| 6 অক্টোবর 2024
Categories
চলচ্চিত্র ধারাবাহিক

ভারত গৌরব জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা (পর্ব-৮) । বাসুদেব দাস

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

    জ্যোতিপ্রসাদ বার্লিন ছেড়ে আসার কিছুদিন পরেই সমগ্র ইউরোপে অর্থনৈতিক সংকট তীব্র রূপ ধারণ করে যাকে আমরা ‘গ্রেট ডিপ্রেশন’ নামে জানি। স্টক মার্কেট অচল, ব্যাংক বন্ধ, কারখানা, শিল্প প্রতিষ্ঠানে তালা,দলে দলে মানুষ বেকার হতে শুরু করল। জার্মানিতে নাৎসিবাদের উত্থান ঘটে। মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের  টুটি টিপে ধরা হল। জ‍্যোতিপ্রসাদের জার্মান বন্ধুরা ইতিহাসের এই ঘটনা স্রোত  থেকে দূরে সরে থাকতে পারলেন না। তাদের মধ্যে অনেকেই জীবিকা হারাল। কোনোভাবে বেঁচে থাকার সংগ্রাম চলতে লাগল। এরমধ্যে শ্বেকের সঙ্গে ড’রার বিচ্ছেদ ঘটে এবং একজন জার্মান নার্সের সঙ্গে শ্বেক দ্বিতীয়বারের জন্য বিবাহ পাশে আবদ্ধ হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হয়। যুদ্ধের  সমর্থন না করে ও জ্যোতিপ্রসাদের জার্মান বন্ধুদের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হয়। প্রায় পনেরো বছর পরে ১৬ এপ্রিল ১৯৪৬ সনে জ্যোতিপ্রসাদের অন্য এক বন্ধু আলফ্রেড ব্লীকের কাছ থেকে জ্যোতিপ্রসাদ একটি চিঠি পান। চিঠিতে জ্যোতিপ্রসাদের অনেক  পরিচিত জার্মান বন্ধুর যুদ্ধে মৃত্যু এবং হাত পা হারিয়ে পঙ্গু হওয়ার  খবর ছিল। তারমধ্যে শ্বেকের  খবরও ছিল। ১৯৪8 সনের শুরুতে শ্বেক  গৃহহারা হন। সেই  বছরেই  শরৎকালে তিনি পুরোনো  পলিশ সীমান্তের কাছে সৈনিক হিসেবে যোগদান করেন। পরের বছর শ্বেক থাকা জায়গাটা  শত্রুপক্ষের হাতে চলে যায় । সবাই আশা করেছিল শ্বেক  যুদ্ধবন্দি হিসেবে  রাশিয়ায় আছে  এবং একদিন ফিরে আসবে। কিন্তু বাস্তবে তা হল না। তার কোনো সন্ধানই পাওয়া গেল না। যুদ্ধের নৃশংসতার মধ্যে শ্বেক  চিরকালের জন্য হারিয়ে গেলেন।

    শ্বেকের  আগের চিঠিতে উল্লেখ করা থেকে জানা যায় যে জ্যোতিপ্রসাদ তার ইউরোপে কাটানো দিন গুলি সম্পর্কে কিছু রচনা লেখার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু সেই লেখা হয়েছিল কিনা বা প্রকাশিত হয়েছিল কিনা সেই বিষয়ে কিছু জানা যায় না। এখানে উল্লেখ করা করা যেতে পারে  যে ১৯৪৮ সালে প্রকাশিত জ্যোতি প্রসাদের ‘লভিতা’ নাটকের প্রথম সংস্করণের পেছনের প্রচ্ছদে জ্যোতিপ্রসাদের  লেখা ‘বিলাতর পত্র’ নামের একটি বইয়ের বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু বইটির  সম্পর্কে আজ আর কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। লেখাটি পাওয়া গেলে জ্যোতিপ্রসাদের  চিন্তা-চেতনার বিকাশে ইউরোপের প্রবাসী জীবনের প্রভাব কতটা কার্যকরী হয়েছিল তার একটি মূল্যায়ন করা যেত।

     নাটক, কবিতা,গীত,গল্প-উপন্যাস, শিশু সাহিত্য, প্রবন্ধ, সাহিত্যের এই প্রতিটি বিভাগেই জ্যোতিপ্রসাদ নিজের প্রতিভার পরিচয় দিয়েছিলেন। নাট্যকার হিসেবে তিনি যেমন অসমিয়া নাট্য সাহিত্যে এক আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এসেছিলেন তেমনই অসমিয়া কাব্যের ধারায় একজন তেজস্বী কবি হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছিলেন । অসমিয়া  গীতি সাহিত্যে জ্যোতি প্রসাদের স্থান শীর্ষে । জ্যোতি সঙ্গীত নামে এই ধারা জনপ্রিয়তার শীর্ষস্থান স্পর্শ করেছে। তার প্রবন্ধগুলিতে ফুটে উঠেছে একজন চিন্তা সমৃদ্ধ প্রতিচ্ছবি। অন্যদিকে শিশুর জন্য লেখা কবিতা, প্রবন্ধ এবং কাহিনি গুলিতে ধরা পড়েছে শিশুর মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ যা অসমিয়া শিশু সাহিত্যের ভান্ডার কে সমৃদ্ধ করেছে।

    জ্যোতিপ্রসাদের একটি প্রধান পরিচয় হল তিনি একজন নাট্যকার। মোট ছয়টি পূর্ণাঙ্গ নাটক লিখে তিনি অসমিয়া নাট্য সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে তুলেছেন। জ্যোতিপ্রসাদ যে সময়ে নাটক লিখতে শুরু করেন সেই সময় অসমিয়া নাটকের খুব একটা গৌরবময় ঐতিহ্য ছিল বলা যায় না। উনবিংশ শতকে মিশনারিদের কর্তৃক প্রকাশিত ‘অরুণোদই’ পত্রিকায় বিচ্ছিন্নভাবে প্রকাশিত গুণাভিরাম বরুয়ার ‘রাম-নবমী’ নাটককেই অসমিয়া আধুনিক নাটকের আরম্ভ বলা যেতে পারে। বিধবা বিবাহকে বিষয় হিসেবে নিয়ে লেখা  এই সামাজিক নাটক শুধুমাত্র অসমিয়া নাট্য সাহিত্যকে নয়, অসমিয়া মানসের ও একটি সংস্কারমুখী দিক উন্মোচন করেছিল । উনবিংশ শতকের বঙ্গের সমাজে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং রামমোহন রায়ের  সংস্কারবাদী ভূমিকা  যে ঢেউ তুলেছিল  তার প্রভাব  পড়েছিল গুণাভিরামের  ব্যক্তিমানসে। গুনাভিরাম বরুয়া সেই সময় কলকাতায় পড়াশোনা করতেন। কলকাতা থেকে ফেরার পথে তিনি এই নাটক লিখতে শুরু করেন।

    ‘রাম-নবমীর’অনেক পরে বেণুধর রাজখোয়া নরনারীর প্রণয়ের শোকাবহ ঘটনা অবলম্বনে ১৮৯৪ সনে ‘সেউজী কিরণ’রচনা করেন।বিংশ শতকের প্রথমভাগে প্রকাশিত কয়েকটি নাটক হল পদ্মনাথ গোহাঞি বরুয়ার জয়মতী,গদাধর,সাধনী,লাচিত বরফুকন,লক্ষ্ণীনাথ বেজবরুয়ার বেলিমার,জয়মতী কুঁয়রী,চক্রধ্বজ সিংহ,রাধানাথ সন্দিকৈর মূলাগাভরু এবং নকুল চন্দ্র ভূঞার বদন বরফুকন,চন্দ্রকান্ত সিঙ্ঘ,বিদ্রোহী মরাণ।

    প্রকৃতপক্ষে উনবিংশ শতকের শেষ থেকে বিংশ শতকের আরম্ভ পর্যন্ত অসমিয়া নাট্যমঞ্চে পৌরাণিক নাটক প্রভাব বিস্তার করেছিল।সেইসময় বাংলা নাটকের অনুবাদই  অসমিয়া মঞ্চে প্রভত্ব বিস্তার করেছিল। সঙ্গী্তের ক্ষেত্রেও হিন্দুস্থানী এবং বাংলা সঙ্গীতই অসমে প্রভাব বিস্তার করেছিল।


আরো পড়ুন: ভারত গৌরব জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা (পর্ব-৭)

    ‘শোণিত কুঁয়রী’জ্যোতিপ্রসাদের প্রথম নাটক। ১৯১৭ সনে মাত্র ১৪ বছর বয়সে এই নাটক রচনা করেন।তাঁর নিজের বক্তব্য অনুসারে এই নাটক ১৪ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে লেখা।মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে নাটকটি রচনা করে জ্যোতিপ্রসাদ তাঁর প্রতিভার পরিচয় দিয়েছিলেন।জ্যোতিপ্রসাদের এই নাটকের কাহিনিভাগ পৌ্রাণিক।নাটকের কাহিনিভাগ হরিবংশ এবং ভাগবত পুরাণে পাওয়া যায়।অন্যদিকে হরিবংশ এবং ভাগবত পুরাণ থেকে উপাদান আহরণ করে অনন্ত কন্দলী ‘কুমার হরণ’ এবং পাঁচালি কবি পীতাম্বর ‘ঊষা পরিণয়’ নামে কাব্য রচনা করেছিলেন। জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা ‘কুমার হরণ’এবং ‘ঊষা পরিণয়’এর ঊষা অনিরুদ্ধের প্রেমকে বিষয়বস্তু হিসেবে নিয়ে এই নাটকটি রচনা করেন।

    শিব ভক্ত বাণ রাজার কন্যা ঊষা।কন্যার বয়স বৃ্দ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাণ রাজার চিন্তাও বাড়তে লাগল।তাই যথেষ্ট  নজর রাখার জন্য কন্যাকে অগ্নিগড়ে রাখলেন। একদিন ঊষা স্বপ্নে এক সুন্দর রাজকুমারকে দেখলেন।স্বপ্নের কথা বলায় সখী চিত্রলেখা সুন্দর পুরুষদের ছবি এঁকে ঊষাকে দেখালেন।ঊষা তার মধ্য থেকে নিজের স্বপ্নের পুরুষকে সনাক্ত করলেন।সেই সুন্দর পুরুষ হলেন শ্রীকৃষ্ণের নাতি অনিরুদ্ধ।চিত্রলেখা যে কোনো উপায়ে অনিরুদ্ধকে ঊষার কাছে নিয়ে আসার সঙ্কল্প গ্রহণ করলেন।চিত্রলেখার সঙ্গে অনিরুদ্ধ অগ্নিগড় উপস্থিত হলেন।বাণ রাজা সমস্ত কিছু জানতে পেরে অনিরুদ্ধকে বন্দি করলেন।এই খবর শুনে শ্রীকৃষ্ণ সৈন্যসামন্ত নিয়ে এসে বাণ রাজার রাজত্ব আক্রমণ করলেন।শিব বাণের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন।এই যুদ্ধ হরিহরের যুদ্ধ নামে পরিচিতি লাভ করে। শেষ পর্যন্ত ব্রহ্মার দৈববাণীতে যুদ্ধের অবসান হয়।বাণরাজা আনন্দিত মনে কন্যার সঙ্গে অনিরুদ্ধের বিয়ে সম্পন্ন করালেন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত