্ত দিয়েছিলবুলেট খেয়েছিল বারবার!

আবেগভাসা  বাংলার মানুষতারা জানেনাকাকে বলে স্বাধিকার।

তারা চেয়েছিল একমুঠো ভাতএক চিমটি নুন,

আর কথা বলার অধিকার

 

আমার কাছে মানুষের চেয়ে বড় কোন মতবাদ নেই।

জীবনের চেয়ে বড় কোন শ্লোগান নেই

 

 

 

 

 

আমি জানতাম না চব্বিশের জুলাইটা এত দীর্ঘ হবে

 

আমি জানতাম না চব্বিশের জুলাইটা এত দীর্ঘ হবে,

আমি জানতাম নাঅগাস্টকেও  রাহুর মত গ্রাস করবে এই রাক্ষুসী জুলাই

আমরা গুণে চলেছি৩২৩৩৩৪৩৫৩৬ জুলাই 

আরতো পারি না…!

আর কতআরও কত দীর্ঘ হবে তুমি জুলাই

এবার থামোথামতে তোমাকে হবেই।

 

এখন আমি আর ঘুমাতে পারি না,

আমার দম বন্ধ হয়ে আসে,

আমার সামনে দুমড়েমুচড়ে পড়া ইয়ামিনের শরীরটা কুঁকড়ে থাকে

আমি ঘুমাতে গেলে দেখতে পাই

সকালে চোখ খুললেও দেখতে পাই

ইয়ামিনের ফুসফুসটা তখনও একটু অক্সিজেনের জন্য তড়পাচ্ছে।

 

আমি চোখ বুজলেই আবু সাঈদ আমার সামনে এসে দাঁড়ায়,

দীপ্তরুদ্রফারহানহৃদয় আর শান্তরা এসে ভীর করে

তাদের বুক থেকে গড়িয়ে পড়া রক্তে আমার ঘর ভেসে যায়,

আমি কী করে ঘুমাই বল

 

ভয়েপ্রবল তৃষ্ণায়  আমার গলা শুকিয়ে যখন খটেখটে হয়ে যায়,

মুগ্ধ এসে বলেপানি লাগবেপানি

আমি পানির জন্য হাত বাড়াই,

তাকিয়ে দেখিমুগ্ধর হাত থেকে পানির বোতলগুলো গড়িয়ে পড়ছে,

মুগ্ধর কপালের ফুটো থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরছে।

বলআমি কী করে পানি পান করবো

 

আমি শুনতে পাই

ভীততাড়িত তৃষাঅনবরত কড়া নেড়ে বলছে,

দরজাটা একটু খুলুন প্লিজদরজাটা একটু খুলুন।

আটলান্টিক সাগরের এই পাড়ে

আমি এক দুখিনি মা

সারা রাত দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকি। 

আহাআমার মেয়েটি একটু আশ্রয় যেন পায়। 

 

সানসেডে  টারজানের মত ঝুলতে থাকা ছেলেটির কথা মনে পড়ে

কী ভয়ার্তকী অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে ছেলেটি। 

পুলিশের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেল ওর পলকা নিম্নাঙ্গ,

তখনও সে প্রশ্নবোধক চিণ্হের মত ঝুলে আছে। 

 

শুধু জুতা হারাতো বলে কত বকা খেতো ঐটুকুন ছেলে

তার মা আজ ছেলের জুতোজোড়া বুকে চেপে কাঁদছে,

 জুতাজোড়া এখনও আছেকেবল তার ছেলেটা নাই। 

 

আমার বুকের ভেতর ক্রমাগত ধ্বশ নামে,

আমি রক্তাক্ত হই

ক্ষোভের আগুনে আমি পুড়ে যাই। 

প্রবল ঘৃণায় আমার মুখে থুথু জমে।

স্বৈরাচার তুমি নিপাত যাও!!

 

ছিঃতুমি এতটা  অমানুষ

তুমি এতটা নিষ্ঠুর!

তুমি এমননি সাইকোপ্যাথ!

তোমার যিঘাংশা এত ক্রুরআমরা বুঝতে পারিনি।

আরও কতগুলো মানুষ হত্যা করলেতোমার বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ হবে

 

ক্ষমতার দাপটে তুমি অকালবোধন করলে

রক্তপিপাসু তুমিনরবলী দেবে বলেই হয়ত

পুজোর আয়োজন করলে ভরা বর্ষায়,

ছল করেপথে নামিয়ে আনলে রক্তজবাপলাশশিমূল আর কৃষ্ণচূড়ার দল,

তাদের লালে রন্জিত হল বাংলার পলিমাটি আর রাজপথ।

 

আমি চাইতোমার উপর অভিশাপ নামুক

এই বাংলার আকাশবাতাস আর গণমানুষের অভিশাপ

বাংলার পলিমাটির অভিশাপ,

পলাশশিমুলকৃষ্ণচূরা আর রক্তজবার অভিশাপ,

এই বাংলায় তোমার যেন আর হয় না ঠাঁই!!

 

৩৬ জুলাইয়ের নতুন সূর্যএক নতুন খবর দিলো,

দীর্ঘতর জুলাই  শেষ হয়েছে। তোমরা আনন্দ কর,

ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে দেয়ার সময় এসেছে আজ। 

আজ ৫ অগাস্ট। দেশ রাহুমুক্ত হয়েছে,

স্বাধীনতার আনন্দে আমার দুই চোখের পাতা বুজে এলো

এবার আমি একটু ঘুমাতে চাই

 

 

 

 

 

প্রজন্মের জাগরণ শুনি

 

তোমরা আমাকে  ডায়াসপোরা বল, 

আমি মেনে নিয়েছি!

তোমরা আমাকে প্রবাসি বল, 

আমি মেনে নিয়েছি।

কিন্তু ভুলে যেও না,

একজন যাযাবরসে কিন্তু নিজের মাতৃভূমিকে ভালোবাসে!

মাতৃভূমির জন্য তারও মন কাঁদে।

 

এই পরদেশে,

আমার  বুকের উপর কেউ কখনও বন্দুক তাক করে না! 

কেউ আমার কণ্ঠরোধ করে না! 

তবুও আমার দিনরাত এক হয়ে গেছে। 

আজকাল আমি ঘুমাতে পারিনা।

 

আমার বুকের ভেতর ঘুমিয়ে থাকা ‘একাত্তর’ জেগে উঠেছে।

আমি হন্যে হয়ে ফেইসবুক,

ইনস্ট্রাগ্রামইউটিউব স্ক্রল করি!

উদভ্রান্তের মত ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকি!

একটি মানচিত্রের খোঁজে!

 

একাত্তরে আমাদের দরজায় দরজায় কড়া নড়েছিল, 

মুক্তি হ্যায় কেয়া ঘার মে?’

আজও দেখিঢাকার রাজপথেসেই খাকি প্যান্টের টহল,

জলপাই রঙা ট্যাঙ্কের বহর! 

গভীর রাতে দরজার খটখট,

ঘরে ছাত্র কে আছেছাত্র আছে ঘরে?’

 

আজও আন্দোলনে উত্তালদেশের রাজপথ,

রক্তে রন্জিতনির্ঘুম শহর!

চোখ বুজলেই দেখতে পাইসাইদমুগ্ধশান্ত আর সৌহার্তের মুখ!

ওরা সংখ্যায় অগুনতি

জনের নাম লিখবো আমার কবিতায়? 

তরুন বয়সে আমার বুকেও এমনি  প্লাবন এসেছিল, 

তাইতো আমার উষ্ণ রক্তে 

আমি প্রজন্মের জাগরণ শুনি।

 

প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে,

যুগে যুগেকালে কালে তরুনরাই  প্রাচীর ভেঙ্গেছে।

ফাইয়াজদীপ্তরুদ্র মত জেনজিরা তাই নেমেছে পথে। 

অনেকেই ভাবতেনজেনজিরা নাকি বখে গ্যাছে 

ড্রাগসপর্ণইন্টারনেটে নাকি তাদের বড্ড আসক্তি।

 

আসলে ওরা সোজাসাপ্টা! ওরা স্বাধীনচেতা!

উল্টাপাল্টাঘোরপ্যাচে দারুন অনিহা!

ওদের কথা একটাই

পারলে কিছু কর! না পারলে সরে দাঁড়াও!

 

বুমার্স, বেবি বুমার্সবেবি বাস্টজেন এক্স,

এসো, ভুলে যাই জেনারেশন গ্যাপ, 

এসোআমাদের চোখ খুলি, 

এসোআমাদের হৃদয় খুলি,

এসো, হাত ধরে, দাঁড়াই ওদের পাশে! 

উদিয়মান জেনআলফার জন্য একটা শক্ত জমিন তৈরি করি। 

ওরা বাঁচুকএকটি বাকস্বাধীনতার দেশে! 

 

 

 

 

জুলাই! তোমার হাতে কেন রক্তজবার ফুল?

 

জুলাই! জুলাই! তোমার হাতে কেন রক্তজবার ফুল?

কার হবে পুজো আজ? কাকে দেবে বলী?

কে সেই রাবণ? কোন সে অসুর? 

দেখছো না? কেমন ঘণ লালে ছেয়ে গ্যাছে পতাকার সবুজ।

লাল! লাল! এত লাল কেন চারিদিকে।

তবে কী কৃষ্ণচূডা়য় লেগেছে আগুন?

 

কিন্তু এই লাল-তো রক্তজবার নয়,

এই লাল নয় কৃষ্ণচূড়ার। 

এই গন্ধ কোন সুবাসিত ফুলের নয়!

মানুষের শরীরের লোনা গন্ধ মিশে গেছে এই লালে। 

শত শহীদের রক্তের ফোঁটা,

শতশত রক্তজবা হয়ে ফুটে আছে,

বাংলার পথেঘাটে! 

 

তুমিই বল?

গুলির মুখে এভাবেও দাঁড়িয়ে থাকা যায়?

যীশুর মতই দুই হাত মেলে দিয়ে,

মাথা উঁচু করে দাড়িয়েছিল সাঈদ।

ভাবেনি; সত্যিই ভাবেনি সে।

নিজের ভাইয়ের বুকেই গুলি চালাবে পুলিশ!

সাঈদের মৃত্যুর আহাজারি,

পৌছে গেছে দেশ থেকে দেশান্তরে!

 

চোখ দুটো যবে, ঘুমে বুজে আসে,

মুগ্ধ ডাকে, পানি হাতে এসে। 

‘পানি লাগবে? পানি? পানি?’

টিয়ারশেলের ঝাঁঝে আধবোঁজা চোখ,

রোদে-ঘামে জবজবা দেহখানি।

 

খানিকপরেই হায়,

মু্গ্ধর পানির বোতল মাটিতে  গড়াগড়ি খায়। 

লাল রক্তের ধারা নামে পিচঢালা পথে। 

মুগ্ধ নামের ছেলেটি লুটিয়ে পড়ে, মাথা এফোর-ওফোর করা বুলেটের একটি আঘাতে।

 

ওরা চায়নি স্বাধীকার,

চেয়েছিল কোটা সংস্কার। 

মাত্র ১৭ বছরের ফারহান ফাইয়াজ,

সে কী জানে,  কে মুক্তিযোদ্ধা?

কিংবা কে রাজাকার?

তবুও জীবন দিতে হল তার!

 

সালাম, রফিক, বরকতের মত,

যোগ হ’ল আরও কত নাম, কত কত মুখ! 

লিখে রেখে দিবো, মনে রেখে দিবো,

যেন কখনও ওদের ভুলে না যাই—

 

বায়ান্ন কিংবা একাত্তরের মত,

জুলাই, রক্তাক্ত জুলাই, তুমিও শোকাবহভাবে স্বরনীয় হবে,

মনে থাকবে, মনে রেখে দিবো,

নরবলী দিতে এসেছিলে, রক্তজবা হাতে!

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত