| 7 অক্টোবর 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

লাল রঙের আব্বা

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

বুলু, ও বুলু, বেটি’…. ডাক শুনে সৰ্ষে তেলে মাখানো মুড়ির ছোট টুকরিটা নামিয়ে বুলু ছুটেন। পাশের ঘরের জ্বরে পড়া জ্যাঠি ততক্ষণে আধশোয়া হয়ে একটা বাজ ঝড়িয়ে পুনরায় নেতিয়ে গেছেন- ‘মেয়েটা দুটো দণ্ড জিরুতেও পারে না।  এই হাক, তো সেই ডাক।’

‘বুলু মা লজেন্স দাও।  মুখ শুকায় আসে। ‘ মানুষটার বড়ো লজেন্স খাওয়ার বাতিক হয়েছে।  খেয়াল না করলে পুরো লজেন্সের প্যাকেট এক বসাতেই শেষ করে ফেলেন। বুলুর তাই নিয়ম পাতা-  ‘না আব্বা, সব না। আমি আপনারে দেব। চারটে সকালে, চারটে বিকেলে।’ গরমকালে এর সাথে যোগ হয় আইসক্ৰিম। পাড়ার ছেলেপুলেদের সঙে জুটে আইসক্রীম নিয়ে আসেন।  তারপর উঠোনের মাঝখানে সূর্যের দিকে তাকিয়ে এক ঠ্যাং বক হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাওয়া। আইসক্রীমওয়ালাও হয়েছে তেমন, বারণ করলেও শুনবে না। মাঝেসাঝে চোখের পানি মুছতে মুছতে শুনান- ‘কী মানুষটা কী হইছে!  মাষ্টর সাবরে আমিই খাওয়াব। তোমরার পয়সা দেয়া লাগব না।’

বুলু আঁচলের খুট থেকে টাকা গোছাতে গোছাতে উত্তর দেন- ’পয়সার কথা তো না।  ঠান্ডা যে বাঁধাবে। আর অমন করে খেতে আছে?’ তারপর উঠোনের মানুষটার দিকে তাকিয়ে সাত তাড়াতাড়ি নিজের চোখই মুছেন,  ‘আব্বা, সূর্যের দিকে তাকায়া খাওয়া লাগে না।’ মানুষটা ক্ষেপে আরও এক শীতল কামড় জুড়ে দেন, ‘আমারে শিখাবা? এমনে খাওয়া উত্তম।  বইতে আছে।’ আহা কতো সারে সারে বই- রামায়ণ-বিষাদ সিন্ধু-দ্যা ওল্ড ম্যান এন্ড দ্যা সী-নজরুল-রবি-শরৎ-মাৰ্কস-এনসাইক্লোপেডিয়া। দিন যার কেটেছে কালো কালো অক্ষরের ঘূৰ্ণিপাকে, সে মানুষটা আজ পৃথিবীর তাবৎ লিখে যাওয়া বইয়ে খুঁজে চলে বকের ঠ্যাং হয়ে মালাইবরফ খাওয়া।

কোন কোন বেলায় ‘বুলু , ও বুলু, বেটি’ ডাক শুনে ছুট্টে আব্বাকে দেখার আগেই বড়ো বৌয়ের অভিযোগে হূুমড়ি খেতে হয়- ‘দেখো বুড়ার কাণ্ড। এক ঝাপটা লবণ নিয়ে খেতে বসছে, লবণ কড়কড় করতেছে দাঁতে।’ বুলুও অভিমান বাড়িয়ে ধরে, ‘মানুষটার কি সেই বুঝ আছে? এত লবণ নিছে মানা করবা না?’ বৌও উল্টে শান দেয় ননাসের কথায়- ‘ আপনি ছাড়া আর কেউ বললে  শুনে? দেখায় তো ঐ মেজাজ!’ আহা মেজাজ! চোখে দুই দান সুরমা, দু বগলে সুবাস আর প্রতাপ ছড়িয়ে হেঁটে যাওয়া মানুষটার মেজাজ মর্জির জুড়ি ছিল কোথাও! পাঁচ গ্রামের সালিসের তুখোড় বটবৃক্ষ। পুলিশ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে যেত সমীহে।

বয়সে আগাপাশতলা কতো কিছু বদলায়।  বদলেছেন বুলুও। বয়স বেড়েছে। এত ছুটোছুটি কি আর শরীরে সয়।  তাছাড়া তাঁরও যে আছে ছুটে চলা সংসার। সেখানে নাতি-নাতনী-মেয়েকে দেখতেও  ছুটে যেতে হয়। তখন বুড়ো মানুষটার পেরেশানি বাড়ে। হয়তো একদিন ঝড়ো বৃষ্টিতে একা একা ভিজেন, কাঁচা উঠোনে পিছলে পড়েন। জল-কাঁদায় একসা হয়ে নিজের ঘর ভুলে ছোট বৌয়ের ঘরের দিকে যান।  সে দরজায় তখন গেঁথে আছে একশ বছরের আদিম পাথর। অনেকবার দরজায় শব্দ তুলে মানুষটা আবার বড়ো বৌয়ের ঘরের দিকে ছুটেন। সেখানেও শব্দ ঝমঝম করে- ‘ভিজাইয়া সব ভরাবে , দরজা বন্ধ করে দে রতন।’

অথচ একদিন এই সংসার এই বৈভব এই আয়োজন এইসব মানুষ সবই ছিল ওঁর তুমোল  মুঠোতে। সব ছিল তাঁর নিজের হাতে পোষা সোনার ফসল। সেসব বাকিদের আর মনে পড়ে না আজকাল। মানুষটা নিজেও ভুলতে বসেছে সব। তবু কী একটা যেন মনে আসে। ভেসে যাওয়া মলিন একটা কেয়ার পাতার মতো মানুষটা গোয়াল ঘরের দিকে ছোটে। গরুর দিকে তাকিয়ে মনে আসা সেই নামে ডাকে- ‘বুলু, ও বুলু, বেটি, ঘরে যাব মা, ভাত দে।’ মনুর বৌ সিতারা রান্নাঘর থেকে হৈচৈ ছড়ায়- ‘ও বড় মিয়া তুমি কোন মায়েরে বিছরাও।’  

বৌদেরই বা দোষ কি। আচার আচরণের বালাই নাই,  সময় জ্ঞান নেই, পাঁচবার জোহর পড়েন, ঠিক ঠিকানা নেই হাগুমুতের- এমন মানুষের ধকল কতো আর সহ্য হয়। এতবার বিছানা ধুতে গেলে স্বয়ং জগধাত্রী মায়েরও বুঝি বিরক্তি আসে।  তাই হয়তো মানুষটার বিছানা-তোষক সরিয়ে ফেলা হয়। এক লুঙি, আধল্যাংটাতেই কেটেকুটে যায় বাঁধাধরা দিন। ভোর হলেই অবশ্য পুকুরে ঝাঁপ দেন। নাতবৌ রসিকতা করে- ‘বুড়া বয়সে রঙ হইছে।  একটা দাদীর দরকার।’ কখনো সখনো টসটস করে তেঁতুল খাওয়া দেখলেও হাসির বান ছুঁড়ে- পোয়াতী হইছেন।

ব্যাস, বড়ো মিঞা যায় ক্ষেপে। জোরে জোরে ডাকেন- বুলু, ও বুলু, বেটি। বাবার সেই ডাক  চিঠির পথ ধরে, মেঘের পথ হেঁটে

বুলুর কাছে পৌঁছুয় না।  কিংবা হয়তো পৌঁছুয়! নয়তো কেনোই বা পাহাড়ের শহরে মেয়ের আদরের সংসারে বুলুর বড়ো মন কেমন করে?  স্বপ্ন দেখে মেয়েকে জড়িয়ে ধরেন- ‘মা’রে আমি যাই আজকেই। আবার আসবো।’ মেয়ে অভিমান করে। পোলাও বসিয়েছে, খাসীর ভুনা হয়ে এলো বলে, কুলোয় মাখামাখি করছে গলদা চিংড়ি।  বাড়িতে মানুষ কি নেই আর! তবু সব অভিমান যুক্তিকে পেছনে জমিয়ে একাই বাসে রওয়ানা দেয় বাবার আদরের বুলু।

শীতের সন্ধ্যায় বাড়ি পৌঁছে দেখেন লুঙির নিচে হারিকেন রেখে, দাঁড়িয়ে দুপা সেঁকছেন আব্বা।  ঘর জুড়ে তীক্ষ্ম বুনো সব গন্ধ। মুখ দেখে কী আন্দাজ করে খানিকটা লুঙি সরিয়ে বুলু দেখেন সেঁক দিতে দিতে উরু গেছে পুড়ে, গোটা গোটা ফোস্কায় ঢেকে গেছে আব্রু। হাঁফ ছেড়ে বসা বৌদের, ভাইদের ধমকান- ‘একটু যত্নও নিতে পারিস নাই? রহমতের ফেরেশতা কেমনে আইবো এই নাপাক ঘরে।’ আবার তোষক, চাদর, শালুক লাল লেপ, ওয়ালক্লথ পাতা হয়।  পাশে কলার ডাট বসিয়ে প্রসাবের ব্যবস্থা, তারও পাশে চিলুমচি। ‘আব্বা এখানেই সব করবেন। আমি পরিষ্কার করবো। অতদূর যেতে হবে না।’ সারা ঘরে সুগন্ধ ছড়ে, ভিজে জুঁই ফুল গন্ধ বিলায়। আরামে চোখ বুজতে বুজতে বড়ো মিঞা প্ৰশ্ন উত্তর নিয়ে পাঁচ গুটি খেলেন ‘তুমি আমার কে গো? মা গো মা।’ তারপর রাজ্যের সব ছড়া গুনগুন করেন, কখনো হুটহাট মনে করেন কলের দিনে শোনা সন্ধ্যাকে – কে তুমি আমারে ডাকো।  

বুলুর তখন সেই ছোট্টবেলায় বাবার কোলে বসে গল্প শোনার কথা মনে পড়ে, মনে পড়ে বরের মৃত্যু সংবাদ নিয়ে ফেরা আঠারো বছরের মেয়েকে দেয়া জবান- তোর সব দায়িত্ব আমার, মনে  পড়ে বাবার পাশে থেকে এতদিনকার বৈধব্যের সংগ্রাম। ঠিক এই ঘরেই একদিন মানুষটা হিন্দু মেয়েদের আশ্ৰয় দিয়েছিলেন, তারপর সকালে বোরখা পড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন ওপাড়ে। এই মানুষটাই ভরা মজলিসে সুবহানের বাড়ানো রামদার সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে বলেছিলেন- ফেল মাথা।  কী করে মানেষ পারে নিজেকে ভুলে যেতে এতটাই! আহা, ক্লান্ত হয়ে শুয়ে আছে রাজা, পৃথিবীর সকল প্রতাপ হারানো।

বুলুকে আবার ছুটে যেতে হয় সন্তানের টানে। এবার কাছে কোথাও নয়।  সীমানা পেরিয়ে সেই বরফের দেশে। পার্সপোর্ট ভিসা সবকিছু ঠিক করে এনেছে পিএইচডি শেষ করে ফেরা মায়ের অহংকার।  কি করে সন্তানের আনন্দকে ফেরায় মা! কী করে ফেরাতে পারে পিতা! এখানে ভালো নেই তাও তো নয়। ছেলের সংসার, সফলতা, প্রথম নাতী দেখা এও কী কম সৌভাগ্যের? তবু কোথাও যেন এক ফেরার টান। দাদুপাগল নাতীন কতোরকম চকলেট দেয়। বুলু না খেয়ে সব লুকিয়ে রাখেন সুটকেসের কোন একটা কোণে, চুপিচুপি ক্যালেন্ডারে দাগ টেনে রাখেন, বরফের দুপুরে কাঁথা বুনেন, ফুল তুলেন দূরের ফেলে আসা উষ্ণ ঘুমের জন্য।

বুলুর বুকে থেকে থেকে ঘুরপাক খায় দুটো টলটলে চোখ।

এই যেমন এখন। কেন যে বারে বারে আব্বার মুখে শোনা সেই কবিতা মনে পড়ে “আজিকে তুমি ঘুমাও, আমি জাগিয়া রব দুয়ারে,/রাখিব জ্বালি আলো।/ তুমি তো ভালো বেসেছ, আজি একাকী শুধু আমারে বাসিতে হবে ভালো”।   হঠাৎই কানে আসে ঠিক সেই ডাক- বুলু, ও বুলু , বেটি। চমকে তাকিয়ে দেখেন দেয়াল আয়নায় হাড় জিরজিরে একটা রুগ্ন বিষাদী মুখ, দুটো টলটলে চোখ। বুলু কেঁপে ওঠেন হাওয়ায় পাওয়া দোলনার মতোন। তখনই বুঝি হুহু করে ওঠে এ বাড়িটার ফোন। কিছু পরে ছেলেও ডাকে- আম্মা কাম সুন।  দেশ থেকে জরুরী।

বুলুর ততক্ষণে অবশ্য কেটে গেছে ঘোর।  ধাতস্থ চোখে ভুল মুখ গড়িয়ে গেছে, ছিটকে গেছে সেই ডাক। আসলে একটা লাল পাখি জানলার পাশের চেরী গাছটায় বসে ডাকছে।  নাতনী সেদিন শুনিয়েছিল ‘লোকে বলে লাল কার্ডিনাল পাখি মৃত মানুষের আত্মা নিয়ে ফেরে। মৃত মানুষ প্রিয়জন দেখতে আসে একটা লাল পাখি হয়ে।’

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত