কাল জন্ম নেবে আমার ভাই
রূপকথাটা লিখেছেন ক্রিস্তিয়ান ঝোলু বুয়া
অনুবাদ করেছেন জাহীদ রেজা নূর
ছবি এঁকেছেন ক্রিস্তিয়ান অঁরি
মুরগিছানাদেরই সময় এটা। যে মুরগিছানাগুলো একটু আগেই ডিম ফুটে বের হয়েছে, তারাই আমুদে পরিবেশে আনন্দে গা ভাসিয়ে দিয়েছে লনে।
শুধু ওই গোলাপি মুরগিছানাটা, কারমেলিতো যার নাম, তার মনটা ছিল খারাপ। ও নিজের বন্ধুদের দিকে বড় বড় রাগি চোখে তাকিয়ে ছিল। আর ভাবছিল, ‘কেন আমার একটা ছোট ভাই জন্মালো না! একটা ছোট ভাই আজ জন্মালে আমার বন্ধুদের মতো আমিও তো ছোট ভাইটাকে সঙ্গে নিয়ে খেলতে পারতাম, কেঁচো ধরতে পারতাম!’
কারমেলিতো চিৎকার করে নিজের বন্ধুদের জিগ্যেস করল, ‘সম্মানিত মোরগ বন্ধুরা, আপনারা কি আমাকে আপনাদের কোনো বাচ্চাকে একটু ধার দেবেন?’
‘না না, ধার দেব কেন?একদম ধার দেব না। এরা তো আমাদের ভাই!’
তখন রাগে দুঃখে গোলাপি মুরগিছানারা হাত পা ছুঁড়ে চিৎকার করে বলল, ‘আমিও একটা ভাই চাই!’
গোলাপি মুরগিছানাটা ওর মা– বাবার কাছে গিয়ে বলল, মা, বাবা, বাচ্চা কীভাবে হয়?’
মুরগী–মা কারমেলা তার ছেলে কারমেলিতোকে তাঁর কোলের ওপর বসালো তারপর সে বাচ্চাটাকে বলতে থাকল জীবনের মহান গোপন কথাটি।
‘শোনো আমার প্রিয় কারমেলিতো, একটা বাচ্চা হওয়ানোর জন্য মা মুরগিকে তিন সপ্তাহ ধরে একটা করে ডিম পাড়তে হয়।’
মোরগ বাবা পিট যোগ করল, ‘কিন্তু খামারের চাষীরা আমাদের সবগুলো ডিম নিয়ে যায়, কারণ এই পুরো খামারে তোমার মা সবচেয়ে সুন্দরী। ডিম নিয়ে যায় বলে তোমার মায়ের কাছে আর ডিম থাকে না, তাই ছানাও আর ডিম থেকে বের হয় না। কারমেলিতো বুঝল, কোনোদিনই ওর কোনো ভাইয়ের জন্ম হবে না।
তখন পেটুক পাখি পেদ্রো পাখা ঝাঁকিয়ে বলল, ‘বন্ধুরা, বিশ্বাস করো, ওই খামারি কখনোই আমার বাড়িতে তোমাদের ডিম খুঁজতে আসবে না।’
‘আরে! দারুণ তো! ঠিক বলেছো!’ একসাথে বলে উঠল মোরগ মুরগি।
‘পেটুক পাখির বাড়িতে ডিমটা থাকবেও ভালো। ওর বাড়িটা নরম।’ বলল পিট।
‘‘হুম. ডিমটাকে কেউ ওখানে খুঁজবে না।’ বিড়বিড় করে বলল কারমেলা।
‘গোপন মুরগিছানা!’ বলল কারেমলিতো।
এভাবেই ওরা পেটুক পেদ্রোর ঘরের সামনে অপেক্ষা করতে লাগল গোপন ডিম থেকে গোপন মুরগিছানার জন্য। ওরা ওদের গোপন কথাটা নিয়ে টু শব্দটিও করেনি। খামারি জানতেই পারল না এখানে কিছু একটা হচ্ছে!
প্রতি রাতে কারমেলিতো নিজের বাড়ি ছেড়ে পিপার মধ্যে বানানো পেদ্রোর বাড়িতে যেত। তারপর জিগ্যেস করত, ‘পেদ্রো, আমার ভাইটাকে কবে আমি দেখতে পাব, বলো তো!ওকে দেখা জন্য আমার মন ছুটে যাচ্ছে!’
কারমেলিতো শুনতে পেত, ডিমের ভেতর কে যেন দুর্বল পায়ে আঘাত করছে। সে আওয়াজ শুনে কারমেলিতো মনে মনে ভাবল, যদি আমার ভাই হয়, তাহলে নাম রাখব শানতেক্লার। আর বোন হলে নাম রাখব কারমেন।
একদিন কারমেলিতো তার প্রিয় বন্ধু ভেড়ার পো বেলিনোর সঙ্গে গল্প করতে করতে ঠিক করল, যে ভাইটি আসছে, তার জন্য উপহার হিসেবে ওরা একটি লাঠি তৈরি করবে। খুবই সুন্দর একটা লাঠি!
ঠিক সে সময় পিক আর নিক নামের দুটো ক্ষুধার্ত বাচ্চা সজারু গলা পর্যন্ত খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এমনিতেই ওরা চোখের সামনে যা পেত, তা–ই খেত, পোকা, ব্যাঙের ছাতাসহ যা পেত, তাই খেয়ে নিত। কিন্তু আজকের দিনটায় পিক আর নিক, দুই ভাই একটু আয়োজন করে উৎসব করে খেতে চাইল।
হঠাৎ দুই ভাইয়ের মধ্যে যে ছোট, সেই সজারু ভাইয়ের নাকে এল আপেলের ঘ্রাণ!
কিন্তু বড় সজারু ভাই এক ঝটকায় ওকে আপেলের কাছ থেকে সরিয়ে নিল। কারণ, বড় সঁজারুটা জানত, ফাঁদ পাতা থাকলেই কেবল এত সুস্বাদু ফল শুধু এভাবে পড়ে থাকে।
তখন সজারুর বাচ্চাদুটো ঠিক করল এই বিশাল শস্যভাণ্ডারের অন্যপ্রান্তে যাবে, সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কত খাবার!
আর বাড়ির সামনে উঠোনে তখন পেদ্রো তাঁর বন্ধুদের দেখাচ্ছিল লাঠি নিয়ে সে কী ধরনের কসরত করতে পারে।
‘দেখ দেখ বাচ্চারা!’
আর তখনই কারমেলিতো একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখল।
‘সজারু দুটো কী নিয়ে খেলছে?’ প্রশ্ন করল কারমেলিতো।
দুই বন্ধু এবার ছুটল ওদের পিছনে। ভেড়ার ছানা বেল্লিনো দৌড়ালো মাঠের মধ্য দিয়ে আর কারমেলিতো দৌড়ালো বনের দিক দিয়ে।
পেদ্রো শুধু ওদের একটু সাবধান করে দিতে পারল। আর কোনো সাহায্যই করার ছিল না ওর।
আর ওদিকে সজারুরা বলছে, ‘নিক,আমার দিকে ছুঁড়ে দাও।’
’‘এবার আমাকে দাও।’ ডিম লোফালুফি করতে করতে বলছিল দুই ভাই।
‘ওকে নিয়ে লোফালোফি কোরো না’—কে এ কথা বলল জানো?
ডিমের ভিতর থেকেই এই প্রতিবাদটা এল!
‘আরে!ডিমটা দেখি কথা বলে!’
‘সাবধান নিক। আমার মনে হয়, ডিমটার ভিতরে কেউ আছে!’ বলল পিক।
সজারু দুটো এতোটাই ভয় পেল যে ডিম রেখে সাঁ সাঁ দৌড়ে পালালো। কারমেলিতো যখন সেখানে এসে পৌঁছালো, তখন সঁজারু ভাইদের টিকিটাও দেখা গেল না আশপাশে।
কারমেলিতো একেবারে ঠিক সময়ে সেখানে পৌঁছালো। ও নিজের চোখে দেখভল, কীভাবে একটা ডিম থেকে মুরগিছানা বের হয়।
‘আমার ভাই! না! এ তো দেখছি একটা মেয়ে!’ বোনকে দেখে মন খারাপ হয়ে গেল কারমেলিতোর।
‘আমার যে কী ভালো লাগছে!’ বলে উঠল কারমেলিতোর বোনটা।
বোনের নাম কারমেন। কারমেন লাঠিটা হাতে নিল। কারমেলিতো চেঁচিয়ে উঠল, ‘এটা ধরিস না কারমেন, এটা বাচ্চা মেয়েদের খেলনা নয়!’
‘ঠিক আছে, তবে তুমিই নাও।’
কারমেলিতো ভাবতে লাগল, কী করে এখন এই লাঠির সাহায্য নিয়ে নদী পার হবে।
‘এই নদীটা পার হতে হবে আমাদের। তবেই বাড়ি পৌঁছুতে পারব।’ বলল কারমেলিতো। ‘তোর কি খিদে পেয়েছে? আয় আয়। দাঁড়া! তোর জন্য কোনো খাবার জোগাড় করছি।’
কয়েক মূর্হর্ত পরেই কারমেলিতো বুঝল, বোনের জন্য যে খাবার সে খুঁজছে, তা পেয়ে গেছে।
‘কারমেন, তুই আপেল খেতে ভালোবাসিস?’ জিগ্যেস করল কারমেলিতো।
আর তখনই ফাঁদটা এসে কারমেলিতোর মাথায় এসে পড়ে আর কি! কারমেন প্রথধমে ভেবেছিল, বড় ভাইয়া বুঝি ওকে মজা দেবার জন্য এ রকম খেলা খেলছে। পরক্ষণেই ও বুঝতে পারল, এখন ভাইকে সাহায্য করতে হবে। তখন কারমেন হাতে তুলে নিল লাঠি আর সেই লাঠির সাহায্যে ফাঁদ থেকে বের করে নিয়ে এল ভাইকে।
‘কারমেন’ আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল কারমেলিতো। ‘তুই যে আমার বোন, এ কথা ভাবতেই আমার গর্ব হচ্ছে!’ কারমেলিতোর মন ভরে গেল বোনের জন্য ভালোবাসায়।
আর অন্যদিকে বেল্লিনো তো খুঁজেই চলেছে, খুঁজেই চলেছে।
‘লেডি, আপনি কি গোলাপী মুরগিছানাকে দেখেছেন?’
‘খুব ভালো একটা মুরগিছানার কথা জিগ্যেস করছি আপনাকে।’
‘কারমেলিতো!!!’
কারমেন পথে খুঁজে পেল এক টুকরো পাউরুটি, তারপর আরেক টুকরো, তারপর আরেক টুকরো।
‘কী খাচ্ছিস তুই?’ জিগ্যেস করল কারমেলিতো।
জানা গেল, এই রুটির টুকরোগুলো আসলে ফেলে গেছে বামনেরা। ওরা রুটির টুকরো দেখে দেখে বাড়ি ফেরার পথ খুঁজে নেবে। কারমেলিতো আর কারমেন যখন প্রায় পৌঁছে গেল বাড়ির কাছে, তখনই কেবল ওই সজারুগুলোকে দেখতে পেল।
‘কাপুরুষ হয়ে না থাকলে যুদ্ধে এসো। আমি প্রতিশোধ নিতে চাই!’ বলল কারমেলিতো।
কিন্তু সজারু দুটো ভয়ে গোল বলের মতো হয়ে গুটিসুটি মেরে পড়ে থাকল।
তখন কারমেলিতো ওদের নিয়ে একটা অন্যরকম খেলার কথা ভাবল।
লাঠির বাড়ি খেয়ে সজারু দুটো গিয়ে পড়ল একেবারে বেল্লিনোর… (বলা যাবে না কোথায়)
‘আরে! বেল্লিনো! তোমার কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছি। দেখো, ও আমার বোন। আমার বোনটা খুব চালাক আর সাহসী। অবশ্য ও এখনো কথা বলতে শেখেনি।
খামারে মুরগির ঘরে যা সাধারণত হয় না, সে রকমই একটা ঘটনা ঘটল। সব মোরগ মুরগি এক হয়ে উৎসব করা শুরু করল। তারা কারমেনকে নিয়ে লোফালোফি করতে লাগল । মা বাবা কারমেলা আর পিট দুজনের দিকে গভীর চোখে তাকালো। তবে বলে রাখা ভালো, সবচেয়ে খুশি হয়েছিল কারমেলিতো।
এক সকালে খামারি এসে অবাক হয়ে দেখল ঘুমন্ত কারমেনকে!
‘তুই এলি কোথা থেকে?’ অবাক হয়ে জিগ্যেস করল খামারি।
‘চোখে সূর্যের আলো এসে পড়ছে।’ বলে উঠল কারমেন।
‘আরে! আমাদের কারমেন কথা বলতে শিখে গেছে!’ কারমেনের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল মোরগ মুরগির দল।
সাংবাদিক, সাহিত্যিক, অনুবাদক