স্নেহ
কাঁহাতক আর এভাবে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা যায়! বুকের মধ্যে যেন দশমীর ঢাক বাজছে। সর্বক্ষণ যেন একটা সন্ত্রস্তা ঘিরে রেখেছে তাদেরকে।
কাজটা খুব সাবধানে সারতে হচ্ছে, একই সঙ্গে রাখতে হচ্ছে বাজপাখির মতো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এবং নেউলের মতো সতর্কতা!
এতো যে সে চুরি নয়, হু হু বাবা– খোদ অনিমা ঠাকুমার বাড়ির বাগান থেকে পেয়ারা চুরি করা !
এমন গর্হিত এবং কাজ বুঝি পৃথিবীতে আর নেই। এ যেন সিংঘের মুখ থেকে মাংস টুকরো আনা কিংবা বিষধর সাপের মাথা থেকে স্পর্শমণি উদ্ধার করা – হয়ত তার চাইতেও দুঃসাহসিক কিছু!
যতটা সম্ভব নিঃশব্দে কাজটা সারা হচ্ছে দুপুরবেলা এমনিতেই চারিদিক সব শুনশান, তার ওপর সামান্য টু শব্দ হলেই কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে! অনিমা ঠাকুমা যে কি মূর্তি নিয়ে উদয় হবেন তা চিন্তা করবারও সাহস এদের নেই! হয়ত সব কটাকে ধরে ঘরের মধ্যে নিয়ে গিয়ে বেতের বাড়ি মারবেন কিংবা দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখে তাদের বাপ–মা কে খবর দেবেন! বাকি কাজটা তারপর বাবা–মা-ই করবে। ওনার অসাধ্য কিছু নেই, এসব কাজে ইনি একাই একশ! ‘তারা’ মানে বিচ্চু, খোকা, পারুল, রুমা, ইসমাইল সবাই রেল কোয়ার্টারের ছেলে–মেয়ে। বয়স তাদের পাঁচ থেকে তেরোর মধ্যে। পাড়ার খুদে গ্যাং এলাকার ছোটখাটো ত্রাস ও বটে! তাদের দৌরত্মে পাড়ায় টেকা দায় মানুষের! দেখলে মনে হবে, সব কটার লেজ একসঙ্গে কাঁটা পড়েছে! বাঁদরামো দেখলে বাঁদরও লজ্জা পাবে! যেন বারুদে ঠাসা তুবড়ি, সামান্য আঁচেই ফেটে চৌচির হবে। কারো শাসন মানবে না, উল্টে যে শাসন করতে যাবে, তাঁরই অবস্থা সঙ্গিন করে ছাড়বে।
একমাত্র একজনই পারেন এদেরকে ঠাণ্ডা করতে অনিমা ঠাকুমা !
বয়স্কা, প্রবীণাদের দেখলে ছোটো ছোটো বাচ্চাদের ভয় পাওয়াটা স্বাভাবিক ব্যপার, বিশেষ করে সেই ব্যাক্তি পাড়ায় একাকি বসবাস করেন, তাহলে তো কথাই নেই। অচিরেই তিনি বাবা–মায়েদের কাছে খুদে বাচ্চাদের শাসন করবার অস্ত্র হয়ে ওঠেন! একবার তাদের মনে ভীতির সঞ্চার ঘটাতে পারলে ভালো এমন অব্যর্থ ওষুধ পাওয়া ভার! শুধু এইটুকুই বলে- তমুক পাড়ায় যাস না, ওখানে থাকে ‘অমুক’ বুড়ি, বুড়ি কে জানিস তো? কিংবা ‘খাবি না তো, দাড়া! ডাকছি ‘অমুক’ বুড়িকে! ব্যস, সাথে সাথে অ্যাকশন।
এমনটাই চিরাচরিত ছবি থাকে মানুষের জীবনে। প্রত্যেকের ছেলেবেলাতেই এমন “পাঁজি” বুড়ি থাকে, যার থেকে ভয়ের জিনিষ আর হয়না! তারপর বয়স বাড়লে এবং বুদ্ধির বিকাশ হলেই সেই বৃদ্ধা, অনাত্মীয় ঠাকুমাই হয়ে ওঠেন সবথেকে প্রিয় এবং সম্মানের পাত্রী যার কাছে গরীব-বড়লোক, উঁচু- নিঁচু সমস্ত বাচ্চাই একই রকম আদরের! যার ভালোবাসাতে কোন পক্ষপাতিত্ত্ব থাকে না।
কিন্তু এই অনিমা ঠাকুমা যেন কেমন! নিয়মের বিপরীত একজন মহিলা। উনি যেন সত্যি সত্যিই গল্পের “ডাইনি” বুড়ি! ছোট বাচ্চা উনি দেখতেই পারেন না, দেখলেই ক্ষেপে ওঠেন। অমন বদমেজাজি, ক্ষ্যাপা লোক পাড়ায় বুঝি আর দুটো নেই। পাড়ার দক্ষিন দিকে, যেখানে রেল কলোনির কোয়ার্টার শেষ হয়েছে, সেখানে বিশাল বাগান নিয়ে অনিমা ঠাকুমার একতলা বাড়ি , অনেকটা বাংলো বাড়ির মতো। আদপেই ওটা রেলের বাংলো বাড়ি, রেল ইঞ্জিনিয়ারের জন্য। অনিমা ঠাকুমার স্বামীই ছিলেন রেলের চিফ ইঞ্জিনিয়ার। শোনা যায়, স্বামী- ছেলে-মেয়ে নিয়ে ভরা সংসার ছিল ঠাকুমার। অল্প বয়সে বেশ মিশুকে ছিলেন, পাড়ার সব মহিলার সঙ্গেই হেসে খেলে কথা বলতেন। শহুরে আদব-কায়দার জন্য রেল কলোনির সবাই বলত ‘মেম-বউঠান’। কোনদিনও তাঁকে কেউ রেগে যেতে দেখেনি।
তারপর যত দিন যেতে লাগল, সব কিছু কেমন পালটে যেতে থাকল। রিটায়ার করার কয়েক বছরের মধ্যেই স্বামী মারা গেলেন। ততদিনে তাঁর ছেলে–মেয়েরা সব প্রতিষ্ঠিত, এবং বিয়ে করে সংসারী। তারা অচিরেই চাকরিসুত্রে এবং নিজেদের সংসার পাতবার জন্য শহরে চলে গেলো আলাদা ভাবে, এবং সেখানে বসবাস করতে লাগল। অনিমা ঠাকুমাকে একা রয়ে গেলেন। ছেলেমেয়েরা বছরে একবার হয়ত মায়ের সাথে দেখা করতে আসে, তাও নিয়মিত নয়!
সবাই বলে, এতেই কষ্ট পেয়ে ঠাকুমা কেমন হয়ে গেছে। ছেলেমেয়েরা তাঁকে দূরে সরিয়ে রাখায় যত না কষ্ট পেয়েছেন, তার থেকেও বেশি কষ্ট পেয়েছেন তাঁর নাতিনাতনিদের তাঁর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নেওয়ায়!
অনেকে ভাবে, এই কারণেই বাচ্চাদের সহ্য করতে পারেন না! নাতিনাতনিদের সর্বক্ষণ চোখে হারাতেন, তাদের জন্য বুকটা খা খা করত! তাই কোন বাচ্চাকে চোখের সামনে দেখতে পারতেন না।
পাড়ার লোকের সঙ্গে কথা বলাও বন্ধ করে দিয়েছিলেন। অপকৃতিস্থ, ভূতগ্রস্থের মতো একাকি নিজেকে ঘরের মধ্যে বন্দী করে রাখতেন। থাকবার মধ্যে ছিল দুটো চাকর, একজন মালি আর রান্নার লোক, তাদের সঙ্গেও বেশি কথা বলতেন না। তারাও বেশি ঘাঁটাত না মালকিনকে।
একবার কেউ যদি তাঁর বাগানে ঢুকে পড়ত, তাহলে তো দক্ষযজ্ঞ বাধিয়ে দিতেন, বিশেষ করে কোন বাচ্চা ঢুকে পড়ত! যেন সব থেকে নিষিদ্ধ যায়গায় সে ঢুকে পড়েছে, রেগে গিয়ে হিস্টিরিয়া রুগীর মতো সেই অনুপ্রবেশকারী শিশুর ওপর অগ্নিবর্ষণ করতেন যে বেচারা পালাতে পথ পেতো না, নয় সামনা সামনি ভ্যা করে কেঁদে ফেলত।
শুধু এতেই শান্ত থাকতেন না, যদি নাগালের মধ্যে কোন বাচ্চাকে ধরতে পারতেন তাহলে ঘরের মধ্যে নিয়ে গিয়ে উত্তম-মধ্যম দিতেন! আশেপাশে কে রয়েছে তা দেখতেন না, পাড়ার লোক এব্যপারে অভিযোগ জানালেও তিনি কর্ণপাত করতেন না! ছোট, ছোট সব বাচ্চা। যাদের দেখলে অতি বড় পাষণ্ডেরও হৃদয় গলে জল হয়ে যায়। তাদের সঙ্গে যেন তাঁর জন্মের শত্রুতা।
এই তো সেদিনের ঘটনা! এই বিচ্চু খোকনদের দল, এমনই এক দুপুরবেলা ঠাকুমার বাগানে হানা দিয়েছিল ফুল চুরি করবে বলে, এবং সমস্ত রকমের সাবধানতা অবলম্বন করে, যাতে ঠাকুমা ঘুণাক্ষরেও টের না পান।
কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি! যখন সব কিছু ঠিকঠাক মিটে আসছিল, রুমার তক্ষনি হাঁচিটা লাগল, আর সেই শব্দেই জেগে উঠলেন ঠাকুমা, সাথে-সাথে রণচণ্ডী মূর্তি নিয়ে সামনে উদয় হলেন!
“হতচ্ছারাদের দল। বলি এটা কি তোদের বাপের বাগান! ফুলগাছগুলোকে তো নেড়া করে দিয়েছিস! বলি যেমন ফুল ছিঁড়েছিস, তোদের কানগুলোও যদি অমনভাবে ছিঁড়ি!”
সবাই তখন মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে, ছুটে পালিয়ে যাওয়ার কথা মাথাতেও আসেনি। যত না ভয় পেয়ে তারা চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল, তাঁর থেকেও লজ্জায় তাদের মাথা নিচু হয়ে গেছিল। সত্যিই, ঠাকুমার মুখে সেদিন কোন লাগাম ছিল না।
“চল ভেতরে, সব কটার আজ ব্যবস্থা করছি! ফুল ছেঁড়া বেরিয়ে যাবে! “
সবাই কেমন সম্মোহিতের মতো ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়েছিল, তারপরই শুরু হয়েছিল তাদের ওপর নির্মম অত্যাচার।তাদের কান মুলে দেওয়া হয়েছিল, সাথে একখানা করে চড় বরাদ্দ! বুড়ির হাতে অমন জোর থাকতে পারে বোঝাই যায়নি। ওদের মধ্যে সবথেকে দুরন্ত ছেলে বিচ্চু, যে কিনা চড় খেয়ে খেয়ে গণ্ডারের চামড়া বানিয়ে ফেলেছে, তারও চড় খাবার পর মাথা ঘুরে গেছিল! মনে হয়েছিল, এমন মোক্ষম চড় বহুদিন কেউ ঠাটিয়ে দেয়নি! আর মেয়েগুলো মানে পারুল, রুমা সেই যে কান্না আরম্ভ করেছিল, বাড়ি গিয়েও থামেনি।
ঘটনাটা খোকা, বিচ্চুদের মধ্যে গভীর ভাবে রেখাপাত করে। খোকা আর বিচ্চু বাকিদের থেকে বড়, তাই তাদের আত্মস্মমান বোধটাও বেশি, তাই তারা কিছুতেই এ জিনিষ হজম করতে পারল না। এতো বড় অপমান! ঘরের মধ্যে নিয়ে গিয়ে গায়ে হাত তোলা! কেন, ওদের ঘরে কি মা–বাবা নেই, অভিভাবক নেই তাদের শাসন করার জন্য! বুড়ির সব ব্যপারে এতো মাতব্বরি কেন!
নাহ! এর একটা বিহিত না করলেই নয়। ওরা সবাই মিলে একরকম বদ্ধপরিকর হয়ে উঠল, এই অপমানের শোধ না নিয়ে ওরা ছাড়বে না।
সেই মতো প্ল্যান বানানো হল। জব্বর প্ল্যান, এতে বুড়ি ধরাশায়ী হবেই। একটু ঝুঁকি আছে, তাতে দলের অনেকের, বিশেষ করে বোচা, ইসমাইল আর রুমার ভারি আপত্তি আছে।
বোচার কথায়, “অতো বড় বুড়ি মানুষটাকে অমন করে ফেলবি? উনি যে আমাদের ঠাকুমার বয়সী !”
শুনে খোকা বলেছিল, “রাখ তোর ঠাকমা! উনি কি আমাদের নাতিনাতনিদের চোখে দেখে! কোনদিন শুনেছিস কোন ঠাকুমা তাঁর নাতি-নাতনিদের ঘরের মধ্যে নিয়ে চড়-থাপ্পড় মারে! না না, ওঁকে উচিত জবাব দিতে হবে!”
রুমা উদগ্রীব হয়ে বলে, “বুড়ি মানুষ- যদি পড়ে লেগে যায়, হতেও পারে, কোমর ভেঙ্গে গেলো! কিংবা মাথা ফেটে গেলো! ধর যদি মরে যায়।”
বিচ্চু এবার হেসে জবাব দিলো, “ও বুড়ি মরলে তো বেঁচে যাই! ওই ক্ষেপি বুড়ি মরলে গোটা বাগানটা তো আমরা দখল নিতে পারব। তখন কেউ আমাদের ফল চুরি করতে আটকাতে পারবে না। তুই মিছিমিছি ভয় পাচ্ছিস রুমা। ওই বুড়ি যা টেটিয়া মাল, এতো সহজে মরবে না- হ্যাঁ, একটু চোট-আঘাত লাগতে পারে।”
রুমা আবার বলে, ‘আমার কিন্তু বেশ ভয় করছে !”
এবার বিচ্চু রেগে গেলো। রেগে গিয়ে বলল, “জো ডর গয়া, উও মর গয়া! ভিতুদের আমাদের টিমে রাখব না! যার মনে ভয় আছে তারা যেন না আসে !”
প্ল্যানটা ছিল এরকম- অনিমা ঠাকুমাদের ঘরের সামনের চাতালটা একটু ঢালু, বৃষ্টি পড়লে সেটা বেশ পিচ্ছল হয়ে যায়।গতকালকেও বৃষ্টি হয়েছে, চাতাল ও পিছল হয়ে গেছে, সাবধানে না পা দিলে চিৎপটাং হওয়ার সম্ভবনা ভারি। বিচ্চু-খোকাদের প্ল্যান ছিল, সেই চাতালটাকে যদি আরও পিছল করা যায় তাহলে তো ওটার ওপর দাঁড়ানোরই ক্ষমতা কারোর থাকবে না। পা হড়কাবেই। সেটাই ওদের উদ্দেশ্য- চাতালতার ওপর তেল ঢেলে ওটাকে মারাত্মক পিছল বানাবে, তারপর বাগানে গিয়ে হুটোপুটি করবে ইচ্ছে করেই, আর সেটা শুনে ঠাকুমা ছুটে বেরিয়ে আসবেই, আর একবার যদি চাতালটার ওপর পা দেয়- ব্যাস! সাতদিনের জন্য বিছানায়, একমাস ও হতে পারে!
দুপুরবেলাতেই ওদের অপরেশনের টাইম ঠিক হল। দুরুদুরু বুকে ওরা রান্নাঘর থেকে চুরি করা সর্ষের তেল ভর্তি কৌটো নিয়ে ঠাকুমার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। এইবার অ্যাকশনের পালা। চাতালটার ওপর তেল ঢেলে ভালো করে পালিশ করে দিতে হবে, যাতে ঠাকুমা টের না পায়।
সবার মধ্যে চাপা টেনশন হতে লাগল। ওদের মধ্যে সবচেয়ে সাহসী যে সেই বিচ্চু অব্দি কাচুমাচু হয়ে খোকাকে বলছিল, “কিছু হবে না তো ভাই?”
খোকাও এতক্ষনে বেশ সাহস–টাহস সঞ্চয় করে রেখেছিল, বিচ্চুর এই মিনমিনে কথায় সেসব উবে গিয়ে নার্ভাসনেস শুরু হয়ে গেলো। কোনমতে সে বলল, “মারব মাথায় গাট্টা। কিছু হওয়ার জন্যই তো করছি এসব ! লাস্ট টাইমে এসে বাঁধা দিস না!”
লিডারের কথায় সবাই চুপ হয়ে গেলো। অতি সন্তর্পণে তারা ঠাকুমার পাঁচিল টপকাবার জন্য উদবত হল, কিন্তু তখনই উপস্থিত হল মূর্তিমান বিপর্যয়।
না, ঠাকুমা নন। সেই বাচ্চা ছেলেটা।
ওদের থেকে দশ হাত দূরে বাচ্চাটা দাঁড়িয়ে আর খিলখিল করে হাসছে দাঁড়িয়ে–দাঁড়িয়ে, আর জোরে হাততালি দিচ্ছে।ছেলেটা তো কয়েকদিন ধরে ওদের জ্বালিয়ে মারছে! ওদের পেছনে ঘুরঘুর করেই চলেছে গত কয়েকদিন ধরে। তারা কেউ জানে না কে এই বাচ্চাটা! মনে হয় ওদের পাড়ার কুলিবস্তির ছেলে। গায়ের ময়লা কাপড়–জামা দেখলে তো সেরকমই মনে হয়। বিচ্চু–খোকারা ওকে বহুবার ধমক–টমক দিয়ে সরাবার চেষ্টা করেছে, কিন্তু ধমক খেয়ে ব্যাটা পাগলের মতো খিলখিল করে হাসে– যা দেখে ওদের গা জ্বলে যায়। ছেলেটা আজব তো! ধমকালেও হাসে! মাথায় গণ্ডগোল নেই তো– তারা বুঝে পায় না। এমনকি নাম জিজ্ঞেস করলেও খিলখিলিয়ে হাসি ছাড়া মুখ দিয়ে আর কোন শব্দ বেরোয় না। খোকা–বিচ্চুরা এও বুঝতে পারে না যে ছেলেটা বোবা কিনা। ওদের সবকিছুতেই কেমন ধন্দ লাগে। কিন্তু এটা ভালোই বুঝতে পারছে যে ছেলেতা মহা পাজি! নইলে এই নির্জন দুপুরের নিস্তব্ধতাকে খানখান করে দিয়ে তারস্বরে হেসে বিচ্চুদের কাজ পন্ড করে দিতো না।
এর ফলও হল তেমন। হাসির আওয়াজে ঠাকুমা জেগে উঠলেন, পড়িমড়ি করে ছুটে বেরিয়ে এলেন, সেই ঢালু চাতালটা পেরিয়ে, নিরাপদে। এসে ওদেরকে দেখে সেই চেনা রণংদেহী মূর্তি ধারন করলেন। ঠাকুমার উদ্ভ্রান্ত চেহারা দেখে বোঝাই যাচ্ছিল– সদ্য তাঁর কাঁচা ঘুম ভেঙ্গেছে, আর সেটার রাগ–বিরক্তি সব চোখে–মুখে ফুটে উঠছে।
“তোরা আবার এসছিস! সেদিন অতো করে সবাইকে ঠ্যাঙ্গালাম তাও তোদের শিক্ষে হল না। পাঁচিল ডিঙ্গিয়ে আবার বাগানের মধ্যে ঢুকতে চাইছিস? আর ওকি! তোর হাতে তেলের কৌটো কেন? কি মতল্বে ঢুকছিলি?”
ঠাকুমার হঠাৎ আবির্ভাবের আকস্মিকতায় সবাই যে যার যায়গায় দাঁড়িয়ে পড়েছিল, একটু নড়বার সুযোগ পায়নি।খোকার হাতে তখনও তেলের কৌটোটা ধরা ছিল, সেটাই ঠাকুমার চোখে পড়েছে। সে কোনমতে সেটা লোকাবার চেষ্টা করে বলল, “কি–কিছু না ঠা–ঠাকুমা !”
“কিছু না! আমায় কি বোকা পেয়েছিস? আমি জানি, তুই সব থেকে বড় বাঁদর। তোর মাথায় সবসময় দুষ্টুবুদ্ধি গিজগিজ করছে। তোদের ব্যবস্থা করছি। সব কটাকে আজ বাঁধব– তারপর আসুক তোদের বাড়ির লোকেরা। পুলিশে দেবো সবকটাকে” বলে ঝটিতি পাঁচিলের কাছে এসে খোকার কান ধরে পাঁচিল থেকে নামিয়ে তার গালে দুটো ঠাস–ঠাস করে চড় মারল।সবাই হতভম্ব হয়ে চুপ হয়ে গেলো। শুধু ওই বাচ্চা ছেলেটা খিলখিল করে হেসে উঠল।
সবাই অবাক হয়ে গেলো, মায় ঠাকুমাও– একি কান্ড! যেন ছেলেটা গর্হিত কোন অপরাধ করে ফেলেছে। বাকিরা প্রত্যেকে ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে ছেলেটাকে চুপ করতে ইশারা করল, কিন্তু সে ছেলের কোন ভ্রূক্ষেপই নেই, আরও জোরে হাততালি দিয়ে হাসতে থাকল।
তা দেখে ঠাকুমা তেলে–বেগুনে জ্বলে উঠলেন, চেঁচিয়ে বললেন,” এই, কে তুই! অমন হাসছিস কেন?” তারপর খোকা–বিচ্চুদের প্রশ্ন করলেন,”ছেলেটা কে?”
কেউ মুখ থেকে কোন কথা বার করতে সাহস পায়না, ঠাকুমা ফের ঝাঁঝিয়ে উঠে বল্লেন,” আমি কিছু জিজ্ঞেস করলাম তো নাকি?”
এবার পারুল আমতা–আমতা করে বলে, আ–আমরা জা–জানিনা ঠাকুমা ছেলেটা কোথা থেকে এসেছে। কয়েকদিন ধরেই আমাদের পেছনে ঘুর-ঘুর করছে। কিছু জিজ্ঞেস করলেই খালি খিলখিল করে হাসে।”
শুনে ঠাকুমা চোখ পাকিয়ে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলেন, “এই ছেলে, তোর নাম কি? আর আমায় দেখে অমন হাসছিস যে বড় !”
অন্য কোন বাচ্চা হলে সে সময় ভয়ে কেঁদেই ফেলত কিন্তু ছেলেটার কোন বিকার নেই।একই ভাবে হেসে যাচ্ছে। যেন পেটের মধ্যে হাসির খনি। ছেলেটার মধ্যে কোন ভয়ডর যেন নেই- ওর কান্ড দেখে ঠাকুমাও চুপ হয়ে গেছেন।
সবাই দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করতে লাগল চূড়ান্ত কিছু ঘটার। আগ্নেয়গিরি ফেটে পড়ার আগে সবাই তঠস্থ হয়ে অপেক্ষা করছে দমবন্ধ করে।
আর সেই থমথমে, গুমোট পরিবেশের মধ্যে ছেলেটা একটানা হেসে চলেছে।
কিন্তু একি! ঠাকুমা গেট খুলে বাইরে বেরচ্ছেন যে! ওনার দাপট দেখে মনে হচ্ছে কিছু একটা হেস্তনেস্ত না করে ছাড়বেন না! তাহলে যে ঝড়টা খোকা-বিচ্চুদের ওপর দিয়ে যাওয়ার কথা ছিল সেটা কি এই অচেনা বাচ্চাটার ওপর দিয়ে যাবে। তাহলে তো এই ছেলেটার কপালে অশেষ দুঃখ আছে। বেশ হবে, ওদের পেছনে ঘুরঘুর করার মজা টের পাবে, আর কথায়-কথায় খিলখিলিয়ে হাসিও বেরিয়ে যাবে।
কিন্তু একি দৃশ্য দেখছে তারা! ঠাকুমা ওই ছেলেটার কাছে গেলেন ঠিকই, কিন্তু ওর কান ধরে টানলেন না, বা ওর গালে চড় ও মারলেন না। বরং ওর ময়লা জামা থেকে ধুলো ঝেড়ে ব্ললেন,” ইস! এইটুকু ছেলেকে কেমন ময়লা জামা–কাপড় পড়িয়ে রেখেছে। কে জানে কতদিন কাঁচা হয়নি! মা–বাবারও বলিহারি– এতোটুকু ছেলেকে যে ময়লা জামা পড়ালে অসুখ–বিসুখ করবে সে হুঁশও নেই!” তারপর খোকা–বিচ্চুদের উদ্দেশ্যে বললেন, “হাঁ করে দেখছিস কি! আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে সামনের মিষ্টির দোকান থেকে কচুরি–জিলিপি–সিঙ্গারা যা মনে লাগে খা গে যা! সেদিন মার খেয়েছিস, আজ একটু ভালো–মন্দ খাবি! বাগানে গাছের ফল পাকলে তাই দিতাম, কিন্তু তোদের জ্বালায় কোন ফল পাকবার উপায় আছে! যা–যা পালা, আমার এখন অনেক কাজ!” বলে বাচ্চাটাকে নিয়ে হনহন করে বাড়ির দিকে হাঁটা দিলেন !
ছোড়াটা কেমন পাঁজি দেখো, এখনও ওদের দিকে চেয়ে কেমন হেসে যাচ্ছে! বিচ্ছুর গাছ একখানা !
আর রুমা–পারুল–খোকাদের মুখগুলো হয়েছে দেখবার মতো। যেরকম হাঁ হয়েছে সবার মুখ, তাতে একটা বড় সাইজের রসগোল্লা অনায়াসে ঢোকানো যায়। যা দেখল তাতে আক্কেল–গুড়ুম হওয়াটাই স্বাভাবিক !
সেদিন দলের সবাই মিলে কথা বলে একটা চরম সিদ্ধান্ত নিলো!
আর অনিমা ঠাকুমার পেছনে লাগবে না তারা। কে জানে, মেজাজ তাঁর কখন কেমন থাকবে– এই গরম চাটু তো এই ঠাণ্ডা বরফ! না–না, এমন মানুষ থেকে দূরে থাকাই ভালো।
জন্মস্থান : আগরপাড়া, উত্তর চব্বিশ পরগনা, পশ্চিমবঙ্গ। পেশা : গবেষণা। কৈশর থেকে কবিতা লেখা শুরু, প্রথম কবিতা প্রকাশ স্কুল ম্যাগাজিনে,প্রথম গল্প প্রকাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্ত্রিকায়। প্রথম শারদীয়ায় গল্প প্রকাশ “নবাঙ্কুর শারদীয়া সংখ্যা ২০১৫”তে । বিভিন্ন লিটিল ম্যাগাজিন ও বানিজ্যিক প্ত্রিকায় লেখা প্রকাশিত। লেখালিখির জন্য প্রাপ্য সম্মান- নবাঙ্কুর সেরা সাহিত্য সম্মান, ২০১৫, তাছাড়া ২০১৮ সালে আয়োজিত “স্ক্রিন সট ফেস্ট” এ “বেষ্ট কন্টেন্ট রাইটিং” প্রতিযোগিতায় সেরা দশ জনের মধ্যে জায়গা করে নেওয়া। শখ : বইপড়া, ঘোরাঘুরি, সিনেমা দেখা, খেলাধুলো।