| 9 অক্টোবর 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা ১৪৩১

উৎসব সংখ্যা গল্প: সালিশের আদিরস পর্ব । মাহবুব আলী

আনুমানিক পঠনকাল: 23 মিনিট

বিয়ের দু-তিন সপ্তাহ পেরিয়েছে মাত্র, ঘরে নতুন বউ; এই সময়ে কেউ পালায়? কি যে ভেতরের ব্যাপার! বিজন পালিয়েছে। পাড়া-পড়শির সামনে যত না কৌতুক-কৌতূহল তারচেয়ে বড় কথার অপমান জুগিয়ে পগারপার। এখন কারও মুখের দিকে তাকাতে বিব্রতকর অস্বস্তি, এমনকি মুখলাল লজ্জা আসে; আর অনুরাধার চোখে? সে তো পরের বাড়ির মেয়ে। তার কথা কে বলে? সেখানে যে নিবিড় মায়া আর বোবা বেদনার খেলা, তাকানো যায় না। জয়িতা তো মা, সন্তানের চোখের দিকে তাকিয়ে সহজে কষ্ট বুঝে নিতে পারে। সে পরের বাড়ির মেয়ে হোক বা আপন সন্তান। অনুরাধা যে এখন ছেলের বউ। নিজের ছেলে বিজন কুমার রায়। তার আদরের একমাত্র কুমার! তাকে নয়-দশ মাস পেটে রেখেছিল। তিল তিল রক্তে বড় হয়েছে। তারপর যখন পৃথিবীর আলোয়, তার কোলে এলো, জগৎ আলোময়; আলোর রশ্মি সেও কিছু বুঝতে দেয়নি। সেই ছেলের পেটে পেটে এত! বউ পছন্দ না হলে আগে বলে দিতে পারত। জয়িতা তখন কতবার ওঝার মন্ত্রের মতো বিড়বিড় করেছে, সময় আছে; বিজনের মুখে এককথা ‘এখন বিয়ে করব না মা।’ সে কথা রাখা যায়? এমন মেয়ে আর কয়টি আছে? সাক্ষাত উর্বশী-অপ্সরা

জয়িতা এলোমেলো ভাবনায় পড়ে যায়। ‘আ রে বাবা, বয়স তো কম হলো না, দিনে দিনে প্রায় সাতাশ বছর। এখন বিয়ে করবে না তো কি মধ্য বয়সে? বাচ্চাকাচ্চা মানুষ করার সময় পাবে?’ জয়িতার যখন বিয়ে হয়েছিল, মানুষটির বয়স চব্বিশ-পঁচিশ। সে-সময় আরও অল্প বয়সে ছেলেমেয়েদের বিয়ে হতো। তার জন্য উপযুক্ত বয়সই বলা যায় নাকি পুতুল খেলা সাঙ্গ হলো আর ‘উঠ্‌ ছুঁড়ি তোর বিয়ে’ কি না…কে জানে। এদিকে দেড়-দুই বছর ঘুরে আসতে না আসতে ঘরে ‘টোঁয়া টোঁয়া’ শব্দে ঘোষণা, নতুন মানুষ এসে গেছে। যখন কুমারের জন্ম হয়, তার বয়স কত? ষোলো-সতেরো। আড়াই-তিন বছর পর পর আরও তিনজন। একজন আঁতুর ঘরেই বিদায়, অন্যজন চার বছর পেরোয়নি, পুকুরে ভেসে উঠল এক দুপুরে; কেউ খেয়াল রাখেনি। আঙিনার দেয়াল পেরিয়ে বাহির উঠোন। সামান্য দূরে পুকুর, তারই অগ্নিকোণে ছায়া-ছায়া অন্ধকার; সেখানে ভেসে উঠল মেয়ের ফুটফুটে লাশ। ফুলে-ফেঁপে ঢোল। অনেক কষ্ট পেয়েছিল নিতাই। মামার কোলে কোলেই বেশি থাকত লক্ষ্মী। সেদিন নিতাই শহরে গিয়েছিল। বিকেলে ফিরে এসে দেখে এই ঘটনা। তার আহাজারি-চিৎকার চারপাশের বাতাসে ঢেউ তোলে। জয়িতা তো মা। তার বুকে মেঘের নিশ্চুপ গর্জন। সে শুধু কাঁদেনি…পাগলিনি হয়ে গিয়েছিল। সেই কান্নাশোক ঠেলে নিয়ে গেল কয়েক মাস। শরীর-মন ভেঙে গেল। কয়েক বছরে, ধরতে গেলে অল্প বয়সেই জয়িতা এখন বুড়ি। সে যা হোক, এখন কি তার দিন আছে? শখ করে নয়, ছেলের বিয়ে দিতে হবে, সে সংসার করবে, জয়িতার নাতি-নাতনির মুখ দেখতে ইচ্ছে হয়, আদর আর খেলার সাধ; অথচ ছেলে বিয়ে করতে চায় না। বড় মুখচাপা কুমার। তারপরও এদিক-ওদিক মেয়ে দেখাদেখি চলতে থাকে। জয়িতা ঘুরে বেড়ায়। লক্ষ্মী প্রতিমার মতো বউমা চাই। দেখা হলো বেশ কয়েকজন। জাত-বর্ণ মেলে তো চেহারা মেলে না। কারও নাক বোঁচা কারও মোটা ঠোঁট। কারও উঁচু নাকে রাতডাকা শব্দ। নাকডাকা তো নয়, উচ্চিংড়ের কানফাটা আওয়াজ। ওদিকে যা একবার পছন্দ হয়, দেবীর মতো মুখছবি, লম্বা, মাথা-ভরতি চুল; কিন্তু স্বাস্থ্য খটখটা কাঠ। নিশ্চয়ই ডায়েট কন্ট্রোল করে। চোখে তার মরুভূমি উদাস দৃষ্টি। কত শত নানান বাধা। অবশেষে অনেক খুঁজে খুঁজে তবেই অনুরাধাকে পাওয়া। যেমন শরীর স্বাস্থ্য তেমন মায়াবতী চেহারা। রূপকথার গল্পে পড়া ভানুমতি যেন। অপরূপ মুখছবি…সক্ষম কর্মঠ। গৃহস্থ বাড়ির বউ একটু শক্ত সামর্থ না হলে চলে না। ওদিকে পণ হিসেবে যে অঙ্ক পাওয়া যাবে, কুমারের দোকান দিতে কম কিসে? মূলধনের আরও দরকার পড়লে না হয় পাঁচ বিঘে জমির একবিঘে বেচে দেওয়া যায়। এক বিঘে নমিতার বিয়েতে খসে যেতে পারে। মেয়েরও তো বিয়ের বয়স হয়ে এলো। সকলের ইচ্ছে, আগে কুমারের হোক। তারপর দেখা যাবে। বিয়ের কাজ অনেক ঝামেলার। সব প্রজাপতি ঋষির ইচ্ছে আর দয়া। অবশেষে কুমারের বিয়ে যথারীতি সু-সম্পন্ন হলো। ছেলে বোধহয় একটু রাগ করেই মত দিয়েছে। জয়িতা অবশ্য কোনো ত্রুটি রাখেনি। কুমারকে একান্তে ডেকে বারবার বলেছে, –

‘হ্যাঁ রে কুমার, তোর বিয়ে, একবার পাত্রিকে দেখবি না? কানা-খোঁড়া নাকি খেঁদি-বুচি, ঘুমে নাক ডাকে কিনা? দেখতে হয় বাপ। সারাজীবনের প্রশ্ন।’

‘বিয়ে তো আমার হচ্ছে না। বিয়ে হচ্ছে ওই মেয়েটার। আমি তো বারবার বলছি, একটু গুছিয়ে নিই, তোমরা তো শুনছই না, নিয়ে আসো তোমাদের পছন্দের মানুষ।’

জয়িতা আহত হয়। আজ ছেলে কয়েক বছর হলো শহরে থাকে। কখনো আসে কখনো অনেকদিন পেরিয়ে যায়। দিনাজপুর শহর আর কত দূর? বাসে উঠে বসলে আধঘণ্টার পথ। দিব্যি বাড়িতে এসে থাকা যায়। ঘরের ছেলে কাছে থাকলে মায়ের মনে কত শান্তি! অথচ এই পথটুকু মাড়িয়ে মায়ের দৃষ্টিসীমায় আসা যায় না। শহরের গুড়গোলার মেসে থাকে। চারুবাবুর মোড়ে ওষুধের দোকান। সেখানে কাজ, কাজ নয় চাকরি; একরকম ব্যবসা শেখাও বটে। ওষুধপত্র বা ড্রাগের ব্যবসা, কপাল খুলে গুটি লাল হতে বেশিদিন লাগে না। কুমারের বারবার একই মন্তব্য সহজ উক্তি। নিজের যদি একটি দোকান হয়, সকলে নিশ্চিন্ত; সুখের ঘরে দখিনা বাতাস ঢেউ খেলে যাবে। জীবন আর অস্তিত্বে কোনো দুশ্চিন্তা থাকে না। নীলরঞ্জন বাবু শেষে জয়িতার ইচ্ছে পূরণে উঠে পড়ে লাগেন। বিয়ে হয়ে গেল। বিজন কুমার সহজ-শান্তশিষ্ট-নির্বোধ-লাজুক পাত্রের মতো প্রজাপতি ঋষির সকল আয়োজনে কোনো গোলমাল করল না। সবকিছু ভালোয় ভালোয় শেষ। জয়িতার মুগ্ধ নয়ন, আহা দু-জনকে কি মানিয়েছে! একেবারে ভাইবোনের মতো। ঠিক রাধাকৃষ্ণ। এবার মনের কোণায় কত শান্তি! জয়িতা মনে মনে ব্রহ্মাকে আনত কৃতজ্ঞতা জানায়। অথচ কয়েকটি দিন পেরোয়নি, কেউ কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে চলে যায়? নতুন বউ ঘরে রেখে?

জয়িতার চোখ-মুখ শুকনো। কী করা উচিত কিছু বুঝে উঠতে পারে না। সবকিছু অস্থির দোলায় এলোমেলো চঞ্চল। বাড়ির ভেতর আর বাহিরের আঙিনায় বিষাদ বাতাস মন পোড়ায়। বুক শূন্য খাঁ-খাঁ করে। সে কখনো নমিতার পাশে, অন্যবার অনুরাধার কাছে গিয়ে বসে থাকে; তবু কোনো স্বস্তি নেই। নীলরঞ্জন যখন ফিরে আসেন, খুব ব্যস্ত-আগ্রহে দ্রুত এগিয়ে যায়; নতুন কোনো সুখবর শুনতে মন আনচান করে।

‘কুমারের কোনো খবর পাওয়া গেল?’

‘পাওয়া যাবে, এত অধৈর্য হয়ো না তো!’

স্বামীর রাশভারী দৃষ্টিতে চোখের সামনে অমন সুন্দর উজ্জ্বল বিকেল ম্লান হয়ে পড়ে। একজন আরও আছে যার কাছে কোনো আনন্দ সংবাদ পাওয়া যেতে পারে, সে হলো নিতাই; জয়িতার দূরসম্পর্কের দাদা। সে ভাগিনার নানান খবরের সঙ্গী। কুমারের পছন্দ-অপছন্দ সম্পর্কেও স্বচ্ছ ধারনা রাখে। ছেলে শহরের যে দোকানে কাজ করে তার দু-একটি দোকানের আগে তার দোকান। সেও সেলস্‌ম্যান। কখনো বা মাঝে মধ্যে ঘটকালি করে। বংশ-জাত-কূল মিলিয়ে প্রজাপতির পাখনায় রং ছড়িয়ে দেয়। অনেকের জীবন তো সুন্দর রাঙিয়ে দিল। কুমারের জোড়া মিলিয়ে দেওয়াও তার, কিন্তু এখানে যে কোনোকিছু রঙিন হলো না। কোথায় কোন্‌ খটকা কে জানে! তাকে খবর দেওয়া আছে। রাতে আঙিনায় এসে দাঁড়ালে অধীর জিজ্ঞাসা নিয়ে চোখ তোলে জয়িতা। ছেলের খবর পাওয়া গেল? শহরে আছে নাকি অন্য কোথাও চলে গেছে? সেটি হলেই বিপদ।

 

 

জয়িতা বিয়ের পর থেকে লক্ষ্য করে আসছিল। কোথাও একটু খাপছাড়া লাগছে। ছন্দপতন। বোধহয় ভুলই হলো। এক বিকেলে চা খেতে খেতে স্বামীকে বলেও ফেলে বুকের সকল অস্বস্তি আর জিজ্ঞাসা।

‘কই কুমার তো কখনো বউয়ের কাছে বসে না। পুরুষ মানুষ নতুন বউ পেলে ঘরের দোর বন্ধ করে রাখে, আর তোমার ছেলে বাজারে গিয়ে আড্ডা দেয়। শহরে চলে যায়। সিনেমা দেখে। কেমন অদ্ভুত না?’

‘বলো কি! আগে বলোনি তো!’ নীলরঞ্জন বিস্মিত হন।

‘আমিই কি বুঝতে পেরেছিলাম। নমিতা বলল, দু-জনের মধ্যে কথাবার্তাও নেই। শেষে মহাপাপ হয়ে গেল নাকি গো?’

‘কি যে বলো জয়িতা! ছেলে মানুষ, শরম পাচ্ছে, কুমার তো এমনিতেই লাজুক, একটু সময় দিয়ে দেখ; সব ঠিক হয়ে যাবে।’

‘কুমারকে আজকাল আরও ভ্যাবলা দেখায়।’

‘শোনো যত বড় বেহায়া পুরুষ হোক, বিয়ের পর তাকে একটু ভ্যাবলাই দেখায়। লাজুক লাট্টু ছেলে সময়ে ঠিক হয়ে যাবে।। দেখ দু-এক মাস।’

‘হলেই ভালো। তোমার ছেলে। তুমি কিন্তু এমন ছিলে না।’

‘কেমন ছিলাম? আমি তো প্রথম রাত থেকেই তোমার আঁচলে বাঁধা…ঠিক কি না?’

‘নাহ্‌ তুমি বড় যাচ্ছেতাই।’

নীলরঞ্জন ফ্যাস্‌ ফ্যাস্‌ শব্দে ভুঁড়ি কাঁপিয়ে হাসেন। তারপর খুব আবেগে জয়িতার পিঠে হাত রেখে সোহাগে চাপ দেন। জয়িতা আবেশে কয়েক মুহূর্ত নিশ্চুপ থেকে আলগোছে উঠে দাঁড়ায়। বাইরের আঙিনায় ধান শুকোচ্ছে। গরু-ছাগলে মুখ দিলে বিশ্রী ব্যাপার হবে।

 

অনুরাধা বসে আছে। সিঁথিতে উজ্জ্বল দুপুরের মতো জ্বলজ্বল করছে সিঁদুর। সামান্য সাজ-প্রসাধন। বারান্দার উত্তরে একটি লম্বা চৌকি ফেলে রাখা। তার উপর সকলের আহারপর্ব সারা হয়। গ্রীষ্মের রাতে কেউ ঘুমোয়। জয়িতা দেখে ছেলে-বউয়ের মুখে কোনো ভাবান্তর নেই। ঘণ্টাখানেক আগে জিজ্ঞেস করেছিল। কুমার কিছু বলে গেছে কি না? তাদের দু-জনের মধ্যে কোনো মতান্তর বা কথা কাটাকাটি? এই দু-একদিনে তেমনকিছু হয় না, তারপরও আবার কিছু যদি হয়; সেই জিজ্ঞসার জবাব পাওয়া যায়নি। তখন নমিতা ধারেকাছে দাঁড়িয়ে পেয়ারা খেতে খেতে দেখে আছে। একসময় মুচকি হেসে বলে, –

‘দাদা বউদির জন্য নীলপদ্ম আসতে গেছে মা…নাকি গো পরের বেটি?’

‘ফাজলামো করিস না নমিতা। ছেলে আমার কোন্‌ কারণে কোথায় চলে গেছে খুঁজে দেখবে, তা না কাব্য করা হচ্ছে! শেষে বিবাগী হলে কী নিয়ে থাকব?’

‘ছেলে তোমার বেশি দূর যায়নি গো মা। পুরুতের দৌড় ওই মন্দির পর্যন্ত।’

‘তিন-চারদিন হয়ে গেল, এখনো কোনো খোঁজ নাই, শহরের দোকানেও যায়নি। তোর বড়মামার বাড়িও না। গেল কোথায়?’

জয়িতা চোখ সরু করে অনুরাধার দিকে দৃষ্টি ফেলে। সেখানে কোনোকিছু খোঁজে। নিজেদের মধ্যে কিছু হয়েছে কি না কে জানে। দম্পতি নারী-পুরুষের মধ্যে যে সম্পর্ক, ওরা ছাড়া কে বলতে পারে? তার মনে সন্দেহ গুনগুন করতে থাকে। মনে হয় কিছু হয়েছে। ছেলের বউ পছন্দ হয়নি, অথবা…ছেলের বিয়ে দেওয়া ঠিক হলো কি না? হাজার ভাবনায় মাথা গুলিয়ে ওঠে। এখন অপেক্ষা। নিতাইকে এক জায়গায় পাঠানো হয়েছে। সে এলে যদি কিছু জানা যায়, তবে দু-জনের মধ্যে নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে। এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে সামনে তাকিয়ে থাকে জয়িতা।

 

বিয়ের মাত্র তিনটি দিন পেরিয়েছে। বিজন কুমার রায় যত ক্লান্ত, শরীর থেকে অবসাদ যেন সম্পূর্ণ দূর হয় না; চোখে ঘুমও নেই। এতদিন নিজের ঘরে একটি বড় খাটে কত আরামে ঘুমিয়েছে! সেখানে অন্য একজন একেবারে তার পাশে শুয়ে রয়েছে। তার নিজের সবকিছুতে বসিয়েছে ভাগ। বড় অংশীদার। মনে হচ্ছে, এতদিন নিজের বলে জমানো সাজানো সকল জিনিসে তার পছন্দ-অপছন্দ আর নিজস্বতা অবশিষ্ট নেই। তার একক মালিকানা শেষ। কেউ একজন দখল করে নিয়েছে। সে নিক, একটু যে ঘুমোবে সেখানেও ব্যাঘাত। সে খাটের একেবারে বাঁ-ধারে শুয়ে তির্যকদৃষ্টিতে সামনে তাকায়। কড়িকাঠের সঙ্গে হালকা সবুজ একটি বাল্‌ব জ্বলছে। পাঁচ ওয়াট। ঘরময় আলোছায়ার মায়াময় খেলা। অনুরাধা ড্রেসিং টেবিলের ওখানে বসে আছে। সে খুব ধীরে চুলের বেণি খুলে আটপৌরে খোঁপা বাঁধে। হাতের চুড়ি বের করে টেবিলের একপাশে রং মিলিয়ে সাজায়। এসবের মধ্যে তার দিকে একমুহূর্ত নির্নিমেষ তাকিয়েও থাকে। তারপর আকস্মিক দাঁড়িয়ে একটানে শাড়ি খুলে ফেলে। তার পরনে ব্লাউজ আর পেটিকোট। ব্লাউজ সম্ভবত তার নয়। চেয়ারের উপর ম্যাক্‌সি। ওটাতে হাত দিতে গিয়ে কী ভেবে থেমে আবার তার দিকে তাকায়। কুমার চুপচাপ সুবোধ বালকের মতো নিষ্পলক দেখে আছে। মনে হচ্ছে কোনো তামাশা। অনুরাধার চেহারায় ভাবান্তর নেই। অদ্ভুত রহস্যময়। সেখানে তবুও প্রচ্ছন্ন কোনো কৌতুক খেলা করছে বলে মনে হয়। কুমার ভেবে নেয়, এই মেয়েটি তার বউ। উজ্জ্বল ধবধবে ফরসা। সুঠাম শরীর। হাসলে গালে টোল্‌ পড়ে। নিজের হাতে প্লাগ করা ভুরুর নিচে বড় বড় দুটি ঝিনুক চোখ। এতকিছুর পরও অচেনা এক মেয়েমানুষ সে। কুমারের অদ্ভুত অনুভূতি হয়। বোধকরি ভালো লাগে না। সে আরও কিছু ভাবছিল, চুড়ির রিনিঝিনি শব্দে সচকিত হয়। তার সামনে এক অনাবিষ্কৃত পৃথিবী। অনুরাধার উপরের অংশ একেবারে উদোম। ঘরের হালকা আলোয় সুডৌল স্তনের খয়েরি দুটো বোঁটা চোখের মতো তাকিয়ে আছে। কুমার শিহরে ওঠে। হৃৎপিণ্ড বুঝি ধক্‌ করে লাফিয়ে স্পন্দন দ্রুত করে ফেলে। কয়েক মুহূর্ত। সে তাড়াতাড়ি নিজেকে অন্যদিকে পাশ ফিরে নিয়ে যায়। অবসাদে ঘুম পাচ্ছে তার।

এরপর কিছুক্ষণ খসখস শব্দ। স্পষ্ট বোঝা যায়, অনুরাধা পাশের বালিশে মাথা রেখে শুয়েছে। তার খুব কাছে। সেখানে গভীর শ্বাসপ্রশ্বাসের মৃদু ছন্দ। একটু কি চঞ্চল অস্থিরতা? কুমারের বুকে ঢেউ জাগে…এই মেয়েটি তার বউ। তখন মেয়েটি তার পিঠে হাত রাখে। উষ্ণ গভীর স্পর্শ। তারপর ফিসফিস করে বলে উঠে, –

‘একটা কথা বলব?’

‘কী?’

‘আমাকে তোমার পছন্দ হয়নি না?’

‘এ কথা কেন?’

‘না এমনি মনে হলো।’

‘ও।’

‘তুমি নাকি বিয়ে করতে চাওনি? পালিয়ে গিয়েছিলে?’

‘কে বলেছে তোমাকে?…নমিতা?’

‘কেউ যেন বলছিল শুনলাম।’

‘ও।’

‘এদিকে একটু মুখ ঘোরাবে? একটা কথা বলব।’

‘শুনছি বলে ফেলো।’

‘এদিকে একটু তাকাও না বাবা, একটা কথা বলব।’

অগত্যা কুমার তার দিকে পাশ ফেরে। লাল রঙের জমিনে সাদা আর হলুদ ফুলের প্রিন্ট ম্যাক্‌সি পরেছে অনুরাধা। হালকা মৃদু আলোয় তেমনই মনে হয়। তখন তার আবার মনে পড়ে, এই মেয়েটি তার বউ। সহধর্মিণী। একে নিয়ে সারাজীবন কাটাতে হবে। উহ কি সাংঘাতিক! আপাতত একে বউ নয়, একজন অপরিচিত মানুষ ভাবা যাক। সে দেখে মেয়েটি তার চোখে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে আছে। রাতের আলো-আঁধারে চকচক করছে চেহারা। সেই দৃষ্টিতে উদগ্র জিজ্ঞাসা। কুমার ওই চোখে তাকিয়ে অপেক্ষা করে। অনুরাধা ডানহাত ধরে নিজের বুকের দিকে টেনে নেয়। কুমার শিহরে ওঠে। সে পুনরায় সচকিত হয়, পাশের মানুষটি একজন স্ত্রী-লোক; তার জীবনসঙ্গী।

‘বলো কী বলবে?’

‘তুমি বিয়ে করেছ কেন?’

এই প্রশ্নের মুখোমুখি কোনো পুরুষ হয় কিনা কুমারের জানা নেই। সে হাতে-পায়ে চমকে ওঠে। অনুরাধা এমন প্রশ্ন কেন করল? কী জবাব আছে? কোনো জবাব নেই। সে চুপ করে থাকে। চোখ বুঁজে সবকিছু এড়িয়ে যেতে চায়। একটু ঘুম দরকার। বড় ক্লান্তি লাগে।

অনুরাধা ব্যাকুল আগ্রহে তাকিয়ে থাকে। তখন বাইরে কদম গাছের কোনো শাখায় একটি পেঁচা ডেকে উঠছে…হুউম হুউম। এই ডাকটি তার পরিচিত হয়ে গেছে প্রথম রাতেই। নমিতাকে জিজ্ঞেস করেছিল। সে জানায়, রোজ রাতে একটি পেঁচা তাদের বাড়ির উত্তরে কদম গাছের ডালে বসে। লক্ষ্মী পেঁচা। অনেকক্ষণ ডেকে চলে যায়। আজও একটুপর চলে যাবে। সে তার প্রশ্নের উত্তর পায় না।

‘তুমি কারও সাথে প্রেম করতে? ওকে বিয়ে করার ইচ্ছে ছিল?’

‘এই প্রশ্ন করা কি ঠিক হচ্ছে? তুমি বলো তো কেন বিয়েতে বসেছ?’

‘আমি মেয়েমানুষ…বাবা-মায়ের বোঝা। বিয়ে দিয়েছে। তাদের টেনশন হালকা হয়েছে, কিন্তু তোমার বিয়ে করার উদ্দেশ্য কী?’

‘মা-বাবাকে খুশি করা।’

‘ও! তার মানে আমাকে তোমার পছন্দ হয়নি।’

‘আমি এসব ভাবছি না।’

‘কিন্তু আমি ভাবছি। তুমি আমাকে একটু ছুঁয়ে দেখলে না। জড়িয়ে ধরলে না।’

 বিজন কুমার খুব আবেগে স্ত্রীর বাঁ-কাঁধ আর হাতের উপর নিজের ডানহাত রাখে। মেয়েদের শরীর এত নরম আর মোলায়েম! বেকারির পাউরুটির মতো তুলতুলে। একটু গরম ভাঁপ রয়েছে।

‘কই জবাব দিলে না?’

‘কী?’

‘তুমি বিয়ে করেছ কেন?’

‘জানি না।’

‘গাধা!’

অনুরাধা আকস্মিক তার ঠোঁটে গালে চপ চপ করে চুমু দেয়। কুমারের ঘিনঘিনে লাগে। কেমন মেয়ে? তার সারা মুখে থুতু লাগিয়ে দিল! অনুরাধার কোনো যায় আসে না। সে দ্রুত ম্যাক্‌সি খোলে। তারপর তার বুকের উপর চড়ে বসে। অনুরাধার হাতদুটো চঞ্চল হয়ে এদিক-ওদিক ঘোরাফেরা করে। কুমারের করার কিছু নেই। সে নিশ্চুপ দেখে যায়। কোনো কথা বলে না। তার প্রচণ্ড ঘুম পায়। অনুরাধা শেষে হাঁপাতে হাঁপাতে ফিসফিস করে বলে উঠে, –

‘তোমার সমস্যা, বলো নাই তো! তুমি বিয়ে করলে কেন? নাকি ভান করছ?’

‘জানি না।’

 

অনুরাধা জানে কুমার কেন চলে গেছে নাকি পালিয়েছে; কিন্তু সেই কথা কেমন করে বলে? ওসব কি বলা যায়? সে ভেতরে ভেতরে খুব স্বার্থপরের মতো গুমরে মরে যেতে থাকে।

অনুরাধা আরও দেড় সপ্তাহের উপর শ্বশুর বাড়ি থাকল। বাবা-মায়ের কাছে খবর গেছে। এসব খবর বিষ্ঠার গন্ধের মতো বাতাসে ছড়িয়ে যায়। কথা ছড়ানোর লোক আছে। সে ভাবছিল বাবা আসবে। জামাই হঠাৎ চলে গেছে নাকি নিরুদ্দেশ হয়েছে, তাদের জানতে নিশ্চয় কৌতূহল হবে। সেটি ঘটনার জন্য যতটুকু, তার চেয়ে মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুর্ভাবনা। একটু দায়িত্ব বা অধিকার তো থাকে। একান্ত হলেও হালকা যে গুজব বা কানকথা তার সত্যতা জানারও বিষয় আছে। মেয়ের জীবন। অথচ বেহাইর বাড়ি যেতে আড়ষ্ট হয়ে আছে তারা। আজকালকার ছেলেমেয়েদের ব্যাপার। কুমার নিশ্চয়ই ফিরে আসবে, কিন্তু দেখতে দেখতে অনেকগুলো দিন পেরিয়ে গেল; সে আর ফিরে এলো না। অনুরাধার বাবা-মাও এসে দাঁড়াল না।

 

সেদিন সন্ধের আগেই নিমাই আসে। হাসিখুশি আর খুব অস্থির চঞ্চল মানুষ। অনুরাধা আগে দেখেছে। বিয়ের সময় বেশ হই-হুল্লোড় করেছিল। সে লোকও কেমন নিশ্চুপ। শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে কী কী সব আলোচনা করে। দরজা ভেজানো। অনুরাধা তেমন কান দিতে পারে না। অভ্যেস নেই। কদম গাছের নিচে সন্ধের ছায়া। সেখানে বসে নমিতার সঙ্গে গল্পে মজে যায়। তার ননদ যেমন সুন্দর তেমন বন্ধুর মতো হাসিখুশি। একটু ফাজিলও…আজেবাজে কথা আওড়ায়। দাদা কতক্ষণ ধরে চুমু খেয়েছে? তার দম বন্ধ হয়ে আসছিল কি না? তারপর কেমন ভালবাসে? লাজুক ছেলেরা নাকি বড্ড…। অনুরাধা শুনতে শুনতে লাজরাঙা শেষে বিরক্ত হয়ে ওঠে।

‘দাদা সম্পর্কে এসব বলতে খারাপ লাগছে না?’

‘ও মা আমি কী বললাম! দাদা তোমাকে কেমন ভালবাসে তাই বলেছি।’

‘এমন ভালবাসে যে বউ ফেলে চলে যায়। নমিতা তুমি সত্যি করে বলো তো, তোমার দাদা অন্য কাউকে বিয়ে করতে চেয়েছিল কিনা?’

‘আ রে দূর! যে ছেলে মেয়েদের দেখলে কুকড়ে থাকে, অমন মানুষের জীবনে প্রেম হয়? তুমি খামোখা এসব ভাবছ। এবার সে দায়িত্ববান মানুষ হবে, বিয়ে করেছে কাঁধে বোঝা এসেছে; নিশ্চয়ই বড় কোনো কাজের ধান্ধায় আছে। আমাদের অবাক করে দেবে।’

‘আমি কি তোমাদের বোঝা?’

‘আমাদের নয়, দাদার ফুলের বোঝা। পদ্মফুলের বাকেট। এবার বলো তো কেন না বলে গেল সে?’

‘আমি জানি না। সে ফিরে এলেই ভালো।’

‘বাব্বা…এই ক-দিনেই!’

অনুরাধা এইসব কথাবার্তার মধ্যে দেখে নিমাই এসেছে। বেশ দ্রুত শ্বশুরের ঘরে গিয়ে বসেছে। নিশ্চয় খবরাখবর আছে। অনুরাধার ইচ্ছে হয়, সেও সেখানে গিয়ে খোঁজ নেয়। কুমারের কোনো খোঁজ পাওয়া গেছে কি না? পরে আর যেতে পারে না। সেখানে যাওয়া যদি অযাচিত হয়ে যায়? আলোচনা কী হলো কে জানে। ঘোষণা হলো পরদিন সকালে। নতুন বউ কয়েকটি দিন বাপের বাড়ি ঘুরে আসুক। অবশেষে অনুরাধা অপূর্ণ সাধ বুকে চেপে ফিরে চলে বাপের বাড়ি। টেম্পুতে ওঠার সময় নিমাই কিছু কথা বলে। তার দিকে তাকিয়ে করুণা করতে ইচ্ছে হয় অনুরাধার। মনে হয় তার নয়, লোকটির কপাল পুড়েছে। নিমাই বলে, –

‘এদিকে-ওদিকে কিছু খোঁজ করা গেছে বউমা, কোথাও নেই; তবে যাবে কোথায়! ঘরকা মুরগি ঘরেই ফিরে আসবে। তুমি না হয় কিছুদিন বাবার বাড়ি বেরিয়ে আসো। আমি বগুড়া-ঢাকায় ওর কয়েকটা ঠিকানা আছে খুঁজে আসি।’

‘আচ্ছা!’

‘বউমা তুমি কিছু ভেবো না, আমি সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে ওকে খুঁজে বের করব।’

অনুরাধা আর কী বলবে? সে চুপ করে টেম্পুর ভেতরে গিয়ে বসে। এই আড়ালটুকু খুব দরকার ছিল। নিমাই সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার বুকের কথাগুলো পড়তে শুরু করেছে। টেম্পু চলতে শুরু করে। তার মনের গহিনে হাজার ভাবনার জাল ভেসে ভেসে ছড়িয়ে যেতে থাকে। কুমারকে তার খুব পছন্দ হয়েছে। প্রথম দিনেই। ছায়াছবির নায়কের মতো সুন্দর চেহারা। কথাবার্তা এত স্পষ্ট আর মধুর! পোশাক-আশাকে কে বলবে বেশি দূর শিক্ষিত নয়। অত শিক্ষা নিয়ে কী হবে? পণ হিসেবে বাবা এক লাখ টাকা দিয়েছে। জামাই দোকান দেবে। সেই দোকান বসবে বাজারের এককোণায়। একটি ওষুধের দোকান মানে অনেক টাকা। দোকান ধীরে ধীরে অনেক বড় হবে। কুমার প্রতিদিন সকালে দোকানে যাবে। সে তার জন্য খুব যত্ন করে ভাত-তরকারি রান্না করবে। ভালবাসায় ভরিয়ে দেবে শরীর-মন। একদিন ছেলের মা হবে সে। ছেলেকে দু-জন মিলে বড় করবে। বড় মানুষ হবে। স্বামী আর সন্তান নিয়ে সুন্দর সুখী জীবন হবে তাদের। এ ছাড়া আর কোনো ভাবনা নেই…স্বপ্ন নেই, অথচ সব কেমন গুলিয়ে গেল। এসব ভাবতে ভাবতে তার দৃষ্টি বাজার-দোকানপাট-সবুজ ক্ষেত ছেড়ে বিরান পাথারে এসে পড়ে।

 

সেই লজ্জার কথা মুখে আনতে কেমন লাগে। বুকের মধ্যে বড় কষ্ট। অনুরাধা কষ্টের বাধ ভেঙে এসেছে। ঘরভরতি মানুষজন। প্রায় দশ-পনেরোর উপর। উভয়পক্ষের অভিভাবক। আত্মীয়স্বজন। সকলের কৌতূহলী অলস মনোযোগ। এসবের একপ্রান্তে তাপস দুর্বোধ্য আগ্রহী দৃষ্টি নিয়ে বসে আছে। তার দু-চোখে কখনো কৌতুক কখনো নিষ্ঠুরতা খেলা করে। আজ প্রায় তিন মাস হয়ে গেছে। অনুরাধা সেই যে বাপের বাড়ি এলো, কেউ তেমন করে খোঁজখবর নেয়নি। অনুরাধা নিজ গরজে লজ্জার মাথা খেয়ে বারকয়েক খবর নেওয়ার চেষ্টা করেছে। একদিন আকস্মিক স্বপ্নের মতো শোনা যায়, বিজন কুমার রায় ফিরেছে। প্রিয় মানুষটি আসবে বিশ্বাস ছিল। একেই বুঝি বলে মনের টান। ঈশ্বর যেমন জোড়া দিয়ে মর্ত্যে পাঠিয়েছে, তেমন পরস্পরের প্রতি মনের মায়াও সৃজন করে রেখেছেন; অনুরাধা বোধকরি সেই টানেই কয়েকদিন অকারণ ভাবনায় শিহরিত হয়। ভালবাসার প্রতীক্ষায় দু-চোখ দূর রাস্তায় আর পাথারে ছড়িয়ে রাখে, কিন্তু না, তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য কুমার কিংবা অন্য কারও তেমন সাড়া পায়নি। বাড়ির অন্যজনের না হোক, প্রিয় মানুষটির মনে কি একটুও টান জাগে না? তার তো একটু আগ্রহ থাকা উচিত। নতুন বিয়ে করা বউ কোথায় আছে, কেমন আছে, বেঁচে না মরে গেছে খোঁজ নিতে এলো না? অনুরাধার কাঙাল মন তবু নিশ্চুপ আকুল ভাবনায় গুমরে থেকে থেকে অবশেষে নিষ্ঠুর সত্যকে খুঁজে বের করে আনে। কেউ তার কথা ভাবে না। এসবের মানে কী? পণের টাকার জন্যই কি তবে বিয়ে? সে কথা ঠিক কিংবা ঠিক নয়, কে জানে; তার মনজুড়ে প্রচণ্ড অভিমান বরফের মতে জমে জমে কঠিন হয়ে যায়। চোখের কোণায় অবিশ্বাসী হতাশা জেগে ওঠে।

এরমধ্যে অবশ্য একদিন নীলরঞ্জনবাবু এসেছিলেন। অনুরাধা শ্বশুরকে দেখে খুব পুলকিত হয়। অনেক সম্মান করে ঘরে নিয়ে বসায়। নকশি হাতপাখা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাতাস করে। সকলের খোঁজ-খবর নেয়। সেই কথকথায় কিছু অভিমানও থাকে। এতদিন হয়ে গেল কেউ একবার খোঁজ নিতে এলো না? সে কি কোনো দোষ করেছে? বিয়ের পর স্বামী ফেলে রেখে যায়, এ তার দোষ নয়; সব নিয়তি। অথচ তাকে একমাসের মাথায় বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হলো। কেন? সেও যদি হলো তো পরে কেউ কোনো খোঁজ নেয় না। শ্বশুরও খবর জানতে এলেন দেড়-দু মাস পর। সে বড় হতভাগী। এসব গল্প করতে করতে একে-ওকে দিয়ে মুরগি ধরা আর পোলাও রান্না করে যতটুকু সম্ভব আতিথেয়তা চলে। দীপেন চন্দ্র রায় আর রেনুবালা, বাবা আর মা এটা-সেটা গল্প-আলাপে এত ব্যস্ত হয়ে পড়ে, কে বলবে কারও বুকের মধ্যে কত কঠিন পাথর চেপে বসে আছে! বিকেলে ফিরে যাওয়ার সময় গুরুজন মানুষটি বলে কিনা, আর দিন আট-দশ পর তাকে নিয়ে যাবে। এ কি কথা! তার কি একবার সাধ হয় না স্বামীকে দেখতে? নমিতা কেমন আছে? মায়ের মতো শাশুড়ি? বুকের কথা মুখে আনা যায় না। সে আবদার বেহায়াপনা। মেয়েদের সে-সব করতে নেই। লাজলজ্জা বলে কথা। সে তাই বোবা হয়ে থাকে। এ সমাজে মেয়েদের বেশি কথা বলতে নেই, সকলে দোষ ধরে; নাম হয় বাচাল।

 

আজ সে অনেক কথা বলে। সবকিছু নগ্ন করে খুলে বলতে কণ্ঠে জড়তা নেই। বুক কাঁপে না। চোখের পাতায় পলক স্থির হয়ে থাকে। কেননা সেই আট-দশদিন খুব সহজে পার হয়ে গেছে। তারপর আরও অনেকদিন। তারা নিয়ে যায়নি…নিয়ে যাবে না। বিজন কুমার রায় ফিরে এসেছে, কিন্তু তার পক্ষে বউয়ের খোঁজ নেওয়ার মতো আগ্রহ কিংবা সময় নেই। সেই মামা নিমাই, তিনিও আর এসে কিছু বলেন না। তাদের আসল উদ্দেশ্য, পণের টাকা; বউ নয়। অনুরাধার বুকে গুমোট অভিমান ডুকরে ওঠে। তাই খুব অনায়াসে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে বলে ফেলে, –

‘বিজন কুমার রায় নপুংসক। তার কোনো পুরুষ ক্ষমতা নেই।’

এই একটি বাক্যে মৃদু গুঞ্জন জেগে ওঠে। সালিশ ঘরে ফিসফাস গুনগুন কথা উঠবে এটি স্বাভাবিক, কিন্তু এই উচ্চারণ প্রচণ্ড জোর আওয়াজ তোলে। বাতাসে ভেসে ভেসে কানে কানে ঘুরে ঘুরে ঘরময় ছড়িয়ে যায়। এমন বিচার-সালিশে মানুষজনের মজা বেশি। তাদের চিন্তায় কাহিনির সবটুকু অস্থির ঢেউয়ের মতো আদিরস ভাবনা উসকে দেয়। চেয়ারম্যান-মেম্বার আর সকলে কানখাড়া করে কথা শোনে। উভয়পক্ষের কথা শোনা হয়। যাঁচাই-বাছাই হয়। যুক্তিতর্ক বিশ্লেষণ চলে। সাক্ষী-সাবুদ কথা বলে। সবশেষে প্রমাণ আর একটি রায়। বিজন কুমারের অক্ষমতার প্রমাণ সাক্ষীরা কী করে দেবে? তারা কিছু জানে না। জানার কথাও নয়। সে কথা বলতে পারে নিজের মানুষ। অনুরাধা হলো নিজের মানুষ, হোক তা দুই-তিনদিন কিংবা তিন সপ্তাহ অথবা কে বলে অনন্তকালের।

অনুরাধার পরনে লাল রঙের জমিনে সাদা-হলুদ-নীল-সবুজ বর্ণের নানান ফুলের প্রিন্ট শাড়ি। বেশ বড় করে আঁচল টেনে মুখ ঢাকা। তার সামান্য ফাঁক দিয়ে পুব দিকে তাকায় সে। বিজন কুমার রায় দূরে চেয়ারে বসে আছে। মাথা নিচু। সাদা পাঞ্জাবিতে চমৎকার দেখায়। একটু শুকনো মুখ…রোগা রোগা। তারপরও মনে হয় সমস্ত ঘর আলো করে বসে আছে তার স্বামী। স্বামী…কেমন স্বামী? অনুরাধার সিঁথিতে সিঁদুর নেই। দেয়নি। সে কুমারকে চেনে না। যে পুরুষ স্ত্রীর কাছে থাকতে পারে না, সে স্বামী নয়; জীবনসাথি হওয়ার প্রশ্নও আসে না। সে পুরুষ নয় অথর্ব মানুষ। এমন মানুষ দিয়ে সংসার চলে না। এ কথা ভাবতে কষ্ট হয় তার, কিন্তু উপায় নেই; জীবন বড় কঠিন। সে দেখে নীলরঞ্জনবাবু, তার শ্বশুর সামনের সারিতে বসে আছেন। নির্বিকার চেহারা। তার পাশে নিমাই, মামাশ্বশুর, অনেক জড়সড়। তাদের পেছনের সারিতে শাশুড়ি জয়িতা আর ননদ নমিতা। অস্থির কাতর চেহারা। অনুরাধার নিজের বলতে বাবা-মা আর পাড়ার দু-চারজন জ্ঞাতি এসেছে। এসেছে তাপস। বড় উৎসাহী মানুষ। আজ একটি ফয়সালা হবে। এর আগে একবার বসা হয়েছে। কোনো সমাধান হয়নি। প্রথম যেদিন এইসব কথা উঠে, তার খারাপ লাগে, এতটা লাজহীন হতে বাধে; তার জিহ্বা আড়ষ্ট হয়। সে-সময় পাশের বাড়ির খুড়িমা কানে কানে মন্ত্রণা দেয়, –

‘রাধা বলে ফ্যাল মা, লজ্জা করিসনি। সারাজীবন এমন অসুখ নিয়ে থাকার চেয়ে ঘর ভাঙা অনেক ভালো। বলে ফ্যাল।’

অবশেষে সে বলে আর তখন মনে হয় ঘরের ভেতর এক বিস্ফোরণ ঘটে গেছে। সেখানে বিষময় ধোঁয়া ওঠে, উড়তে থাকে আর ছড়িয়ে পড়ে চারপাশ। বিজন কুমার রায় একজন পুরুষত্বহীন মানুষ। তার কোনো অনুভূতি নেই। অনুরাধা মেয়েমানুষ, লজ্জার মাথা খেয়ে তার শরীরে হাত রেখেছে, কিন্তু সে বরফশীতল…পাথরের মানুষ। তাকে জাগানো সম্ভব নয়।

সালিশ ঘরের লোকজন স্তব্ধ হয়ে শোনে। অনুরাধার ঠোঁট নড়তে চায় না। বোবায় ধরা মানুষের মতো হাত-পা স্থবির, জড়জঙ্গম, তবু চোখের পাতা জোর করে মেলে দিতে চায়…পারে না। চেয়ারম্যানের ওপাশ থেকে কেউ একজন জিজ্ঞেস করে, –

‘অনুরাধা দেবী আপনি বিয়ের পর কতগুলো রাত আপনার স্বামীর সাথে ছিলেন?’

‘নয় দশ রাত হবে হয়তো।’

‘আপনি বলছেন বিয়ের তিন সপ্তাহ পর্যন্ত কুমারের ঘরে তার সাথে ছিলেন।’

‘এর মধ্যে ছয় দিন ননদ নমিতার কাছে ছিলাম।’

‘কেন?’

‘এ সময় আমার…আমার শরীর খারাপ হয়।’

‘ও আচ্ছা! এ সময়গুলোতে আপনি কি অন্যরকম থাকেন? মানে বুঝতে পারছেন তো?’

অনুরাধা নিশ্চুপ হয়ে পড়ে। এ কোন্‌ ধরনের প্রশ্ন! লোকজন এত নির্লজ্জ-বেহায়া! সে মাথানিচু বাকরুদ্ধ হয়ে থাকে। খারাপ লাগে যেনবা চেয়ার থেকে পড়ে যাবে। সে আঁচল টেনে নিতে থাকে। তখন আবার প্রশ্ন।

‘বুঝতে পারছি এসব কথা শুনতে খারাপ লাগে, কিন্তু উপায় নেই। কেননা আপনার স্বামী অর্থাৎ কিনা বিজন কুমার রায় বলছেন, সকল অভিযোগ মিথ্যা।’

‘বলেন কী জানতে চান?’

‘আপনার বিয়ে তো ঘটকালি করে হয়েছে। প্রায় চার মাসের বেশিদিন বয়স। বিয়ের আগে খোঁজখবর নেওয়া হয়েছিল? এরমধ্যে কতদিন স্বামীকে কাছে পেয়েছেন?’

‘খোঁজখবরের বিষয় বাবা-মা বলতে পারবেন। স্বামীকে বেশিদিন কাছে পাইনি। দিনের বেলা উনি বাসায় থাকতেন না। শহরে কাজে যান এটুকু জানি। এ ছাড়া অন্য কোথাও যান কিনা জানি না। জিজ্ঞেস করিনি কোনোদিন। তিনি তেমন কথা বলেন না। সবসময় গম্ভীর হয়ে থাকেন।’

‘আপনি কথা বলার চেষ্টা করেছেন?’

‘করেছি…পাশ কাটিয়ে যান। মনে হয় আমাকে সহ্য করতে পারেন না, এড়িয়ে চলেন।’

‘এই সময়ের মধ্যে আপনাদের মধ্যে কোনো প্রেমালাপ বা গল্প কিছু হয়নি? আপনি নিজ থেকে এগিয়েছেন?’

‘উনি কথা প্রায়ই বলতেন না। তার সাথে একই বিছানায় শুয়েছি, কিন্তু কোনোসময় আমাকে স্পর্শ করেননি।’

‘তারপর?’

‘আমি…আমি তাকে ভালবাসার চেষ্টা করি, তার শরীরে হাত দিই। কিন্তু…!’

‘আলিঙ্গন করেছেন?’

‘জি?’

‘মানে জড়িয়ে ধরেছেন কখনো?’

‘হ্যাঁ। আর আর…।’

‘আর আর কী করেছেন? নিজে থেকে চেষ্টা করেছেন?’

‘চুমু খেয়েছি, কিন্তু তিনি সাড়া দিতেন না। তার ভালো লাগত না মনে হয়।’

‘তারপর?’

‘ওই একদিনই, আমার লজ্জা পেয়েছিল।’

একসময় অনুরাধার মনে হয়, এসব কথাবার্তা আদিরসাত্মক গল্প-আলাপ বা আলোচনা ছাড়া কিছু নয়। কুমারের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে। তিন সপ্তাহ শ্বশুর বাড়ি থেকেছে। এরমধ্যে কয়েকটি রাত স্বামীকে কাছে পেয়েছে। সে পাওয়া নিষ্ফল বাসরের কাহিনি। কুমারের নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা আছে। সে তার স্ত্রী। যে-কোনো সমস্যা তাকে বলতে পারে, কিছু বলেনি; তাকে কোনোকথা জিজ্ঞেসও করে না। একটু ভালো বা মন্দ কোনোকিছু না। তারপর সে কাউকে কিছু না বলে কোথায় চলে যায়। তাকে বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এর সবই ধারাবাহিকভাবে সাজানো নাটক। কুমারের সকল বিষয় শ্বশুর-শাশুড়ি জানে। এগুলো গোপন করা হয়েছে। তাদের সঙ্গে চালবাজি করেছে। প্রতারণার কেস। ফৌজদারি মামলা হলে চারশ কুড়ি ধারা। তারা কোর্টে যেতে চায় না। সেখানে উকিল-মুহুরি টাকা-পয়সা অনেক হাঙ্গাম। তাই ইউনিয়ন পরিষদে আবেদন করা। এখন বিবাহ-বিচ্ছেদ দরকার। এমন লোকের ঘরে গিয়ে জীবন নষ্ট করা যায় না। একটিই জীবন। বিবাহ-বিচ্ছেদ আর পণ হিসেবে যে এক লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে তা ফেরত চাই। অনুরাধা বেশ সহজে সার কথাগুলো বলে ফেলে।

 

আজ আকস্মিক অনুরাধার মনে হয়, যে যাই বলুক সে কথাগুলো বলতে চায়নি। এই নাটক বাধ্য হয়ে সাজাতে হয়েছে অথবা সবই তার অভিনয়। নাটক না সত্যি কে জানে, মানুষটি তাকে একদিন জড়িয়েও ধরল না। সে অপাঙ্গে কুমারের দিকে তাকায়। প্রথমদিন যেমন উজ্জ্বল দেখেছিল, আজ মানুষটির চেহারা বিমর্ষ হয়ে আছে। অনুরাধার খুব মায়া লাগে। এটি না করলেও পারত সে। কেন করল? তাপসের জন্য?

 

যেদিন সে বাপের বাড়ি ফিরে এলো, ঠিক তার একদিন পর বাড়ির আঙিনায় এসে দাঁড়ায় তাপস। ঢাকায় ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। পরনে জিন্‌সের হালকা চাপা প্যান্ট, চোখে মার্কারি-কোডেট কালো চশমা, স্টিকি চুল। যে লোক ধুতি-লুঙ্গি পরে থাকত, মাথার চুলে চপচপে সরষে তেল ঘষে বেড়াত; এখন সম্পূর্ণ বদলে গেছে। তার মুখচোরা চেহারা-চাহনি কখনো বেহায়ার মতো মনে হয়। অনুরাধা অবাক হয়ে যায়। চেনার চেষ্টা করে। তারপর হাসবে না কাঁদবে কে জানে, সে ভেবে পায় না। অবশেষে কোনোকিছু তেমন নয়, মনেও থাকে না; সে নিরাসক্ত দৃষ্টিতে কথা বলে। কুশল জিজ্ঞাসা করে। তার নিজের ভালো-মন্দের কথা মৃদুহাসি দিয়ে জানিয়ে দেয়। মনে হয় সবকিছু শেষ করেছে, কিন্তু সে আর কত দিন? তাপস একদিন কথায়-কথায় সব জেনে যায়। তখন অনুরাধা হেঁশেলে বসে মায়ের কাজে সহায়তা করছিল। তাপস সামনে দাঁড়িয়ে মায়ের কথা শুনছে। অনুরাধা মুখ ঘুরিয়ে কয়েকবার ইশারা করে, বুড়ি কিছু বোঝে না। রেনুবালার কোনোদিকে লক্ষ্য নেই, খুব অনয়াসে কুমারের পালিয়ে যাওয়ার গল্প করে বসে। তখন তাপস তির্যক দৃষ্টি অনুরাধার দিকে ছুড়ে দেয়। বেহায়ার মতো বেশ কিছুক্ষণ নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে। অনুরাধা কী করে? এসব কথা-কাহিনি চাপা থাকে না, লুকোন যায় না; চারদেয়াল ছেড়ে পাখনা মেলে শিমুল তুলোর মতো ভেসে ভেসে উড়ে চলে। সে উনুনের আগুনের দিকে চোখ ফিরিয়ে ভাবতে থাকে, তার বুকের আগুন কি এর চেয়ে তীব্র গভীর নয়?

 

তাপস অনেক বদলে গেছে। নিজের চেহারা আর পোশাক বদল করার সঙ্গে-সঙ্গে পালটে ফেলেছে মুখের কথা। আকার ইঙ্গিত চোখের ভাষাও। যে তাপসকে এতগুলো দিন নিজের বন্ধু-অভিভাবক ভেবে এসেছে, তার মুখে অন্য ভাষা; চোখের দৃষ্টি অদ্ভুত দুর্বোধ্য। অনুরাধার মুখে আর কথা জোগায় না। একদিন নিজ গরজে তাকে ডেকে বলে,-

‘আমার একটা কাজ করে দিতে পারবি তাপসদা?’

‘বল।’

‘লোকটির খোঁজ এনে দিতে হবে, কিন্তু কেউ যেন জানতে না পারে।’

‘আচ্ছা শহরে গেলে খোঁজ নেব।’

‘কেউ যেন জানতে না পারে দাদা।’

‘কেন জানলে কী হবে? লজ্জা লাগছে!’

‘পারলে এখানে নিয়ে আসিস।’

সে বেশ ত্রস্ত হাতে তার হাতে একটি একশ টাকার নোট গুঁজে দেয়। তারপর পুকুরপাড়ের ধার ঘেষে শরীরে থোকা থোকা বড়ই নিয়ে আধশোয়া দাঁড়িয়ে থাকা গাছটির দিকে এগিয়ে যায়। সন্ধ্যা নেমে আসছে। সেখানে ছায়া ছায়া অন্ধকার। মনের গহিনে অভূতপূর্ব শিহরন আর বিশ্বাস, তাপস তার কাজ করবে। সে নিশ্চিন্ত হয়। তাপস তখন তার পেছনে পেছনে এসে দাঁড়ায়।

‘রাধা একটা কথা বলি তোকে?’

‘কী?’

‘সে লোক মনে হয় তোর সাথে ঘর করবে না, অন্য কোথাও গিট্টু আছে।’

‘না না ওসব কিছু নয়…খুবই বোকা মানুষ। কেন দেখিসনি, বিয়ের সময় কেমন মাটিতে মিশে যাচ্ছিল!’

‘আমি তো একবার দেখেছি। তুই বলতে পারবি কেমন লোক। তবে আমার মনে হয়, সে তোর সাথে থাকবে না।’

‘না তাপসদা, এ তোর ভুল ধারণা। লোকটিকে আমার কাছে একবার এনে দে না দাদা।’

‘যদি আসতে না চায়?’

‘এ্যাঁ…এটা তো আমি ভাবিনি…না না আসবে।’

‘শোন্‌ কোনো পুরুষ বিয়ে করা বউ রেখে এতদিন আলগা থাকতে পারে না। পুরুষ মানুষ হলো বাঘের মতো। রক্তের স্বাদ পেলে তাকে আবার লোকালয়ে যেতে হয়। বিজন কুমার তো দেবতা নয় যে ধ্যানে বসতে জঙ্গলে গেছে!’

অনুরাধা কী বলে? তার কুমার বাঘ নয়। একজন অতিভদ্র নমনীয় মানুষ। কে জানে কোনো সমস্যা আছে কি না? তাকে একটু স্পর্শ পর্যন্ত করল না। কতগুলো রাত পাশাপাশি শুয়ে রইল, অথচ…। তবু তার এই মানুষটিকে ভালো লেগেছে। মেয়েদের বিয়ে তো একবারই হয়। সে-সব ছবি দু-চোখের পাতায় মৃদু কম্পনে ভেসে ওঠে। সে কী উত্তর দেবে ভেবে পায় না। তাপস বলে চলে, –

‘তোকে একটা কথা বলি, অবশ্য এখন বলে কী লাভ আমি বুঝতে পারছি না। আমার খুব ইচ্ছা তুই আমার সাথে থাক।’

‘এসব কী বলছিস তাপসদা?’

‘কেন রে এখন সব হয়! তুই শুধু মেম্বারের কাছে বা পরিষদে গিয়ে একটু অভিযোগ করবি। তারপর তুই আর আমি দুজনে…বুঝতে পারছিস তো?’

‘এসব কথা বলার জন্য কদিন ধরে ঘুরঘুর করছিলি না?…আমার যখন বিয়ে হয়নি, তখন কোনোদিন বলিসনি। এখন এসব কথা শোনাও পাপ।’

‘শোন তুই বড় পূণ্যবতী, তোর ভালোর জন্য বলছি। মন না চাইলে আর কি করা যাবে! তুই বললে আমি তোর লোককে খুঁজে এনে দেব। তবে আমার একটি শর্ত আছে, বলব?’

তখন আশপাশের দু-একটি ঘরে আলো জ্বলতে শুরু করেছে। পুকুরপাড় আর রাস্তার ধারে উচ্চিংড়ে-ঝিঁঝিঁপোকা শব্দ তুলেছে। অনুরাধা সন্ধের সেই ছায়ান্ধকারে সামনে দাঁড়ানো তাপসের চোখে যা দেখে, ভয়ংকর শিহরে উঠে। সে খুব আড়ষ্ট হয়ে যায়। তারপর নিজেকে সেই অন্ধকার থেকে বাঁচানোর জন্য মৃদু অথচ দৃঢ় গলায় জবাব দেয়।

‘শর্ত? কী শর্ত? ছি তাপসদা!’

 

অনুরাধা আর একবার সামনে দৃষ্টি ফেলে রাখে। বিজন কুমার রায়ও কাঙালের মতো তার দিকে তাকিয়ে আছে। সেই দৃষ্টির উপর চোখ পড়তেই কুমার মাথা নিচু করে ফেলে। অনুরাধার বুক ফুঁড়ে অজান্তে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে যায়। আনমনে বুকের তলায় গুমোট কান্না জেগে ওঠে। সে কি কোনো ভুল করছে? অবিচার? সে আলগোছে লুকিয়ে আরও একবার দৃষ্টি ফেরায়। কুমার তখনো দৃষ্টি অবনত করে বসে আছে। অনুরাধার খুব মায়া হতে থাকে।

 

তাপস বসে থাকেনি। সে খুব কুটবুদ্ধি করে রেনুবালাকে বুঝিয়ে দেয়, অনুরাধা সেখানে সংসার করতে পারবে না। বিজনের সমস্যা আছে। সে অনেক কথা শুনেছে। নেশাখোর। ডাইল খায়। গাজা টানে। আরও কত কি! শহরের গোপন কিছু জায়গায় রোজ রাতে নেশা করতে যায়। দোকানের কাজ হলো বাহানা, তা না হলে একটি পয়সাও কি বাড়িতে দেওয়া যায় না? বরং সপ্তাহে সপ্তাহে মোটা টাকা নিয়ে যায়। মা-বাবার অতি আদরে বখে যাওয়া মুখমুন্দা লম্পট ছোকরা হলো বিজন কুমার। কী দেখে সন্বন্ধ করেছে কাকা-কাকি? এসব কথা ফিসফাস থেকে উঁচু গলায় চলতে থাকে। অনুরাধার কানে এসেও আঘাত হানে। কখনো বিবমিষার উদ্রেগ হয়। ঘরের কোণে রাখা কীটনাশক খেয়ে প্রাণ জুড়োনোর ইচ্ছে জাগে। সে কেন এত নির্লজ্জ বেহায়ার মতো ভেতরের গোপন কথা বলতে গেল? একুট ধৈর্য ধরে পরখ করা যেত না? সমস্যা যদি থাকে, চিকিৎসা আছে; সমাধান আছে। এখন কথার শর ছুটে গেছে। ফিরিয়ে নেওয়ার উপায় নেই।

সে একদিন বিকেলে তাপসকে আড়ালে ডেকে নেয়। সেই পুকুরপাড় আর ম্লানমেদুর ছায়া। তাপস খুব আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে আসে। অনুরাধার কেন জানি মনে হতে থাকে, চতুর এক কুকুর খুব দ্রুত পেছন থেকে তার হাত চেপে ধরতে আকুলিবিকুলি করছে। সে খুব শক্ত হয়ে বুকে ভয়ের কাঁপন থামানোর চেষ্টা নেয়। তারপর দৃঢ় গলায় বলে বসে, –

‘তাপসদা তুই এসব কী বুদ্ধি দিচ্ছিস মা-বাবাকে? ইউনিভার্সিটি পড়ছিস, সেখানে চলে যা। আমার ব্যাপারে তোকে আর কিছু করতে হবে না। আমি ওর সাথে দেখা করি আগে। তারপর যা করার আমি করব।’

‘তুই মেয়েমানুষ এসব আইনি প্যাঁচ বুঝবি না…দেখে যা না, কী করি!’

‘তোর উদ্দেশ্য কী, আমার সংসার ভাঙা?’

‘তোর আবার সংসার হলো কোথায়?’

‘আমার অনুরোধ দাদা, তুই এসব কাজ করিস না। তোর পায়ে পড়ি। মেয়েদের একবারই বিয়ে হয়। সে যা আছে তা আমার ভাগ্য। অনেক নেশাখোর মানুষ ভালো হয়ে যায়।’

‘তুই তো দেখি সুচিত্রা সেনের রোল করছিস। আমি তোকে ওখান থেকে ছাড়িয়ে নেব। তারপর তোকে ঘরে আনব।’

‘আমি বিষ খাব তাপসদা।’

‘তা হলে আমার শর্ত মেনে নে।’

‘তুই আবার খারাপ খারাপ কথা বলছিস…আমি তোর ছোটবোনের মতো দাদা।’

‘দেখ রাধা, আমার সাথে নাটক করবি না। তোর বিয়ে হয়ে গেছে, কারও সাথে বিছানায় গেলে কেউ টের পাবে না। আমার কথা মেনে নে, তোদের এক করে দেব, নইলে…।’

‘নইলে কী? আমি মা-বাবাকে জানিয়ে দেব।’

‘নইলে কী দেখবি?’

সে-সময় তাপস পিঠের দিক থেকে সার্ট উঠিয়ে একটি চাপাতি বের করে। শেষ-বিকেলের সূর্যের তির্যক আলোয় ঝলমলিয়ে ওঠে তার সুতীক্ষ্ণ ধার। অনুরাধা শিহরে এক পা পেছনে সরে যায়। তাপসের মুখে যে ক্রূরতা ভেসে ওঠে, গ্রামের সেই হাবাগোবা যুবকের মধ্যে কখনো ছিল না। আগে দেখেছিল কি? অনুরাধা আঁতকে ওঠে।

‘এটা দেখেছিস, তোর প্রেমময় স্বামীর কাল্‌লা ফাঁক করে দেব। এখন বল তুই আজকে আমার সাথে যাবি?’

‘কোথায়…না না না।’

‘যদি কোনোদিন দেখিস বিজন কুমার রায় বুনিয়াদপুর নালাখালে গলাকাটা পড়ে আছে, সে কিন্তু আমার কাজ নয়।’

‘ঢাকায় গিয়ে এসবই শিখেছিস তুই?’

‘আরও অনেককিছু শিখেছি। জীবন-যৌবনের হাজার মজা। আয় মজা করি। না হলে তুই টাকা নে…কত নিবি?’

‘সত্যি তুই…তুই…তোকে এত ভালবাসতাম তাপসদা।’

অনুরাধা খুব দ্রুত পালিয়ে আসে। তার সঙ্গে সঙ্গে সন্ধ্যার বিষাদ কান্নার গমক মিলেমিশে যায়। সে কেন এত বড় ভুল করতে গেল! কুমারের নিস্পৃহতার কথা কেন মাকে বলেছিল? রেনুবালাই-বা কেন তাপসকে বলে বসল? কোন্‌ ভরসায়? অনুরাধা এখন কী করবে? এসব দুর্ভাবনায় তার দু-চোখ ক্লান্ত-বিমর্ষ অন্ধকার হয়ে ওঠে। তার ঘুম আসে না। সারারাত প্রায় জেগে থাকে। রাতের নিস্তব্ধতার মধ্যে কতরকমের আওয়াজ হয়। আকস্মিক বাতাস কাঁপানো শব্দ ভয়ংকর লাগে। কখনো দূরে কোথাও তক্ষক ডেকে ওঠে। রাতজাগা পাখি। বাঁশবাগানের ওপারে শেয়াল আর পরপরই কুকুরের হুমকি হুংকার। রাত হয়ে ওঠে রহস্যময় একাকী নিশ্চুপ। অন্ধকার দেয়ালে অসহায় কোনো ছায়া অস্ফুট কান্নায় ডুকরে ওঠে। সে কিছু করতে পারে না। কোনো কোনোরাত ঘরের দেয়ালের ওপাশে খসখস শব্দ জানিয়ে দেয় কারও উপস্থিতি। জানালায় এক-দুই-তিন অস্থির টোকা। সে তাপস। চেনা সুগন্ধি বাতাসে ভেসে আসে। অনুরাধা নিশ্চুপ কাঠ শুয়ে শুয়ে রাত জাগে। ভয় পায়। কত দীর্ঘ হয়ে যায় সেই রাত!

 

এবার নিতাই চন্দ্র রায় সকলের মনোযোগ আকর্ষণ করে নেয়। প্রতিপক্ষের শওয়াল-জবাবে অনেক কাহিল হয়েছে অনুরাধা। মেঝের দিকে দৃষ্টি রেখে বুঝিবা মনে মনে প্রার্থণা করে চলে, ‘ধরণী দ্বিধা হও।’ নিতাইয়ের খুব খারাপ লাগে। অনেক গ্রাম ঘুরেছে বিজনের জন্য কনে দেখতে। এই গ্রাম সেই গ্রাম চরকি চক্কর আর সময়ের ক্ষেপন শেষে কিনা মাত্র সাত-আট কিলোমিটার দূরেই পাওয়া গিয়েছিল জামাইবাবুর ঘরের প্রতীমা। সেদিন অপরাহ্ণে দেখাশোনা শেষে নীলরঞ্জন বাবু অনেক খুশি খুশি কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, –

‘নিতাই কনে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। যেমন রূপ তেমন কথাবার্তা। কি সুমিষ্ট কণ্ঠ! আহা! বাবার আর্থিক অবস্থ তেমন না হলেও আর স্ত্রীধন কী পাওয়া যাবে কি যাবে না, সে-সবের তোয়াক্কা না করেই বলি, ঘরটি ভালো; আত্মীয়তা করা যায়। মেয়েটাকে বিজনের সাথে মানাবেও বেশ।’

‘আমারও তাই মত। এই সন্বন্ধ ছেড়ে দেওয়া যায় না।’

জয়িতার চোখে-মুখেও আনন্দ। শেষপর্যন্ত নমিতার পছন্দও ইতিবাচক হলে দিন-তারিখ-লগ্ন। এত আশা-প্রত্যাশা, কত আয়োজন, তারপরও কেন এমন হলো? এই জিজ্ঞাসা মাথায় সবসময় ঘুরপাক খেয়েছে নিতাইয়ের। সমাধান পায়নি। বিজন কুমার রায় শুধু ভাগ্নে নয়, বন্ধুর মতো বটে; তারপরও কেন অজানা গোপন থেকে গেল সবকিছু? কেনই-বা সে সকলের অগোচরে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়? অবশেষে বিজনের খোঁজ পেয়েছে। অনেক গল্প-আলাপও বাদ যায়নি। কোনো সমস্যাই নেই। বিজন মানসিকভাবে একটু অস্থির আর ভিতু মাত্র। সে এমনিতেই লাজুক ছেলে। নিতাই চেয়ারম্যান-মেম্বারের কাছে কিছু কাগজপত্র উপস্থাপন করে। প্রতিপক্ষের প্রতিনিধি গম্ভীর হয়ে পুনরায় জিজ্ঞেস করে বসে, –

‘এইসব কাগজের সত্যতা যাঁচাই করে দেখা হোক। আজকাল টাকা ছড়ালে অনেক সার্টিফিকেট তৈরি করা যায়।’

‘এই প্রামাণ্য কাগজাদি রাস্তার ধারে ডায়াগনিস্টিক সেন্টারের কম্পোজ করা নয় ধর্মাবতার, একজন নিবন্ধিত সরকারি মেডিকেল অফিসারের পরীক্ষার ফলাফল।’

‘তারপরও প্রশ্ন থেকে যায়, কোনো সমস্যা নাই যখন, তবে অনুরাধা রায়কে শ্বশুরালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়নি কেন?’

 

বিশাল ঘরের পুবকোণায় বসে আছে অনুরাধা। এই একটি আলোচনায় তার নতদৃষ্টি অদ্ভুতরকম ঋজু হয়ে ওপরে উঠে যায়। কোনো লাজশরম বিব্রতকর পরিস্থিতি সব যেন হারিয়ে গেছে। তার কুমার সুস্থ। কোনোরকম শৈথিল্য বা দুর্বলতা নেই। এতদিন যে সে এখানে পড়ে রইল, কতদিন রাস্তার দিকে তাকিয়ে কত প্রতীক্ষায় প্রহর কাটিয়ে দিল, তার সকল কষ্ট-যন্ত্রণা তখন আলগোছে মুছে গেছে। সে নিতাইয়ের দিকে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে কথা শুনতে থাকে।

‘হ্যাঁ এটা আমাদের ভুল হয়েছে। আসলে পারিবারিকভাবে সমস্যাটি নিয়ে মনোযোগ ও তৎপরতা দ্রুত নেওয়া উচিত ছিল।’

‘আমরা খবর পেয়েছি, বিজন কুমার রায়ের অন্যত্র বিয়ের চেষ্টা চালানো হচ্ছে।’

‘এটা ঠিক নয়। অনুরাধা বউমাকে সাদরে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতির মধ্যে আচমকা আমরা নোটিশ পেয়েছি। বিজনের বাবা নীলরঞ্জন রায় একদিন ওই বাড়ি গিয়ে গল্প-আলাপও করে এসেছিলেন। তারা এই অবস্থার মধ্যে কীভাবে বিচার-সালিশের জন্য অভিযোগ করে বসলেন আমরা বুঝতে পারছি না ধর্মাবতার।’

‘আপনারা পণের একলক্ষ টাকা ফেরত দিতে পারছেন না বিধায় এমন কথা বলছেন। আমরা মনে করি, নিরপেক্ষ তরফ থেকে নিয়োজিত চিকিৎসক দিয়ে আবারও পরীক্ষানিরীক্ষা করা উচিত। বিজন কুমার একজন নপুংসক ব্যক্তি কি না? যথাযথ পরীক্ষার ফলাফল সাপেক্ষে এবং কন্যাপক্ষের আত্মীয়তা রাখা-না-রাখার সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করবে অন্যান্য কাজ।’

‘অন্যান্য কাজ বলতে কী বোঝায়? আমরা আমাদের গৃহলক্ষ্মীকে নিয়ে যাব।’

‘এটা আদালতের সিদ্ধান্ত, তবে কোনো সংসার ভাঙা বা বিচ্ছেদ ঘটনা আদালত চায় না।’

‘সিদ্ধান্ত তো উভয় পরিবার একমত হলেই হবে নাকি? দীপেন কাকুর পরিবার সম্পর্ক রাখতে রাজী নয়।’

আগত ব্যক্তিবর্গের মধ্য থেকে জোরগলায় চিৎকার করে ওঠে তাপস। সকলেই বিস্মিত হয় এমন মন্তব্যে। এই ফাঁকে অনুরাধা একপলক বিজনের দিকে তাকায়। কে জানে সেও তার দিকে দৃষ্টি রেখেছিল! ইলেকট্রিক শকের মতো চার চোখের মধ্যদিয়ে অচেনা তরঙ্গ শেষ-সকালের বুকে ঢেউ তুলে যায়। তারপর আবার খোলা দরজা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকা। অনেক দূরে ফসলের ক্ষেতে কাজ করছে কয়েকজন মানুষ। শ্যালো মেশিনের ধক্‌ ধক্‌ শব্দে জলসেচের দৃশ্য। জলের মতো স্ফটিক স্বচ্ছ আর কি আছে! এখন ক্রমে ঘটনার সবকিছু পরিস্কার হতে শুরু করেছে। অনুরাধার হাজার ভাবনার মধ্যে চাঞ্চল্য বুঝি নিজেকে স্থির রাখতে দেয় না। এই সালিশ আলোচনা অর্থহীন লাগে। বিজনের সামনে গিয়ে হাতদুটো ধরতে খুব ইচ্ছে হয়। যত নষ্টের গোড়া তাপস। এর কারণে আজ কী সব আজেবাজে কথার মধ্যে ডুবে যেতে হচ্ছে। এখন কি তবে সব ফয়সালা হবে? কে জানে কী হতে যাচ্ছে কিছুই বোঝা যায় না। সে আশপাশে তাকিয়ে তাপসকে খোঁজে। কেমন নিষ্ঠুর পাথরের মতো নিশ্চুপ বসে আছে। চোখের মধ্যে চকচক করছে ধূর্ততার খেলা।

 

সেই সময়ে ঘন-ঘন বাসায় আসে তাপস। অনুরাধা সাধারণত সামনাসামনি হয় না। সেদিন থেকে তাকে এড়িয়ে চলে। তারপরও কখনো দৃষ্টি তুলে দেখে, তাপসের দৃষ্টিতে ভয়াবহ দিনের অশুভ সংকেত। অনুরাধা কুকড়ে ওঠে। কোনোদিন তাপস বেশ সহজভাবে কিছু জিজ্ঞেস করে। সে কোনোটির জবাব দেয়-দেয় না। তাপস মুচকি হেসে রান্নাঘরের দাওয়ায় বসে। রেনুবালার কাছাকাছি হয়ে নিচুস্বরে কী কী সব গল্প করে। সে-সব বুঝি দুস্তর রহস্য। অনুরাধা কখনো ভয়ে কাঠ হয়ে যায়। মনের কোণে অশুভ সন্দেহের দানা বেঁধে ওঠে। সে কোনো অবলম্বনও খুঁজে পায় না, কাকে বলে ভয়ের কথা, দুঃস্বপ্নের দৃশ্যছবি; একজন মানুষ নালার এদোকাদায় উপুড় হয়ে নিষ্প্রাণ পড়ে আছে। জলে ধুয়ে গেছে রক্তের স্রোত। ফ্যাকাশে হয়ে আছে সাদা বালু। অনুরাধা চমকে উঠে। রাতের নিঃসীম শূন্যতায় হাতড়ে বেড়ায় কোনো অবলম্বন। কাউকে কি একটু তাগাদা দিয়ে ফিরিয়ে আনা যায় না? কোথায় আছে মনের মানুষ? তারপর সবকিছু এলোমেলো আতঙ্কে জমে যেতে থাকে। একদিন সেই আশঙ্কা আচমকা সত্য হয়ে ওঠে। মা-বাবা আর দু-চারজন স্বজনের মুখে কথা শুরু হয়। নতুন করে সংসার গড়ে তোলা দরকার। বিজন কুমার অক্ষম পুরুষ। মেয়ের তো জীবন আছে নাকি? অনুরাধা কোনো বুদ্ধি পায় না…ভরসাও। সে একা কী করতে পারে? সে পারে, কিন্তু তখনই নিশ্চল হয়ে যায়; তাপস খুব ভয়ংকর। কুমারের ক্ষতি করে বসে যদি!

 

অনুরাধা এখন সংসার ভাঙতে চায়। গুরুতর অভিযোগ। স্বামী বিজন কুমার রায় নপুংসক। সেই সঙ্গে বাবার দেয়া এক লক্ষ টাকা ফেরত দাবি। তাপস এক এনজিওর মাধ্যমে ইউনিয়ন পরিষদ সদস্যের কাছে অভিযোগ আবেদন দাখিলের সব ব্যবস্থা করে ফেলে। পারিবারিক সমস্যাগুলো গ্রাম আদালতে বিচারসালিশে তেমন সমাধান হয় না। তারপর এক লক্ষ টাকার মামলা। সরকারের ‘গ্রাম আদালত সংশোধন আইন ২০১৩’-র মাধ্যমে সালিশ বিচার। একজন ইউপি চেয়ারম্যান, দুইজন মেম্বার আর বাদি-বিবাদি পক্ষের মনোনীত দুইজন; মোট পাঁচজনের বিচার-মীমাংসার সিদ্ধান্ত। এই আদালত সর্বোচ্চ পঁচাত্তর হাজার টাকা পর্যন্ত নির্দিষ্ট কিছু দেওয়ানি আর ফৌজদারি বিরোধ মীমাংসা করতে পারে। অনুরাধার বাবার আবেদন বা বিরোধ প্রতারণার ফৌজদারি মামলা। সবকিছুতে সতর্ক ব্যবস্থা। তারপরও এ-পাড়া থেকে ও-পাড়া গুঞ্জন-গল্পকাহিনি ভেসে ভেসে হাজারও রঙে রঙিন হয়ে কারও কারও মনোরঞ্জন করে যায়। অনুরাধার কিছুই ভালো লাগে না। তার মাথা ভার ভার লাগে। সে কী ভাবে, কী করে, কোথায় যায়, কী বলে কোনো বোধ নেই। তার সেজেগুজে থাকা মনও মরে গেছে। প্রায়শ পুকুরপাড়ে সেই বড়ইগাছের ছায়ায় নিশ্চুপ বসে থাকে। সেখান থেকে দূরের সড়ক আর মেঠো পথ দেখা যায়। একটি-দুটি করে রিকশা-ভ্যান-টেম্পু আর গরুরগাড়ি চলে যায় পুব থেকে পশ্চিমে। মানুষজন হেঁটে যায় নিজ নিজ গন্তব্যে…শুধু সেই প্রাণের মানুষটির ছায়াকাঠামো দেখা যায় না। অনুরাধা বুঝি প্রতীক্ষায় থেকে থেকে মরে যেতে শুরু করে। মেঘলা-বিমর্ষ হয়ে যায় সমস্ত নীল আকাশ। রেনুবালা সেদিন আবছায়া বিকেলে বলে উঠে, –

‘এটাই ভালো হলো রাধা। আগেভাগে জানা গেছে। টাকা থাকলে ছেলের অভাব! তোর আবার বিয়ে দেব।’

‘একবার বিয়ে হয়ে যাওয়া মেয়েকে কে বিয়ে করবে শুনি…তাপস?’

‘তাপস কেন? তার কথা উঠছে কেন? সে তো তোর জন্য অনেককিছু করছে।’

‘হিন্দু মেয়ের বিয়ে একবারই হয় মা। এটা চুক্তি নয় যে, ইচ্ছে হলো বাতিল করা যায়।’

‘এখন আমাদের সমাজেও এসব চলে। বিয়ে না দিলে কী নিয়ে জীবন চলবে? ওসব ভাবনা তোকে করতে হবে না। আমরা যা করব ভালোর জন্যই তো…আর তাপস কম কিসে? ঢাকার কলেজে বড় পাশ দেবে এবার। শিক্ষিত।’

‘তুমি খুব লোভি মা!’

‘কী বলছিস তুই?’

অনুরাধা আর কিছু বলে না। সে অসহায়ের মতো এদিক-ওদিক তাকিয়ে অস্থির হয়ে পড়ে। অনেকসময় সবকথা কাউকে বলা যায় না। মাকেও অনেক দূরের মানুষ মনে হয়। তার চোখের সামনে কুমারের হাত-পা বাঁধা গলাকাটা মৃতদেহ ভেসে ওঠে। ফরসা মুখের একপাশের গাল ফ্যাকাশে-নীল। চোখদুটো নিষ্প্রভ…খোলা-আধখোলা। সেই চোখের দৃষ্টিতে ব্যাকুল জিজ্ঞাসা, ‘আমি তোমার কী ক্ষতি করেছিলাম অনুরাধা? আমার রাধা?’ হায় অনুরাধা সহ্য করতে পারে না! কেমন আছে কুমার?

 

মুকুন্দুপুর ইউনিয়ন পরিষদ অফিসের মিটিং রুম থেকে কতগুলো মানুষ বেরিয়ে আসে। দুপুরের পর সালিশের কার্যক্রম পুনরায় শুরু হওয়ার কথা। অথচ যাদের নিয়ে সমস্যা তারা কোথায়? কয়েকজন উত্তরের রাস্তায় হেঁটে এদিক-ওদিক তাকিয়ে খোঁজ করে। কেউ কেউ দক্ষিণের জঙ্গলে গভীর দৃষ্টি ছুড়ে কাউকে হাতড়ায়। ওপারে ঢেপা নদীর জল। অনেক মন্থর বয়ে চলে। জলভেজা বাতাস ভেসে আসে মৃদুমন্দ। ভালো লাগে। এসবের মধ্যে সকলের জিজ্ঞাসা। কোথায় গেল তারা? একে একে ভেতরে বসে থাকা সবাই বারান্দায় এসে দাঁড়াতে শুরু করে। কৌতূহলী চোখে চারিদিক তাকিয়ে খোঁজে। একসময় পুবে অনেকদূরে তাদের ছায়া দেখা যায়। তারা কি সেই দু-জন? তেমনই তো মনে হয়। মানুষ দু-জন হাত ধরাধরি করে ফসলের ক্ষেত আইল ধরে দ্রুত হেঁটে চলেছে। যাদের নিয়ে সমস্যা আর বিচার সালিশ তারা পালিয়েছে। এ পলায়নের মধ্যে কোনো মঙ্গল আছে কিনা কে জানে, তবে সকলে বুঝে ফেলে সালিশের আর প্রয়োজন নেই। সমাধান হয়ে গেছে।

 

তখন বটতলির রেস্তোরাঁয় বসে চা খেতে খেতে জয়িতা আর নমিতার চোখে-মুখে রহস্যময় হাসি ভেসে ওঠে।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত