দামী ও সস্তা
এক সন্ধ্যায় গ্রামের এক চাষি তার বাড়ির উঠোনে পরিবারের সবার সাথে বিশ্রাম নিচ্ছিল। সবাই নিজের পছন্দের কাজটি করতেই ব্যস্ত ছিলো। চাষি উঠোনে আগুন জ্বেলে তার ছেলে-মেয়েদেরকে গল্প শোনাচ্ছিল। মেয়ে বউরা ঠাট্টা তামাশায় মশগুল ছিল আর চাষির সবচেয়ে ছোট ছেলে এক ঘটি জল নিয়ে খেলায় ব্যস্ত ছিল।
রাত বাড়ল। সবাই নিজেদের কাজের জন্য বাড়ির ভেতরে চলে গেল। উঠোনে কেবল পড়ে রইল সেই এক ঘটি জল ও চাষির জ্বালানো জ্বলন্ত আগুন।
অনেকেই জানে না যে পৃথিবীর সবকিছুই কথা বলতে পারে, তবে নিজেদের ভাষায়।জল ও তেমনি হঠাৎ কথা বলে উঠলো। বোধহয় সে খুব একা অনুভব করছিল আর সেটা কাটাতেই গল্প করতে চাইছিল; কারণ সাধারনত জিনিসরা খুব প্রয়োজন না পড়লে কথা বলে না। যাই হোক জল বলল, আগুন দাদা, ও আগুন দাদা, কেমন আছ গো?
-তুই সবসময় খালি এই একটা কথাই বলিস।আর কিছু জিজ্ঞেস করতে পারিস না?
-না না তা কেন হবে! আমার তো শুধু একটু গল্প করতে ইচ্ছে করছে।
-তাই বল!
-তা বলছি তোমার কী বড্ড একা একা লাগছে?
-নারে। তবে আমার মনে একটা প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। সেটা নিয়েই চিন্তা করছি।
-তাই! কী প্রশ্ন? বল না, বল না!
-প্রশ্নটা খুব অদ্ভুত রে!
-কি প্রশ্ন সেটা তো বল।
-প্রশ্নটা হল; এই দুনিয়াতে কে সবচেয়ে বেশি দামী?
-বেশ কঠিন প্রশ্ন বটে। তবে এর উত্তর ও তো জানতে হবে বল।
-তা তো বটেই। তবে কে আমার এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে বল তো?
-আমার মনে হয় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন।
-ঠিক ঠিক। চল তার কাছেই যাই।
দুজনে মিলে উড়ে চলল ভগবান শ্রীকৃষ্ণর কাছে। শ্রীকৃষ্ণ তখন কেবল মাত্র ঘুমুতে যাবেন। রাত হয়েছে। দেবতাদের বুঝি ঘুম পায়না! কিন্তু হঠাৎ জল ও আগুনকে দেখে সে ঘাবড়ে গেল।
-কিরে! তোরা তো দেখছি জল আর আগুন।এত রাত্রে এসেছিস যে!
জল বলল,
-হে ভগবান! আপনার কাছে যে আমাদের এক প্রশ্ন রয়েছে।
-প্রশ্ন! সারাদিন তোদের পাহারা দিই। এখন কী একটু শান্তি মতন ঘুমোতেও দিবিনে বাপু!আচ্ছা বল, কি প্রশ্ন!
-হে ভগবান, আমাদের প্রশ্ন হল এই যে এই পৃথিবীতে সবচেয়ে দামী কে?
-কি! ভারী কঠিন প্রশ্ন করেছিস দেখছি।
কৃষ্ণ মনে মনে একটু ভাবল; আচ্ছা,এই তাহলে প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তর শুধু মুখে বলে নয়, একেবারে হাতে কলমেই বুঝিয়ে দিতে হবে কৃষ্ণ বললো।
-ঠিক আছে। তবে আগে আমি যেকোন দুজনের মধ্যে তুলনা করে বলব যে তাদের মধ্যে কে বেশি দামী। তোমরাই বল, আমি কার কার মধ্যে তুলনা করব? জল ও আগুন একটু ভাবল। তারপর বললো ভগবান, আপনি আগে আমাদের দুজনের মধ্যেই তুলনা করুন।
-তাই হবে। আমি পৃথিবীতে সব জায়গায় জল ও আগুনের সংযোগ বন্ধ করে দিয়েছি।তোমরা পৃথিবীতে যাও আর নানান জায়গায় গিয়ে দেখ কোন জায়গায় কার দরকার। যার বেশি জায়গায় দরকার পড়বে, সেই বেশি দামী।
-ঠিক আছে। দুজনে তখনই রওনা দিল।
প্রথমে তারা গেল একটা চাষীর বাড়িতে। চাষীর বউ তখন চাষীকে বলছে,
-ওগো, দেখ না, আজ রাত থেকে কোথাও জল পাচ্ছিনা। কোথাও কোন জল নেই।কুয়োটায় পর্যন্ত জল নেই!
-রাখ তো জল! জল কিছুক্ষন পরেই আসবে।আর বাড়িতে তো একগাদা ড্রাম ভর্তি জল রয়েছে। সেসব খাও। কিন্তু আগুনই তো নেই।রান্না করবে কি দিয়ে শুনি! কোন রান্নাই তো ফ্রিজে নাই।
শুনে আগুন ওমনি বলল, দেখেছিস, আমার কদরই বেশি। জল মুখ ভার করে বললো এখনো সব জায়গা ঘোরা শেষ হয়নি। হু! জল আর আগুন এবার গেল মরুভুমিতে।
মরুভূমির এক বাড়িতে।
-আজ সন্ধ্যা থেকে জল নেই। কী যে করি!কোথাও কোন জল নেই।
-ঠিকই বলেছ। আসলেই এটা খুবই চিন্তার ব্যাপার। জল কিনতে গিয়েছিলাম। কিন্তু বললো, যে আজ তাদের কাছে নাকি জল নেই।
-এদিকে প্রাণ যে যায় যায়!
ওমনি জল বলল, হু হু! আমার কদরই বেশি বুঝলি? আগুন গোমড়া মুখে বলল, আরো কিন্তু যাওয়ার জায়গা আছে। এখান থেকে চল তো বাপু। কি গরম! এমনিতেই আমি গরম। তার ওপর মরুভুমি!
এবার দুজনে মিলে গেল সুইডেনে। সুইডেনে ভীষন ঠান্ডা। দু’জনেই ঠান্ডায় কাঁপতে লাগল।হু হু!
সুইডেনের এক বাড়িতে।
-ও মা! কি ঠান্ডা! অথচ চিমনিটাই জ্বালাতে পারছি না। কেন যে আগুন জলছে না! এত্ত সোয়েটার পরেও শীত মানছে না! আগুন ছাড়া চলে! ওমনি আগুন বলল, এই যে দেখ। আমিই বেশি দামী। জল বলল, অন্য জায়গায় চল।
তারপর তারা আরো নানান জায়গায় ঘুরল।কিন্তু কে আসলে বেশি দামী তা তারা বুঝল না! কারণ নানান পরিস্থিতেতে নানান জনকে দরকার। তারা ফিরে গেল কৃষ্ণের কাছে। কৃষ্ণ তখন কেবল একটু ঘুমিয়েছে। তাদের দেখেই জেগে উঠল।
ওরা বললো ভগবান, আমরা তো বুঝলামই না কে বেশী দামী। নানান জায়গায় যে নানান জনকে প্রয়জন! আপনিই বলে দিন।
কৃষ্ণ বললো, আচ্ছা। আমিই বলছি শোন, দেখ, মরুভুমিতে মানুষ এক আঁজলা জলের জন্য পাগল হয়ে যায়। কারণ সেখানে জল নেই। তাই সেখানে জল বেশি দামি। আবার সুইডেনে ঠান্ডা ভীষণ তাই সেখানে আগুনের দরকার। যেই বাড়িতে ড্রাম ভর্তি জল মজুদ আছে, সেই সময় ওই বাড়িতে আগুন লাগলে জল দরকার। আবার বাড়ির জল শেষ হয়ে গেলেই দরকার জল। তার মানে হল, পৃথিবীতে বস্তু নয়, পরিস্থিতিই দামী। যেই পরিস্থিতিতে যেই জিনিসের দরকার সেটাই বেশি দামি। মানুষ সব সময়ই বলে যে টাকাই আসল। একজন মানুষের সামনে যদি তুমি ১০ হাজার টাকার নোট আর এক গ্লাস জল রাখ, সে অবশ্যই টাকা নেবে। কারণ ওইটা দিয়ে সে অনেক জলের গ্লাস কিনতে পারবে।কিন্তু যদি সে মরুভুমিতে আটকা পড়ে তবে জলই হবে তার কাছে আসল। তাই জিনিস নয়, পরিস্থিতিই দামী। এবার বুঝেছ?
জল আর আগুন একসাথে বলল, হ্যাঁ ভগবান, বুঝেছি। আমরা আর এটা নিয়ে ঝাগড়া করব না। তারপর কৃষ্ণ পৃথিবীতে আবার জলের সংযোগ ফিরিয়ে দিল আর জল ও আগুন আর কখনোই এটা নিয়ে ঝগড়া করেনি। কারণ তারা ঠিক করেই বুঝেছিল যে পৃথিবীতে কি সবচেয়ে দামী।
[মহাভারতের গল্প অবলম্বনে]
কবি,গল্পকার
খুব সুন্দর গল্প।অনেক শুভকামনা।