৩০৪ নং কেবিন (পর্ব-১)
জীবন মৃত্যুর মাঝখানে একটা হাইফেন ।এই হাইফেনটা কখনো কখনো এতটাই কাছে এসে যায় যে মনে হয় সব বুঝি নিভে গেল ।মেঘঅদিতির নিজের জীবনের ক্ষেত্রে এই হাইফেনটা কয়েক বছর অন্তর অন্তর একদম ছোটো হয়ে আসে , যেকোন মুহূর্তে মনে হয় এই বুঝি . . .
এই এবার যেমন, কোনো কিছু নেই, হঠাৎ করেই রাতের দিকে কাঁপুনি দিয়ে রোজ জ্বর, সে কী আর জ্বরে বাড়ি বসে থাকার মেয়ে! ক্যালপল আর কাজ, দিব্যি চলছিল পাঁচ দিন ধরে এমনি।কিন্তু ওই যে মাঝেমধ্যে সেই সুদূরের আহ্বান আসে. . ব্যাস, মেঘ কাবু, তারপর থেকে নার্সিংহোমের ৩০৪ নং কেবিন বরাদ্দ ।তাও এক সপ্তাহ হতে চলল।
প্রতিদিন শুয়ে শুয়ে সে ভাবে , আসছে, ডাক্তারের চিঠি আসছে, আমার ছুটি, আর তখনি বেহায়া শরীর নতুন কোনো ফন্দি আঁটে, ঠিক কিছু না কিছু এতটাই বাড়িয়ে দেয় যে, চিঠি আসে না। সেপ্টোসেমিয়া বলে নাকী! লিভার, ইউরিনারি ট্রাক, চেস্ট, লাংগস, আরো কত কী !সব সব ইনফেকটেড।
মালট্অরগ্যান ফেলিওর হচ্ছে কী! তাহলে আমার উপন্যাস লেখা যে শেষ হবে না। মেয়েটাও তো বড় ছোটো। এখনো কলেজে পড়ছে। আমি কী বাঁচব না বেশিদিন? ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করে মেঘ।
ডাক্তার রিপোর্ট খুলে বোঝাতে বসেন, দেখুন এতগুলো লেভেল বেশি।ইউ টি আই সত্তরহাজার ছাড়িয়ে গেছে।
এই ইউ টি আই কী জিনিস মেঘের অজানা। এতে তার শরীরের কি ক্ষতি হয়েছে বা হচ্ছে সেটাও তার জানা নেই। কিন্তু এগুলো নিয়ে ভাবার কোনো দরকার আছে বলে তার মনে হয় না।
সে আর শোনে না। শুধু দূর্বল থেকে দূর্বল হতে থাকে।বাম হাতের শিরা ফুলে যায় স্যালাইন খেতে খেতে , স্থান বদলে ডান হাত. . তারও অবস্থা ক্রমেই জটিল. .।
যন্ত্রণা ভুলতে মেঘ গল্প শুরু করে যত সিস্টার, আয়া মাসি, আর এম ও, সুইপার, ক্যান্টিনবয়. .। সিস্টার সুজাতা তার বোন হয়ে যায়। সে মেঘের মামার বাড়ি অঞ্চলের মেয়ে ।তার সঙ্গে মনে মনে মনে ছুটে বেড়ায় রামপুরহাট, নিশ্চিন্তপুর, শৈশবের মামার বাড়ি। চোখের সামনে কত ঘটনা ছবির মতো ভেসে ওঠে। রেল কোয়াটার, পিছনে বিশাল জামরুল, সজনে, আম, লিচু গাছ।আর সামনে ঋতু অনুযায়ী ফুলের বাগান। সারা বছর কোনো না কোনো ফুল দিয়ে সেজে থাকত পুরো প্রাঙ্গনটা।
আর ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
তাঁর সঙ্গেও মেঘের প্রথম পরিচয় মাত্র আড়াই বছর বয়সে রামপুরহাট রবীন্দ্র ভবনে। দিদার রেল কোয়াটারের পাশে থাকতেন অনিল দাদু ও দিদা আর মাসিরা।এই মাসিরাই (বলাকা মাসি, শ্বেতা মাসি আর টিঙ্কু মাসি) মেঘের ওই বয়সের যাবতীয় দৌরাত্ম্য সামলাতো।তারাই এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল রবীন্দ্র জয়ন্তী উপলক্ষে। মেঘকে সাজিয়ে গুছিয়ে হাতে একতারা দিয়ে স্টেজে উঠিয়ে দিল। অস্পষ্ট মনে আছে মেঘের , গানটা ছিল ‘বাদল বাউল. .’ সেই বিশাল স্টেজে খুঁজে পাওয়া যাবে না ভেবে তার ঠাঁই হয় হারমোনিয়াম রাখার জন্য বরাদ্দ টেবিলে। কী নেচে ছিল মনে নেই আর।তবে এটা মনে আছে অনেক হাততালি আর অনুষ্ঠানের পর একটা টিফিনকৌটো দিয়েছিল সাদা পাঞ্জাবী পরা এক দাদু।
সেই প্রথম না জেনে না বুঝে হাত পা নেড়ে নাচ, স্টেজ শো ও রবীন্দ্রনাথ।তারপর ধীরে ধীরে কবিতা, গান, নৃত্যনাট্যর মধ্যে দিয়ে তিনি ঢুকে পড়লেন মেঘের প্রাত্যহিক জীবনে। মা রোজ রবীন্দ্রনাথের শিশু ভোলানাথ থেকে কোনো না কোনো কবিতা মুখস্থ করাতেন। সেগুলো আবার কদিন অন্তর ধরতেনও।ক্লাস থ্রি তে পাড়ায় মহালয়া।পাড়ার জনপ্রিয় দিদি মালাদি। তাকে আর সুমাকে চন্ডালিকা শেখালেন।না বুঝেই মালাদিকে কপি করে দুবোন করে ফেলল মা আর মেয়ের চরিত্র ।
আর তারপর রবীন্দ্র জয়ন্তী। মেঘকে শেখালেন ‘আমার নয়ন ভুলানো এলে. .’। সেই নাচ আবার ভূপালে ছোটোমাসির বাড়ি বেড়াতে গিয়ে এক অনুষ্ঠানে করে রাতারাতি কাগজে টিভিতে ছবি চলে এল ছোট্ট মেঘের।
ব্যাস্ শুরু হয়ে গেল রবীন্দ্রনাথের প্রতি তার প্রেম, সঙ্গে শুরু হল রবীন্দ্র নৃত্যে তালিম প্রসিদ্ধ নৃত্যশিল্পী আয়ুস্মতীদির কাছে।সেই তালিম আজো মনের মধ্যে , শরীরে বহন করে চলেছে সে। এখনো কারণে অকারণে বেসুরে সকাল শুরু করে যেকোন একটা রবীন্দ্র সংগীত দিয়ে।তারপর সারাদিন কোনো না কোনো সুর গুনগুন করে যায় কাজের মধ্যেই। কখনো বৃষ্টির দিনে মা-মেয়ে চিৎকার করে গলা ছেড়ে গান গাইতে শুরু করে, নাচে – ঝরো ঝরো মুখর বাদল দিনে . . . কিংবা পাগলা হাওয়ার. .।
এই বয়সে এসে মেঘঅদিতি উপলব্ধি করে রবীন্দ্রনাথ আসলে নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের মতই একটা স্বাভাবিক অক্সিজেন, যা ছাড়া বাঁচা সম্ভব নয় ।
এখানেও যেমন দৃশ্যান্তরে সিস্টার রুপা গান শোনায় ‘শ্রাবনের ধারার মত, . . .’।
মেঘ ঝরতে থাকে. . . অপেক্ষায় থাকে . . . সেই বাদল বায়ুর যে ফুৎকারে উড়িয়ে দেবে সব রোগ. .। সে ফিরে গিয়ে বসবে তার প্রিয় টেবিলে, হাতে তুলে নেবে কলম. .। কে জানে আরো কতদিন!
.
কবি,কথাসাহিত্যিক,সম্পাদক ও প্রকাশক