গত পর্বের পরে…
পর্ব- ২
বাংলার সাহিত্যসাগরে মাছের অবাধ বিচরণ এক সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ইতিহাস। এই মাছের মধ্যে আবার ইলিশ নিয়ে একটু বেশিই পক্ষপাতদুষ্ট বাংলার সাহিত্যিকরা। বিদগ্ধজনের মতে নাটক বিনে ইংরেজি সাহিত্য অন্ধ তেমনি মাছ বিনে বাংলাসাহিত্য ।
বঙ্কিমচন্দ্রের ‘চন্দ্রশেখর’ উপন্যাসে ইলিশের কথা আছে নবাব মীর কাশেমের স্ত্রী দলনী বেগম ও তার দাসী কুলসুমের কথোপকথনে। দলনী যখন কুলসুমকে দুঃসাহসিক কাজ করার কথা বলেন তার কুলসুম উত্তরে বলে, ‘কী? ইলিশ মাছ খেতে হবে না ঠান্ডা জলে নাইতে হবে?’
আবার কমলাকান্তের দফতরে আছে মাছ নিয়ে কথার ফুলঝুরি।
সেখানে “আমার মন” প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, “সেখানে ইলিশ মত্স্য সতৈল অভিষেকের পর ঝোল গঙ্গায় স্নান করিয়া, মৃন্ময়, কাংস্যময়, কাচময় বা রজতময় সিংহাসনে উপবেশন করেন সেখানেই আমার মন প্রণত হইয়া পড়িয়া থাকে। ভক্তিরসে অভিভূত হইয়া সেই তীর্থস্থান আর ছাড়িতে চায় না”
শরতচন্দ্রের শ্রীকান্ত প্রথম পর্বে শ্রীকান্ত এবং ইন্দ্রনাথের সেই দুধর্ষ মত্স্য অভিযানের কথা? কিম্বা রামের সুমতি তে রামের অতি প্রিয় কার্তিক-গণেশ নামের মাছ দুটি? শেষমেশ সেই অবলা জীব দুটিই গল্পের মোক্ষম মোচড়।
আবার মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ তে সেই ইলিশের বর্ণনা?
‘পদ্মায় ইলিশ মাছ ধরার মরসুম চলিতেছে।নৌকার খোল ভরিয়া জমিতে থাকে মৃত সাদা ইলিশ মাছ।লণ্ঠনের আলোয় মাছের আঁশ চকচক করে। মাছের নিষ্পলক চোখগুলিকে স্বচ্ছ নীলাভ চোখের মণির মতো দেখায়।’
শ্রী অদ্বৈত মল্লবর্মণের “তিতাস একটি নদীর নাম” এ নদীর পাড়ের জেলে বসতির জীবনের টানাপোড়েন, হাসিকান্নার সেই বিশাল পটভূমি? কিম্বা সমরেশ বসুর “গঙ্গা’য় রূপোলী জলজ শস্যের সন্ধানে ঘরছাড়া মানুষের নৌকায় জীবনযাপনের চিরন্তন সংগ্রামের চিত্রটি? অথবা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের “কতয় হল” নামক অনবদ্য ছোট গল্পে লেখকের লেকমার্কেট থকে ইলিশ কিনে হাতে ঝুলিয়ে বাড়ি ফেরার পথে ট্রামে, সাইকেল রিকশায় এবং সবশেষে বাড়িতে ঢোকামাত্রেই সবার মুখে এক কথা “কতোয় হল?” অর্থাত মাছটির দাম কত? সবশেষে তাঁর প্রশ্ন, যদি ভদ্রলোক শোলমাছ ঝুলিয়ে আসতেন তবে কি কেউ তাঁকে এমন প্রশ্নবাণে জর্জরিত করত? বাঙালী লেখকের লেখায় যুগে যুগে এই মৎস্য বিলাসিতা তাঁদের অকুন্ঠ মৎস্য প্রীতি থেকেই।
শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘মেলা কথা কস্নে’ ছড়াটিতে যত মাছের নাম রয়েছে তাতে বেশ বোঝা যায়, এইসব চুনোচানা মাছ বোধহয় ওনার বেশী প্রিয় ছিল…
কারো কৈ ভাল লাগে,
কারো লাগে খলশে
কেউ খায় ঝোলে ফেলে
কেউ খায় ঝলসে।
কেউ খায় তিতপুঁটি
ভাজা নয় সুক্তো
ঘটি-বাটি বলে জাত
বাঙালেরা ঠুকত।
গেঁড়ি ও গুগলি খাস
আর চাঁদা চৈতন
পদ্মার বুক ভ’রে
মেছো বান বইত
কাঁচা খাস, ডাঁসা খাস
চুষে খাস পাখনা
আঁশ-ফাঁস খাস যা-তা
পেলে বিনি মাগ্না।
স্ত্রী’র হাতে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের প্রিয় ইলিশমাছের মাথা দিয়ে চালকুমড়ো বেশ সোজা চটজলদি রান্না ।

ইলিশমাছের মাথা নুন হলুদ মাখিয়ে তেলে ভেজে নিতে হবে। ঝিরি ঝিরি করে কাটা চালকুমড়ো হালকা করে ভাপিয়ে রাখতে হবে। এবার কড়াইতে সর্ষের তেলে আদা, জিরে বাটা দিয়ে লঙ্কা, হলুদ, নুন দিয়ে চালকুমড়ো দিয়ে নেড়েচেড়ে মাথা দিয়ে চাপা দিতে হবে। সেদ্ধ হলে মুড়ো একটু ভেঙে দিয়ে গায়ে মাখামাখা হলে নামিয়ে নিলেই তৈরী ।
শক্তিবাবুর মায়ের কাছ থেকে মীনাক্ষী দির শেখা আরেকটি রান্না হল পদ্মমান কচুর পাতার মধ্যে চিংড়িমাছ, সর্ষে, পোস্ত, কাঁচালঙ্কা আর তেল, নুন দিয়ে ভাতের মধ্যে ভাপিয়ে পাতা সহ ভাত মেখে খাওয়া।
শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার হাত ধরে গদ্যপুরে পাড়ি দিয়ে দেখলাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়িতেও সর্বত্র মেছো গন্ধ। সম্পূর্ণ আমিষাশী কবির মতস্যপ্রীতি যে কতখানি প্রবল তা বোঝা যায় ভাল করে।
‘না-পাঠানো চিঠি’ কবিতায় ছত্রে ছত্রে মাছের নাম,
“কালু-ভুলুরা মাছ পেয়েছে কিছু?
একবার মেঘের ডাক শুনে কই মাছ উঠে এসেছিল ডাঙায়
আমি আমগাছ তলায় দুটো কই মাছ ধরেছিলাম
তোমার মনে আছে, মা ?’
এমনকি ‘অতনু ফিরে যাবে’ ছোটগল্পেও সেই নানাবিধ মাছের নাম।
‘ধানক্ষেতের পাশে যে অগভীর জলাভূমি, সেখানে গামছা দিয়ে মাছ ধরত কয়েকটি কিশোর, মাছ বিশেষ পাওয়া যেত না, ঝাঁপাঝাঁপি, কাদা মাখামাখিই সার, কখনও হয়তো পাওয়া যেত কিছু কুচো চিংড়ি, বেলে আর পুঁটি। একদিন অতনু দুটো খলসে মাছ পেয়েছিল’
আবার ‘মহারাজ, আমি তোমার’ কবিতাতেও তিনি মহারাজের চোখের জলে মাছ ধরতে চাইলেন
‘মহারাজ, আমি তোমার চোখের জলে মাছ ধরেছি
মাছ না মাছি কাঁকরগাছি একলা শুয়েও বেঁচে তা আছি।’
তাঁর কথায়, “আসল ইলিশের স্বাদ দেড় কিলো থেকে পৌনে দু’কিলোতে। আমরা বাল্যকাল থেকে ইলিশের সমঝদার। আমার মতন এমন মানুষ খুব কমই আছে, যে জ্যান্ত ইলিশকে লাফাতে দেখেছে” (আনন্দবাজার পত্রিকা)

স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর শাশুড়ির হাতের অন্যতম মাছের পদটি শিখে নিয়ে তাক লাগিয়েছিলেন। সেটি ছিল রুই মাছের দৈ মাছ। নুন হলুদ মাখানো রুইমাছ হালকা করে ভেজে নিয়ে বাড়িতে পাতা টাটকা টক দৈ ফেটিয়ে নিয়ে তার মধ্যে একে একে পেঁয়াজবাটা, আদার রস, লঙ্কাগুঁড়ো, দিয়ে রাখলেন। তারপর কড়াইতে সর্ষের তেল আর একটু ঘি দিয়ে তেজপাতা আর গোটা গরম মশলা ফোড়ন দিলেন আর দৈয়ের মিশ্রণটা ঢেলে দিলেন। কষতে কষতে তেল ছাড়লে গরমজল, নুন, মিষ্টি চেরা কাঁচালঙ্কা আর ভাজা মাছ ছেড়ে দিলেন। ফুটে উঠলে মাখামাখা দৈ মাছ নামিয়ে নিলেন ওপর থেকে সামান্য ঘি ছড়িয়ে ।
মাছ অন্তপ্রাণ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় পূর্ববাংলার মানুষ বলে বোয়াল, চিতল, চাঁদা কিছুই বাদ দিতেন না।অথচ কি আশ্চর্য পমফ্রেট বা ভেটকিমাছ একটুও পছন্দ ছিলনা তাঁর। একটু আধটু ফিশফ্রাই বা ফিংগার খেতেন শুধু।
“বোয়ালমাছের চরচরা’ এদের বাড়িতেই তো শিখেছি। জানালেন স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায় । “খুব ভাল বানাতেন আমার শাশুড়িমা” স্মৃতি রোমন্থনে উঠে এল
বোয়ালমাছ কেটে নুন হলুদ মাখিয়ে কাঁচামাছ কাঁচা সর্ষের তেলে ছেড়ে দিতে হবে। মাছ ভেঙে গুঁড়ো হতে থাকল। তখন কাঁটাগুলো তুলে নিতে হবে হাতে করে। এবার ঐ তেলের মধ্যেই ঝিরিঝিরি করে কাটা মূলো, বেশ কিছুটা কাঁচালঙ্কা আর কাঁচা সর্ষের তেল দিয়ে নামিয়ে নিলেই তৈরী হয়ে যাবে বোয়াল মাছের চরচরা।
সাহিত্য অন্তপ্রাণ বুদ্ধদেব বাবুর কবিতার ছত্রে ছত্রেই প্রমাণ মেলে যে তিনি খাদ্যরসিক ছিলেন। আর তাঁর মত্স্যপ্রীতিরও যথেষ্ট পরিচয় মেলে তা থেকে। ১৯৩৮ সালের ভরাবর্ষায় লেখা ইলিশ কবিতাটি অন্ততঃ তাই বলে।
রাত্রিশেষে গোয়ালন্দে অন্ধ কালো মালগাড়ি ভরে জলের উজ্জ্বল শস্য,
রাশিরাশি ইলিশের শব, নদীর নিবিড়তম উল্লসের মৃত্যুর পাহাড়।
তারপর কলকাতার বিবর্ণ সকালে ঘরে-ঘরে ইলিশ ভাজার গন্ধ;
কেরানির গিন্নির ভাঁড়ার সরস সর্ষের ঝাঁঝে। এলো বর্ষা, ইলিশ উত্সব।
আমাদের বাড়িতে ইলিশমাছ নিয়ে প্রায় পুজোপার্বণের মত ঘটা হত। বললাম, সে তো টের পেলাম কবিতার মধ্যেই। বললেন, আরো আছে এমন কইমাছ নিয়ে। বলেই মুখস্থ বলে গেলেন কন্যা মীনাক্ষী দি।
“কালো কালো কইমাছ লাল তেলে ভাসে সবুজ মটরশুঁটি সাজে পাশে পাশে’ এতো বাবার লেখা ছড়া।
প্রতিভা বসুর হাতে বুদ্ধদেব বসুর প্রিয় পদ ছিল কাঁচা কুমড়ো দিয়ে ইলিশ মাছ। আর সেটিই বসু পরিবারের সিগনেচার ডিশ। মাছ হালকা ভেজে নিয়ে কালোজিরে, কাঁচালঙ্কা দিয়ে কাঁচা কুমড়োর টুকরো নেড়েচেড়ে নিয়ে সেদ্ধ হয়ে এলে ভাজা মাছ আর কাঁচা সর্ষের তেল দিয়ে নামিয়ে নিতে হবে অতি সহজ অথচ অমূল্য এই পদটি। এটা অবিশ্যি প্রতিভা বসুর বাবার বাড়ির রান্না।
বসুবাড়ির আরেকটি উল্লেখযোগ্য রান্না ছিল কলাপাতায় সর্ষের তেল মাখিয়ে সর্ষেবাটা, কাঁচালঙ্কা দিয়ে চারাপোনা বা নলা মাছ অথবা ভেটকির পাতুড়ি। কড়াইতে সেঁকে নেওয়া হত কলাপাতায় মোড়া এই রান্না।
ঘিনি ট্যাংরা দিয়ে পেঁয়াজকলি আর নারকোল কোরা, সর্ষেবাটা, কাঁচা লঙ্কা, সর্ষের তেল দিয়ে মেখে চিংড়িমাছের ভাপা ছিল বুদ্ধদেব বসুর ফেবারিট।
এইসব রান্নার উল্লেখ আছে বুদ্ধদেব বসুর “গোলাপ কেন কালো” বইতে ।
ঢাকার মধ্যবিত্ত বাঙালী পরিবারের চিত্রটি সেখানে উপচে ওঠে সাহিত্য রসে।
“উচ্ছে আর মৌরলা মাছের তেতো চচ্চড়ি দিয়ে তারপর ডালের সঙ্গে পটলভাজা আর মুড়মুড়ে কাচকি মাছের ঝুরি, তারপর কুচকুচে কালো কইমাছ আবির্ভূত হলেন টুকটুকে লাল তেলের বিছানায় ফুলকপির বালিশের ওপর শোয়ানো। আবার কোনওদিন হয়ত শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ইলিশঃ ভাজা, সর্ষেতে ভাপানো, কলাপাতায় পোড়া পোড়া পাতুড়ি, কচি কুমড়োর সঙ্গে কালোজিরের ঝোল, ল্যাজামুড়োর সদ্গতি হল কাঁচা লংকা ছিটোনো লেবুর রসে পাতলা অম্বলে। কোনোদিন রুইমাছের মাথা দিয়ে রাঁধা মুগডাল, নারকোল চিংড়ি, চিতলের পেটি। কোনোদিন ধনেপাতা আর ডালের বড়ির সুগন্ধে মাখা বিশাল পাবদা, কোনোদিন আদা-পেঁয়াজ খণ্ড খণ্ড আলুর সঙ্গে মাংসালো মাগুর”
একে বাঙ্গালীর মৎস্য সাহিত্য রসনাও বলা যায়।

সব বাঙালবাড়ির মতই ইলিশমাছে খুব আসক্তি ছিল গোস্বামীবাড়িতেও। জানালেন সাহিত্যিক হিমানীশ গোস্বামীর কন্যা হৈমন্তী। লাউশাক দিয়ে ইলিশ অন্যতম রান্না ছিল। হালকা করে ভেজে রাখা ইলিশমাছের তেলেই কালোজিরে আর কাঁচালঙ্কা ফোড়ন দিয়ে কচি লাউ ডাঁটা কেটে নিয়ে দিতে হবে। তারপর একটু লঙ্কাবাটা। লাউশাক থেকে যে জল বেরুবে সেটাতেই ভাজা মাছ দিয়ে শুকিয়ে নিতে হবে। এর মধ্যে বেগুণ দেওয়া যায় এর। আর কাঁচালঙ্কা, কাঁচা তেল দিয়ে নামিয়ে নিতে হবে লাউশাক ইলিশ।
আরেকটি হল চৌকো করে পাতলা পাতলা করে কেটে নেওয়া লাউ দিয়ে ইলিশমাছ। সর্ষের তেলের মধ্যে কালোজিরে কাঁচালঙ্কা ফোড়ন দিয়ে লাউ সেদ্ধ হয়ে এলে ভাজা ইলিশমাছ দিয়ে লাউচিংড়ির মত লাউ ইলিশ আমাদের বাড়ির অন্যতম রেসিপি। বললেন, হৈমন্তী।
দাদু পরিমল গোস্বামীর স্মৃতিচিত্রণ গ্রন্থে আছে, স্নান করতে নেমে তাঁর নদীতে মাছ ধরা আর সে সময়ের বাজারের বর্ণনাও। এক পয়সায় আটটি ইলিশ অথবা একদিন জমিয়ে শুধু ইলিশের ডিম খাওয়া হত সেসময়। আর একদিন বাড়িতে শুধুই রান্না হত ইলিশের মুড়োর ঝোল আর চচ্চড়ি। দৈনিক চার পয়সায় আর মাসিক মাত্র পাঁচটাকায় সংসার চলত। তিনি বাজার করতে গিয়ে নদীর পাড়ে বসে কাটারুদের প্রকান্ড ঝকঝকে বঁটিতে মাছ কাটার যে বর্ণনা দিয়েছেন তা স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেয় তিনি কি পরিমাণে ভোজন রসিক ছিলেন।
স্নানে নেমে কাছাকাছি নৌকায় বাঁধা গামছা বা কাপড়ের জালে মাছ ধরার কৌশলটি অনবদ্য। শীতকালে ইলিশ কমে এলে বড় রুই, চিতল কিনে ভাগ করে নেওয়ার উল্লেখ পাই। সকালবেলা কয়েকজন বন্ধু মিলে দাঁতন করতে করতে পদ্মাপারে গিয়ে কিনে নিতেন। পিঁয়েল, বাঁশপাতা, খরশোলা প্রভৃতি মাছের উল্লেখ আছে সেখানে।
মাছ রান্নার ব্যাপারে বাবা আমাদের মা’কেই হায়েস্ট নাম্বার দিতেন সবসময়। বললেন সাহিত্যিক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের বড় মেয়ে মলি দি।
ওল-চিংড়ি কিম্বা মোচা-চিংড়ি, কাঁচা ইলিশের ভাপা, মৌরলা, কাচকি কিম্বা আমুদি মাছের চচ্চড়ি, তেল কৈ, কালোজিরে কাঁচালঙ্কা আর বেগুন দিয়ে ইলিশের পাতলা ঝোল কিম্বা মাছের মাথা দিয়ে ডাল যেমন হয় সব বাড়িতে। কাঁচা মাছ নুন, সর্ষে কাঁচালঙ্কা বাটা দিয়ে ম্যারিনেট করে সামান্য নারকোল বাটা দিতেন মা ইলিশ ভাপা তে। এবার সর্ষের তেল আর চেরা কাঁচালঙ্কা ছড়িয়ে বন্ধ কৌটোয় পুরে মিনিট পাঁচেক। ব্যাস! এছাড়াও বাবার প্রিয় ছিল থোড় দিয়ে চিংড়ি এবং চিতলমাছের মুঠিয়া। চিতলের গাদায় খুব কাঁটা তাই গাদা ঘষে নিয়ে আলুসেদ্ধ দিয়ে মেখে ধোঁকার মত কেটে পিস করে বানাতেন মা।

নবনীতা দেব সেন জানালেন তাঁর শ্বশুরবাবার মাছ ধরবার প্রবল নেশার গল্প। দিল্লী থেকে কখনও মীরাট যেতেন গাড়ীর মাথায় নৌকো বেঁধে। কখনও যমুনার ধারে। মাছ ধরে আনতেন। নবনীতাদি গিয়ে শ্বশুরবাবা কে বসিয়ে দিয়ে আসতেন আর বিকেলে গিয়ে নিয়ে আসতেন। বাবা বাড়িতে এসে সেই মাছ কাটা শেখাতেন। আমাদের সাহায্যকারী মাছ কেটে ধুয়ে দিত। আমি রান্না করতাম। বাবা নিজের হাতে বেছে দিতেন কোন্ মাছের পিস কার থাকবে আর কোন্ কোন্ পিস দিয়ে কি কি রান্না হবে’
পূর্ববাংলার না হয়েও দিদি চিতলমাছের ‘মুঠি’ রাঁধেন নিজের মত করে। এইটে হল ভালো-বাসা বাড়ীর নিজস্ব রেসিপি।
গড়গড় করে বলে চললেন আড্ডার মেজাজে।
প্রথমে চিতলমাছের পিঠ চামচ দিয়ে চেঁছে ছাল থেকে মাছ সরিয়ে, কাঁটা বেছে মাছ ছাড়িয়ে নিবি। এবার সেদ্ধ আলু মোলায়েম করে মেখে নুন, পেঁয়াজবাটা, রসুনবাটা, কাঁচালঙ্কা বাটা দিয়ে আলু আর মাছ চটকে মাখতে হবে। কড়াইতে জল ফুটবে। সেই ফুটন্ত জলে লম্বা লম্বা মাছ-আলু-মশলার সেই রোল ফেলতে হবে। সাত আট মিনিট ফুটবে। ঠিক যেই ভেসে উঠবে তখন জল থেকে তুলে নিয়ে ট্রে তে কাগজ পেতে রোলগুলো রাখলেই জল টেনে মিনিট কুড়ি পরেই। এরপর ছুরি দিয়ে রোল থেকে স্লাইস করে গোল গোল করে কেটে নিয়ে
ছাঁকা তেলে ভেজে তুলে রাখার পালা। অন্য কড়াইতে আন্দাজ মত তেল দিয়ে পিঁয়াজবাটা, রসুনবাটা, আদাবাটা, লঙ্কার গুঁড়ো দিয়ে সামান্য চিনি-নুন দিয়ে কষিয়ে ভাজা মুঠি গুলো ফেলে দিলেই হল। ফুটে উঠলে গরমমশলা বাটা আর গোটা কাঁচালঙ্কা দিয়ে মাখামাখা চিতলমাছের মুঠি।

আজকাল হোটেলে ডাবচিংড়ি নামে একটি মাগ্যির ডিশ সার্ভ করা হয়। এমন কিছু আহামরি নয়, শুধু দামে গালভারী। সেখানেও মাছ কিন্তু দেখনদারির পণ্য। অথচ আজ থেকে একশো বর্ষ আগে আমার মামারবাড়িতে এই রান্না হত ডাব দিয়ে নয়। নারকোলের শাঁসসুদ্ধ দুটি মালার মধ্যে বাগদাচিংড়ি সর্ষে-পোস্ত-কাঁচালঙ্কা বাটা দিয়ে মেখে, কাঁচা সর্ষের তেল, হলুদ, লঙ্কা, নুন দিয়ে নারকোলের মালায় রেখে এবার নারকোলটিকে বন্ধ করে সেই ফাটা অংশে ময়দার পুলটিশ লাগিয়ে মরা উনুনের আঁচে ঐ নারকোলটি রেখে দেওয়া হত ছাইয়ের ভেতরে । ঘন্টা দুই পরে তাক লাগানো স্বাদ ও গন্ধে ভরপুর ভাপা চিংড়ি নাকি খুঁড়লেই বেরিয়ে আসত নারকোলের শাঁসের সঙ্গে। চিংড়ির মালাইকারীও এভাবে রাঁধা হয়েছে বহুবার। সেখানে সর্ষের বদলে পিঁয়াজ, আদা-রসুন গরমমশলা বাটা আর তেলের বদলে ঘি দেওয়া হত।
চিংড়ি মাছের কথা উঠলেই মনে পড়ে যায় আমার এক মামার কথা। উনি খুব রগুড়ে ছিলেন। ওনাদের সময় কত্ত বড় চিংড়ি খেয়েছিলেন তা বোঝানোর জন্য উনি একবার বলেছিলেন “জানিস? এ আর কি চিংড়ি? এ তো লবস্টার কো বাবালোগ। আমরা যে চিংড়ি খেয়েছি তার খোলাগুলো ডাস্টবিনে পড়ে থাকলে তার মধ্যে দিয়ে কুকুরের বাচ্ছা ঢুকতো আর বেরুত।”
চিংড়ি আর কাঁকড়া মাছ নয় বলে আর সম্পূর্ণ অন্যজাতের সজীব বলে বুঝি ওদের এত স্বাদ। আঁশটে ব্যাপরটা নেই। আছে এক অন্য রসায়ন। সংস্কৃত শ্লোকে পর্যন্ত চিংড়ি নিয়ে ঠাট্টা পড়েছিলাম কল্যাণী দত্তের “থোড় বড়ি খাড়া’ য়।
গলদাং বাগদাং রস্যাং নারিকেল সমণ্বিতাম্
অলাবু লোভানাং কৃত্বা তক্ষিতব্যং শুভে যোগে।।
রসিক রবির গল্পে পাকড়াশীদের কাঁকড়াডোবা অথবা ডিমভরা কাঁকড়ার কথায় মনে পড়ে মেয়ে কাঁকড়ায় ডিম হয় বলে ছেলে কাঁকড়া কিনলে নাকি মাস বেশী পাওয়া যায়। যাদের এলার্জি তারা এ স্বাদের ভাগ পাবেনা। দাঁড়াগুলো ভেঙে নিয়ে চুষে রস বের করতে ছোটবেলায় আমাদের সারাটা দুপুর কাবার হত। হাতের এঁটো শুকিয়ে যেত। ভাত শেষ হয়ে যেত। কাঁকড়ার এমনি মোহ। কেউ রাঁধে পিঁয়াজ-রসুন-আদা দিয়ে রসা। তার এক স্বাদ। তবে সর্ষে কাঁকড়ার ঝাল অন্যরকম। কাঁকড়ার গন্ধটা পুরো পাওয়া যায়। আর তার পা গুলো দিয়ে পুঁইশাক চচ্চড়ির স্বাদ অনবদ্য।
মাছ নিয়ে বাঙ্গালীর এই বিলাসিতা জিইয়ে রাখার জন্যেই সবশেষে বলি,
এ যুগে বাংলায় অন্নদামঙ্গল রচিত হলে দেবীর কাছে ঈশ্বরী পাটনি নিশ্চয়ই চেয়ে বসতেন এই বর “আমার সন্তান যেন থাকে মাছে ভাতে”
কিম্বা সুকুমার রায় গোঁফ চুরি না লিখে লিখতেন “মাছ চুরি” শুধু বিশ্বের দরবারে নতুন করে বাঙালী কে চেনানোর জন্য।
“ মাছের আমি, মাছের তুমি মাছ দিয়ে যায় চেনা” এই বলে।

উত্তর কলকাতায় জন্ম। রসায়নে মাস্টার্স রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ থেকে। বিবাহ সূত্রে বর্তমানে দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা। আদ্যোপান্ত হোমমেকার। এক দশকের বেশী তাঁর লেখক জীবন। বিজ্ঞানের ছাত্রী হয়েও সাহিত্য চর্চায় নিমগ্ন। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায়। প্রথম উপন্যাস সানন্দা পুজোসংখ্যায়। এছাড়াও সব নামীদামী বাণিজ্যিক পত্রিকায় লিখে চলেছেন ভ্রমণকাহিনী, রম্যরচনা, ছোটোগল্প, প্রবন্ধ এবং ফিচার। প্রিন্ট এবং ডিজিটাল উভয়েই লেখেন। এ যাবত প্রকাশিত উপন্যাস ৫ টি। প্রকাশিত গদ্যের বই ৭ টি। উল্লেখযোগ্য হল উপন্যাস কলাবতী কথা ( আনন্দ পাবলিশার্স) উপন্যাস ত্রিধারা ( ধানসিড়ি) কিশোর গল্প সংকলন চিন্তামণির থটশপ ( ধানসিড়ি) রম্যরচনা – স্বর্গীয় রমণীয় ( একুশ শতক) ভ্রমণকাহিনী – চরৈবেতি ( সৃষ্টিসুখ) ২০২০ তে প্রকাশিত দুটি নভেলা- কসমিক পুরাণ – (রবিপ্রকাশ) এবং কিংবদন্তীর হেঁশেল- (ধানসিড়ি)।অবসর যাপনের আরও একটি ঠেক হল গান এবং রান্নাবাটি ।