প্রধান এসেছে, অনেক ক্ষণ হয়ে গেছে। প্রথমে তো পাশের ঘরে কিছুক্ষণ বসে ছিল। ডাক পাওয়ার পর ভিতরে গেছে। তাও প্রায় এক ঘন্টা পার হয়ে গেল।
চৈত্র মাস। বেলা সাড়ে তিনটে। এসময় পাখির ডাক এমনিতেই একটু কম থাকে। তবুও যদি কোথাও কোনো পাখি ডেকে উঠছে, প্রচণ্ড বিরক্ত লাগছে রাজার। যেন তাকে ব্যঙ্গ করতেই আওয়াজ তুলছে পাখি।
এই বাড়ির দুদিকে ঘন হয়ে গাছ লাগানো। লাগানো, ঠিক বলা যায় না। কোনো এক সময় হয়তো কিছু গাছ যত্ন করে লাগানো হয়েছিল! এখন তাদের ডালপালা, নীচে বেশ কিছু ঝোপগাছ, মিলে মিশে জঙ্গলের আকার নিয়েছে। হরেক রকম রং বেরং এর পাখির বাসা সেখানে। কাছে পুকুর আছে বলে কয়েক রকম বকও বাসা বেঁধেছে। বকগুলো নিঃশব্দে পুকুরপাড়ে মাছের লোভে ঘোরাফেরা করে। প্রধানকে দেখলেও রাজার ওরকম শিকারী বক মনে হয়।
প্রধান লোকটাকে রাজা পছন্দ করতে পারে না। একটুও না। মাথা নিচু করে প্রধানের সব কথা তাকে শুনতে হয়। কারণটা শুধু তার পেট নয়; কারণটা তার নিজেরই অজানা।
প্রধান যে এবাড়িতে কি আলোচনা করতে এসেছে, আন্দাজ করার কোনো উপায় নেই রাজার। তবে সে ধরেই নিয়েছে, যাই আলোচনা হোক না কেন, মুখ্য বিষয়বস্তু হল রাজা।
এ বাড়িতে রাজার আজ ছয় দিন। শুধু এই বাড়িতে নয়, বাড়ি থেকে চলে আসা ছয় দিন হয়ে গেল। রাজা জানে, ফেলে আসা বাড়িতে কাজের সময়টুকু ছাড়া তার কথা কেউ মনে করবে না। বাইশ বছর যে বাড়িকে সে নিজের বাড়ি বলে মেনেছে, সে বাড়ির প্রতিটি মানুষ, প্রতি মুহূর্তে তাকে কিন্তু আশ্রিত বলেই মনে করেছে। তাই এখনও পর্যন্ত কোনো পিছুটান তার মনে আসছে না।
এ বাড়িতে আসা, হঠাৎ একটা যোগাযোগে। ততটাই আকস্মিক তার সিদ্ধান্ত।
খবরের কাগজের শুধু দু’লাইনের বিজ্ঞাপন।
ম্যাসাজ জানা কর্মঠ যুবক চাই। থাকা খাওয়া, কাজ অনুসারে বেতন।
রাজাদের দোকানে কেউ হয়তো কাগজটা পড়তে পড়তে ফেলে রেখে গেছিল। দুপুরে দোকান গোছানোর সময় সেই কাগজ এবং এই বিজ্ঞাপন রাজার চোখে পড়ে।
পরদিন সোমবার। দোকান বন্ধের দিন। সেদিনই রাজা ফোন করে বসল ঐ নাম্বারে। তার আগে নিজেকে মিলিয়ে নিয়েছিল রাজা। ম্যাসাজ জানা । ম্যাসাজ করতে শিখেছে রাজা তের বছর বয়স থেকে। তার মানে, নয় বছরের অভিজ্ঞতা। প্রত্যেক দিন রাত্রে বাবাকে ম্যাসাজ করে দিতে হত তাকে। বাবার পিঠে, কোমরে, পায়ে ব্যথা আছে তো! ছোট থেকেই রাজা বাবাকে মালিশ নিতে দেখেছে। গবাকাকা আসত বাবাকে মালিশ করতে। তখন তো ঠাকুমা বেঁচে ছিল। কেউ তো তাকে বলে নি মালিশ শিখতে। নিজের আগ্রহেই দাঁড়িয়ে থাকত রাজা। কোনখানে বাবা বেশি চাপ দিতে বলছে, কোনটায় কম, সব রাজার মুখস্থ হয়ে গেছিল। বাবার মাথায় আর ঘাড়ে গবাকাকা যখন আওয়াজ করে করে মালিশ করত, খুব মজা পেত রাজা। তার ছোট ছোট দুটো হাত জোড়া করে, বাবার মাথায় প্রাণপণে আওয়াজ তোলার চেষ্টা করত সে। বাবা হাসতে হাসতে সেই মালিশ নিয়ে নিত। কিন্তু তারপর গবাকাকা আবার মালিশ করে দিত। দুঃখ পেত রাজা। তক্তপোষের তোষকের উপর জোরে জোরে আওয়াজ তোলার চেষ্টা করত। কবে যে সে ঐ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে, নিজেই বুঝতে পারে নি। ছোটবেলার অনেক কিছুই আর মনে করতে পারে না রাজা। কোন ছোটবেলায় যে মা তাকে তুলসীতলায় ঠাকুমার কোলে দিয়ে ভগবানের কাছে চলে গেছে, রাজার মনে পড়ে না। কিন্তু, ছোট থেকে মায়ের সম্বন্ধে এই ভাষা, ঠাকুমার মুখে শুনে এসেছে সে।
বাড়িতে রান্নার কাজ করতে আসত মালা মাসী। ঠিক সময়ে কেউ না কেউ তাকে খাবার দিয়েছে। জামা -কাপড় দিয়েছে। রাজার কাছে সেটাই স্বাভাবিক ছিল। খেলে এসে হাত-পা ধোওয়ার জন্য বকাবকি করতেও দুজনেই এগিয়ে আসত। পিঠে এক আধ ঘা যে কখনও পড়ে নি, তাও তো নয়। কিন্তু স্কুলের বন্ধু, খেলার মাঠের বন্ধু, কারো সঙ্গে রাজা নিজেকে পৃথক করতে পারত না। শুধু সবার মা আছে, রাজার মা নেই। এটুকুই।
ঠাকুমা যখন মারা গেল, রাজার ক্লাস এইট। বয়স তের। কয়েক দিনের মধ্যেই সব ওলট পালট। বাড়ির সব কিছু। মালা মাসী হঠাৎ করে বাবার বউ হয়ে গেল। মালা মাসীর দুটো ছোট ছোট ছেলেমেয়ে চলে এল এবাড়িতে। রাজার ঘরের দখল নিল তারা।
দরমার দরজা ঘেরা, বারান্দার কোণের ঘরে, জায়গা হল রাজার। স্কুল গেল। বাবার দোকানে কাজ এল সেই জায়গায়। সারাদিনের কাজের শেষে বাবাকে মালিশ করতে গবাকাকা আর এল না। সে কাজ পাকাপাকি হয়ে গেল রাজার। এত তাড়াতাড়ি সব কিছু ঘটে গেল, রাজা কিছু ভাবারই সুযোগ পেল না। ভাবল শুধু একটা কথা। মা তো তাকে ঠাকুমার কোলে দিয়ে চলে গেছে, ঠাকুমা তাকে কোথায় ফেলে দিয়ে চলে গেল। তখন থেকেই রাজা কর্মঠ। তার সব কাজের বিনিময়েও যে তার থাকা খাওয়ার মূল্য মেটে না, এটা সে বুঝেছিল। বুঝেছিল নানা কথাবার্তায়। দোকানে যখন পেটি নামত, সেই পেটি ভিতরে আনলে, ম্যাটাডোরের ড্রাইভার তার হাতে দশ বিশ টাকা গুঁজে দিত। কখনও পঞ্চাশ টাকাও পেয়েছে সে। হাতে নিয়েছে পুরো টাকা, কিন্তু তার অর্ধেক পেয়েছে রাজা। বাকি অর্ধেক নিয়েছে বাবা।
এই প্রধান হল ঠিক তার বাবার মত।
রাজা ম্যাসাজ করে পঞ্চায়েত অফিসের পাশের জমিতে। একটা ছোট ঘরে। গ্রামের লোকজন আসে। ম্যাসাজ নেয়। ষাট টাকা চাইলে চল্লিশ টাকা দেয়। কেউ ত্রিশ টাকা দিয়ে বলে, আর নেই বাবু। মন্দ লাগে না রাজার। কেউ বাবু বলে। কেউ খোকা বলে। একটা মালিশ করা ছেলের নাম বরং রাজা হওয়াটাই যেন বেমানান। রাগ হয় প্রধানের উপর। ঠিক তিনটের পরে আসবে। কত টাকা রোজগার হল, দেখবে। তার অর্ধেক নিয়ে নেবে। এরপর বাকি টাকার অর্ধেক দিতে হয় ম্যাডামকে। ম্যাডাম এবাড়ির মেয়ে। নাম বেবী। সে ই বিজ্ঞাপন দিয়েছিল কাগজে। তার কথা অনুযায়ী কাজ পেয়েছে রাজা। ম্যাডামকে টাকা দেওয়া রাজার কর্তব্য বলে মনে হয়। তাদের বাড়িতেই আছে। খাওয়া দাওয়া, যাবতীয় ঘরে থাকার স্বাচ্ছন্দ্য, সেতো এখানেই।এবাড়িতে আছে ছয় দিন। কিন্তু এবাড়ির সম্পর্কে সে কিছুই জানে না। বাড়ির লোকেদের সে দেখেছে। কিন্তু কার সঙ্গে কার কি সম্পর্ক, সেটা জানা হয়ে ওঠে নি। অথৈ সমুদ্রে একটা কুটো সম্বল করে ভেসে থাকা। কুটোটা কোন গাছের, প্রশ্ন করে কোন জন!খাওয়ার সময় ছাড়া ভিতরে যাওয়ার অনুমতি নেই। খেতে হয় রান্নাঘরের বারান্দায়। নিমে আর রাজা একসঙ্গে খেতে যায়। নিমে ঘটকালি করে। অতএব যেদিন যেমন কাজ, তেমন তার বাড়ি ফেরা। রাত্রে তো অবশ্যই দুজনের একসঙ্গে খাওয়া হয়। যিনি খেতে দেন, তিনি নিমে কে তুই সম্বোধন করেন। কথার ধরণে মনে হয়, নিমে হয়তো এবাড়ির কেউ। নিমের নাম নিমাই পাত্র। এবাড়ির পরিচয়ও পাত্র- বাড়ি। সুতরাং এদের নিজের কেউ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
নিমে থাকে রাজার পাশের ঘরে। রাজার ঘরের তুলনায় এই ঘর বড়। কাঠের চেয়ার টেবিল। স্টীলের তোরঙ্গ আছে চারটে। ঘরের কোণে। দেওয়ালের কাঠের ব্র্যাকেট। একটা পেরেক থেকে পুরোনো ফটো ঝুলছে। তক্তপোষে বিছানা পাতা।
রাজার ঘরে দুটো বেঞ্চ জোড়া লাগিয়ে বিছানা। তবে তোষক, চাদর, বালিশ, মশারি, সবই আছে। দেওয়ালে কয়েকটা পেরেক পোঁতা। তার একটাতে মা সিদ্ধেশ্বরীর ক্যালেন্ডার ঝুলছে। অপেক্ষার প্রতিটি মিনিট দশ গুণ বেশি দীর্ঘ হয়। রাজার আজ সেই অবস্থা। প্রধান এখনও ঘরের ভিতরেই নিশ্চয়! এবাড়ির থেকে বেরোনোর পথ তাদের ঘরের সামনের বারান্দা দিয়ে। বাইরে যাওয়ার আর কোনো পথ আছে কিনা, তাও জানা নেই রাজার। অন্য দিন বিকালে রাজা পুকুরপাড়ে যায়। ওখান থেকে বাড়িটাকে লক্ষ্য করে। বাড়ির দক্ষিণ দিকে ছোট ফাঁকা জায়গার পর পুকুর। যদি বেশ কিছু ফুল গাছ লাগানো যেত, বাড়িটাকে কত সুন্দর লাগত। ছোট থেকেই ঠাকুমার হাত ধরে ধরে ফুলগাছকে ভালোবাসতে শেখা। বছর ভর সকাল-রাত্রে ফুলগাছগুলোর যত্নে তার কত সময় কেটে গেছে। রাত্রে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফুলের হাসি দেখেছে। তার রোজগারের কিছু টাকার বিনিময়ে উঠোনের এক অংশ নানান রঙে ঝলমল করত। আর এখানে তো এত বড় খোলা জায়গা। রোদ জলের অভাব নেই। এই গরমেও পুকুরে জল আছে বেশ। এত বড় পুকুর। এটাকে ও কত কাজে লাগানো যায়। কিন্তু জানালা গুলোর দিকে তাকালেই মনটা দমে যায় রাজার। ঐ জানালার পিছনের মানুষ গুলোকে সে তো জানেনি এখনও। এই বাড়ি, এই গ্রাম, পাশের কাহার পাড়া, সবই তার সম্পূর্ণ অচেনা। ঘরের ভিতর শাঁখ বাজল। সঙ্গে প্রতিদিনের মত উলুধ্বনি। লাল পাড় শাড়ি পরে কেউ না কেউ প্রদীপ আর ধুনো দেখিয়ে যাবে, বাড়ির এই অংশেও। নিমে নিশ্চয় কোনো কাজের খোঁজ পেয়েছে। নিমে থাকলে নানান কথায় সময় কেটে যেত। এখন চুপচাপ অপেক্ষা ছাড়া গতি নেই।
ধুনোর গন্ধ আসছে। সেই গন্ধ ঘুরে ঘুরে দূরে চলে গেল। তার পর দরজায় এসে দাঁড়াল প্রধান। ব্যস্ত হয়ে চেয়ার এগিয়ে দিল রাজা। প্রধান চেয়ারে বসার আগে সারা ঘরে চোখ বুলিয়ে নিল। তারপর মা সিদ্ধেশ্বরীর দিকে জোড় হাতে নমস্কার জানিয়ে চেয়ারে বসল। প্রধানের দেখাদেখি রাজাও নমস্কার করল মা সিদ্ধেশ্বরীর উদ্দেশ্যে। অনেক কথা জমে আছে ঈশ্বরের কাছে বলার জন্য। কিন্তু কখনও বলা হয়ে উঠছে না।
-তোমার পুরো নাম কি? প্রধানের প্রশ্ন শুনে সম্বিত ফিরল রাজার।
দাঁড়ানো অবস্থাতেই বলল, – রাজকৃষ্ণ পাত্র।
-তোমার পদবী পাত্র?
অসতর্ক ভাবে নিজের পদবী ভুল বলায় বেশ লজ্জা পেল রাজা।
-না না। আমি ঘোষ । রাজা ঘোষ । পাত্রবাড়িতে থাকছি বলে…ভুল হয়ে…পাত্র এসে গেছে। আমার ভালো নাম রাজকৃষ্ণ ঘোষ ।
-আধার কার্ড আছে? ভোটার আইডি? জেরক্স কপি?
-হ্যাঁ। এনেছি সব।
বেঞ্চের নিচে রাখা ব্যাগের সাইড পকেট থেকে একটা প্লাস্টিকের প্যাকেটে রাখা আধার কার্ড, ভোটার আইডি, জেরক্স কপি, বার করে প্রধানকে দিল রাজা।
ওগুলো দেখতে দেখতেই প্রধান প্রশ্ন ছুঁড়ল,
-এখানে কেমন লাগছে?
প্রশ্ন করে জেরক্স কপি দুটো ভাঁজ করে পকেটে ভরে নিল প্রধান।
ছাতের কোণ বেয়ে সন্তর্পণে এগিয়ে আসতে থাকা টিকটিকির দিকে তাকিয়ে বলল রাজা, ঐ টিকটিকির মত।
-মানে? অবাক প্রশ্ন প্রধানের। তারপর টিকটিকিটাকে লক্ষ্য করে আবার প্রশ্ন করল প্রধান,
-কেন? টিকটিকিটার মত কেন?
-এই টিকটিকিটা আমার মতই এ ঘরে আগন্তুক। বাইরে যায়। ঘরে এসে ক্যালেন্ডারের পিছনে আশ্রয় নেয়। আমার মতই একা।
-তুমি একা কিসের? এ বাড়ির সবাই আছে। কাহারপাড়ার লোকজন আছে। ম্যাসাজ এর কাজ করছ। তাদের সঙ্গে কথাবার্তা হচ্ছে।
-না! কারো সঙ্গে কথা বলা বারণ। শুধু মাঝে মাঝে নিমের সঙ্গে কথা হয়।
-নিমেদা কে তুমি কাকা বলবে! আলগা ভর্ৎসনার সুর প্রধানের গলায়। আবার গলা নামিয়ে বলতে লাগল প্রধান।
-নিমেদা রোগা পাতলা বলে কমবয়েসি দেখায়। ঠিক আছে, কাকা বোলো।
-যেদিন এখানে এলাম, আপনার বাড়ির রাখালগুলো নিমে বলে ডাকছিল – – তাই – -! কুণ্ঠার সঙ্গে বলল রাজা।
বেশ জোর হেসে উঠল প্রধান। বেশ ঝঙ্কার তোলা হাসি। এতদিন পর ওরকম হাসি শুনে রাজাও একটু হেসে ফেলল।
-ও, রবি আর দীপু! দুই ভাইকেই দেখেছ নিশ্চয়! বাঁশি হাতে -!
কিছুক্ষণ থেমে, হাসি সামলে নিয়ে, আবার বলতে শুরু করল প্রধান।
-নিমেদা বেবীর ছোট কাকা। এবাড়িতে দু’জন বয়স্কা ভদ্রমহিলাকে দেখেছ নিশ্চয়! দেখেছ তো?
হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল রাজা।
-ওরা দুজনেই আমার দিদি। বেবীর মা আমার নিজের দিদি। আর নন্দা, ছন্দার মা, আমার মেজকাকার মেয়ে। আমার খুড়তুতো দিদি। ছোড়দি।
রাজা আন্দাজ করেছে, এবাড়িতে পাঁচজন মহিলা আছে। আজ তাদের পরিচয় জানতে পেরে ভালো লাগল রাজার। নিমে কাকার কথা জেনে আরো খুশি হল রাজা। এবাড়িরই একজন তার ভালোমন্দের খবর নেয়। তাকে খাওয়ার জন্য ডেকে নিয়ে যায়। ভালো লাগার উচ্ছ্বাস তাকে বিছানা থেকে ঠেলে তুলে দিল। উঠে দাঁড়িয়ে এবার সে নিজেই প্রশ্ন করল।
-বলুন, আর কি জানতে চান?
-তুমি এখানে নতুন। এখনও অবধি তুমি তো জানোই না, কেন তোমাকে কাজ দেওয়া হয়েছে! জানো কিছু?
মাথা নাড়ল রাজা। ম্যাসাজের কাজ করতে হবে, এটুকুই জানে। তার বেশি কিছুই জানে না।
-ও হ্যাঁ! তোমাকে একটা প্রশ্ন করা হয় নি। তুমি যে চলে এলে, বাবা-মা কি বললেন? মানে, তোমার বাড়ির সবাই, ভাই বোন, তাদের মত ছিল? অনেক দূর থেকে এসেছ তুমি। এখনও কিছুই স্থির হল না -। তুমি বুঝতে পারছ, আমি কি বলতে চাইছি?
মাথা নাড়ল রাজা। প্রশ্ন শুনেছে ঠিকই, বুঝতে পারে নি ঠিক মত।
-তুমি কি বাবা-মায়ের একই ছেলে? নাকি ভাই বোন আছে?
-আমি আমার মায়ের একটিই ছেলে। আমার মা নেই। কিন্তু বাবার আরো দুটো ছেলে মেয়ে আছে।
-তোমার সৎমা আছেন?
-না। ওরা মালা মাসীর ছেলে মেয়ে।
-মালা মাসী কে?
-ওবাড়িতে রান্না করে।
-যদিও তোমার যা বয়স…, তোমাকে কি ওনারা!
প্রধান ইতস্তত করতে লাগল। পঞ্চায়েত প্রধান হিসাবে থাকে অনেক কঠিন প্রশ্ন করতে হয়। তবু সে সহজ হতে পারল না।
প্রধানের প্রশ্ন সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই বলে উঠল রাজা,
-না! আমিই ওদের ত্যাগ করেছি। আমার নিজের অস্তিত্বের প্রয়োজনে। ওবাড়ির সম্বন্ধে যা জানতে চান, আজই জেনে নিন। তাতে যদি এখানে কাজ না দেন, নাই দেবেন। সাহস করে যখন সব ছেড়েছি, আর ভয় পাই না।
এত কঠিন ভাষ্য, এত সহজ ভাষায়, প্রধান আশা করে নি। কিছুক্ষণ দুজনে চুপচাপ বসে থাকল।
নীরবতা ভাঙল প্রধান।
-তুমি অনেক গাছের বীজ এনেছ নাকি, প্যাকেটে করে? ছোড়দি ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে দেখেছে!
-উঁহু, থামো! হাত তুলে উত্তর দিতে উদ্যত রাজাকে বাধা দিল প্রধান। আগে আমি বলে নি।
কেন বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল, তার কারণ বলা শুরু করল প্রধান।
-এবাড়ির বড় দুই মেয়ে বিউটিসিয়ান কোর্স করেছে। বিউটি পার্লার খুলতে চায়।
একটু থেমে প্রধান জরিপ করতে চাইল রাজাকে।
-আর বিউটি পার্লার করার জন্য পঞ্চায়েত অফিসের পাশে হওয়াটাই ভালো। কারণ, ধরো, ঐ অঞ্চলে রাস্তার পাশে দোকান বাজার আছে। লাইট আছে। বাকি রাস্তা তো অন্ধকার। ঠিক না?
চুপচাপ শুনছিল রাজা। কথাবার্তার মধ্যে এখনও পর্যন্ত তার কাজের প্রসঙ্গ আসে নি।
-এখন গ্রামদেশে লোকের হাতে পয়সা হয়েছে। তারপর ধরো, টিভি, সিনেমাতেও সবাই দেখছে। সাজগোজের দিকে সবার বেশ নজর হয়েছে। – – – তবে, পঞ্চায়েত অফিসের পাশে মেয়েরা তো আর একা আসবে না। সঙ্গে বাড়ির পুরুষেরা ও থাকবে! তাদের জন্য কিছু একটা ব্যবস্থা থাকলে, তবেই ব্যবসাটা চলবে ভালো।
প্রধান একটু থামল। বুঝতে চাইল রাজার মনের কথা।
-এই ব্যবসা যখন সাজগোজের ব্যবসা, স্বাচ্ছন্দ্য দেওয়ার ব্যবসা, তখন ঘর গুলোও সাজানো জরুরি। তাই তো, নাকি? যেমন ধরো, এখন সবাই মাটিতে শুয়ে ম্যাসাজ নিচ্ছে, তখন একটা চৌকি কিনে রাখলে তার উপর ম্যাসাজ নেবে। তোমার কাছে যা তোলা তুলছি, তা দিয়েই ধরো একটা ভালো চৌকি কেনা হোলো।
কথাটা বলেই হা হা করে হেসে উঠল প্রধান। একটু স্মিত হাসি খেলে গেল রাজার চোখে মুখে। অভিজ্ঞ প্রধানের চোখ এড়ালো না সেটা।
-আবার ধরো, ফুলগাছ লাগালে পঞ্চায়েত অফিসের বাগানে। বিউটি পার্লারের বাগানে। আমি আমার রাখাল রবিকে দিলাম। তোমার সঙ্গে হাতে হাতে একটু কাজ করে দিল। একটু নড়ে চড়ে বসল রাজা। উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল প্রধানের দিকে। যদি কিছু বলার অনুমতি দেয়, তাহলে এক্ষুনি বলে ফেলে সে। ডালিয়ার আলুগুলো তো সে এই বাড়ির পিছনে পুঁতেই রেখেছে। যাতে নষ্ট না হয়। বাড়ির উঠোনের ঐ ফুলগুলো ছাড়া, এতগুলো বছর ধরে, কেউ তো হাসে নি তার দিকে চেয়ে। ফুলের কথা ভাবতে ভাবতে সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ল রাজার। প্রধান বুঝতে পারল, শিকড় একটু একটু ছড়িয়ে গেছে। গাছটা বেঁচে যাবে!