কলকাতার রথযাত্রা
পুরোনো কলকাতায় ব্রিটিশ আমলে নাকি রথ হত খুব ধুমধাম করে। সত্যি সত্যি হাঁ করে তাকিয়ে থাকবার মতন মেলাও হত সে যুগে। পুরোনো কলকাতার অন্যতম ব্যাবসায়ী বাসিন্দা শেঠ এবং বসাক পরিবারের আয়োজনে হত এই রথযাত্রা। বৌবাজারে তখন বেরুত ৭০ ফুট উঁচু এই রথ। তাদের কুলদেবতা গোবিন্দজী মূলতঃ অধিষ্ঠিত হতেন এই রথে। তাঁদের বৈঠকখানা থেকে বেরিয়ে লালদিঘি অবধি বিস্তৃত অঞ্চলে এই রথ টানা হত। এছাড়াও পোস্তার জগন্নাথ দেবের তিনটি নামকরা রথ বেরুত এক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার আয়োজনে। রথ চলেছে সবার আগে। তার পেছন পেছন ব্রাহ্মণ, পুরোহিত, গাঁ–গঞ্জের মানুষজনে ছয়লাপ হত পথঘাট। সেই সঙ্গে বাজনা বাদ্যি থাকত যথারীতি। কেউ হাতে রং বেরংয়ের নিশান বা পতাকা নিয়ে। কেউ আবার ঝালর দেওয়া ছাতা ধরে সামিল হত পদব্রজে। কেউ পেল্লায় সাইজের তালপাতার পাখা টানতে টানতে চলেছে। কেউ হাতে মশাল জ্বালিয়ে। কেউ আতর, কেওড়া,অগরু, চন্দনের জল ছিটিয়ে দিচ্ছে। সঙ্গে চলেছে নাম সংকীর্তণের দল । খোল–করতাল–মঞ্জীরা–খঞ্জিরা বাজিয়ে । প্রসাদ ছুঁড়ে দিচ্ছে রথের ভেতর থেকে। আপামর জনসাধারণ কুড়িয়ে নিচ্ছেন সেই সত্র লুঠ। এ যেন প্রতিবছর ঝালিয়ে নেওয়া জগন্নাথের নবকলেবর অভিষেক। তাঁকে নতুন করে পাব বলে। জগন্নাথ সবার। তিনি জগতের নাথ। জাতি–ধর্ম, কুল–পদমর্যাদা, উচ্চ–নীচ এসব ভেদাভেদের ঊর্দ্ধে।
এদের হাত ধরেই মনে পড়ে দেড়শো বছরেরও বেশি পুরনো বউবাজারের রামকানাই অধিকারীর রথের কথা। পুরনো সাবেকি রথটির বদলে আজ ছোট একটি রথে বসানো হয় জগন্নাথকে। মন্দিরের মধ্যেই পালিত হয় রথযাত্রা।
রানি রাসমণির স্বামী জানবাজারের জমিদার রাজচন্দ্র দাসের বাড়ির প্রাচীন মহামূল্যবান রথটি ছিল রুপোর। রথ টানত দু’টি সুসজ্জিত ঘোড়া। একজন সারথি এবং চারটি পরী । এসবই ছিল রুপোর। শুধু রথযাত্রা উপলক্ষেই সে যুগে আড়াই থেকে তিন মণ জুঁই ফুলের মালা কেনা হত । এখন এই রথযাত্রা হয় রাণী রাসমণির স্মৃতি বিজড়িত দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দিরে। রানির গৃহদেবতা ছিলেন রঘুনাথ জিউ । জাতপাত ভুলে এই রথে সামিল হতেন অসংখ্য মানুষ। ঢাক,ঢোল,সানাই, কাঁড়া–নাকাড়ার শব্দে মুখরিত হত কলকাতার রাজপথ। সঙ্গে বেরুত কলকাতার পুরনো ট্র্যাডিশন মেনে সং।
বউবাজারে যদুনাথ দত্তের ঠাকুরবাড়িতে গত ১২০ বছর ধরে তাঁদের গৃহদেবতা জগন্নাথের উদ্দেশ্যে সাড়ম্বরে পালিত হয়ে আসছে রথযাত্রা। এখানে নেই সুভদ্রা ও বলরাম । রথ উপলক্ষে রুপোর সিংহাসনে বসানো হয় দেবতাকে। বিশেষ পুজো, ভোগ হয় এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। নহবত বসে। রাজবেশ,পদ্মবেশ পরানো হয় বিগ্রহে।
মুক্তারামবাবু স্ট্রিটের মার্বেল প্যালেসের রথ? সেখানে বেলোয়ারি কাচের ফানুসে, রেড়ির তেলে ও মোমবাতির আলোয় গৃহদেবতা জগন্নাথ সিংহাসনে উপবিষ্ট । প্রথা অনুসারে পুরীর মতই স্নানযাত্রার পরে জগন্নাথ অসুস্থ হন এবং পাঁচন গিলে তিনি আবার সুস্থ হন। এরপর হয় অঙ্গরাগ, পুজো, আরতি । রাজা রাজেন্দ্র মল্লিক প্রচলিত বৈষ্ণব প্রথা অনুযায়ী আজও হয়ে আসছে সাবেক আচার অনুষ্ঠান। এ বাড়ির রথ বাড়ি সংলগ্ন নীলমণি উদ্যানেই টানা হয়। রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে আজও মেলা বসে।
এরপরেই মনে পড়ে বউবাজারের গোবিন্দ সেন লেনে চুনিমনি দাসীর রথের কথা। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ১২৫ বছরের প্রাচীন জগন্নাথ বিগ্রহ ও সাবেক শিল্পরীতিতে নির্মিত এই রথ পঞ্চ চূড়াবিশিষ্ট এবং ত্রিতল রথের চার দিকে চারটি পুতুল এবং রথের গায়ে আঁকা আছে দেবদেবীর ছবিও। শোনা যায়, পুরীর নব কলেবরের সময় অবশিষ্ট একখণ্ড নিমকাঠ দিয়ে তৈরি হয় এই পরিবারের নিমকাঠের জগন্নাথ বিগ্রহ। এই বিগ্রহের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত শালগ্রাম শিলা। স্নানযাত্রার পরে হয় বিগ্রহের অঙ্গরাগ। এখন আর তাদের রথ রাস্তায় বেরোয় না। বাড়ির উঠোনেই টানা হয়। রথ উপলক্ষে আজও জগন্নাথের রাজবেশ এবং বামনবেশ হয়। প্রতিদিন হয় হরেক রকমের বিশেষ ভোগ নিবেদন। এখনও প্রতি বছর পুরী থেকে পাণ্ডারা আসেন রথ উপলক্ষে।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুরীর জগন্নাথদেবের আচার, ব্যবস্থা মেনেই কলকাতার এই প্রাচীন রথযাত্রা গুলি তাদের কৌলিন্য হারায়নি একটুও। কিছুদিন আগে শুনলাম বর্ধমানের কোন্ এক স্থানে মুসলিম পরিবার রথ নির্মাণে সামিল হয়েছেন। আর কেনই বা হবেন না?তাদের মত ক্রাফটম্যানশিপ ক‘জন হিন্দুদের থাকে?তাদের ঘরের মেয়েরা পর্যন্ত সামিল হন রথযাত্রায় । শুনেও ভাল লাগে। মনে পড়ে যায় রবিঠাকুরের কবিতা।
মিলনের রথ চলে
জীবনের পথে দিনে রাতে,
বৎসরে বৎসরে আসে।
এই তো শুনছিলাম বাংলায় এই রথযাত্রাকে ঘিরে পর্যটন উৎসব চালু হবার কথা। কলকাতার প্রাচীন,ঐতিহ্যমন্ডিত এই রথযাত্রাগুলিকে নিয়েও ভাবা যেতে পারে কিন্তু। রাজ্যের লক্ষ্মী ভাঁড়ারে কিছু রেভিনিউ আসতে বাধ্য। ঠিক যেমন হয় পুজো পরিক্রমা। এই তো গেল বছর মহিষাদলে ড্রোণ নিরাপত্তায় পুরো রথযাত্রা মনিটরিং হল।
এই তো চাই। বাঁধভাঙা মানুষের ভীড় আর বর্ণাঢ্য রথযাত্রার নজরদারি করল ড্রোণ। অথচ এখন কলকাতায় রথযাত্রা মানেই দুর্গাপুজোর খুঁটিপুজো। কেমন পানসে লাগে ভাবলে। খুঁটিপুজোর দেখনদারি বিজ্ঞাপন থাক তবে রথযাত্রা আরেকটু পাত্তা পাক এই শহরে। আরও হাজার মেলার ভীড়ে রথের মেলা হোক না এই শহরে । বেঁচে থাক রাধারানীরা। আমাদের রথ দেখে জুঁই ফুলের মালা হাতে পাঁপড় ভাজা খাওয়া। শুধুই কি ইস্কন আমাদের রথ দেখাবে? কলকাতার রথ মানেই কি ইস্কন? ইস্কনের রথযাত্রা ম্যানেজমেন্ট মানেই একটি টোট্যাল শিল্পময়তা। নিখুঁত ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট। কিন্তু আমরা কেন পারিনা শিখতে?
আমাদের মত জগন্নাথ প্রেমী অনেকেই কথায় কথায় পুরী ছোটেন। কিন্তু পুরীতে সেভাবে কি আমরা আমাদের জগন্নাথকে পাই আজকাল? সেখানে পান্ডারাজের প্রভাব আর প্রতিপত্তি ক্রমবর্ধমান। অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে প্রাণ। জগন্নাথ যেন তাঁদের একার সম্পত্তি। আর কারো অধিকার নেই তাঁর ওপর। এদের ঔদ্ধত্য আর দাদাগিরিতে হাঁফিয়ে উঠি আমরা। প্রতি পদক্ষেপে ফেল কড়ি আর মাখ তেল। মন্দিরে ঢুকতে,বিগ্রহ দর্শন করতে, ছুঁয়ে দেখতে এক একরকম প্যাকেজ এখন। কেন রে বাপু? জগন্নাথ তবে কার সম্পত্তি? তিনি তো একটা ব্র্যান্ড বটেই। তাঁকে ভাঙ্গিয়ে এভাবেই চলবে তবে?
আবারো এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায় রবিঠাকুরকে। সেই যে বিখ্যাত কবিতার লাইনগুলি?
রথযাত্রা, লোকারণ্য, মহা ধুমধাম,
ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম।
পথ ভাবে আমি দেব রথ ভাবে আমি,
মূর্তি ভাবে আমি দেব—হাসে অন্তর্যামী !
উত্তর কলকাতায় জন্ম। রসায়নে মাস্টার্স রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ থেকে। বিবাহ সূত্রে বর্তমানে দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা। আদ্যোপান্ত হোমমেকার। এক দশকের বেশী তাঁর লেখক জীবন। বিজ্ঞানের ছাত্রী হয়েও সাহিত্য চর্চায় নিমগ্ন। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায়। প্রথম উপন্যাস সানন্দা পুজোসংখ্যায়। এছাড়াও সব নামীদামী বাণিজ্যিক পত্রিকায় লিখে চলেছেন ভ্রমণকাহিনী, রম্যরচনা, ছোটোগল্প, প্রবন্ধ এবং ফিচার। প্রিন্ট এবং ডিজিটাল উভয়েই লেখেন। এ যাবত প্রকাশিত উপন্যাস ৫ টি। প্রকাশিত গদ্যের বই ৭ টি। উল্লেখযোগ্য হল উপন্যাস কলাবতী কথা ( আনন্দ পাবলিশার্স) উপন্যাস ত্রিধারা ( ধানসিড়ি) কিশোর গল্প সংকলন চিন্তামণির থটশপ ( ধানসিড়ি) রম্যরচনা – স্বর্গীয় রমণীয় ( একুশ শতক) ভ্রমণকাহিনী – চরৈবেতি ( সৃষ্টিসুখ) ২০২০ তে প্রকাশিত দুটি নভেলা- কসমিক পুরাণ – (রবিপ্রকাশ) এবং কিংবদন্তীর হেঁশেল- (ধানসিড়ি)।অবসর যাপনের আরও একটি ঠেক হল গান এবং রান্নাবাটি ।