অ্যানিমেশন রাজ্যে ঢুঁ
সাইপ্রাসে বাস করতেন পিগম্যালিয়ন। বানাতেন ভাস্কর্য। কেউ কেউ বলত, তিনি ছিলেন সাইপ্রাসের রাজা। গ্রিক ও রোমান পুরাণে তাঁর কথা বলা আছে। একবার তিনি এক নারীর ভাস্কর্য বানিয়েছিলেন এতটাই সূক্ষ্মভাবে যে নিজেই নিজের শিল্পের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন। দেবী ভেনাসের কাছে তাঁর সে কী প্রার্থনা! এই জড় মূর্তিতে যেন দেবী প্রাণ দিয়ে দেন। ভক্তের আকুলতা বুঝতে পেরে দেবী ঠিকই মূর্তিটিতে প্রাণ সঞ্চার করলেন। পিগম্যালিয়ন প্রাণ পাওয়া সেই মূর্তির নাম রাখলেন গ্যালাতিয়া। দুজনে বিয়ে করে গড়লেন সুখের সংসার।
হয়তো এই উপকথা থেকেই উৎসাহ পেয়ে গড়ে উঠেছে আধুনিক অ্যানিমেশন ছবির জগত। তবে চেষ্টা ছিল কিন্তু সেই বহু বহু বছর আগে থেকে। খ্রিষ্টপূর্ব ১৬০০ শতকের দিকে মিশরে দেবী আইসিসের মন্দিরে ১১০টা স্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছিল। এক একটি স্তম্ভে দেবীর এক এক ভঙ্গিমার ছবি আঁকা হয়েছিল, যেন কেউ চলতে চলতে স্তম্ভগুলোর দিকে তাকালে মনে হবে দেবী তাঁর ভঙ্গিমা পরিবর্তন করছে। গ্রীকরা এঁকেছিল মাটির গোল পাত্রের চারদিকে। মানুষের বিভিন্ন ভঙ্গিমার ছবি। পাত্রটি জোরে ঘোরালে মনে হত মানুষ নড়ছে।
এভাবেই ধীরে ধীরে অ্যানিমেশন ছবির বিকাশ হতে শুরু করে। গড়ে উঠে অ্যানিমেশন স্টুডিও। একটা অ্যানিমেশন ছবির জন্য লাগে অনেক অনেক হাতে আঁকা ছবি। একজনের পক্ষে যেহেতু এতো ছবি আঁকা সম্ভব না, তাই একসঙ্গে কয়েকজন আঁকিয়ে মিলে কাজ করেন স্টুডিওতে। হাতে আঁকা সেই ছবিগুলোকে ক্যামেরাবন্দি করে একটার পর একটা চালিয়ে গেলেই ব্যাস, তৈরি হয়ে যায় চলন্ত ছবি। মানে, অ্যানিমেশন। আগে এগুলোকে কার্টুন বলা হত। ছোট ছোট দৈর্ঘ্যের কার্টুন তো এখনো তোমরা দেখ। তবে পূর্ণদৈর্ঘ্যের অ্যানিমেশন ছবিও যে কম দেখ না, সেটা কিন্তু নির্মাতারা খুব ভালো বুঝে গেছেন! তাই তো নব্বই দশক থেকে কার্টুন ছবি বা হালের অ্যানিমেশন মুভি এত্তো জনপ্রিয়। শুধু তোমাদের না, আমাদের মত বুড়োদেরও অ্যানিমেশন ছবি অনেক ভালো লাগে।
তোমরা কি এই ছবিগুলো দেখেছো? একটা ছোট্ট তালিকা দিচ্ছি। যদি না দেখে থাকো, তাহলে দেখে ফেল। পড়াশোনার পর তো এই কোয়ারিন্টাইনে আরও সময় পাচ্ছো।
দ্য লায়ন কিং (১৯৯৪)
হয়তো গেল বছর তোমরা দ্য লায়ন কিং দেখে ফেলেছো। আমি সেটার কথা বলছি না। প্রথম ছবিটা মুক্তি পেয়েছিল ১৯৯৪ সালে। গল্পটা একই। দৃশ্যগুলোও অভিন্ন প্রায়। ভিন্নতা আঁকায়। আর কিছুই না। হ্যাঁ, অভিনয়, মানে কন্ঠশিল্পীদের অভিনয় আরকি, সেটার তফাৎ পেতে পার। কোন অংশেই নতুন লায়ন কিং-এর নির্মাণশৈলীর চেয়ে প্রথমটা কম যায় না। পিতা হারা সিম্বার রাজ্য ফিরে পাবার গল্পটা না হয় একবার পুরোনো ফ্রেমে দেখে নাও, আলবৎ ভালো লাগবে।
মুলান (১৯৯৮)
মুলানের বাবা যুদ্ধে যাবার মত উপযুক্ত ছিলেন না। কিন্তু রাজার নির্দেশ, প্রতি বাড়ি থেকে একজন পুরুষের সেনাবাহিনীতে থাকতে হবে। তখন মুলান একটা বুদ্ধি বের করলো। মেয়ে হয়েও ছেলে সেজে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে চলে গেল। থাক, আর না বলি। তোমরা দেখে নিও।
শ্রেক (২০০১)
রাজকুমারী ফিওনাকে উদ্ধার করে দিতে হবে কুৎসিত শ্রেককে। বিনিময়ে লর্ড ফারকুয়াড শ্রেককে দিবেন পছন্দের জলাভূমি। আর বিয়ে করবেন ফিওনাকে। কিন্তু রাজকুমারীকে উদ্ধার করতে গিয়ে শ্রেক নিজেই প্রেমে পড়ে যায় তার। এরপর ঘটতে থাকে মজার সব ঘটনা। মজার ঘটনাগুলো আরও লম্বা হতে থাকে এই ছবির ধারাবাহিক দুটো কিস্তিতে। এছাড়া টেলিভিশন সিরিজ ও কিছু স্বল্পদৈর্ঘ্য কার্টুনও মুক্তি পেয়েছে
আপ (২০০৯)
আপ ছবির গল্পটা মনে হবে শুরু হওয়ার আগেই বুঝি শেষ হয়ে গেল। কিন্তু না, শুরুটা তখনই হয় যখন এলি মারা যায়। আজীবন টাকাপয়সা জমিয়েছে একটা স্বপ্ন পূরণের জন্য। কিন্তু পূরণ হবার আগেই স্বামীকে একা করে চলে যায় এলি। ভেবে ভেবে এলির স্বামী কার্ল বের করে এক উপায়, কীভাবে প্রিয়তমা স্ত্রীর স্বপ্ন পূরণ করা যায়। ছবিটা দেখলেই বুঝবে!
কোরালাইন (২০০৯)
যারা একটু রহস্য বা ভৌতিক কিসিমের গল্প পছন্দ কর, তারা অবশ্যই কোরালাইন দেখবে, কেমন? জানো, ছোটবেলায় কল্পনা করতাম পৃথিবীর মত আরেকটা জগত আছে। হয়তো আমার বাড়ির উল্টোপাশে। হয়তো আমার ঘরের ছোট কোন দরজা দিয়ে সেখানে যাওয়া যায়। যেখানে আরেকটা আমি, আমার আরেকটা বাবা-মা আছে। যদি তাদের সঙ্গে আমার দেখা হয়, তবে কী হবে! কোরালাইনের গল্পটা অনেকটা এরকম।
জুটোপিয়া (২০১৬)
বর্ণবাদের কথা একটু-আধটু জেনেছো নিশ্চয়ই? জুটোপিয়ায় দেখবে প্রাণীদের মধ্যে বর্ণবাদ। তো এর মধ্যে হয় কী, জুডি স্বপ্ন দেখে বড় পুলিশ কর্মকর্তা হওয়ার। নিক নামে এক খেঁকশিয়ালের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় তার। নিকের সাহায্যে জুডি ক্যারিয়ারে অনেক দূর এগিয়ে যায়। পরক্ষণেই টের পায় বর্ণবাদের কবলে পড়ছে নিকের মত আরও বন্য প্রাণীরা। তাদের সাহায্য করতে চলে জুডির অভিযান।
দ্য অ্যাডভেঞ্চারস অব টিনটিন : দ্য সিক্রেট অব দ্য ইউনিকর্ন (২০১১)
টিনটিনের কমিক বই পড়ে থাকলে এর অ্যানিমেশন ছবিটা দেখেও দারুন মজা পাবে। রহস্য উন্মোচনের অভিযানে বের হয় সাংবাদিক টিনটিন। সঙ্গে থাকে তার সফেদ কুকুর স্নোয়ি। আর মজার সব কান্ড করে হাসায় টিনটিনের বন্ধু ক্যাপ্টেন হ্যাডক।
মনস্টারস, ইঙ্ক (২০০১)
দৈত্যদানোর গল্প মনস্টারস, ইঙ্ক। বাচ্চাদের ভয় দেখিয়ে এরা নিজেদের ক্ষমতা বাড়ায়। কিন্তু বাগড়া বাধায় পিচ্চি একটা মেয়ে। সালি তাকে যতই ভয় দেখায় ততই সে হাসে। সালির সঙ্গে চলে যায় দৈত্যদের দুনিয়ায়। পরে সালি ও তার বন্ধু মাইক মিলে পিচ্চিটাকে তার ঘরে পৌঁছে দিতে চায়। কিন্তু যত বাধা আর বিপত্তি তাদের ঘাড়েই এসে পড়ে।
স্পিরিটেড অ্যাওয়ে (২০০১)
বলা হয় এখন পর্যন্ত জাপানের সবচেয়ে আয় করা ছবি স্পিরিটেড অ্যাওয়ে। এই ছবিতে দুর্ঘটনাবশত চিহিরো প্রবেশ করে এক আত্মার শহরে। বাবা-মাকে সেইসব আত্মা থেকে বাঁচাতে বুদ্ধি বের করতে থাকে ছোট্ট মেয়েটা। জানো, এই অ্যানিমেশন ছবিটা আধুনিক যুগের একমাত্র হাতে আঁকা ভিনদেশী (ইংরেজী ভাষায় নয়) চলচ্চিত্র যেটা অস্কার পেয়েছে!
পিনোকিও (১৯৪০)
মিথ্যা বললে কী হয় জানো? নাক লম্বা হয়ে যায়! একদম সরু লাঠির মত। পিনোকিও দেখলে এমনটাই মনে হবে। পিনোকিও আসলে একটা কাঠের পুতুল। যাকে নীল পরী জীবন দান করে। পরী তাকে বলে সে যেন নিজেকে সাহসী, সত্যবাদী এবং নিঃস্বার্থবান প্রমাণ করে। তবেই সে হতে পারবে একজন আসল ছেলে। কিন্তু সে মিথ্যা বলা বন্ধই করতে পারে না। ফলে তার নাক শুধু লম্বা হতে থাকে। তবে সে চেষ্টা করতে থাকে। কীভাবে? সেটা জানতে হলে দেখতে হবে পিনোকিও।
এরকম আরও দারুণ দারুণ অসংখ্য অ্যানিমেশন ছবি আছে। সময় পেলে টুক করে দেখে নিবে। এই যেমন, স্নো হোয়াইট অ্যান্ড দ্য সেভেন ডোয়ার্ফস (১৯৩৭), সিন্ডারেলা (১৯৫০), অ্যান আমেরিকান টেইল (১৯৮৬), দ্য ল্যান্ড বিফোর টাইম (১৯৮৮), মাই নেইবার টটোরো (১৯৮৮), দ্য লিটল মারমেইড (১৯৮৯), বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্ট (১৯৯১), আলাদিন (১৯৯২), টয় স্টোরি (১৯৯৫), অ্যানেস্টেসিয়া (১৯৯৭), ফাইন্ডিং নিমো (২০০৩), মেগামাইন্ড (২০১০), পুস ইন বুটস (২০১১), র্যাঙ্গো (২০১১), হাউ টু ট্রেইন ইওর ড্রাগন (২০১০), কুংফু পান্ডা (২০০৮), ডাম্বো (১৯৪১), রাইজ অব দ্য গার্ডিয়ানস (২০১২), ট্যাঙ্গেলড (২০১০), ফ্রোজেন (২০১৩), ইনসাইড আউট (২০১৫), কারস (২০০৬), ওয়াল-ই (২০০৮), ডেসপিকেবল মি (২০১০), কুবো অ্যান্ড দ্য টু স্ট্রিংস (২০১৬), কোকো (২০১৭), মি. পিবডি অ্যান্ড শারম্যান (২০১৪), দ্য ক্রুডস (২০১৩), রিও (২০১১)। তালিকা কিন্তু শেষ হবে না।
সূত্র: ইনসাইডার, এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা
![সৈয়দা সাদিয়া শাহরীন](https://irabotee.com/wp-content/uploads/2020/08/116870048_225788828611118_517276368836524211_n-150x150.jpg)
লেখক