কবি পবিত্র মুখোপাধ্যায় ১২ই ডিসেম্বর ১৯৪০ সালে জন্মগ্রহণ করেন অবিভক্ত বাংলার বরিশাল জেলার আমতলীতে এক দরিদ্র পরিবারে। পিতা রোহিণীকান্ত মুখোপাধ্যায় এবং মাতা যোগমায়া দেবী। খুব ছোটবেলাতেই মাকে হারিয়ে কবি ফিরোজপুরে মাসীর বাড়িতে মানুষ হন। দেশবিভাগের টালমাটালে অকালবিধবা মাসী সামান্য পুঁজি নিয়ে শিশু পবিত্র ও যুবক পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে কোলকাতায় চলে আসেন উদ্বাস্তু হয়ে ১৯৪৮ সালে। কবি নিজ প্রচেষ্টায় প্রথমে ভবানীপুর সাউথ সাবার্বান স্কুল ও পরে শ্যামাপ্রসাদ সান্ধ্য কলেজে পড়াশোনা করে স্নাতক হন। পরবর্তী কালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। যোগ দেন এক বীমা কোম্পানিতে বেয়ারার চাকরি নিয়ে। বাকি সময়ে টিউশন ইত্যাদি করে রাত্রে করতেন পড়াশোনা। পেশায় অধ্যাপক, তিনি প্রথম জীবনে চেতলা বয়েজ স্কুলে শিক্ষকতা করেন। পরবর্তীকালে তিনি দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার বিদ্যানগর কলেজের বিভাগীয় প্রধানের পদে নিযুক্ত হন। এখান থেকেই ২০০০ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। ভবানীপুর সাউথ সাবার্বান স্কুলে পড়ার সময়ে কবিতা রচনার সূত্রপাত। সাহিত্য পিপাসু কবিবন্ধুদের সাহচর্য এবং সহায়তায়, ১৯৫৭ সালে প্রকাশ করেন “কবিপত্র” কবিতা পত্রিকা। প্রায় যাট বছর অতিক্রান্ত করে আজও প্রকাশিত হয়ে চলেছে “কবিপত্র”। প্রথম বই দর্পণে অনেক মুখ, বহু পুরস্কারে সম্মানিত। কবি রবীন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার পেয়েছেন ২০০৯ সালে।
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে “দর্পণে অনেক মুখ” (১৯৬০), “শবযাত্রা” (১৯৬১), “হেমন্তের সনেট”(১৯৬১), “আগুনের বাসিন্দা” (১৯৬৭), “ইবলিসের আত্মদর্শন” (১৯৬৯), “অস্তিত্ব অনস্তিত্ব সংক্রান্ত” (১৯৭০),“বিযুক্তির স্বেদরাজ” (১৯৭২), “শ্রেষ্ঠ কবিতা” (১৯৭৬), “দ্রোহহীন আমার দিনগুলি” (১৯৮২), “অলর্কের উপাখ্যান” (১৯৮২), “আমি তোমাদের সঙ্গে আছি” (১৯৮৫), “পশুপক্ষী সিরিজ” (১৯৮২), “ভারবাহীদের গান”(১৯৮৩), “আছি প্রেমে বিপ্লবে বিষাদে” (১৯৮৭)।
কবি প্রধানতঃ দীর্ঘ কবিতার কবি হিসেবেই বেশী পরিচিত। তাঁর “শবযাত্রা” (১৯৬১) ও “ইবলিসের আত্মদর্শন” (১৯৬৯) সার্থক দীর্ঘ কবিতার নিদর্শন। এ ছাড়াও আছে অজস্র খণ্ড কবিতার বই ও সনেটগুচ্ছ। তাঁর সাহিত্য সম্ভার তাঁর জীবনবেদ।
আজ ০৯ এপ্রিল কবি পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের প্রয়াণে ইরাবতী পরিবার শোকাহত। ইরাবতী পরিবারের বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।
অসঙ্কোচে দিয়েছি মেলে
অসঙ্কোচে দিয়েছি মেলে আমার ডালপালা
পাতায় পাতায় চন্দ্রাতপ কঠিন রোদ্দুরে
শিকড়ে যতো তৃষ্ণা আর কান্ডে যতো জ্বালা
রেখেছি সবই বলকলেতে মুড়ে |
ব্যক্ত তার আড়ালে থাকে গোপন অস্মিতা ;
ফোটায় ফুল মানুষ, সুখ এভাবে মেলে ধরে ;
আত্মজেরা সাজায় দূরে শব্দহীন চিতা, —
কে কাকে মনে করে ?
দীর্ঘদিন থাকে না বেঁচে একার বিদ্রোহ |
কান্ড যতো কঠিন হোক, শিকড়ে সংহতি ;
ডালপালায় আছড়ে পড়ে যখন দুর্গ্রহ ,
পাতাও রোখে গতি !
ব্যক্তিগত দ্রোহের শেষে শূন্যে মেঘ জমে |
অসঙ্কোচে মেলেছি তাই আমার ডালপালা |
অস্মিতার আড়ালে থেকে নানান বিভ্রমে
বেড়েছে যতো জ্বালা |
মধ্যবিত্ত
ভিতরে ধিকি ধিকি জ্বলছে তুষ,
বাইরে মুখ রাখি নির্বিকার ;
মধ্যবিত্তের আগুন দপ্ করে
কখন নিভে যায়— এ ভাবনার
আগুনে পুড়ে মরি ; আমি আপন বৃত্তের
বাইরে মেলে দিতে পারিনি ডালপালা,
আত্মমৈথুনে কেটেছে কাল |
দাপিয়ে হেঁটে যায় দুঃশাসন |–
দ্রৌপদীর ট্যানা কাপড়ে টান পড়ে
শিশুরা শুষে খায় মায়ের হাড় ;
মরার আগে মরে হাজারবার |
দাপিয়ে চলে ফেরে দুঃশাসন !
বনিক শকুনির কুটিল হাসি শুনি ;
আমার হাড় দিয়ে বানানো পাশা খেলে
সহজে কাড়ে মাথার গোঁজার ঠাঁই |
শহরে মার্কারি এনেছে রাত্তিরে
প্রবল ব্যস্ততা, প্রখর দিন ;
বেনের কামনার চিতা ঝলসায়
আমার কন্যার স্বপ্ন প্রেম !
আবেগ মরে গেলে শুকনো খাতে শুয়ে
নদীর চলে শুধু রোমন্থন ;
ভিতরে ধিকিধিকি জ্বলছে যে দহন
কখন ছাই হয়ে আকাশে ওড়ে |
শহরে মার্কারি এনেছে রাত্তিরে
প্রবল ব্যস্ততা, প্রখর দিন ;
হাজার মাইল জুড়ে দেহাতী বস্তির
অন্ধকার শোধে সে-সব ঋণ |
কুপিও জ্বালবার সাধ্য নেই, তাই
বনের কাঠকুটো তাডায় শীত ;
একটু নুন পেলে মাদলে ওঠে বোল,
বনের পাতা শোনে সে সংগীত |
নিত্য উচ্ছল জীবনে ভেসে থাকি,
ভাবছি সারা দেশে কার্ণিভাল !
আমার স্থুলদেহ আরামে ঢেকে রাখি |
অদূরে দেখি হাসে ক্রান্তিকাল |
স্বপ্ন দেখি
স্বপ্ন না কি প্রতারক ! তবু আমি স্বপ্ন দেকি গভীর আবেশগ্রস্ত দিনে ;
ঘুমের ভিতরে কিংবা জেগে আধো জেগে একা, জনতার
ভিড়ে দেখি —- মানুষের চোখের শূন্যতা আর সেরকম নেই,
ক্রমশ উজ্জ্বল দীপ্ত স্বপ্নময়, যে রকম শৈশবে দেখেছি ;
পা দুটি কেমন স্রোত ঠেলে ঠেলে ভেসে যাচ্ছে অনির্ভার, সর্বস্ব খোয়ানো—-
হাত দুটি উত্তোলিত, তাতে নেই ভাঙা সান্ কি নিঃস্ব আঁকিবুকি ;
কোথাও দেখেছে না কি প্রতিশ্রুতি সমাজের রাষ্ট্রের নারীর
সন্তানের কাছে, বহু পথ ঘুরে অবশেষে ? এ কোন মানুষ ?
ক্লান্তি অবসন্নতার সীমাহীন খানখন্দ পার হয়ে শেষে
দেখেছে দূষণমুক্ত নদী—– অবগাহনের উচ্ছল আরাম ?
পাড়ে পাড়ে শস্য শিশু ঝুঁকেপড়া মেয়েদের বিশ্রাম, সেখানে
মানুষের ঘরবাড়ি সুস্থির শান্তির কোলে ঘুমিয়ে রয়েছে ?
ঘুমের ভিতরে কিংবা জেগে কিংবা আধো জেগে স্বপ্ন দেখি : কলকাতার পথে
সেইসব উচ্ছিন্ন মানুষ আর মানুষ নামীয় কঙ্কালেরা
কোন মায়ামন্ত্র বলে অদৃশ্য হয়েছে., আর তারাই মেতেছে কার্ণিভালে ;
প্রশস্ত পথের পাশে রঙিন ম্যানসান, পার্কে সুবেশা যুবতী—-
একদিন ডালহৌসির গলাপিচে শতছিন্ন চটি ফেলে রেখে
আদ্যন্ত নৈরাশ্য নিয়ে বাড়ি ফিরে ভেবেছে মৃত্যুর কথা, মাঝরাতে জেগে
দেখেছে, আকাশে কোনো তারা নেই পরিবর্তে বোবা আর দুঃখী শূন্যতা রয়েছে !
এখন পার্কের ঘাসে সেও প্রতীক্ষায় বসে, চুল ওড়ে, শিশুদের দিকে
দু’হাত বাড়িয়ে কিছু স্বপ্ন ধরে, আর কিছু স্বপ্ন দেয় ছুঁড়ে |
আমাদের মাঝখানে
আমাদের মাঝখানে সবুজ প্রান্তর পড়ে আছে—
আর কিছু নেই |
অথচ আমরা কত দূরে, এই মাঠ পেরুলেই
যেতে পারি কাছে
ছেলেবেলাকার মতো | মনে হয় ভারি শেকলের
বোঝা পায়ে নিয়ে ছুট দিতে
পারব না ; জটিল শেকড়ের
বাঁধনে রয়েছি |
ক্রমশ ধুসর হয়ে যাচ্ছে মুখ, পরিচিত শরীর তোমার |
আমাদের ভাষাব্যবহার
দেখে মনে হয় শব্দ তার
. হারিয়েছে অর্থ ও ব্যঞ্জনা ;
একে অপরের দিকে
চেয়ে থাকি ঘাতকের নিষ্পলক ঘোলাটে চোখের
সংকেত ছড়িয়ে | আর কিছু ?
কারা গন্ধ শুঁকে শুঁকে আসে পিছু পিছু ?
দেখি না মুখের রেখা, চোখের দৃষ্টির অর্থবহ
দ্যুতিবিকিরণ | সব কিছু
অপরিচয়ের অন্ধকারে
ডুবে যেতে থাকে ।
কার ডাকে
সাড়া দেব ? ছুটে যাব প্রান্তর পেরিয়ে ইচ্ছে মতো ?
কথা নয় ; যেন পশু হয়েছে আহত—-
ক্রুদ্ধ গোঙানির স্বর শুনি ;
বুঝে নিই —– আমাদের ভাষা
হৃদয়ের তারা থেকে নয় ;
সভ্যতার অর্থ আজ ক্রম অবক্ষয়
মানবিক বোধ ও বিস্ময় থেকে দূরে
সরে গেছে । ভালোবাসাবাসি
অর্থহীন, বাসি।
জীবন ধারাভাষ্য
ছিটের ইজের প্যান্ট হাট থেকে কিনে দিতো মামা,
এক জোড়া ছিটের জামাও ;
এক ছুটে ঈশ্বরীতলায় |
বাবুদের ছেলে মেয়ে দামি জামাকাপড়ের মোড়কে সন্ধ্যায়
শরীরকে মুড়ে বসে চোয়ারে ;
. কোনো খেদ
ছিলো না সেদিন | খেলে, কাদা মেখে পুকুরে নেমেছি
একসাথে ;
বোঝাতে আসেনি কেউ ; আজ
সকলেই বুঝে গেছি, দুজনায় কতোটা প্রভেদ
হাত প’ড়ে গেছে বলে ভাতে।
সময়কে বলি
সময়কে বলি : সময় ! তুমি, ওই পথে যাও
ওইখানে স্থির হয়ে বসো
যেমন বসে, দুঃখ যেমন দেহের পাশে ছায়া, যেমন মরণ
আমি এখন এইখানে
এই পাথরে ফুল ফোটাব এই পাথরে মন্ত্র
এইখানে খোদাই করব নাম
শব্দে-শব্দে দুলিয়ে দেবো নাভিমূল
বাতাসে বাতাসে ভ্রূণবীজ
আমি
পাহাড়ে আঘাত করে খুলে দেব প্রস্রবণ
নীলিমার দিকে হাত তুলে স্পর্শ করব মাটিকে
চোখের মণিতে সূর্য জ্বেলে
জ্বালিয়ে দেব ঘরের প্রদীপ ।
তোমাকে বলি
তোমার হাতেই গচ্ছিত আামার সার-সত্তার সান্ত্বনা
তুমি ওই পথে যাও
ওইখানে স্থির হয়ে বসো।
এক একটা দিন
এক একটা দিন মনে হতে থাকে সব চলে গেল
. সব চলে গেল ;
এক একটা দিন দেখি কারা দূরে নদীর ওপারে
. সাজাচ্ছে চিতা ;
সারাদিন ধরে ঝুপ্ ঝুপ্ পাড় ভাঙার শব্দ
. কান পাতলেই ;
সারা বনটাই চষে ফেলি তবু কোনখানে নেই জনক দুহিতা !
এক একটা দিন মেঘ ও রৌদ্রে শৈশব থেকে
. ছুটে আসে হাওয়া ;
হু হু করে বুক, কীসের অসুখ বুঝি না
. মেঘেরা ঝুঁকে পড়ে নীচে ;
গগন ঠাকুর মৃত্যু সিরিজ সাদা কালো রঙে
. এঁকে যায়, আর—-
ঘুঘু ডাকে অস্ফুট স্বরে, বলে—-
. শুরু হল যাওয়া, শুরু হল যাওয়া ।
আমি ভূতগ্রস্ত
আমি ভূতগ্রস্ত এক সম্মোহিত শব্দের শিকারি ;
আজন্ম তাড়িত আত্মা ; অস্থির অশান্ত, সিদ্ধবাক্ ;
যে তীক্ষ্ম আঘাত করে, আমি পায়ে নত হই তারই,
যদি সে পোড়ায়, আমি পায়ে নত হই তারই,
যদি সে পোড়ায়, আমি পুড়ে পুড়ে হয়ে যাই খাক্
এবং উদ্ভূত ছাই ভ’রে রাখি শব্দের কলসে |
স্রোতে ভেসে যেতে যেতে সে খুঁজে ফিরছে খড়কুটো,
ভাঙন-ভঙ্গুর পাড়ে দাঁড়িয়ে, নিজেরই মুদ্রাদোষে
টেনে তুলি তাকে, —- নেই আমারই আশ্রয়, চাল ফুটো |
আমার পায়ের নীচে অনন্ত গহ্বর মুখ মেলে
প্রতীক্ষায় ; তার চাওয়া সামান্যই, খেতে চায় দেহ ;
জ্বলন্ত শরীর নিয়ে আমি ছুটি দর্পিত পা ফেলে ;
কখনও দিগন্ত জুড়ে হাত পাতি বিশাল সস্নেহ,
সেই হাতে ভিক্ষাপাত্র, প্রেম আর মৃত্যুর ভিখারি |
আমি ভূতগ্রস্ত কবি; সারা বিশ্ব গিলে খেতে পারি |
অনবসানের গান
ঈশ্বরের কথা খুব মনে হয় আজকাল, আর মনে পড়ে
তোমাকে | তুমি
নও ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী, নও অনন্তের | তুমি
এই ব্যক্তবিশ্বের সামান্যা, শুধু —
অসামান্য আমার কল্পনায়, আমার
সত্তায় সংলগ্ন অরূপের বর্ণোদ্ভাস ;
রঙে রেখায়, রক্তের স্পন্দনে
সে এক দৈবী উদ্ভাসই মেনো |
পঞ্চাশ পার হয়েছি, চুলে ধরেছে পাক,
আমি আজকাল অবলীলায় শুনতে পাই
. শূন্যে ঝুলম্ত ঘন্টার ধ্বনি ;
দেখতে পাই সেই
. অদৃশ্য ঘড়ির কাঁটার অবিরাম সঞ্চরণ,
শুনতে পাই
. নৈঃশব্দ মন্থিত কান্নার শব্দ ;
আর আমার প্রিয়তম ইন্দ্রিয়গুলি,
. ওরা ক্রমশই হয়ে উঠছে প্রখর আর অনুভূতিময় |
ভেবেছিলাম এই পড়ন্ত রোদে মিলিয়ে যাবে
. তোমার মহিমান্বিত দৈবী উপস্থিতি ;
হয়তো ফিরে তাকাব অভ্যেসে
. দাঁড়াব না তার টানে ;
এবার দেব ছুটি তোমাকে, আর তা চিরকালের মতো ;
এই রকমই শপফ ছিল আমার |
আর দেখলাম
তুমি রয়েছো আমার আঠারো বছরের শরীরটাকে জড়িয়ে,
আমি বয়ে বেড়াচ্ছি তো আমার একটাই শরীর, যেমন
একটাই আকাশ —
ঝড় উঠলেই মনে হয় কত অচেনা,
মেঘের দিনে দুরলোকের আভাস আনে বহন ক’রে |
আর এই চির পরিচিত মাটি, সেও কেমন
বদলে যেতে থাকে, দিনদিন বদলে যায় |
তুলতুলে মাটি কখন হয় পাথর, আর তার বুকে
ফণিমনসার কাঁটা ফোটে পায়ে
আবার ঘাসের মসৃণতা দুঃখ দেয় ভুলিয়ে |
অথচ তুমি রয়েছ তেমনই ; জড়িয়ে আছ আমার
আঠারো বছরের শরীরটা |
আমি স্থির হতে পারছি না |
ভাঙছে শরীর, আর ছড়িয়ে দিচ্ছি শিকড়গুচ্ছ যতোদূর
আঁকড়ে ধরতে পারি |
ছিলাম এক আর হয়েছি বহু—-
ভাঙতে ভাঙতে বীজ যেমন অনন্য হয়ে ওঠে
একটি গাছ — এক স্বতন্ত্র উত্স থেকে পরিণাম |
তুমি রয়েছ উত্সে জেনো ক্ষণজীবিতের পূর্ণতা;
মেতে মেতে ফিরে ফিরে দেখছি তোমাকে |
এইমাত্র যে শালিকটি উড়ে গেল পশ্চিমের দিকে
ওর পাখার ছায়া সরে যেতে দেখলাম ধুলোয় ;
বাতাস এল উদাসীন আবেগ কাঁপিয়ে
আর উড়িয়ে নিয়ে গেল ছায়া মাখা ধুলোকেই ;
সে সাজলো রাজা ;
একটি পালকও আর পড়ে রইল না ধুলোয় |
পথ ভাঙতে ভাঙতে আমি এসেছি এইখানে |
আমার তরতাজা শরীরটা এখন ক্ষয়িষ্ণু শিলা যেন,
তার উপরে আছড়ে পড়ছে নোনা জলের ঢেউ,
জলের দাঁত দিনরাত্রি খাচ্ছে কুরে কুরে
আমি টের পাচ্ছি ; আর তখনো
আমার রক্তে তোমার দৈবী মুখ কাঁপছে তিরতির ক’রে,
আজ আমি যখন ভাবছি ঈশ্বরের কথা,
ভাবছি তোমার কথাও |
সেই আমার উষ্ণীষ পরা প্রথম অশ্বারোহী দিনগুলো
ছটফটিয়ে তারার দেশে পাড়ি দিতে চাইত একদিন,
আমি ছিলাম চালচুলোহীন রাজপুত্র,
স্বপ্ন ছিল তরোয়াল ;
প্রাণ ধারণে প্রাণান্ত, তবু স্বপ্ন ছিল আমার
হাতের মুঠোয়, আমার হাতের—- |
আমি বাঁচতে চাইলাম তোমাকে প্রতিদিনের তুচ্ছতায়,
তুমি ভয় পেলে |
আমি ছিলাম তখন ফুটোফাটা ডিঙি নৌকোর মাঝি,
কে হবে চরণদার ?
তুমি ভুলে গেলে পরস্পরের আত্মার সৌগন্ধ্য
আর তার বিনিময়ে মুহূর্তগুলি ;
তুমি বিছিয়ে দিলে সাদা চাদর আমার স্বপ্নগুলোর উপর ;
ঠান্ডা মেঝের উপর পড়ে রইল শ্বেতগোলাপের পাপড়ি
ইতস্তত মিথ্যে প্রেমের স্মারক চিহ্ন হয়ে |
আজও মাঝে মাঝে সরিয়ে ফেলি চাদর আর দেখি
আমার মৃত স্বপ্নগুলির শরীর হয়েছে কিনা বিকৃত |
দেখি, ওরা যেমন ছিল তেমনি আছে ;
আমার স্পর্শের প্রতীক্ষায় ঘুমিয়ে আছে যেন ;
স্পর্শ পেলেই চোখ মেলবে, আবার উঠবে জেগে |
কিছু প’ড়ে থাকে
কিছু প’ড়ে থাকে, কিছু খুঁটে খায়., কিছু ঠোঁটে ক’রে
পাখি উড়ে যায় কোন্ দিকে ?
এইভাবেই আমাদের থাকা কিংবা না-থাকা ফুরোয় ?
রাখি বা না রেখে যাই দিনপঞ্জী লিখে,
অলৌকিক পাহাড়ের সোনার চুড়োয়
সূর্য বসে, নেমে যায় খাদে |
সুবাতাস ভারী ক’রে কেউ কেউ দারুণ আহ্লাদে—
পৃথিবীর রাজপথ গলিপথ জুড়ে
রাজকীয় আলোর প্লাবন
দেখে যায়, পায়
চরিতার্থ জীবনের সুখ |
আমাদের পিঠে যদি আছড়ে পড়ে আলোর চাকুক —-
খুঁটে খাওয়া জীবনের এই পরিণাম
ভেবে দুঃখ পাই, দিই
ছানাদের ঠোঁটে তুলে
কাকড়ি দানার অবশেষ |
কুড়োনো খড়ের ঘরে নেমে আসে আলোর আবেশ,
শব্দ ক’রে ভেঙে পড়ে পার,
ঘূর্ণি ওঠে, ওঠে জলস্রোত ;
একদিন এইখানে মাটি ও মানুষ ছিল, তার
কোনো চিহ্ন রেখে যায় নদী ?
ইতিহাসকাল থেকে পুরাণ অবধি
কিছু প’ড়ে আছে, কিছু খুঁটে খায়, পালক ছড়িয়ে
কিছু ঘাসে
চিহ্ন রেখে চলে গেছে ; সেই অন্তর্ভেদী শূন্যতার
হা হা শব্দ চৈত্রের বাতাসে |
