| 2 সেপ্টেম্বর 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

কমলাফুলি

আনুমানিক পঠনকাল: 6 মিনিট

আকাশের রংটা খোসা ছাড়ানো লিচুর মতো। দু’দিন আগেও এক চিলতে রংধনু হয়েছিল পশ্চিম কোণে। আজ কিচ্ছু নেই। পাঁশুটে রঙের সকাল আজ। স্যাঁতলা পরা। দোয়েল এদিক ওদিক তাকায়৷ তারপর মাথা ঘুরিয়ে একবার মাকে দেখে। বকুলি তখন মায়ের কাঁধে মাথা রেখে ঝিমোচ্ছে।

দোয়েল এবার ছুট দেয় ক্ষেতের আলের দিকে। সবুজ রঙের ধানগুলো কী সুন্দর মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে! ফিনফিনে পাখার ফড়িংয়ের দল ছেঁকে ধরেছে ওদের। দোয়েল কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ দেখে। তারপর দু’টো পাখা আঙুলের ফাঁকে কায়দা করে ধরে কোমরে গুঁজে রাখা পুটলিটায় হাত দেয়। সাবুই মুদির দোকানের পাশ দিয়ে আসার সময় একটা বাতিল ম্যাচবাক্স কুড়িয়ে নিয়েছিল। ফড়িংটাকে সেই বাক্সে ভরতে পেরে ফুর্তি লাগে ওর।

লাফাতে লাফাতে মাটিতে পা ফেলতে বড্ড আরাম! দুধে ভেজা রুটির মতো নরম মাটি। থপথপ শব্দটাও কেমন একটা ছড়ার মতো।
এলোনা বেলোনা
ঝুমকালতা ঝুম।
আলাইনা বালাইনা
সালাইমালাই কুম!

মজা পেয়ে আরো জোরে জোরে পা ফেলে সে। শব্দটা বাড়তেই আচমকা মাথার উপর জোরেসোরে গাট্টা পড়ে।

‘ঐ ছ্যাড়ি!’

জিহবায় কামড় লাগে, মুখের ভেতরটা নোনাস্বাদে ভরে যায়। দোয়েল এবার সতর্ক হয়, একটু দূরত্ব রেখে হাঁটতে থাকে। আম্মার মেজাজের কূল কিনারা পাওয়া মুশকিল। কথায় কথায় রেগে যায় মানুষটা। অথচ বকুলি কী সুন্দর হাসছিল ওর লাফঝাঁপ দেখে। নিচের মাড়িতে দুটো মাত্র দাঁত বকুলির। এই তো গত সপ্তা থেকে একটু একটু করে বাড়ছে মুক্তোদানা দুটো। আর তারপর থেকেই বকুলির প্রতি দোয়েলের মনোযোগ বেড়েছে। ওকে একবার হাসাতে পারলেই হয়, হাসির দমকে চোখে জল এসে যায় ওর। ফোলা ফোলা গালগুলো তখন চুমুতে ভরিয়ে দেয় দোয়েল।

ছোট্ট বকুলিকে নিয়ে আম্মা যাচ্ছে সুরতালীর বাজারে। দোয়েল সকাল থেকে ঘুরঘুর করছিল৷ নাজিমুদ্দিন মানে দোয়েলের আব্বা খেয়ে বেরিয়ে গেলে আম্মা দশমাসের মেয়েকে কোলে নিয়ে বের হয়। দোয়েলকে পিছু নিতে দেখে আম্মা প্রথমে রেগে গেলেও পরে বোধ হয় খুশিই হয়েছে মনে মনে। এই শরীরে এতটা পথ বকুলিকে নিয়ে হাঁটা বেশ কঠিন।

সুরতালীর বাজারটা তো খুব একটা কাছে নয়। দেড় দু’মাইল দূরত্ব হবেই৷ দোয়েলের অবশ্য হাঁটতেই বেশ লাগছে। পথঘাট খুব একটা চেনে না সে। তবু আগে আগে ছোটা চাই। মনটা খুশি খুশি তার। আজকে মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়েছে সকালে। সেই আনন্দে ওর চলার গতি বাড়ছে। এমনকি বকুলিও আজকে মাছ দেখে খুশি হয়ে গেছে। উঠোনে মাছ কুটতে বসেছিল আম্মা। জিয়ল মাছ। বকুলি ছাই মাখা মাছ দু’হাতের মুঠোয় নিয়ে টলোমলো পায়ে পালাতে চেয়েছিল। দোয়েল ছুটে গিয়ে ধরতেই কী কান্না ওর!

বোনের উপর খুব দাপট দোয়েলের। বকুলিরও অনেক জেদ। হাত থেকে কিছু নিয়ে নিলে গড়গড় করে শব্দ করে মেয়েটা। তারপর ঠোঁট উল্টে লালা ছিটিয়ে দেয় চারপাশে। দোয়েল মাঝেমাঝে ইচ্ছে করেই ওকে খ্যাপায়। ও যখন গভীর মনোযোগে উঠান থেকে ময়লা কুড়িয়ে মুখে দেয় তখন পেছন থেকে এসে ওকে চমকে দিতে মজা লাগে বেশ। ধরা পড়ে লাজুক ভঙ্গিতে হেসে ফেলে বকুলি।

কাজের সময় ওদের খুনসুটিতে আম্মার মেজাজ বেশ খারাপ হয়। চুলার পাশ থেকে দুই মেয়ের উদ্দেশ্যে উত্তপ্ত বাক্য ছুঁড়ে দেয়। অবশ্য রাগ করাটাও যুক্তিযুক্ত। কত কাজ একহাতে করতে হয় তাকে। দোয়েল হয়তো তখনো বাসনকোসন ধোয়নি, ভেজা কাপড় রোদে মেলে দেয়নি। মারের হাত থেকে বাঁচতে তখুনিই ছুট দেয় সে। তারপর পাতা কুড়ানোর জন্য টুকরি নিয়ে হাটখোলার বাগানেও যেতে হয় ওকে। ফেরার পথে কোনো কোনো দিন কাঁথার কাপড় আনতে হয় বেশ কয়েকটা ঘর থেকে। দুপুরে বকুলিকে ঘুম পাড়িয়ে মা কাঁথা সেলাইয়ে বসে। তখন দোয়েলের কোনো কাজ থাকে না। সে তখন তেরছা রোদে পা ছড়িয়ে বসে নারকেল পাতার চশমা, ঘড়ি, বাঁশি এইসব বানায়।

বাঁশির শব্দে বকুলি মাঝেমাঝে ঘুম ভেঙ্গে উঠে বসে। ওর সামনে সূঁচ নিয়ে বসবার জো নেই। কাঁথার উপর ধুপধাপ ঝাঁপিয়ে পড়ে মেয়েটা। এ অবস্থায় দোয়েলকেই সামাল দিতে হয় সব। বোনকে কোলে নিয়ে সে পুকুরপাড়ে গিয়ে বসে থাকে অনেকটা সময়।

এই পুকুরে মাঝেমাঝে বঁড়শি ফেলে আব্বা। আজ সকালে যেমন ফেলেছিল। দু’টো জিয়ল মাছ পেয়েছে। তারপর আম্মা সেই মাছের ঝোল রেঁধেছে। মাথা, লেজ আর পেটির টুকরো খেয়েছে ওরা তিনজন। আম্মা খায়নি। আম্মা মাছ খেতে চায় না। তার নাকি মাছের গন্ধ সহ্য হয় না। কিন্তু মাছ কুটতে বসে আঁশ পরিস্কার করতে করতে তার মুখটা কেমন হাসি হাসি হয়ে যায়। এই ব্যাপারটা নিয়ে ওর খটকা লাগে। কিন্তু মুখ ফুটে জিজ্ঞেসও করতে পারে না। অবশ্য মাসে দুই তিনবারের বেশি মাছ জোটেও না ওদের। তাই পাতে মাছ পেলে চারপাশ ভুলে খেতে বসে যায় দোয়েল।

আজ সুরতালী বাজার থেকে ফিরে সোজা পুকুরপাড়ে ছুট দিয়েছে সে। জায়গাটা খুব নিরিবিলি, ঠান্ডা ছায়ায় মোড়া থাকে সবসময়। দুপুরে ঘুম না এলে কিংবা কোনো কাজ খুঁজে না পেলে এখানে এসে বসে থাকে সে। আম্মা যখন খন্তা বা ঝাড়ু নিয়ে ওকে তাড়া করে তখনো পালাতে হলে এ জায়গাটা নিরাপদ বলে মনে হয় ওর। জোড়া পিটুলি গাছের আড়ালে লুকানোর বেশ ভালো একটা জায়গাও আছে। আর তারই পাশে আছে চুকাইয়ের ঝোপ। দোয়েল মাঝেমাঝে কোচা ভর্তি করে চুকাই নিয়ে যায়। আম্মা তাই দিয়ে লাল টুকটুকে সালুন নয়তো টক রাঁধে। সেদিন শুধু চুকাইয়ের সালুন দিয়েই ভাত খেয়ে ফেলে ওরা।

আজকে ওর চুকাই কুড়াতে ইচ্ছা করছে না। পুকুরে দুয়েকটা ঢিল ছোঁড়ার পরেও মনটা শান্ত হচ্ছে না ওর। অথচ রোজই ঢিল ছুঁড়ে মাছগুলোকে বিরক্ত করতে ঘুম মজা লাগে ওর। পড়ন্ত দুপুরে এদিকটায় যখন আর কেউ আসে না, পুকুরের জলটা তখন একটু বিশ্রাম পায়৷ সবুজ রঙটা নিচে নেমে গিয়ে উপরের স্তরটা ক্রমশ স্বচ্ছ হয়ে আসে। তখন মুখটাকে যদ্দুর সম্ভব জলের কাছে এনে মাছ পরিবারের সাঁতার দেখে দোয়েল। ওকে একবার দেখতে পেলেই জলের প্রাণীরাও সতর্ক হয়ে যায়, দলছুট হয়ে ইতস্তত ঘুরে বেড়াতে থাকে। দোয়েলের তখন জেদ চেপে যায়। সে একের পর ঢিল ছুঁড়তে শুরু করে। স্বচ্ছ সবুজ রঙটা আবার ঘোলাটে হয়ে যায় তখন।

দোয়েলের আজকে এসবের কিছুই ভালো লাগছে না। হাঁটুতে মাথা গুঁজে বসে আছে সে। জলের নিচের প্রাণীগুলোও বোধ হয় ওর শান্ত ভঙ্গি দেখে অবাক। ওরা দল বেঁধে ঘুরে ঘুরে চক্কর কাটছে স্বচ্ছ জলে। দোয়েলের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। সে একমনে বকুলির কথা ভাবছে। বকুলি এখানে এলে শক্ত করে ধরে রাখে ওকে। বোধ হয় ছায়া ছায়া অন্ধকারে ভয় পায় বেচারি। আর বকুলি মাছ খেতে খুব ভালোবাসে। খেতে বসে অনবরত হাত তালি দেয় মেয়েটা। এইসব ভাবতে ভাবতে ফোঁস করে একটা লম্বা শ্বাস ফেলে দোয়েল। তারপর বিড়বিড় করে নিজেকেই বলে- এবার থেকে বকুলি রোজই মাছ দিয়ে ভাত খাবে।

আঞ্জু খালার বাড়িতে গিয়ে দোয়েলের তো তাই মনে হয়েছে। বকুলি অনেক বেশি সুখে থাকবে ওখানে। কী বড়লোক আঞ্জু খালা! এত্ত বড় পাকা উঠান। দুইতলা বাড়ি। ছাদে কী দারুণ রেলিঙ। ঘরে কী দারুণ সব চেয়ার টেবিল আর খাটপালঙ্ক। কিন্তু খালাকে দেখে মনেই হয় না ওরা অত বড়লোক। খুব রোগা আঞ্জু খালা। গায়ের রঙটা কেমন ফ্যাকাসে। দেখে মনে হয় যেন আম্মার চেয়েও বয়সে অনেক বড়! বোধ হয় ভেতরে কোনো বড় অসুখ আছে তার।

সেদিনই রাতে শুয়ে শুয়ে আঞ্জু খালার গল্প করছিল আম্মা।
এত ট্যাহাপয়সা কিন্তু কোনো ওয়ারিশ নাই!
সবই আল্লাহর ইচ্ছা! আব্বা একটু থেমে তারপর বলেছে- এই বাচ্চাডা আরো আগে নষ্ট করন যাইতো রে দৈলির মা! আবার যদি…! আঃ! ভালা কথা চিন্তা করেন! এবার মানিকই হইবো, আপনে দেইখেন!

আম্মার গলাটা কেঁপে উঠে খানিকটা। এরপর আরো কিছুক্ষণ সংসারের খুটিনাটি আলাপ চলে। দোয়েল না ঘুমিয়ে মাঝেমাঝে সেসব শোনে। সে জানে ওদের টানাটানির সংসারে আরেকজন আসতে চলেছে। মায়ের পেটটা তাই দিনদিন উঁচু হয়ে যাচ্ছে। চুকাইয়ের ঝোপের উইঢিবিটার মতোন! বোধ হয় আরেকটা বকুলি আছে ওটার ভেতর। ভাবতেই খুশি লাগে দোয়েলের। আবার কখনো মনে হয় এবার ভাই হলেও মন্দ হয় না!

কালকে রাতে আম্মার মুখে শুনেছে আঞ্জু খালা বকুলিকে নিয়ে যাবে। কেন নিয়ে যাবে, কতদিনের জন্য নেবে তা জানতে পারেনি। শুধু আম্মা বলছিল- বকুলি খুব ভালো থাকবে ওখানে। দোয়েল এরপর অনেকক্ষণ ঘুমায়নি। তারপর অনেক ভেবে ওর মনে হয়েছে বকুলির ভাগ্যটা বোধ হয় খুলে গেল!

বকুলির ভাগ্যটা খুলে গেল! ভরদুপুরে পুকুরপাড়ে বসে এই কথাটাই এখনো ভাবছে সে। ঝিল্লির ডাকটাও একই কথা গুনগুন করে চলেছে ওর কানে। দোয়েলের গলার কাছে একটা অবাধ্য স্রোত দলা পাকাচ্ছে। ওর ভাগ্যটা এত খারাপ কেন! সামনের মাসেই ওকে আব্বা ঢাকায় দিয়ে আসবে, কথাবার্তা সব হয়ে গেছে। দোয়েলকে কাজ করতে হবে মানুষের বাসায়। হয়ত সেখানে তিনবেলা খাবার জুটবে ওর। কিন্তু আরাম তো পাবে না। আহা বকুলির সাথে যদি নিজেকে অদলবদল করা যেতো!

এর পরের কয়েকটা দিন অসম্ভব সব সম্ভাবনার কথা মনে এলো দোয়েলের। কোনো এক জাদুবলে যদি বকুলিকে রেখে দেয়া যেতো ওদের কাছে৷ কেন চলে যাবে মেয়েটা? এত ছোট বকুলি, মাকে ছাড়া রাতে ঘুমাবে কী করে? দোয়েলের এসব সমস্যা নেই। সে নিজের খেয়াল রাখতে জানে৷ আঞ্জু খালার কোনো কষ্টই হবে না যদি তিনি দোয়েলকে রাখেন।

এভাবে মনে মনে ছটফট করতে থাকা দোয়েলও সপ্তাখানেক পর বকুলির সাথে রওনা দেয় খালার বাড়িতে। বকুলি নতুন জামা পরে, সুগন্ধি পাউডার মেখে আব্বার কোলে চড়ে যায়। দোয়েল আজকেও আগে আগে হাঁটে, সেই ধান ক্ষেতের আলের ভেতর দিয়ে। কিন্তু আজকে ওর মন ভালো নেই। বকুলির প্রতি অনেক হিংসা জমেছে ওর। কী সুন্দর জামা পরেছে মেয়েটা! চুলে রঙিন ক্লিপ! কত বড় বাড়িতে ওর ঠাই হবে! মজার মজার খাবার খাবে প্রতিদিন। এমনকি আঞ্জু খালাকে মা বলে ডাকবে বকুলি৷ খালা কী ভীষণ ভালো! দোয়েলকে কত কী খাইয়েছে সেদিন।

রাগে হিংসায় মাটিতে জোরে জোরে পা ফেলে দোয়েল। দু’হাতে কচলে চোখ মোছে বারবার। নাজিমুদ্দিন মনে করে বকুলির সাথে আসন্ন বিচ্ছেদ ওকেও কাঁদাচ্ছে। দোয়েলের কাঁপুনি থামে না। মেয়েকে ডাক দেয় নাজিমুদ্দিন।

কান্দস ক্যারে? পাও বিষ করে?
আমি ঢাকা যামু না আব্বা।

আব্বা একটু অবাক হয় বোধ হয়। তারপর ওর মাথায় হাত বোলায়। নানান কথায় মিথ্যা আশ্বাস দেয় ওকে। দোয়েল সবই বুঝতে পারে। কান্নাটা থামেনা ওর। অস্ফুট স্বরে কিছু একটা বলতে চায় সে। নাজিমুদ্দিন চমকে গিয়ে মেয়ের দিকে তাকায়। বোধ হয় একটা অসহ্য যন্ত্রণায় সমস্ত অন্তঃকরণ কুঁকড়ে ওঠে তার।

আব্বার হাত ধরে দোয়েল মিনতি করে- বকুলিরে দিও না, আমি থাকমু আঞ্জু খালার ধারে৷
গভীর আকুতি নিয়ে আব্বার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে সে। বড় ভাবনাগ্রস্ত, গম্ভীর সেই মুখ। আব্বার হাঁটার গতি মন্থর হয়ে আসে। দোয়েল হাত বাড়িয়ে বকুলিকে কোলে নেয়। বোনের গালে চুমু খেতে খেতে আবার ছড়া কাটে।

সুয্যিমামার বিয়েটা
কমলাফুলির টিয়েটা।

মুক্তোদানার মতো দাঁত দুটো ঝকঝক করে ওঠে। কমলা রঙের জামায় বকুলিকে ঠিক কমলাফুলির মতোই দেখায়।

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত